সামাজিক আন্দোলন: কাজের ক্ষেত্র, বহুবিধ সমস্যা ও সমাধান কৌশল

লিখেছেন লিখেছেন সফেদ শিশির ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১২:১২:৩৮ রাত

আমরা সমাজের গুণগত বা ইতিবাচক পরিবর্তন চাই। সমাজ এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে একাধিক চরিত্র একত্রে কিছু নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠা করত একত্রে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলে। মানুষের ক্ষেত্রে একাধিক ব্যক্তি একত্র হয়ে লিখিত কিংবা অলিখিত নিয়ম-কানুন তৈরি করত এরকম একত্র বসবাসের অবস্থাকে সমাজ বলে। ফলে একটি বৃহত্তর সমাজের ভিতরও আরেকটি তুলনামূলক ক্ষুদ্র সমাজ হতেই পারে। মানুষ ছাড়াও ইতর প্রাণীর ক্ষেত্রেও সমাজের অস্তিত্ব দেখা যায়, তবে সেখানে মানুষের মতো কাঠামোবদ্ধ সমাজের দৃষ্টান্ত নজরে আসে না। এই সমাজ কাঠামোটাকে বিবেচনায় রেখেই মানুষকে পথ চলতে হয়। সমাজটাকে ভাল করার প্রচেষ্টা হয় ২ভাবে-১. প্রচলিত সমাজ কাঠামো ঠিক রেখে সেই কাঠামোকে মানুষের জন্যে সহনীয় করা। ২. সমাজ কাঠামো পরিবর্তন করে সমাজটাকে অধিকতর ভাল করার চেষ্টা। প্রশ্ন হলো আমরা কিভাবে কাজ করবো? সমাজের মধ্যে থাকে পরস্পর সৌহার্দ্য, সহযোগিতা, মমত্ব, তেমনি থাকে ঘৃণা, লোভ, জিঘাংসা। তাই সমাজের মধ্যে শৃংখলা ধরে রাখার স্বার্থেই অলিখিতভাবে তৈরি হওয়া নিয়ম কানুনকে আমূল পরিবর্তনের চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমূল পরিবর্তনের জন্যে দরকার হয় ক্ষমতা ও রাজনীতি। তাই সুন্দর সমাজের জন্যে আমরা-এই মূল্যবোধ থেকে কাজের উৎসাহ-উদ্দীপনা কিংবা পদ্ধতি বের না হলে ক্ষমতা ও রাজনীতি যুক্ততা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনেকের কাছে চরম অসম্মানজনক, এবং সমাজের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য হয়ে দাঁড়ায়। মনে রাখতে হবে সুন্দর ও সুষ্ঠ সমাজ ব্যবস্থার জন্য অন্যকে প্রতিপক্ষ বানানোর চেয়ে, শত্রুতা বৃদ্ধির চেয়ে সৌহার্দ্য, সহযোগিতা একান্ত দরকার।

ললিতকলা ও বিজ্ঞানের সৃষ্ট সভ্যতার উপর পুরোপুরি আস্থা না আনতে পারার কারণেই কি নতুন সভ্যতা বিনির্মাণের প্রশ্ন! মানব উৎকর্ষর সাথে শিল্পকলা ও বিজ্ঞানের বিকাশ হয়েছে, এসেছে রেনেসাঁস ও আলোকময়তা।– কিন্তু সব নতুনই কি সাদরে গ্রহণীয়? রুশো মনে করেন, ‘‘সমাজ ও সমাজের বিলাসিতা থেকেই জন্ম নেয় মানববিদ্যা, প্রযুক্তি, ব্যবসাবাণিজ্য, পাণ্ডিত্য এবং সেই সব বাহুল্য যা শিল্পের বিকাশ ঘটায় কিন্তু একই সাথে সমাজকে সমৃদ্ধ ও ধ্বংস করে। বিখ্যাত জাতিসমূহের প্রাচুর্য তাদেরকে যে ক্লেদাক্ত দুঃখ-দুর্দশার দিকে ঠেলে দেয় এই হচ্ছে তার কারণ। একদিকে শিল্প ও মানববিদ্যা যতই উন্নতি লাভ করে, অন্যদিকে করের বোঝায় জর্জরিত শ্রমে-ক্ষুধায় কাতর অনাদৃত কৃষক ততই রুজির সন্ধানে শহরমুখী হয়। আমাদের নগরগুলি যতই দৃষ্টিনন্দন হয় ততই গ্রামাঞ্চল বিরান হতে থাকে। অনাবাদী জমির পরিমাণ বাড়ে। নাগরিক হয় ভিখারি বা ডাকাত, আর ওদের জীবনের ইতি হয় ফাঁসির মঞ্চে বা আবর্জনাস্তুপে। এভাবে রাষ্ট্র একদিকে ফুলেফেঁপে ধনী হয়, অন্যদিকে হয় জনশূন্য বিরান। প্রবল প্রতাপ, সাম্রাজ্য এভাবে অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তোলে সমৃদ্ধির সৌধ আর ডেকে আনে জনজীবনে অবলুপ্তি । মানবিক জ্ঞানের উন্নতি এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের ফলে শ্রমের শ্রেণীবিভক্তি সুচিত হয় এবং মানব জাতির প্রাকৃতিক সুখকর অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে ধনী-দরিদ্র বিভাজন সৃষ্টিকরে, পরিণতিতে রাষ্ট্রী সমাজ অত্যাবশ্যক হয়ে যায়। সমাজ গঠনের এমন একটা আদর্শ থাকতে হবে যাতে সমাজভুক্ত সকল ব্যক্তির জীবন ও সম্পদ সমাবেত শক্তির সাহায্যে নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবে এবং প্রত্যেকে পরস্পরের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় আপন আদেশই পালন করবে ও আগের মতই স্বাধীন থাকবে।’’

অনেকে মানুষের দু:খ কষ্টের কারণ হিসাবে বিশ্বাস করেন যে এটা কোন পাপের প্রায়শ্চিত্য। আসলে মানুষের দুর্দশা ও দুর্বলতাকে তকদিরের লিখন বলে যৌক্তিকতা আরোপের চেষ্টা চলে। আপন প্রকৃতির সাথে পরিবেশের দ্বন্দ্ব্ব এবং অসঙ্গতির ফলেই মানুষকে বেদনার্ত হতে হয় বলে অনেকে প্রচারণা চালান। অনেকে প্রতিটি মানুষকেই অফুরন্ত সম্ভাবনাময় ভাবেন, চেষ্টা-সাধনা-প্রয়াস-চাহিদা- উচ্চাকাঙ্খার ভিন্নতার কারণে তাদের মাঝে ভিন্নতা হয় বলে মনে করেন। মানুষের মৌল মানবিক চাহিদা অন্তহীন নয় কিন্তু বেঁচে থাকার জন্যে নূন্যতম সে চাহিদা পূরণে তাকে অন্যের সাথে নিরন্তর সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়। আর হ্যাঁ প্রচারণা- পারিপার্শ্বিকতা তার চাহিদাকে বাড়ায়ে দেয়। সমকালীন সমাজ কাঠামো ব্যাক্তির বিকাশের পথে অন্তরায়, যা মানুষকে মানুষের মুখোমুখি করে দেয়, তাকে দ্বন্দ্ব্বে লিপ্ত হতে বাধ্য করে-এটা যেমন সত্য। তেমনি এটাও ঠিক বর্তমান সমাজে মানুষকে সুখী করার অবারিত সুযোগ রয়েছে।

যুক্তিশীলতার উন্মেষ ঘটার পর মানুষ মনে করতে শিখেছে যে, একজন ঠিক যতটুকু স্বাধিনতা বা অধিকার ভোগ করবে যতটুকু স্বাধিনতা বা অধিকার সে অন্যকেও দিতে প্রস্তুত আছে। এর ভিত্তিতে একত্র হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের যে চুক্তি সম্পাদিত হল তা একটি সার্বভৌম ক্ষমতার সুচনা করে; সে ক্ষমতা একজন ব্যক্তির বা গোষ্টির হতে পারে। এভাবে শান্তির নিশ্চয়তা প্রয়াসী মানুষ তাদের প্রাকৃতিক অধিকারকে একটি ক্ষমতার কাছে হস্তান্তর করে যা ব্যক্তিমানূষকে নিরাপত্তা প্রদান করে ও সমাজকে সাধারণ কল্যাণের দিকে নিয়ে যায় বলে মনে করেন হবস।জন লক এর মতে, নানা কারনে প্রকৃতির রাজ্যে স্বাভাবিক আদর্শ থেকে মানুষের বিচ্যুতি ঘটলে সমান অধিকার ভোগ করতে বঞ্চিত হয়। ফলে ব্যক্তিগত স্বাধিনতা ও অধিকার রক্ষার জন্য তারা সুসংহত সমাজ গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে।

ফ্যামিলি নেটওয়ার্ক মুভমেন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। এর মাধ্যমে পরিবার সামাজিক আন্দোলনের একেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট বলে বিবেচিত হবে। এর মাধ্যমে বড়দের পাশাপাশি শিশুরাও উপকৃত হবে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া একটি জীবনব্যাপী এবং বহুমুখী প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন মানুষ পুরোপুরি সামাজিক মানুষ হিসেবে পরিনত হয়। সমাজবিজ্ঞানী কিংসলে ডেভিস বলেন, সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার দ্বারা ব্যক্তি পুরোপুরি সামাজিক মানুষে পরিনত হয়। এ প্রক্রিয়া ছাড়া ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্ব লাভে ব্যর্থ হয় এবং সমাজে সে এক জন যোগ্য ও উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। সামাজিকীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা মানব শিশু ক্রমশ ব্যক্তিত্বপূর্ণ সামাজিক মানুষে পরিণত হয়। যে সকল মাধ্যমে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া সাধিত হয় তার মধ্যে সর্বপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম পরিবার। কেননা (১)শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে বংশগতি মূল উপাদান যোগায়, সংস্কৃতির নকশা অঙ্কন করে এবং পিতামাতা কারিগর হিসেবে কাজ করে। (২) একটি শিশু তার দৈহিক, মানসিক এবং বস্তুগত ও অবস্তুগত যাবতীয় প্রয়োজন পরিবার থেকেই মেটায়। পরিবারেই শিশুর চিন্তা, আবেগ ও কর্মের অভ্যাস গঠিত হয়। একটি শিশুর সুকোমল বৃত্তিগুলি এবং সুপ্ত প্রতিভা পরিবারের মাধ্যমেই বিকাশ লাভ করে। (৩) শিশু পরিবার থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও গ্রহণ করে, পরিবার থেকেই একটি শিশু আচার-আচরণ, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজে একজন যোগ্য ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে গড়ে ওঠে। সুতরাং একটি শিশুর ব্যক্তিত্ব নির্ভর করে পরিবারের তিনটি বিষয়ের উপর। (ক) পিতা-মাতার সম্পর্ক (খ) পিতা-মাতা ও শিশুর মধ্যে সম্পর্ক (গ) একই পরিবারের একাধিক শিশুদের মধ্যে পরস্পরের সম্পর্ক । এসব সম্পর্কগুলি যদি ইতিবাচক হয় তবে ঐ শিশুরা সৎ, ব্যক্তিত্বপূর্ণ এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে ওঠে এবং সমাজে সহজ জীবনযাপন করতে পারে।

কেউ কেউ সমাজের উচ্চ শ্রেণি ও নিম্ন শ্রেণিতে কাজ করা বেশি জরুরী বলে মনে করেন। তাদের মতে মধ্য শ্রেণিতে প্রচুর কাজ হয়েছে। আমার মনে হয়, উচ্চ শ্রেণি ও নিম্ন শ্রেণিতে একইধরণের কর্মসূচি চলবেনা। আমার পয়েন্ট বুঝার জন্যে শ্রেণী সংক্রান্ত বুঝটা দরকার। একই প্রণালীতে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে সমাজের এরূপ এক একটি অংশ হলো এক একটি শ্রেণি। সমাজের একাংশের শ্রমকে অপরাংশ আত্মসাৎ করতে পায় যাতে তাই হলও শ্রেণি। সমাজের একাংশ সমস্ত ভূমি আত্মসাৎ করলে হয় ভূস্বামী শ্রেণি ও কৃষক শ্রেণি। যদি সমাজের একাংশ হয় কলকারখানা, শেয়ার এবং পুঁজির মালিক, আর অন্য একটা অংশ কাজ করে ওইসব কলকারখানায়, তাহলে হয় পুঁজিপতি শ্রেণি এবং প্রলেতারিয়ান শ্রেণি অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণি। শ্রেণিদের মধ্যে পার্থক্যের মৌল লক্ষণ হলো- সামাজিক উত্পাদনে তাদের স্থান, সুতরাং উত্পাদনের উপায়ের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে। প্রতিটি শ্রেণির থাকে উৎপাদনের উপায়ের সংগে সুনির্দিষ্ট নিজস্ব সম্পর্ক। এই লক্ষণ দিয়েই পার্থক্য করা যায় শ্রেণি আর অন্যান্য সামাজিক গ্রুপের মধ্যে যারা শ্রেণি নয়। যেমন, উত্পাদনের উপায়ের সাথে বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্ক নেই, তাই তারা শ্রেণি নয়, বুদ্ধিজীবীরা হলও বিভিন্ন শ্রেণির অংশবিশেষ নিয়ে একটা সামাজিক স্তর।

অনেকে সেবাধর্মী ও গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান করার পক্ষে। এক্ষত্রে অনেকে দান খয়রাত, জাকাত, অনুদানকে গুরুত্ব দেন আবার অনেকে আয়বর্ধক প্রকল্প নেয়ার পক্ষে। আমার মনে হয় কোন প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আয়েও কিছু প্রোগ্রাম চলতে পারে এবং অনুদান ‍নির্ভর প্রকল্পও থাকতে পারে আবার দুটোরই সমন্বয় হতে পারে। সামাজিক ব্যবসা আদলে কিছু কাজ চলতে পারে। সামাজিক ব্যবসায় নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস প্রবর্তিত একশ্রেণীর অর্থনৈতিক প্রকল্প যার মূল লক্ষ্য মুনাফার পরিবর্তে মানবকল্যাণ। যে কোন সাধারণ ব্যাবসায় প্রতিষ্ঠানের মতোই এই সকল প্রকল্প পরিচালিত হয় ; কেবল লক্ষ্য থাকে মানুষের কল্যাণ - বিশেষ করে দারিদ্র দূর করা। মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭০ দশক থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ব্যাংকিং, টেলিকম, সৌরশক্তি, তথ্যপ্রযুক্তি, টেক্সটাইল, তাঁত, বিপণন প্রভৃতি খাতে অনেকগুলো কোম্পানী স্থাপন করেছেন যেগুলোর মৌলিক উদ্দেশ্য মুনাফা ম্যাক্সিমাইজ করা নয় ; অন্যদিকে এগুলোর কোনটিই ব্যক্তিগত মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত হয় নি। এই উদ্যোগগুলো কার্যত সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য স্থাপিত ব্যবসায়িক প্রকল্প। এ ধরণের ব্যবসায়িক পুজিঁ লগ্নির কথা অর্থশাস্ত্রে নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগে "সামাজিক ব্যবসায়" ধারনাটি প্রবর্তন করেন। সামাজিক ব্যবসার সঙ্গে সনাতন ব্যবসার পার্থক্য কেবল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে: সনতান ব্যবসায় মুনাফামুখী এবং সামাজিক ব্যবসায় কোম্পানি মুনাফা করবে নিশ্চয়ই, কিন্তু মালিক মুনাফা নেবে না, মালিক কেবল মূলধন ফেরত নিতে পারবে।

তবে মনে রাখতে হবে, মূলত সুন্দর সমাজ গড়ার জন্যেই সকল কাজ। যখনই কিছু ব্যক্তি কিংবা পরিবার মিলে সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা সামাজিক আন্দোলন করবো তখন কিছু সামাজিক দায়বদ্ধতাও আসবে। যদি আমাদের আকর্ষণীয় কর্মসূচি কিংবা সৃজনশীল আবেদন থাকে তবে কর্পোরেট কিছু গ্রুপ থেকেও প্রয়োজনে সহায়তা নেয়ার সুযোগ হবে। কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সিএসআর বলে যে ব্যবসায়িক শিষ্ঠাচার বা নীতি আছে তা সমাজের প্রতি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনকে ব্যবসার নিয়মের মধ্য অন্তর্ভূক্ত করে। একটি ব্যবসা নৈতিক ও আইনগত ভাবে পরিচালিত হলেই এর সমস্ত দায়মুক্তি হয়েছে তা বলা যায় না। যে পরিবেশে বা যে সমাজে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে সেই সমাজের প্রতি প্রতিষ্ঠানের কিছু দায়বদ্ধতা জন্মায়। বর্তমান যুগে অধিকাংশ বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই সিএসআর বা সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ করছে। যারা সংগঠিত ও ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হতে পারে তারা এসব সুন্দর বোধগুলো জাগ্রত করে বড় উদ্যোগও বাস্তবায়ন করতে পারে।

আমি দেখছি রাজনৈতিক দলগুলো কেমন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। আরেক দলকে হারিয়েই নিজেকে জিততে হবে। এটা একটা অসুস্থ অবস্থা। প্রতিযোগিতা মানেই এমন একটি ঘটনা বিশেষ যেখানে ব্যক্তিগণ কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সেরা নির্ধারণকল্পে একে-অপরের সাথে মোকাবিলা করে থাকে। প্রতিযোগিতাটা ব্যক্তিগত কিংবা দলীয় পর্যায়ে হয়ে থাকে। প্রতিযোগিতা সহযোগিতার বৈপরীত্য অর্থ বহন করে। কেউ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ বা অনুপ্রবেশ করলে তিনি প্রতিযোগী বা খেলোয়াড় নামে পরিচিত হন। প্রতিযোগীগণ একে-অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত হন। যিনি বা দলগত পর্যায়ে যারা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী বা চ্যাম্পিয়ন হন, সাধারণতঃ দল বা তিনি পুরস্কার পেয়ে থাকেন। দু'টি দলের মধ্যে নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য পূরণে যদি একমত না হয় কিংবা ব্যক্তিগতভাবে ঐক্যমত্য পোষণ ও সহযোগিতা প্রদর্শন করে না তখনই প্রতিযোগিতার উদ্ভব হয়। ব্যক্তিগত বা দলীয় যে-কোন পর্যায়ের প্রতিযোগিতাতেই আরেক পক্ষকে হারিয়ে নিজেকে সেরা প্রমাণের প্রচেষ্টা চলে। কেউ যদি বুঝে যে অমুক আমর শত্রু, আমার ক্ষতি করবে তবে সে বিরোধিতা করবেই।

সে যাই হোক আমার মনে হয় কাউকেই প্রতিপক্ষ বা শত্রু না বানিয়ে কাজ করতে পারলেই ভালো। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই শান্তিপ্রিয়। বৃহৎ পরিসরে শান্তি বলতে ঐক্য, শান্ত অবস্থা, বিঘ্নতা সৃষ্টিকারী পরিবেশ দ্বারা আক্রান্ত না হওয়াকে বুঝায়। সমাজ ও সংগঠনের অভ্যন্তরে শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। শান্তির স্বপক্ষে চিরজাগরুক ব্যক্তিত্ব মার্টিন লুথার কিং, জুনিয়র বার্মিংহ্যাম কারাগার থেকে এক চিঠিতে লিখেছেন যে – ‘‘সত্যিকারের শান্তি কেবলমাত্র উদ্বিগ্নেরই অনুপস্থিতি ঘটায় না; বরঞ্চ ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও উপস্থিতিজনিত কারণে হয়ে থাকে’’।অন্যভাবে বলা যায় যে, প্রকৃত শান্তি তখনই ঘটে যখন সমস্যা, ভয়-ভীতির পরিবেশ দূরীভূত হয়।

বাইবেলে "ন্যায় বিচার ও শান্তি একে-অপরকে চুম্বন করবে" বলে বর্ণিত দৃশ্যে চিত্রিত করা হয়েছে। ধর্মীয় বিশ্বাসের মাধ্যমে প্রায়শঃই মানব জীবনের যাবতীয় সমস্যাসহ অন্য ব্যক্তির সাথে পরস্পর বিপরীতমুখী চিন্তা-ভাবনাকে চিহ্নিত ও পরিচিতি ঘটানোর সুযোগ তৈরী করা হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন যে, কেবলমাত্র সকল প্রকার দুঃখ-দূর্দশা শেষে শান্তি লাভ করা সম্ভব। দুঃখ থেকে পরিত্রাণ লাভ কর ও শান্তি লাভ কর - বৌদ্ধদের দার্শনিক মতবাদের চারটি মহৎ গুণাবলীর অন্যতম একটি হিসেবে স্বীকৃত। ইহুদী এবং খ্রীষ্টানগণ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে, একমাত্র ঈশ্বরের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও সান্নিধ্য স্থাপনের মাধ্যমেই প্রকৃত শান্তি আসবে। খ্রীষ্টানরা দাবী করেন যে নাজারেথের যীশু শান্তির রাজপুত্র। ব্যক্তি, সমাজ এবং সকল প্রকার সৃষ্টির মধ্যে অবস্থানপূর্বক শয়তানকে দূর করে মসীহ খ্রীষ্ট শান্তির রাজত্ব প্রতিপালন করবেন। যীশু খ্রীষ্ট বলেছেন,‘‘তোমাদের শান্তিকে নিয়ে আমি চলে যাচ্ছি; আমার শান্তি আমি তোমাদেরকে দিব। বৈশ্বিকভাবে যে শান্তি তোমরা কামনা করছ আমি সে শান্তি দিব না। তোমরা ভেঙ্গে পড়ো না এবং ভীত-সন্ত্রস্ত হইও না। - জন’’

আপনি যদি কিছুটা উদার না হন তবে সমাজে গোঁড়া বলে বিবেচিত হবেন। সমাজে প্রচলিত প্রথা বা রীতিকে সম্পূর্ণ বাদ দিলে আপনি অসামাজিক ও অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়বেন। উদারতার মানে বাড়াবাড়ি না করা। সুদীর্ঘকাল থেকে চলে আসা যে কোন ধরণের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, নিয়ম-কানুন, বিধি-নিষেধ, বিশ্বাস অথবা কর্মকাণ্ড যা অধিকাংশ সাধারণ জনগণ বা সমাজ কর্তৃক উৎপত্তিকাল থেকে যুগ যুগ ধরে বিনাদ্বিধায় পালন করাসহ মেনে চলে আসছে। উক্ত বিষয়গুলো সাধারণতঃ একই দেশ, সংস্কৃতি, সময়কাল কিংবা ধর্মীয় রীতি-নীতির দ্বারা প্রথা পালন করা হয়ে থাকে। যদি কোন কিছু একই ধরণ বা পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক পালন করা হয় কিংবা একযোগে বা একই নিয়মে অনুসৃত হয় তাহলে তা সামাজিক আইন, সনাতনী প্রথা বা প্রাচীন রীতি নামে পরিচিত। সামগ্রিকভাবে প্রথা মূলতঃ প্রতিপালন ও চর্চার বিষয়। প্রথা সামাজিক আচার নামেও পরিচিত। একসময় তা সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। সুন্দর, শোভন, সামাজিক অভ্যাসগুলো প্রথা হয়ে ওঠে। প্রথা ব্যক্তিগত কোন বিষয় নয়। এর সাথে সামাজিক সম্পর্ক রয়েছে। প্রথা পালনে কিছুটা সামাজিক বাধ্যবাধকতা আছে। প্রথায় কতকগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যথা - প্রথা সমাজে সর্বদা বিদ্যমান ও ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করে। প্রথা সামাজিক আচরণ বিধি। এতে নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিফলন রয়েছে এবং প্রথা এক ধরনের সামাজিক অনুশাসন বা আইন। সমাজকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে ব্যক্তিকে সমাজের প্রচলিত প্রথা ও নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। সামাজিক প্রথা মেনে না চললে বা ভঙ্গ করলে মানসিক শাস্তিস্বরূপ ব্যক্তিকে একঘরে করে রাখা হয়। সমাজে অবস্থানরত বিভিন্ন স্তরের সদস্য বা প্রতিবেশীর সাথে কিরূপ আচরণ বা সম্পর্ক সৃষ্টি করা উচিত তা সামাজিক প্রথার উপর নির্ভরশীল। গুরুজনদের সম্মান জানানো, সালাম বা শুভেচ্ছা বিনিময়, শ্রদ্ধা ও সৌহার্দ্যমূলক মনোভাব, বিবাহ অনুষ্ঠান ও আমন্ত্রিত অতিথিদেরকে আদর-আপ্যায়ন, নববর্ষ পালন, স্বাধীনতা দিবস উদযাপন ইত্যাদি প্রথার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

পরিবর্তনের কথা বারাক ওবামা থেকে শুরু করে ড. ইউনুস কিংবা প্রথম আলো সবাই বলে। আমাদের স্বতন্ত্রতা ও স্বকীয়তা কি থাকবে তা বের করতে হবে। আপনারা জানেন যে, দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকাটি সামাজিক আন্দোলনের সংকেত হিসাবে প্রথমে যে শ্লোগানটি আপ্ত করে তা হলো 'যা কিছু ভালো তার সঙ্গে প্রথম আলো'। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে তা পরিবর্তন করে 'বদলে যাও, বদলে দাও' শ্লোগানটি গ্রহণ করা হয়। ২০১৩ সালে প্রথম আলোর ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে নতুন স্লোগান করা হয় 'পথ হারাবে না বাংলাদেশ।সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও প্রথম আলো জড়িত আছে। এর মধ্যে রয়েছে এসিড সন্ত্রাস রোধ, মাদকবিরোধী আন্দোলনসহ নানা আয়োজন। পাশাপাশি কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনা। এছাড়াও বিভিন্ন অলিম্পিয়াড আয়োজনেও এই প্রতিষ্ঠান সহায়ক ভূমিকা পালন করে। গণিত অলিম্পিয়াড, ভাষা প্রতিযোগ ইত্যাদি এরকমই কিছু আয়োজন। এছাড়া জরুরি জাতীয় আপৎকালীন সময়ে প্রথম আলো ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। সকল অর্থ আসে পাঠক-পাঠিকাদের আর্থিক অবদান থেকে। এ জন্য স্থাপন করা হয়েছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। ভাষা প্রতিযোগ ২০০৫ সাল থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসা একটি ভাষা বিষয়ক প্রতিযোগ খোনে চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। প্রথম আলো-এইচএসবিসি ব্যাংকের যৌথ ব্যবস্থাপনায় এই প্রতিযোগে এক ঘন্টার পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।এই উৎসবের সভাপতি আনিসুজ্জামান। এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০০ স্কুলের ৬০,০০০+ শিক্ষার্থী এতে অংশ নিয়েছে। সাধারণত প্রতি বছর মার্চ মাসে এ প্রতিযোগের আয়োজন করা হয়।অন্যান্য উদ্যোগের মধ্যে আছে,প্রথম আলো জবস ডট কম,প্রথম আলো ব্লগ, কিশোর আলো।২০১২ সালে প্রথম আলো কিশোর নববর্ষ সংখ্যা ১৪১৯ প্রথম প্রকাশিত হয়। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয় প্রথম আলো কিশোর নববর্ষ সংখ্যা ১৪২০।২০১৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হয় কিশোর আলো।

খুব বড় চাকর হলেই যে আপনি বড় সমাজকর্মী বা উন্নয়নকর্মী হতে পারবেন এমনটি নয়। এমনকি ভাল গবেষক ও তাত্ত্বিক হতে গেলেও যে চাকরগীরি খুব সুবিধের নয় এটা বুঝতে আমরা ইমাম গাজ্জালীর (রহঃ) কথা বলতে পারি। আবু হামিদ মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ আল-গাজ্জালি (রহঃ) নিজের যুগের তত্ত্বগত নৈতিক ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও তমুদ্দুনিক জীবনধারাকে যত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন, ততই তাঁর মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে থাকে এবং ততই বিবেক তারস্বরে শুরু করে যে, এই পুঁতিগন্ধময় সমুদ্রে সন্তরণ করা তোমার কাজ নয়, তোমার কাজ অন্য কিছু। অবশেষে সমস্ত রাজকীয় মর্যাদা, লাভ , মুনাফা, ও মর্যদাপূর্ণ কার্যসমূহেকে ঘৃণাভাবে দূরে নিক্ষেপ করেন। কেননা এগুলোই তার পায়ে শিকল পরিয়ে দিয়েছিল। অতঃপর ফকির বেশে দেশ পর্যটনে বেরিয়ে পড়েন। বনে-জঙ্গলে ও নির্জন স্থানে বসে নিরিবিলিতে চিন্তায় নিমগ্ন হন। বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মুসলমানদের সংগে মেলামেশা করে তাদের জীবনধারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। দীর্ঘকাল মোজাহাদা ও সাধনার মাধ্যমে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে থাকেন। ৩৮ বছর বয়সে বের হয়ে পূর্ণ দশ বছর পর ৪৮বছর বয়সে ফিরে আসেন। ওই দীর্ঘকালীন চিন্তা ও পর্যবেক্ষণের পর তিনি যে কার্য সম্পাদন করেন তা হলো এই যে, বাদশাহদের সংগে সম্পর্কেচ্ছেদ করেন। এবং তাদের মাসোহারা গ্রহণ করা বন্ধ করেন। বিবাদ ও বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকার জন্যে শপথ করেন। সারকারী প্রভাবাধীনে পরিচালিত শিক্ষায়তনসমূহে কাজ করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন এবং তুসে নিজের একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান কায়েম করেন। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি নির্বাচিত ব্যক্তিদের বিশেষ পদ্ধতিতে তালিম দিয়ে তৈরি করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু সম্ভবতঃ তাঁর এ প্রচেষ্টা কোনো বিরাট বৈপ্লবিক কার্য সম্পাদন করতে সক্ষম হয়নি, কেননা এ পদ্ধতিতে কাজ করার জন্যে তাঁর আয়ু তাঁকে পাঁচ ছয় বছরের বেশী অবকাশ দেয়নি।

অনেকে সামাজিক আন্দোলনে কিংবা সমাজ পরিবর্তনে সমাজ বিজ্ঞানের জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি অনুভব করেন। আমার ডাক্তার ও প্রকৌশলদের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, আসলে যার মানবিকতাবোধ আছে, পরের স্বার্থে কাজ করার ব্যাকুলতা আছে, একটু সুক্ষানুভূতি আছে সেই সামাজিক আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে পারে। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি ছেড়ে দেয়া ড. ইউনুস হোক, বিশ্বসেরা কোন কোম্পানীর লোভনীয় চাকরী ছাড়া ফজলে হাসান আবেদ হোক, যে কোন পেশারই হোক। ধরুণ প্রকৌশল বা ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে মানুষের সমস্যাবলী সমাধান এবং জীবনকে সহজ করার জন্য বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানের প্রয়োগ। প্রকৌশলীগণ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গণিত এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করবার জন্য তাঁদের কল্পনাশক্তি, বিচারক্ষমতা এবং যুক্তিপ্রয়োগক্ষমতা ব্যবহার করেন। এর ফলাফল হচ্ছে উন্নততর নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু ও নিত্যব্যবহার্য কর্মপদ্ধতির আবির্ভাব যা প্রতিদিনের জীবনকে সহজ করে দেয়। যেই প্রকৌশলী মানুষের প্রতি বেশী দরদী হবে সে নিশ্চয়ই মানব কল্যাণে তার উদ্ভাবনকে উৎসর্গ করবে।

যখন সুন্দর সমাজের জন্য আমরা কাজ করবো তখন সামাজিক ও মানবিক সমস্যাগুলোর সমাধানের প্রয়াসটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠবে। যখন আমরা বিশ্বায়ন, আধুনিকায়ন ও তথ্য প্রযুক্তির সমন্বয়ে নিজেদের চিন্তাধারাকে শানিতকরণ ও প্রচেষ্টাকে জোরদার করতে চাইবো তখন আমাদের আবেদনটা হতে হবে সার্বজনীন, বিশ্বজনীন, সময়োপযোগী। আর আমাদের চিন্তাধারা ও কর্মসূচিকে প্রচার প্রসারের জন্যে উপযুক্ত উপায় উপকরণ ব্যবহার করায় সিদ্ধহস্ত হতে হবে। যেমন ব্লগিং এসময়ে খুব জনপ্রিয়। যদি ই-মেইল আইডিগুলো লেখা থাকে তবে এক ক্লিকে কোন ফাইল লক্ষজনের কাছে পৌছানো যায়। ফলে নেটওয়ার্কিংয়ের জন্যে এই মাধ্যমটাও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক আন্দোলনের কর্মীরা যে মাধ্যমের ব্যবহার নিশ্চিত করে কাজ করবে তা সহজ প্রাপ্য হতে হবে।

অনেক এনজিও পরিবেশ নিয়ে কাজ করছে। পরিবেশটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে কিংবা সংকটে নিপতিত মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনে পরিবেশ ইস্যু নিয়ে কাজ হওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ-এর ২০১০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স (CRI) অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্থ দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ। এই সমীক্ষা চালানো হয় ১৯৯০ থেকে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১৯৩টি দেশের উপর। উল্লেখ্য, উক্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত ২০০৭ এবং ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্থতার বিচারে বিশ্বব্যাপী গবেষকগণ বাংলাদেশকে পোস্টার চাইল্ড (Poster Child) হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। বহুবিধ সমস্যা যেমন-বৃষ্টিপাত হ্রাস, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক তাপমাত্রা, মরুকরণ, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস, সুপেয় পানির অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি। ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থা ম্যাপলক্র্যাফ্‌ট-এর তালিকায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার আগে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মান ওয়াচ-এর প্রতিবেদন (২০১০) অনুযায়ী ১৯৯০ থেকে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশে বড় ধরণের প্রায় ২৫৪টি দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। ঘুর্ণিঝড় বা টর্নেডো বাড়ছে। জাতিসংঘ প্রকাশিত প্রতিবেদনে (২০১০) ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে বাংলাদেশ। সূত্র: UNDP।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং (IWM)-এর গবেষণামতে, বাংলাদেশের উপকূলের ১৪টি শহর জলোচ্ছাসের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। স্থায়ী জলাবদ্ধতা, শিলাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও তীব্র বন্যা বাড়ছে। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত তালিকায় বন্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম (১ম)। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং (IWM)-এর গবেষণামতে, ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের বন্যার পর দেশে বন্যাপ্রবণ এলাকার পরিমাণ ১৮% বেড়েছে এবং বর্তমানে (২০০৯) পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের ৩৪টি শহর বন্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। নদীভাঙন, ভূমিধ্বস ও ভূমিকম্প বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ পরিচালিত রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট টুলস ফর ডায়াগনোসিস অফ আরবান এরিয়াস এগেইন্সট সাইসমিক ডিযাসটার (রেডিয়াস) জরিপে ভূতাত্ত্বিক ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকাও অন্যতম। সুনামির সম্ভাবনা, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি (SLR) ও প্রাকৃতিক সম্পদ হ্রাস মোটেই ছোটখাটো সমস্যা নয়। ইউনেস্কোর "জলবায়ুর পরিবর্তন ও বিশ্ব ঐতিহ্যের পাঠ" শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন কারণে সুন্দরবনের ৭৫% ধ্বংস হয়ে যেতে পারে৷ মৎস্যসম্পদ হ্রাস,জীবজন্তুর অবলুপ্তি , উদ্ভিদ প্রজাতি ধ্বংস, পক্ষী প্রজাতির বিলুপ্তি, কৃষিভিত্তিক উৎপাদন হ্রাস বা ধ্বংস, খাদ্যসংকট, জীবনোপকরণ হ্রাস, জীবিকার উৎস ধ্বংস, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে মানুষ, অপুষ্টি, রোগব্যাধি,জলবায়ু উদ্বাস্তু বৃদ্ধি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন-সবই ভয়াবহ সমস্যা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির ফলে তলিয়ে যাওয়া অঞ্চল থেকে ২০৫০ সাল নাগাদ ৩ কোটি মানুষ গৃহহীন হতে পারে৷

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির সংবাদ মতে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১-১.৫ কোটি মানুষ বড় বড় শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচের গবেষণা প্রতিবেদন (২০১০) অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে গড়ে বছরে ৮,২৪১ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। পরিবেশগত বিপর্যেয়ের কারণে সামাজিক অবক্ষয় বাড়ছে, হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষতি। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচের গবেষণা প্রতিবেদন (২০১০) অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের বাৎসরিক ক্ষতির পরিমাণ ২,১৮৯ মিলিয়ন ডলার, জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে যা ১.৮১% নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৯০ থেকে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সারা বিশ্বে হওয়া ক্ষতির প্রায় ২০%-ই বাংলাদেশে হয়েছে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিষয়টি উঠে এসেছে প্রায় প্রতিটি গণমাধ্যমে; খবর হয়ে উঠে এসেছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদভিত্তিক চ্যানেলে। বিবিসিতে সিমন রীভ্‌-এর উপস্থাপনায় ৬ পর্বের তথ্যচিত্রভিত্তিক টিভি সিরিজ "ট্রপিক অফ ক্যান্সার"-এর (Tropic of Cancer), ৬০ মিনিটব্যাপী ৫ম পর্বে বাংলাদেশের, পদ্মানদীসংলগ্ন পশ্চিমাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নদীভাঙ্গনের তীব্রতা তুলে ধরা হয়েছে। তাছাড়া লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও, ল্যাইলা কনার্স পিটারসন, চাক ক্যাসেলবেরি এবং ব্রায়ান গার্বারের তৈরি করা ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের পরিবেশভিত্তিক তথ্যচিত্র্র (Documentary film) "দ্যা ইলেভেন্থ আওয়ার"-এ (The 11th Hour) দেখানো হয় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধিজনিত কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় প্রায় ২৩০লক্ষ, চীনে প্রায় ১৪৪০লক্ষ, নেদারল্যান্ডে প্রায় ১২০লক্ষ এবং বাংলাদেশে প্রায় ৬৩০লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হবার সম্ভাবনা রয়েছে।

অপরাধ প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠতে পারে। অপরাধী যাতে শাস্তি পায় এজন্যে জনস্বার্থ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জনসচেতনতা তৈরিতে কাজ হতে পারে। সমস্যাটা হলো আমাদের দেশে অপরাধ দমনকারীরও অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে পড়া। আমরা নীতি নৈতিকতার পক্ষে। সত্যিকারের মানুষ মানেই নৈতিক মানুষ। যেখানে অনৈতিকতা যত বেশি সেখানে নৈতিকতার প্রয়োজনটাও তত বেশি। অনেকের মনে হতে পারে আমরা যে এমন কথা বলছি কিংবা লিখছি এমন ধরনের সংগঠন পরিচালনা করার মতো নেতৃত্ব কি আমাদের আছে। এক্ষেত্রে যদি কোন একক ব্যক্তিকে চিন্তা না করে একটি গ্রুপকে নেতা কল্পনা করি তবে আমার মনে হয় এটি খুব সহজ হয়ে যায়। এটাও ঠিক কাজ করতে শুরু করলে উপযুক্ত নেতৃত্বের সন্ধানও মিলবে। যদি একটি গ্রুপ সামাজিক প্রভাবের সাহায্যে কোনও একটি সর্বজনীন কাজ সম্পন্ন করার জন্য অন্যান্য মানুষের সহায়তা ও সমর্থন লাভ করতে পারে তবে আশংকার কিছু থাকেনা। আমরা মানুষের জন্য একটি পথ খুলে দেওয়ার চেষ্টা করবো যাতে তারা কোনও অসাধারণ ঘটনা ঘটানোর ক্ষেত্রে নিজেদের অবদান রাখতে পারে।

দলের সব সদস্য একতার ব্যাপারে সচেতন থাকবেন। আন্তঃব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকতেই হবে। সদস্যদের নিজেদের অবদান রাখা, অন্যের কাছ থেকে শেখা এবং অন্যদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ থাকা অবশ্য প্রয়োজন। একটি সাধারণ লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য অদস্যদের একসঙ্গে কাজ করার ক্ষমতা থাকতেই হবে। শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতেই হবে। এই সেক্টরকে অবহেলা করার কোনই কারণ নেই। জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে জ্ঞান ভিত্তিক সংগঠন খুব জরুরী। জ্ঞানভিত্তিক আন্দোলনের জন্যে শিক্ষিত হওয়ার কোন বিকল্প নেই। জ্ঞানকে বাড়াতে হবে, চেতনাবোধকে জাগাতে হবে এবং বিশ্বাসকে সুগভীর করতে হবে।

বিষয়: বিবিধ

১৪৪৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

267712
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১২:৫৭
কাজী লোকমান হোসেন লিখেছেন : পর্বাকারে দিতে পারতেন , ব্লগ ফেসবুকে গুনগত লেখার কদর পাঠকদের কাছে নাই বললেই চলে Praying Rose অনেক ভালো লাগলো Rose , এই রকম লেখা আরও চাই , ধন্যবাদ Thumbs Up Thumbs Up

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File