বাবা ও মুক্তিযুদ্ধ
লিখেছেন লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ জুনিয়র ২২ মার্চ, ২০১৪, ০৪:০৩:৪৫ বিকাল
আপনাদের যাদের বাবার স্মৃতি মনে আছে তারা আসলেই অনেক ভাগ্যবান । কতটুকু ভাগ্যবান সেটা সম্ভবত আপনাদের চেয়ে - আমাদের মত যাদের বাবার স্মৃতি বলতে তেমন কিছু নেই তারা ভাল অনুভব করেন ।
বাবার স্মৃতি বলতে যতটুকু অবশিষ্ট আছে তাকে স্মৃতি না বলে কিছু কালো দুঃস্বপ্ন বলা চলে ।
--
১৯৭১ সালের ঘটনা .....
চারিদিকে গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেছে । এখানে বলে রাখা ভাল , ৭১ এর যে ঘটনাকে আজ আমরা মুক্তিযুদ্ধ বলে ডাকি – তখন ১৯৭১ সালে , অন্তত আমাদের সেই প্রত্যন্ত এলাকার সাধারন মানুষ একে এই নামে ডাকত না । বরং পুরো পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখলের জন্য নিজেদের মধ্যে এই মারামারিকে স্থানীয় মুরুব্বিরা গণ্ডগোল আখ্যা দিয়েছিলেন ।
-
আমার বাবা ছিলেন পোস্ট মাস্টার । রেললাইনের পাশে পোস্ট অফিস , আর তার পিছনে বিশাল এক জঙ্গল । জঙ্গলের পিছনেই ছিল আমাদের বাড়ি । আমাদের বাড়ির সাথেই ছিল সাত্তার চাচাদের বিশাল দালান ঘর । উনি ছিলেন উপজেলা হাইস্কুলের রিটায়ার্ড শিক্ষক । টাকা পয়সার পাশাপাশি একজন মস্ত শিক্ষক মানুষ হওয়ায় এলাকার সকলেই তাকে মুরুব্বী হিসেবে মানত ।
গণ্ডগোল যে আস্তে আস্তে যুদ্ধে রুপান্তরিত হয়েছে এটা সকলে সাত্তার চাচার কাছ থেকেই জানতে পারে । সিলভার কালারের একটা ভারী রেডিও ছিল উনার খবরের সূত্র । সন্ধ্যার পর থেকেই সে দালান ঘর লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত । দুটো কান খাড়া করে লোকজন রেডিওর খবর শুনত । খবর শেষ হলে শুরু হত সাত্তার চাচার বিশ্লেষণ । সব খবরের ব্যাখা করে দিতেন সুন্দর করে .....
এভাবেই যুদ্ধের দিনগুলি যেতে লাগল .... একদিন শুনলাম সাত্তার চাচার দুই ছেলে নাকি যুদ্ধে গেছে । আমার ছোট মস্তিষ্ক সম্ভবত সেইদিন বুঝতে পারে – দেশে যা চলছে তা মোটেই ভাল কিছু না । বরং যারা যুদ্ধে যায় তারা মারা যায় !
যুদ্ধের দিনগুলিতে পোস্ট অফিসের তেমন কাজ থাকত না । বাবাকে দেখতাম সারাদিন সাত্তার চাচার সাথে থাকতেন , নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন । সন্ধ্যার পর রেডিও শুনতেন – আর মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে উঠে দেখতাম জায়নামাজে দাঁড়িয়ে ঝরঝর করে কাঁদছেন । সিজদায় দাঁড়িয়ে দেশের জন্য দোয়া করছেন । অনেক সময় সকালে উঠেও তাকে ঐ জায়নামাজেই দেখতাম ।
আসলে কালো দুঃস্বপ্ন বলে কথা ! বাবার চেহারাটাও এতো স্পষ্ট মনে নেই ! কেবল মনে আছে কালো রঙের একটা মাঝবয়সী লোক । গালভর্তি কালো দাড়ি । চেহারাতে রুক্ষতা ছিল , মায়াও ছিল । মায়াবী দুটি চোখের একটা আরেকটার চেয়ে কিছুটা ছোটবড় ছিল ।
আর মনে আছে বাবার সেই একগাল হাসি .....
--
যুদ্ধের শেষ দিকে .... অলস মনে বসেছিলাম পুকুর পাড়ে । পুকুরের মাছগুলোর শান্তির চলাফেরায় বাঁধার সৃষ্টি করছিলাম । এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসলেন পাশের পাড়ার সজিনা খালা । জানালেনঃ বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে কিছু লোক ! সকালে বাজারে গিয়েছিলেন – তখন সকলের সামনেই জোর করে অজ্ঞাত জায়গায় নিয়ে গেছে তারা । দুপুর হয়ে গেছে – এখন পর্যন্ত কোনও খোঁজ খবর নেই ।
অজানা এক ভয়ে ডুকরে উঠল আমার বুক । এক দৌড়ে বাড়িতে পৌঁছে আম্মার কাছে গেলাম । যেয়ে দেখি আম্মাও কাঁদছে । আমি আম্মার আঁচলের মাঝে মুখ লুকালাম – পুরো শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছিল .... এরপর আর বেশি কিছু খেয়াল নেই ।
সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে বাবার লাশ আনা হল । হাত পা একাট্টা করে আটকানো , চোখে লাল গামছা বাঁধা । মুখ দিয়ে সাদা তরল বের হয়ে শুকিয়ে রয়েছে । সাদা শার্টটা রক্তে রঙিন !
বাড়ির উঠান মানুষে ভরে গেছে । দেখলাম , সাত্তার চাচা চোখ মুখ মুছতে মুছতে সকলের উদ্দেশ্যে কথা বলছেনঃ “ শোন তোমরা , আমজাদ কে যারা ধরে নিয়ে গেছে তারা হল রাজাকার । এরা পাকিস্তানিদের সাথে হাত মিলাইছে । এরা কয় , আমজাদ নাকি মুক্তিবাহিনীরে অস্ত্র সাপ্লাই দিছে ! অথচ আমি আপনি সবাই জানি আমজাদ নিরীহ । সে এইসব কিছুই করে নাই । আজকে যারা সবার সামনে এই কাজটা করছে তাদের আপনারা সবাই চিনেন । এদের নেতা হইল উত্তর পাড়ার করিম শেখের পোলা এলাকার সবচেয়ে শয়তান - তমিজ মোল্লা । তমিজ মোল্লার সাথে ছিল ঐ পাড়ার মুচি চাঁদ মিয়া । এদের কাউরে ভুইলেন না । সময়মত পশুগুলোরে উচিৎ শিক্ষা দেওয়া হবে । আপনারা ..... ”
এরচেয়ে বেশি কিছু আর শুনতে পারিনি । তার আগেই আবার ফিট হয়ে গিয়েছিলাম ।
--
ছোটকালের আনন্দময় স্মৃতিগুলো এভাবেই আমার হৃদয় থেকে ছিনিয়ে নেয় কিছু জারজ পশু ! একটা ছোট শিশুর স্মৃতি কেড়ে নেওয়ার মত অপরাধের কোনও শাস্তি এই ধরায় আছে কিনা আমি জানিনা । সম্ভবত নেই .....
তারপরেও এই অপরাধের বিচার নিয়ে কিছু কথা বলব , কারণ আজ এইসকল অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে ।
প্রথমেই , একটা কথা বলে রাখি – আজ অনেকেই মনে করেন রাজাকার মানেই বুঝি দাড়িওয়ালা কিছু হুজুর মানুষ । তাদের উদ্দেশ্যে বলিঃ আমার বাবাকে যারা হত্যা করেছেন তারা রাজাকার ছিল – কিন্তু তারা কেউ দাড়ি টুপিওয়ালা ধর্মপ্রাণ কেউ ছিল না – বরং তারা ছিল কিছু ধর্মহীন পশু । যাদের একজনকে আগে থেকেই সকলে শয়তান নাদান হিসেবে চিনত । আরেকজন হল এক দরিদ্র মুচি । যদ্দুর জানি টাকা পয়সা পাওয়ার লোভেই এই দলে যোগ দিয়েছিল সে । যুদ্ধের পরে অবশ্য তাকে হাত পা কেটে মেরে লাশ চারদিন কাঁঠালগাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল ! কিন্তু শয়তান তমিজ মোল্লাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি । অনেকেই বলে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই সে ইন্ডিয়া পালিয়ে গিয়েছিল ।
দ্বিতীয়ত , বিচার সম্পর্কে বলবঃ যুদ্ধকালীন সময়ে সাধারন মানুষের বিরুদ্ধে যারা অমানবিক আচরণ করেছে তাদের অবশ্যই বিচার চাই । তবে – আপনাদের অনেকের কাছেই এটা শুধুমাত্র একটা বিচার । কারও কাছে আবার এটা একপ্রকার রাজনৈতিক অস্ত্র ! কিন্তু আসলেই ঐদিন যারা ভিক্টিম ছিল তাদের কাছে এটা একটা সামান্য বিচারের চাইতেও অনেক কিছু ......
তাই আমার অন্তর থেকে চাওয়া , আপনারা আর যাই করেন – অন্তত এইসব বিষয় নিয়ে রাজনীতি করবেন না । আপনার যদি চাওয়া হয় সুষ্ঠ বিচার – তবে আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের একজন মানুষও এর বিরুদ্ধে থাকবে না । কিন্তু আপনি যদি এটা নিয়েও রাজনীতি শুরু করেন তবে স্বাভাবিকভাবেই নানা মহল থেকে নানা প্রশ্ন উঠবে ।
পরিশেষে ; আমার বাবার মত আরও অনেকের প্রিয়জন সেই মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন , তাদের সকলের আত্মার শান্তি কামনা করছি .....
বিষয়: Contest_father
১৮৫২ বার পঠিত, ২৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চালিয়ে যান ভাই ....
অনেক ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন