বাঙালীর প্রাণের উৎসব _সফিউল্লাহ আনসারী_
লিখেছেন লিখেছেন আনসারি ২৭ এপ্রিল, ২০১৮, ০৮:৪৯:৩৫ সকাল
বাংলা এবং বাঙালীর ঐতিহ্যের প্রতীক, প্রাণের উৎসব ‘বৈশাখ’। বৈশাখ মানেই বাঙালীর সার্বজনীন উৎসব। বৈশাখের ছন্দ-উচ্ছাস এসো হে বৈশাখ’-গানটিও যেনো মিশে গেছে বাঙালী আর বৈশাখী উৎসবে। পহেলা বৈশাখ মানেই বাঙালীর চিরায়ত সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ । যে উৎসবকে অস্বীকার করা যায় না। কারন সকল জাতি-গোষ্ঠি, মতাদর্শেও লোকের কাছেই সমনা গুরুÍের দিন এই পয়লা বৈশাখ।
বৈশাখকে ঘিরে বাঙালীর চেতনা জুড়ে রয়েছে অন্যরকম আবেগ। উৎসাহ ও দেশীয় সংস্কৃতিকে ধারন করার আবেগ-অনুভূতি এই বৈশাখী আনন্দকে অর্থবহ করেছে। বৈশাখ মানে উচ্ছাস, উত্তাপ আর উৎসবের আমেজ। চারদিকে সাজ সাজ রব। দেশের সকল প্রান্তের মানুষের মনকে আলোড়িত করে, করে উচ্ছসিত। বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস বৈশাখের আগমন ঘটে সূচী-শুভ্র-নির্মল-পবিত্রতায়। সারা বছরের যতো জঞ্জাল ধুয়ে-মুছে নতুন করে স্বপ্নে-উচ্ছাসে দিন শুরু করা। যেখানে নতুন দিনের নতুন ভাবনায় সময়, সমাজ এবং জীবনবে রাঙিয়ে তোলা যায়।
“মুছে যাক গ্লানি ঘুছে যাক জরা অগ্নি¯œানে সূচী হোক ধরা। রসের আবেশ রাশি শুষ্ক করে দাও আসি আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক। এসো হে বৈশাখ এসো এসো “এসো হে বৈশাখ, এসো এসো….. প্রাণের উৎসবকে নিয়ে কবি গুরুর অসাধারণ-প্রানবন্ত রচনা। এ গানটি না হলে যেনো বৈশাখ পালনে অপুর্ণতাই থেকে যেতো। দেশ জুড়ে বৈশাখ জুড়েই মেলা আর আনন্দ মানেই এসো হে বৈশাখ গানটি। সুরের মূর্ছনায় আলোড়িত করে যায় এসো হে বৈশাখ এসো এসো…!
বছর ঘুরে প্রতিটা বাঙালীর আঙ্গিনায় বৈশাখের আগমন ঘটে আলাদা আবেগ আর দেশীয় চেতনা নিয়ে । বাংলা নববর্ষ বা ১ লা বৈশাখ পালন যেনো দেশীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ,যেখানে বিভেদহীন সমাজ গঠনের ডাক দিয়ে যায়। পহেলা বৈশাখকে ঘিরে শহর, গ্রাম-গঞ্জে নানা উৎসব-পার্বণের আয়োজনে পরিবেশ থাকে মুখরিত । বৈশাখের এ সার্বজনীন উৎসব দেশের প্রতিটা মানুষকে নানাভাবে ঐতিহ্যের ভাবনায় সমৃদ্ধ করে। উৎসব আর আনন্দ উল্লাসে মাতোয়ারা বাঙালী জাতি প্রতিটা উৎসবকেই উদযাপন করে একান্ত সামাজিকতায় আন্তরিকতার সবটুকু বিলিয়ে দিয়ে। বৈশাখের বেলায় এর ব্যাতিক্রমতো নয়ই বরং আরো একদাপ এগিয়ে নিয়ে যায় আমার ঐতিহ্যকে ধারন করে । বাংলা নতুন বছর মানেই বাঙালীর প্রাণের স্পন্দন, নুতনের আহবানে জেগে উঠা। সত্য ও সুন্দরের জয়গান।
বৈশাখ জুড়ে শুধুই কি আনন্দ উৎসব? মোটেই না, সারাদেশে বৈশাখী মেলায় বাংলার সংস্কৃতি ও লোকশিল্পকে ছড়িয়ে দিতে অবদান রেখে চলেছে এই সার্বজনীন উৎসবটি। বৈশাখ তার আপন ঐতিহ্যকে ছড়িয়ে দেয় স্ব-মহিমায় প্রতিটা বাঙালীর অন্তরে। বৈশাখের আকিঁবুকিতে বাঙালী নারী আর শিশুদের নানা রঙের পোষাকের সাঁজ ও ছেলে-বুড়োদের বৈশাখী পোষাকে চেতনাকে জাগিয়ে দেয় অন্য রকম স্বাদে । বৈশাখী মেলা মানেই বাঙালীর সার্বজনীন মিলনমেলা।
পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ঢাকা শহরে বৈশাখের প্রথমদিনে মঙ্গল শোভাযাত্রা । বর্তমানে সাংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে এই শোভাযাত্রা সকল শ্রেণী পেশার মানুষের অংশ গ্রহনে। রমনার বটমূলে অসাম্প্রদায়ীক আনুষ্ঠানিকতা বৈশাখ যাপনের গুরুত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রায়। বৈশাখের মঙ্গল শোভা যাত্রা অশুভ শক্তির বিনাশ, শুভ শক্তির উদয়ে এই আয়োজনে নানা পেশা-শ্রেণীর মানুষ অংশ গ্রহন করে অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকেই যেনো লালন করে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর দেশ প্রেমের এই শোভাযাত্রায় শুদ্ধতা চর্চাকে উৎসাহীত করে আগামীর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে চলতে পথ দেখায়। যদিও নিরাপত্তার কারনে এবারও এই শোভাযাত্রায় রয়েছে সরকারি নির্দেশনা, রয়েছে বিধি-নিষেধ। এতে উৎসবের সীমাবদ্ধতা এলেও নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের সচেতন ও সোচ্চার হওয়া জরুরী।
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রার শুভ সূচনা হয়। বিশাল আয়োজনের এ মঙ্গল শোভাযাত্রায় হাতি, বাঘ, ঘোড়া, পাপেট, ময়ূর, লক্ষ্মীপেঁচা, কুমিরসহ নানা ধরনের মুখোশ শোভা পায়। এসবের মধ্য দিয়ে হাজার বছরের বাঙালীর চলমান রাজনীতি থেকে শুরু করে নানা রকম সঙ্গতি-অসঙ্গতি ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ, সামাজিক,অ র্থনৈতিক বাস্তবতা রুপকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়। শিল্পি, কবি-সাহিত্যিকদের স্ব-প্রতীভ পদচারনায় এদিনটি থাকে উৎসব মুখর। বৈশাখের আগমনে প্রাণের জোয়ার জাগে বাঙালীর প্রাণে প্রাণে। ধর্ম-বর্ণ, জাতী নির্বিশেষে পহেলা বৈশাখ বাঙালীর মন-মননে অন্যরকম আনন্দ উৎসবের ভাবনাকে নাড়া দিয়ে যায়।
মুসলমান সমাজে বৈশাখ বরণে তেমন নিয়ম-কানুন না থাকলেও হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মালম্বিদের রয়েছে আলাদা স্বাতন্ত্র ও রেওয়াজ। তবে পয়লা বৈশাখের এ সময়ে ভেদাভেদহীন অংশগ্রহনে বৈশাখী উৎসব বাংলাদেশের প্রতিটা ঘরে অন্যরকম আনন্দে উদযাপিত হয় থাকে। বৈশাখী মেলাতে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে রাখা হয় নাগরদোলা, পুতুলনাচ ও সার্কাসসহ মেলার ক্লান্তি দূর করতে যোগ হয় নানান স্বাদের গান। গ্রাম ও শহরে উৎসবের ভিন্নতা থাকলেও আনন্দেও মাত্রাটা সব খানে সমান। গ্রামাঞ্চলে ্ৈবশাখকে রীতিনীতিতেও পালন করতে দেখা যায়। বৈশাখের আগের দিন গ্রামের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় গরু-খাসি জবাই করে মাংস বিলাতেও দেখা যায়। বৈশাখ মানে মেলা আর খেলাই নয় বাঙালীর খাবার-দাবারের রয়েছে উৎসবের আমেজ।
‘পার্বত্য এলাকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও নানা আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়ে থাকে। বর্ষবরণে চাকমা ও মারমারা উৎসব পালন করে ধর্মীয় ভাবগার্ম্ভিযে। বৈশাখী পূর্ণিমা উদযাপনেও নৃ-গোষ্ঠীর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা বহুকাল থেকে পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে আদিবাসী সমাজ এই বৈশাখে ঐতিহ্যবাহী পিঠা উৎসব, খেলাধুলার আয়োজন, বৌদ্ধ মন্দিরে বুদ্ধ প্রণাম, ধর্ম উপদেশ প্রার্থনাসহ নানা ধরনের কর্মযজ্ঞ করে থাকে। অপরদিকে কোঁচ, সাঁওতাল, ওরাও, গারো, ম্রো, মোরাং, মান্দাই, হাজংসহ অন্যান্য আদিবাসীরা তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতি অনুযায়ী বৈশাখ উদযাপন করে থাকে অনেকটা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যদিয়ে। আর এভাবেই এ দেশে জাতী-ধর্ম ভেদকে উপেক্ষা করে বৈশাখ হয়ে সার্বজনীন উৎসব । বাঙালীর প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ , এতে কোনই সন্দেহ নেই। রঙিণ স্বপ্নের ঘুরি উড়িয়ে বৈশাখ যেনো বলে যায় বাঙালী জাগো, ভুলে পুরাতন-জীর্নতা ।’
বাংলা নবর্বষ আসে ১২টি মাসের তেরো পার্বন নিয়ে। এই ১২ মাস নিয়েও রয়েছে নামকরনের ঐতিহ্যগাথা কথকথা। বছরের পয়লা মাস বৈশাখকে ঘিরে যতোটা উত্তাপ অন্য মাসগুলোতে তেমনটা না হলেও ষড়ঋতুর বৈচিত্রে ভরপুর বাংলায় বারোটি মাসে উৎসবের কমতি থাকেনা কোন। বাংলা আর বাঙালী মানেই উৎসব-আমুদে উল্লসিত জাতি। ঐতিহ্যকে লালন কওে এ জাতি বিশ্বের দরবারে তাদের গৌরবগাঁথাকে তুলে ধরে আপন স্বকীয়তায়।
বৈশাখ আসে নতুনের আগমনে, পুরাতনকে বিদায় করে বাংলা এবং বাঙালীর জীবন ও সময়কে রঙিন-মঙ্গলময় করে দিতে। যতো পাপ-তাপ-গ্লানি মুছে দিয়ে বাঙালী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠে বৈশাখ । বাঙালী সারা বছরের জীর্নতা শেষে নতুন দিনের প্রত্যাশায় বরণ করে নেয় বছরের প্রথম দিন, পয়লা বৈশাখ, নববর্ষকে। পহেলা বৈশাখ বাঙালীর প্রেরণা। এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়কে শানিত করে, করে উজ্জীবিত বছর জুড়েই। শত ব্যাস্ততায়ও, মহাকালের চিরায়ত নিয়মে বৈশাখ বরণে, নববর্ষের উদ্দীপনায় মেতে উঠে বাংলার সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ। বৈশাখ যে বাঙালীর সার্বজনিন উৎসব তার প্রমাণ এই বৈশাখের প্রথমদিন এবং বৈশাখ বরণের সকলে অংশ গ্রহনে আনুষ্ঠানিকতা। বলতে দ্বীধা নেই-পয়লা বৈশাখই হতে পারে বাঙালির জাতীয় উৎসবের দিন, যার উৎসব হিসেবে কোন আলাদা ভিন্নতা নেই। সকলের জন্য এই উৎসব একই অনুপ্রেরণায় উজ্জিবিত। এই উৎসবে নেই ধর্মী আচার বা ভিন্নতা। তাই এটা সার্বজনিন উৎসব হিসেবে সকলের কাছে সমান গুরুত্বের।
অবিরাম শুভ কামনায় বাংলা নববর্ষ মঙ্গময় হোক, সত্য-সুন্দরের চর্চায়। সবাইকে শুভ নববর্ষে অকৃত্তিম শুভেচ্ছা। শুভ হোক প্রতিটা ভোর, প্রতিটা প্রহর, প্রতিটা ক্ষণ, এই কামনা এই শুভ ক্ষণে। আনন্দ আর উদ্দীপনায় জাগরণ হোক দেশ আর মানুষের কল্যাণে। নিরন্তর সময়ের ¯্রােত হোক শুধুই কল্যাণ আর মঙ্গলের বারতায়।
সত্য আর সুন্দরের জয়গানে আমাদের আগামী দিনগুলো পুর্ণতা পাক সুখ-সমৃদ্ধিতে। শুভ হোক বাংলা নতুন বছর-১৪২৫ !
সফিউল্লাহ আনসারী
সংবাদকর্মী,স্বেচ্ছাসেবি।
(তথ্যসূত্র- বিভিন্ন পত্রিকা,অনলাইন ও ইউকিপিডিয়া)
বিষয়: বিবিধ
৬৯৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন