উপজ্বালার স্বাদ লুটতে মরিয়া আওয়ামী লীগ-বিএনপি!
লিখেছেন লিখেছেন বাঙালী তীরন্দাজ ২১ মার্চ, ২০১৪, ০৫:১৪:৩২ বিকাল
কাল বাদে পরশু চতুর্থ পর্বের উপজেলা নির্বাচন। এর আগে গত ১৫ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছে তৃতীয় পর্যায়ের উপজেলা নির্বাচন। আগের দু'পর্বের চেয়ে তৃতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে সহিংসতা, কারচুপির অভিযোগ বেশি। সেই হারে নির্বাচনোত্তর সহিংসতার ঘটনাও বেশি। গত ক'দিন প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও জ্বালাও-পোড়াও, হামলা-পাল্টা হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। গণমাধ্যমগুলোতে বেশ কিছু অংশ জুড়ে থাকছে এসব সহিংসতার খবর।
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে উপজেলা নির্বাচন এক ধরনের পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল ও সংসদের বাইরের প্রধান বিরোধী দলের জন্য পরীক্ষাটা একটু বেশি কঠিন। এ পরীক্ষায় চূড়ান্ত 'পাস-ফেল' এখনই নির্ধারণ করা সমীচীন হচ্ছে না। তবে আগামী দিনের রাজনীতির পথ পরিক্রমায় এ ফলাফলকে প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই বিবেচনায় নেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
উপজেলা নির্বাচন প্রচলিত ধারণায় রাজনৈতিক নির্বাচন নয়। কিন্তু তৃণমূলে বাস্তবে ষোলো আনাই এটি রাজনৈতিক জমজমাট নির্বাচন। গণমাধ্যমগুলোতেও নির্বাচনী ফলাফলকে উপস্থাপন করা হচ্ছে রাজনৈতিক পরিচয়েই। বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশের মতো দেশে যেকোনো নির্বাচনেই প্রার্থীরা কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। উন্নত গণতন্ত্রের দেশগুলোতেও স্থানীয় নির্বাচন হচ্ছে রাজনৈতিক দলগত অবস্থান থেকেই। সেখানেও দলীয় প্রার্থীরাই নির্বাচনে অংশ নেন। বরং সেসব দেশে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘটনা ক্রমশই কমতে শুরু করেছে। ব্রিটেনের মতো পুরনো ও স্থায়ী গণতান্ত্রিক দেশের স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেয়া এবং প্রতীক ব্যবহারের সংস্কৃতি চালু আছে। এর ফলে স্থানীয় পর্যায়ের শাসন ব্যবস্থাতেও দলীয় মতাদর্শ প্রতিফলিত হয়। তৃণমূলে বাজেট প্রণয়ন, উন্নয়ন-পরিকল্পনার মতো বিষয়ে রাজনৈতিক ইচ্ছা বাস্তবায়ন হয়। এ উদাহরণ রয়েছে ভারতেও। বাংলাদেশে দলীয়ভাবে অংশগ্রহণের বিষয়টি কাগজ-কলমে বাদ দেয়া হলেও কার্যত প্রতিটি নির্বাচন রাজনৈতিক দলের ভিত্তিতেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে তা প্রমাণ দিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি উচ্চ আদালতের নির্দেশে রাজনৈতিক নিবন্ধন হারানো দল জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত প্রার্থীদের সংশ্লিষ্ট দলটির নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে মিডিয়াতে তুলে ধরা হচ্ছে। তা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও বাস্তবে ঘটে চলছে। অথচ কে-না জানে নির্বাচন কমিশনে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধব বাতিল করা হয়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে এদেশের কোনো নির্বাচনে অযোগ্য করা হয়েছে দলটিকে। তারপরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানকে জামায়াতের প্রার্থী বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে নির্বাচনের মাঠে রাজনীতির গতিপ্রবাহ আইন মানতে চায় না। আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনেতো মোটেই না। এ বাস্তবতার কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকেও প্রকাশ্যে রাজনৈতিক পরিচয় ও প্রতীকে করার প্রস্তাব আসছে। সরকারের তরফ থেকেই প্রস্তাবনাটি বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এ নিয়ে প্রতিদিনই বক্তব্য দিচ্ছেন।
তিন ধাপে ২৯৫টি উপজেলায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা জিতেছেন ১২৩টিতে। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হয়েছেন ১১৭ জন। জামায়াত পেয়েছে ২৬টি। বাকিরা জাতীয় পার্টি, বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র। এ ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের দুই বড় দলের ভোট ব্যাংক এখনও অটুট। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে এই দুই বড় শক্তির সামর্থ্য এখনও অক্ষুণ্ন আছে। যদিও দু'পক্ষই নিজেদের সেরা দাবির পাশাপাশি জালিয়াতি-কারচুপির অভিযোগে একপক্ষ অন্যপক্ষকে দোষারোপ করছে। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীনদের দিকে এই তীর বেশি জোরালো। তার ওপর আবার নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা, নির্বাচনের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিদেশ সফরসহ কয়েকটি ঘটনা বিশেষভাবে সমালোচিত। এই উপজেলা নির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নাজুক অবস্থা দেখিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে এ নির্বাচন সরকারের জন্য আত্দমূল্যায়ন ও সংশোধনের বিশাল এক সুযোগ এনে দিয়েছে।
ক্ষমতাসীনরা বিএনপিকে যতো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে মাঠের অবস্থা যে তা নয়_উপজেলা নির্বাচনে তা স্পষ্ট। এছাড়া বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রতিহত করতে দেশব্যাপী যে জামায়াতনির্ভর সহিংসতা করেছে তা থেকে বেরিয়ে এসে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তা-ও প্রমাণ করতে পেরেছে দলটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতেও তাদের দক্ষতা-আন্তরিকতা আছে তারও এক পসলা প্রমাণ মিলেছে। উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল আসলে দেশের দুটি বড় দলকেই অনেক 'মেসেজ' দিয়েছে। এখন যার যার প্রয়োজন এবং বোঝার ক্ষমতানুযায়ী ম্যাসেজগুলো কাজে লাগানোটা নির্ভর করছে দুই দলের নেতৃত্বের বিচক্ষণতার ওপর।
বড় রকমের ম্যাসেজ আছে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির জন্যও। উপজেলা শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথেই চলে আসে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নাম। ১৯৮৪ সালে উপজেলা পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন তিনি। এর মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কথা। তখন আওয়ামী লীগ-বিএনপি উপজেলা পদ্ধতির তীব্র বিরোধিতা করে। উপজেলা সৃষ্টিকে এরশাদের অন্যতম অপকর্ম বলেছিল দু'দলই। ব্যঙ্গ করে উপজেলাকে তখন দুই দলের নেতারা বলতেন'উপজ্বালা'। সেই বিরোধিতার মধ্যেও আওয়ামী লীগ এরশাদ আমলে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়। কোথাও কোথাও অংশ নেয় বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরাও। '৯১-তে ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন বিএনপি সরকার উপজেলা পদ্ধতি বাতিল করে দেয়। তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এতে ক্ষুব্ধ হয়। তারা উপজেলার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয়। উপজেলা বাতিলের প্রতিবাদে জাতীয় পার্টির সঙ্গে মিলে হরতালও করে তারা। সময়ের ব্যবধানে উপজ্বালা নামের সেই উপজেলা পদ্ধতি এখন বিএনপির কাছেও আকর্ষণীয় এবং উপভোগের। বাংলাদেশের রাজনীতির এটাই ট্রাজেডি অথবা বাস্তবতা। দলকানা বুদ্ধিজীবী, সুশীল, শিক্ষিতরাও দলের অবস্থানের পক্ষে কোমর বেঁধে নেমে যায়। কখন যে কে কোনোটার পক্ষে বা বিপক্ষে তা গ্যারান্টি দিয়ে কেউ বলতে পারে না। তা বোঝার সাধ্য কারো নেই। বিতর্কিত, নিন্দিত সেই উপজেলা এখন সকলের কাছেই প্রিয়। কেউই এর বিরোধী নয়। বরং উপজেলার মজা বা সুবিধা লুটতে গিয়ে বড় দু'দলের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা। যার যার দলীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার একটি চমৎকার উপলক্ষে পরিণত হয়েছে এ উপজেলা নির্বাচন। তা করতে গিয়ে যে যেখানে পারছে হিম্মত দেখাচ্ছে। কেন্দ্র দখল, হাঙ্গামা সৃষ্টিতে কেউ কারো চেয়ে ততো পিছিয়ে নেই। যেখানে যার সাধ্য আছে সে-ই দখলবাজি, জালিয়াতিতে লিপ্ত হচ্ছে। কেউ ব্যালট ছিনতাই করছে, কেউ ছিনতাই হওয়া সেই ব্যালটে আগুন দিচ্ছে। তবে ট্রাজেডি হচ্ছে এরশাদ এবং তার দলের জন্য। যিনি এর উদ্ভাবক বা প্রবক্তা তার দলের অবস্থা এবারের উপজেলা নির্বাচনে বড় করুণ। তিন ধাপে হয়ে যাওয়া ২৯২টি উপজেলার ফলাফলে জাতীয় পার্টির উল্লেখ করার মতো অবস্থা নেই। এমন বিপর্যয়ের পর উপজেলার ইমেজ-আমেজ কাজে লাগাতে পারলে জাতীয় পার্টির তৃণমূলকে এখনো উজ্জীবিত করা সম্ভব। এক্ষেত্রে দরকার সুষ্ঠু কিছু পদক্ষেপ এবং পদক্ষেপগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন।
বিষয়: বিবিধ
১০৪৯ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন