আমাদের রাজনীতিকরা খুবই অনুকরণ প্রিয়
লিখেছেন লিখেছেন সুজায়েত শামীম ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০২:২০:২২ রাত
আমাদের দেশের রাজনীতি একটি কথা বেশ প্রচলিত। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। এটির অনেক প্রমানও আমরা পেয়েছি গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে। ক্ষমতা পাওয়ার লোভে মফস্বলের পাতি নেতা থেকে শুরু করে শীর্ষ নেতারা যেমন দল বদল করেছেন। তেমনই আমাদের স্বাধীনতা বিরোধী সংগঠন জামাত শিবিরকে নিয়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজপথে আন্দোলন করেছে।
সময়ের প্রয়োজনে বা ক্ষমতার লোভে রাজনীতিকদের রং পরিবর্তন একটি সাধারণ নিয়ম। কিন্তু এটির সাথে আরও একটি বিষয় যুক্ত হয়েছে রাজনীতিকদের পরিকল্পনা ও পলিসিতে।
আওয়ামী লীগ যেটা শুরু করে, বিএনপি সেটাকে নিয়ে যায় STREAM পর্যায়ে। আবার বিএনপি যেটা চালু করে, আওয়ামী লীগ সেটাই বিএনপির উপর ব্যবহার শুরু করে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় RAB সৃষ্টি করে প্রকৃত অপরাধীদের কথিত ক্রসফায়ারে মারার প্রচলন শুরু করে বিএনপি। অপারেশন ক্লিনহার্ট নামে যৌথবাহিনীর অভিযান পরিচালনা করে তৎকালীন বিএনপি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চরমপন্হী দমনসহ সারা দেশে নিজের দলের ক্যাডারদেরও হত্যা করে। ওই সময় দলের ছত্রছায়ায় থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও বাদ পড়েনি।
বর্তমানে আওয়ামী লীগও যৌথ বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রেখেছে। তবে সেটি প্রকৃত অপরাধীদের টার্গেটের পাশাপাশি প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের হত্যা করার প্রক্রিয়া চলছে।
যেকারণেই জানতে ইচ্ছে করে ক্রসফায়ারে কোন রাজনৈতিক দলের জেলা বা থানা পর্যায়ের শীর্ষ নেতা বা জনপ্রতিনিধি মারা যাবেন কেনো ? এ প্রসঙ্গে আলোচনার পূর্বে দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে দু'চারটা কথা তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।
ঢাকার বনানী এলাকায় থাকেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তাকে কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, এবারের ভোটে আপনার এলাকা থেকে কে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি কোন উত্তর দিতে পারলেনন না। সরাসরি বললেন, আপাতোত দেশের "জনপ্রতিনিধি" নিয়ে তার কোন আগ্রহ নেই। কয়েক সেকেন্ড পর মেজাজ খারাপ করেই বললেন, " আমাদের ট্যাক্স-ভ্যাটের টাকায় আকাশে আকাশে উড়ে বেড়াতেন দীপু মনি । যেদেশের জনপ্রতিনিধিরা স্রেফ মাছ চাষ করে ৫ বছরের ব্যবধানে সম্পদের পাল্লা ভারি করতে পারেন হাজারগুণ, সেদেশের জনপ্রতিনিধিদের ওপর থেকে আমাদের বিশ্বাস ও প্রত্যাশা উঠে গেছে। আমরা ভাই কেরানী, সারা জীবন কেরানীগিরি করে যাবো, আর আমাদের ট্যাক্সের টাকায় দেশের জনপ্রতিনিধি ও তাদের চ্যালাচামুন্ডারা আরাম-আয়েশ করবে।"
বেসরকারি ব্যাংকের ওই কর্মকর্তার ক্ষোভের কথা উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, তার মত আমরা অনেকেই জানিনা কে হয়েছেন আমার এলাকার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। কেননা আমরা এমন একটি নির্বাচন হয়ে যেতে দেখলাম, যেখানে আসলে ভোটারের কোন প্রয়োজন পড়েনি। ভোটারের কাছে এসে হাতজোড় করে ভোট ভিক্ষা চাওয়া লাগেনি।
২০০৮ সালে যেখানে ৮৭ ভাগ মানুষ ভোট দিয়েছিলেন, সেখানে এই দশম সংসদ নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন মাত্র ১৮ ভাগ মানুষ। পর্যবেক্ষকদের মতে এ সংখ্যা ১০ শতাংশ।আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলছে ৯৫ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে যায়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা জোর গলায় বলছেন, ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন। তবে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের খবর দেখে অনুমান করা গেছে, ঘন কুয়াশার কারণে দুপুর পর্যন্ত দেশের সব কয়টি সেন্টারে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। পাশাপাশি নির্বাচন প্রতিরোধকারীদের হুঙ্কারে অধিকাংশজনই ভোট সেন্টারে যাননি। তাছাড়া আরও একটি মজার ব্যপার হলো, দশম সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি আমাদের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিনসহ সারা দেশের প্রায় ৫ কোটি ভোটার। প্রার্থী না থাকায় দেশের ১৫৩টি আসনে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ভোট বঞ্চিত হলেন।
২৪ জানুয়ারি সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সাউথ এশিয়া ইয়ুথ ফর পিস অ্যান্ড প্রসপারিটি সোসাইটি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অবস্থা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, যারা একটি ভোট না পেয়েও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন তাদের সংসদে কথা বলা মানায় না। প্রসঙ্গক্রমে ওই বৈঠকে তিনি আরও উল্লেখ করেন, বর্তমান শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা নেই। গণতন্ত্রকে অর্থপূর্ণ করতে হলে মানুষের অধিকার ও শাসনকারীদের ন্যায়-নিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণতন্ত্রকে অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার জন্য বর্তমান সরকার ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করেছে। অপরদিকে সদ্য সমাপ্ত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য আখ্যায়িত করে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য অবিলম্বে নতুন নির্বাচনের প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান। সকালে বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সে এটিএন বাংলা ও ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বিএসবি ক্যামব্রিয়ান নির্বাচনী বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
কেবল গোলটেবিল বৈঠক বা বিতর্ক প্রতিযোগীতার মধ্যে কি সীমাবদ্ধ থাকছে দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যত এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি?
এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হয়তো আরও অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। তবে বিশ্ব মিডিয়াতে "ভোটার শূন্য" এ নির্বাচনের খবর যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে, তাতে করে বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসাবে আমাদের কি লজ্বা পাওয়ার কথা? পেতাম, যদি বিশ্ববাসী অভিনন্দন জানানো থেকে বিরত থাকতো। যারা নির্বাচনের সমালোচনা করেছেন, তারাই আবার নব নির্বাচিত সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
ভারত, চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, থাইল্যান্ড, উজবেকিস্তান, মালদ্বীপ, নেপাল, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, শ্রিলংকা, ব্রাজিল, ব্রুনাই, ফিলিস্তিন, বেলুরাস, কম্বডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুরের পর মিসরও জানিয়েছে অভিনন্দন। এটির ক্ষেত্রেও আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বেশ সফলতা দেখিয়েছে। এখনও অব্যাহত আছে অভিনন্দন সংগ্রহের তৎপরতা।
মূল আলোচনায় ফিরে আসি।নির্বাচন শেষ করেই আওয়ামী লীগ সরকার তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সারাদেশে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে প্রতিপক্ষ রাজনীতিক ও সমর্থকদের হত্যা ও গুম প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে।
এটি নিয়ে সন্দেহর কোন অবকাশ আছে কি?
সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, নীলফামারি, সীতাকুন্ডুসহ দেশের কয়েকটি জেলায় চলছে যৌথবাহিনীর অভিযানের নামে সরকার বিরোধীদের পাকড়াও করা। বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার হচ্ছে গুলিবিদ্ধ লাশ। এসব নিয়ে মিডিয়া প্রশ্ন করলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়েজিত কর্তা ব্যক্তিরা বলছেন ক্রস ফায়ারে মারা গেছে। অথবা সম্পূর্ণ ভাবে অস্বীকার করা হচ্ছে আটক করার খবর।
এই তো, তিন-চার দিন আগের কথা। ঢাকা প্রেসক্লাব এলাকা থেকে গ্রেফতার হওয়া সোনাইমুড়ী উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহবায়ক তৌহিদের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হলো সোনাইমুড়ীর আমিশপাড়ায়। এ খবরের রেশ কাটতে না কাটতেই সব কয়টি নিউজ পোর্টাল চলে এলো ফেনীতে বন্দুকযুদ্ধে এক যুব নেতা নিহত হওয়ার খবর। এরও আগে কুষ্ঠিয়া, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, নীলফামারিসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আ্ইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
নিহতদের প্রায় সকলের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। কেউ আবার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী! কিন্তু এদের সকলের রয়েছে আলাদা আলাদা রাজনৈতিক পরিচয়।তাও নিষিদ্ধ ঘোষিত কোন রাজনৈতিক দলের নয়। এক কথায় দেশের প্রধান বিরোধী দলের, যারা একাধিকবার এসেছে রাস্ট্রীয় ক্ষমতায়।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেছে, এদের অধিকাংশ জনের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলো সমসাময়িক এবং রাজনীতিক।
অপরদিকে যশোরে হিন্দু ধর্মাম্বলীদের ওপর চলা নির্যাতনের সাথে প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষ ভাবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুপক্ষের দ্বন্দর কথা উঠে এসেছে। কিন্তু সেটিও কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে চিরচরিত নিয়মে আমরা জামাত-শিবিরের ওপর দায় চাপিয়ে দিয়েছি। জামাতের প্রতি নুনূতম দূর্বলতা নেই আমার। বরং এই রাজনৈতিক দলের প্রতি ঘৃর্ণা এবং তাদের অমঙ্গল কামনার প্রতি আগ্রহী থাকি সবসময়। কিন্তু এদের ওপর দোষ চাপিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করে দেয়ার চেষ্টা মটেও সমর্থনযোগ্য নয়।
সম্প্রতি নাগরিক তদন্ত কমিটির ব্যানারে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সহ-সভাপতি এবিএম ওয়ালিউর রহমান খান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিরাজউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, সদস্য জয়ন্ত কুমার কুণ্ডুসহ নাগরিক তদন্ত কমিটির একটি প্রতিনিধি দল যশোর অভয়নগরের মালোপাড়া ও সাতক্ষীরায় সরেজমিনে তদন্ত করেন। এ প্রতিনিধিদল যশোরে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘সাতক্ষীরায় যৌথবাহিনী ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ এর নামে নিরপরাধ বহু মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছে। গোটা সাতক্ষীরা এখন যুদ্ধবিধ্বস্ত আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে।’
এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগে,
দেশের মাঠ পর্যায়ের রাজনীতিকরা কথিত বন্দুকযুদ্ধে একর পর এক নিহত হতে থাকবে, বা গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হতে থাকবে, বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আর কোন খোঁজ থাকবেনা, এভাবেই কি চলতে থাকবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ!
পরিশেষে একটি কথা বলতে দ্ধিধা নেই, চলুক। কিন্তু ভয় সেই এক জায়গাতেই, আমাদের রাজনীতিকরা খুবই অনুকরণ প্রিয়। তারা সবসময় প্রতিপক্ষ দলের খারাপ জিনিসটা অনুসরণ করে।ক্ষমতায় এলে পুরানো কথা মনে রেখে সেটির সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটায়।
বিষয়: রাজনীতি
১১৫৯ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জয় আওয়ামিলীগ জয়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন