পিলখানা ট্র্যাজেডিঃ ক্রিকেট বনাম মানবিকতা
লিখেছেন লিখেছেন ইমরান বিন আনোয়ার ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ১১:১৯:৩৩ রাত
আমার চেয়ে বড় ক্রিকেট-ফ্যান আমি এখনো কাউকে পাইনি। ক্রিকেট-ভালবাসায় আমার সামান্য কিছু অবদান আপনি এভাবে পাবেন যে, প্রায় একশ' চার-ডিগ্রী জ্বর নিয়েও আমি রাত-গভীরে বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচ দেখতে মাইল-খানেক পাড়ি দিয়ে ফেলেছিলাম। প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে শ্রীলংকা-ওয়েস্ট ইন্ডিজ-এর মত দলের খেলা দেখতে বাড়ী থেকে বের হয়ে গিয়েছি, তাও সেটা ছিল টেস্ট ম্যাচ! দশ হাজার টাকার 'অমূল্য' চাকরীকে শুধুমাত্র বাংলাদেশের ম্যাচ দেখার লোভেই বিসর্জন দিতে হয়েছে। আসলে বলতে থাকলে এমন হাজারো উপমা বেরিয়ে আসবে যা শুনে কেউ কেউ আমায় 'পাগল' উপাধি দিয়ে দিতে পারেন। আমি শুধু বলতে চাই, ক্রিকেটটাকে আমি-আমরা, বাংলাদেশীরা; খুব বেশি প্রাণে ধারণ করি। নিজে খেলি অথবা না খেলি, প্রত্যক্ষভাবে এর সংস্পর্শ থেকে যতই দূরে থাকি, ক্রিকেটের একটা পরোক্ষ আবহ আমাদের প্রাণে সবসময়ই বিরাজ করে। বলা ভালো, ক্রিকেটকে আমরা 'ভালবাসি' বলে রাত-দিন গলাও ফাটাই। কিন্তু এত এত ক্রিকেট-আবেগ বুকে লালন করা সত্ত্বেও, ক্রিকেটের জাদুকরী আকর্ষণ আমাদেরকে 'দিওয়ানা' বানিয়ে দেয়ার পরেও যে প্রশ্নটা আজ আমার মনে খুব বেশি মাথাচাড়া দিচ্ছে, সেটি হল ক্রিকেট-ভালবাসা কি দেশ-প্রেমের চেয়েও বড়? ক্রিকেটের আবেদন কি আমাদের মানবিকতার সীমানাকেও অগ্রাহ্য করতে পারে? যদি তাই না হবে, তবে স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাসে বাংলাদেশের সবচেয়ে লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের দিনে, এই ২৫'শে ফেব্রুয়ারিতে, এশিয়া কাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কেন আয়োজন করা হচ্ছে? কেন আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর-সন্তানদের অমানবিক দুঃখ-জ্বালার দিনেই আমরা নিজেদের লোলুপ অন্তরাত্মার অসৎ কামনা চরিতার্থ করছি? ক্রিকেট-টুর্নামেন্টেরই হোক অথবা ফুটবলের, কিংবা পৃথিবীর তাবৎ খেলাধুলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানগুলোতেই দর্শকদের যতটা না বিনোদন দেয়া হয়, তারচেয়ে বেশি উপহার দেয়া হয় অশ্লীলতা! সোনার হরিণ উদ্বোধনী-অনুষ্ঠানের 'টিকেট' কিনে যারা মাঠে প্রবেশ করেন, তাদের 'অপরিসীম' কষ্টকে কিছুটা লাঘব করতেই পরম 'উদার' রসবোধে বিশ্বাসী হয়ে উঠেন আয়োজকেরা! অতএব, নাচ-গান, দেহ-প্রদর্শনী; আতশবাজি ফুটানো থেকে শুরু সাধ্যমত সব চিত্তমনোহরী-উপাদানই সেখানে জমায়েত করা হয়। অবশ্য এতসব অনৈতিক চর্চায়ও আমার খুব বেশি বিচলিত হওয়ার কারণ ছিলনা। কেননা মনুষ্য-সমাজে আত্মপ্রাসাদ-জাগানো যে সংস্কৃতি একবার চালু হয়ে যায়, সেটিকে পরিবর্তন করা মহা-মনীষীদের পক্ষেও সম্ভব হয়ে উঠেনা। সেখানে আমার মত পশ্চাৎপদ মানুষগুলো'তো সার্কাসের অবলা দর্শক ছাড়া আর কিছুই নয়। তথাপি আমার মন যে ব্যপারটিতে খুব বেশি বিদ্রোহী হয়ে উঠছে সেটি হল, আজকের এই দুঃখের দিনে, আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার মুহুর্তেটিতে, কোথায় আমরা আমাদের অকুতোভয় সৈনিকদের জন্য দু'ফোটা অশ্রু বিসর্জন দিব-তা না করে উল্টো তাদের ধংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে নির্লজ্জ-বেহায়ার মত জাতীয় কাম-লালসায় একসাথে 'শীৎকার' করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা কিভাবে ভুলে গেছি যে, ২০০৯'র ২৫ ও ২৬'শে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন 'বিডিআর' হেডকোয়ার্টারে ঘাতকদের নির্মম আঘাতে প্রাণ হারান ৫৭'জন সেনা কর্মকর্তা সহ মোট ৭৪'জন মানুষ। দুঃস্বপ্নকেও ভয় পাইয়ে দেওয়া সে ভয়ানক নৃশংস ঘটনাকে আমরা এত তাড়াতাড়িই হজম করে ফেলেছি! মায়ের চোখের পানি, স্ত্রীর আহাজারি আর সন্তানের হাহাকারে ভরা সে বিষাদময় উপাখ্যান আমাদের সৃতির ডায়েরি থেকে এত দ্রুতই মুছে গেছে। আসলে আমরা বাংলাদেশীরা এমনই। দুঃখের সৃতিগুলো খুব দ্রুত ভুলে যাই। আবার ভুলে যাওয়া সৃতিগুলোই অসময়ে আমাদের মনে খুব বেশি ঘুরপাক খায়। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি 'এশিয়া-কাপ' শুরু হওয়ার। তবে এটাও মানতে পারছিনা যে, ২৫'শে ফেব্রুয়ারির মত আমাদের জাতীয় কলঙ্কের দিনেই এর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে! হোকনা সে 'প্রারম্ভিকা' খুব সাদামাটা। অথবা কল্পনার রঙ্গীন আকাশে দাগ কেটে যাওয়া উদ্দাম-উচ্ছাসে ভরা। আমি কোনোটাই সমর্থন জানাতে পারছিনা। আমাদের হারিয়ে যাওয়া বীর-যোদ্ধাগণ, যারা আমাদের প্রতিটি বিপদের অগ্রভাগে নিজেদের বুক চিতিয়ে আমাদের উদ্ধারে সচেষ্ট ছিলেন, তাদের এমন মর্মন্তুদ বিদায়ের দিনেও আমরা যদি আনন্দ-নৃত্যে পাগলপারা হয়ে উঠি; তবে জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জার আর শেষ থাকবে কি?
বিষয়: বিবিধ
১২৩২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন