ঈশ্বরবাদ, নিরীশ্বরবাদ ও মৌলবাদ
লিখেছেন লিখেছেন এমরুল কায়েস ভুট্টো ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৯:৩৬:৩৬ রাত
‘Theism’ and ‘Atheism’ অর্থাৎ- ‘ঈশ্বরবাদ’ ও ‘নিরীশ্বরবাদ’ বর্তমান পৃথিবীর একটি অত্যন্ত আলোচিত বিষয়। বিষয়টি নিয়ে যুক্তিবাদীরা মুক্তমনের দোহাই দিয়ে ঈশ্বরের বিপক্ষে তাদের মত পেশ করেন, আর মুক্তিবাদীরা নিজেস্ব ধর্মিয় মতবাদে অটল থেকে স্রষ্টার মহিমা তুলে ধরেন। স্টিফেন হকিংস যখন ঈশ্বর বিহীন পৃথিবীর কথা বললেন, তখন নিরীশ্বরবাদীরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেলেন। বানর, সিপপান্জী, টিকটিকি বা ইঁদুরের বংশধর (বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীদের মতে) বিবর্তনবাদীরা মিডিয়ায় তোলপাড় শুরু করে দিলেন অনেকটা “মুই কি হনু রে!” স্টাইলে। তাদের মতের পক্ষে এমন সব যুক্তি দাঁড় করতে থাকলেন, যেন তারাই পৃথিবী নামের গ্রহটির একমাত্র জ্ঞানীগুণী একচ্ছত্র অধিপতি!
আস্তিক্য ও নাস্তিক্য নিয়ে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর এই লড়াই পৃথিবীতে দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। এক কথায় বলা যায় ‘আস্তিকতা’ মানে ধর্মগ্রন্থ বিশ্বাসী এবং ‘নাস্তিকতা’ মানে ভোগবাদী। একেক সময় একেক মতবাদের উপর ভিত্তি করে ভোগবাদী বা নিরীশ্বরবাদীরা স্রষ্টার বিপক্ষে নিজেদের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করতে চেষ্টা করে; বর্তমানে বিজ্ঞানকে তারা তাদের যুক্তিধর্মের মুলমন্ত্র বলে মনে করছে, কিছুকাল আগেও যা ছিল সম্পূর্ণরুপে বস্তুবাদে বিশ্বাসী। নাস্তিকদের ভাবসাব দেখে মাঝে মাঝে খুবই আশ্চর্য হতে হয় – পৃথিবী যেন একমাত্র তাদেরই উত্তরাধিকার, তারাই যেন সব জান্তা! বিজ্ঞানীরা যেন শুধুমাত্র তাদেরই জন্য কাজ করছে, বিজ্ঞান যেন শুধু তাদেরই একচেটিয়া সম্পত্তি!
‘জ্ঞান’ এমন একটি আপেক্ষিক বস্তু যার পুরোপুরি সংজ্ঞা নির্দিষ্ট কোন ছকে ফেলে করা বড়ই দুষ্কর; যার উৎস মস্তিস্কের দশ হাজার কোটি নিউরন। কম্পিউটার, মোবাইল বা আধুনিক কোন প্রযুক্তির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনের জন্য যেমন বাহ্যিক শক্তির যোগান দিতে হয়, ঠিক তদ্রুপ মস্তিস্কের নিউরন সচল ও কর্মক্ষম করতেও শিক্ষা নামের এই অতি উচ্চ গতি সম্পন্ন শক্তি সঞ্চয় করতে হয়; লেখাপড়ার মাধ্যমেই তা অর্জন করতে হয়। সেই অতি জ্ঞানী ছাত্রের মত বলা যাবে না – ” লেখাপড়া করলে ফেল করতে হবে বলে গণিতে প্রমাণ করা যায়, অতএব না করাই ভাল!”
চলুন প্রমাণটি একটু দেখে নেই –
লেখাপড়া = না ফেল……….(১)
না লেখাপড়া = ফেল ……….(২)
(১) ও (২) যোগ করে পাই ,
লেখাপড়া + না লেখাপড়া = না ফেল + ফেল,
বা, লেখাপড়া ( ১ + না ) = ফেল ( না + ১ ),
বা, লেখাপড়া = ফেল ; [ (না+১) দ্বারা ভাগ করে ],
অতএব, লেখাপড়া = ফেল; (প্রমাণিত)।
গণিত বা বিজ্ঞানের হিসাব দিয়ে নাস্তিক্যবাদের প্রমাণ দেখানোটাও অনেকটা এই স্বঘোষিত অতি পন্ডিত ছাত্রের মত। ঈশ্বরকে বুঝতে চাইলে কোন বৈজ্ঞানিক বা গাণিতিক বা বস্তুবাদী যুক্তিবিদ্যার প্রয়োজন পরে না, নিজ স্বত্বার অস্তিত্ব প্রমাণই এর জন্য যথেষ্ট।
‘আস্তিক’ শব্দটি ইংরেজী ‘Theism’ বা ‘আস্তিক্য’ শব্দের নাম বিশেষ্য; যার আভিধানিক অর্থ – ‘ঈশ্বরবাদ’। পূর্বসূত্রানাসারে ‘আস্তিক’ শব্দটি দ্বারা হিন্দু ধর্ম দর্শনের একটি বিশেষ শ্রেণীবিভাগকে বুঝায়, যা দিয়ে হিন্দু ধর্মানুসারীদের বিশেষ কিছু ব্যক্তি গুষ্টিকে বুঝানো হয়। ‘আস্তিক’ দর্শন অনুসারে ‘বেদ’-কে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশিত ধর্মগ্রন্থ বা পান্ডুলিপি হিসেবে ধরা হয়। এই সংজ্ঞানুসারে সংখ্যা, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, পূর্ব মীমাংসা এবং বেদান্তকে আস্তিক দর্শনের শ্রেণীভুক্ত করা হয়।
আবার- ‘আস্তিক’ দ্বারা ঈশ্বরে বিশ্বাসীদেরকেও বুঝানো হয়।
[ সূত্র ]
ঈশ্বরবাদীদের মাঝে শত মত ও পথের ভিন্নতা থাকলেও সৃষ্টিকর্তা প্রশ্নে তারা এক ও অভিন্ন। মানব সৃষ্টির ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় – যুগে যুগে ঈশ্বর তাঁর অস্তিত্ব ও একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিশেষ কিছু মানুষকে বিশেষ বিশেষ জ্ঞান দিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সেই সব বিশেষ মানুষদের দ্বারা প্রচারিত মতবাদই ঈশ্বরবাদীদের ধর্মের মুলমন্ত্র। ধর্মিয় আচার অনুষ্ঠানে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হলেও ‘ঈশ্বর’ প্রশ্নে সবাই এক মত; আল্লাহ্, খোদা, গড, ঈশ্বর, ভগবান সবই একই স্রষ্টার ভিন্ন ভিন্ন যপ।
নাস্তিক শব্দটি ইংরেজী ‘Atheism’ বা বাংলা ‘নাস্তিক্য’ শব্দের নাম বিশেষ্য; যার আভিধানিক প্রতিশব্দ – নাস্তিকতা, ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাস, দুষ্টতা, অধার্মিকতা। নিরীশ্বরবাদ নাস্তিকতাবাদের একটি মূল দর্শণ; যাতে ঈশ্বর বা স্রষ্টার অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় না; সম্পূর্ণরুপে ভৌত ও প্রাকৃতিক উপায়ের উপর ভিত্তি করে শুধুমাত্র প্রকৃতির ব্যাখ্যা দেয়া হয়। মুলত: আস্তিক্যবাদ এর বর্জনকেই নাস্তিক্যবাদ বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে নাস্তিক্যবাদ কোন বিশ্বাসই নয় বরং অবিশ্বাস; যা সম্পূর্ণভাবে শুধুই যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বাসকে খণ্ডন করাই শুধু নয় বরং বিশ্বাসের অনুপস্থিতিই এখানে মুখ্য।
‘Atheism’ শব্দটির মুল উৎপত্তি ঘটেছে গ্রিক ‘θεος’ (এথোস) শব্দ থেকে। শব্দটি দিয়ে সেই সব মানুষকে নির্দেশ করা হয়েছে যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এবং প্রচলিত ধর্মগুলোর অন্ধবিশ্বাসকে যুক্তি দ্বারা ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করতে চেষ্টা করে। দিনদিন মুক্ত চিন্তার নামে সংশয়বাদী চিন্তাধারার এতোটাই প্রসার ঘটছে যা বলা বাহুল্য। বস্তুবাদীদের মুল টার্গেট মুলত: ধর্মজ্ঞানীরা ও ধর্মগ্রন্থগুলো। ধর্মজ্ঞানীদের নিয়ে নির্লজ্জভাবে তারা এমন সব কথা বলে ও ধর্মগ্রন্থের বিপক্ষে এমন সব যুক্তি দাঁড় করে যা শুধুই মিথ্যার বেসাতি। ধর্ম, ধর্মজ্ঞানী ও ধর্মগ্রন্থের কঠোর সমালোচনা করে তারা শুধুমাত্র নিজেদের সস্তা জনপ্রিয়তার উদ্দ্যেশ্যে, সাথে সাথে নাস্তিক্যবাদের প্রচার প্রসারের অভিপ্রায়ে।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ নিজেদের নাস্তিক বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল ; এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যার ২.৩% মানুষ নিজেদের নাস্তিক বলে পরিচয় দেয় এবং ১১.৯% মানুষ কোন ধর্মই বিশ্বাস করে না। জাপানের ৬৪% থেকে ৬৫% মানুষ নাস্তিক অথবা ধর্ম অবিশ্বাসী। রাশিয়াতে এই সংখ্যা প্রায় ৪৮%, ইউরোপীয় ইউনিয়নে ৬% ( ইতালী) থেকে শুরু করে ৮৫% ( সুইডেন ) পর্যন্ত নাস্তিকতায় বিশ্বাসী। পশ্চিমা দেশগুলোতে নাস্তিকদের সাধারণ ভাবে ধর্মহীন বা পরলৌকিক বিষয়ে অবিশ্বাসী হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের মত যেসব ধর্মে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হয় না, সেসব ধর্মালম্বীদেরকেও নাস্তিক হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। একজন ‘নাস্তিক’ ব্যক্তিগত ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা, হিন্দু ধর্মের কিছু দর্শন, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ ও প্রকৃতিবাদকে বিশ্বাস করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে নাস্তিকরা কোন বিশেষ মতাদর্শের অনুসারী নয় এবং তারা সবাই বিশেষ কোন আচার অনুষ্ঠানও পালন করে না। অর্থাৎ ব্যক্তিগত ভাবে যে কেউ যে কোন মতাদর্শের সমর্থক হতে পারে। নাস্তিকদের মিল শুধুমাত্র এক জায়গাতেই, আর তা হল ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অবিশ্বাস করা। আধুনিক যুগের এই একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীতে কয়েকজন নাস্তিক গবেষক ও সাংবাদিকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নাস্তিক্যবাদের একটি নতুন ধারা বেড়ে উঠেছে যাকে ‘নব্য-নাস্তিক্যবাদ’ বা ‘New Atheism’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
২০০৪ সালে স্যাম হ্যারিসের দি ইন্ড অব ফেইথ: রিলিজান, টেরর, এন্ড দ্যা ফিউচার অব রিজন বইয়ের মাধ্যমে নব্য- নাস্তিক্যবাদের যাত্রা শুরু হয়েছে বলে মনে করেন আরেক প্রখ্যাত নব্য-নাস্তিক ভিক্টর স্টেংগার। প্রকৃতপক্ষে স্যাম হ্যারিসের বই প্রকাশের পর এই ধারায় আরও ছয়টি বই প্রকাশিত হয় যার প্রায় সবগুলোই নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলারে স্থান করে নিতে সমর্থ হয়। মোটামুটিভাবে নিচের বইগুলোই নব্য-নাস্তিক্যবাদী সাহিত্যের প্রধান উদাহরণ হিসেবে স্বীকৃত:-
১। দি ইন্ড অব ফেইথ: রিলিজান, টেরর, এন্ড দ্যা ফিউচার অব রিজন (২০০৪) – স্যাম হ্যারিস।
২। লেটার টু এ কৃশ্চিয়ান নেশন (২০০৬) – স্যাম হ্যারিস।
৩। দ্যা গড ডিলিউশন (২০০৬) – রিচার্ড ডকিন্স।
৪। ব্রেকিং দ্যা স্পেল: রিলিজান এ্যাজ এ ন্যাচারাল ফেনোমেনন (২০০৬) – ড্যানিয়েল ডেনেট।
৫। গড: দ্যা ফেইলড হাইপোথিসিস – হাউ সাইন্স সোজ দ্যাট গড ডাজ নট এক্সিস্ট (২০০৭)- ভিক্টর স্টেংগার।
৬। গড ইজ নট গ্রেট: হাউ রিলিজান পয়জনস এভরিথিং (২০০৭) – ক্রিস্টোফার হিচেন্স।
৭। দ্যা নিউ এইথিজম (২০০৯) – ভিক্টর স্টেংগার।
শেষোক্ত ৭ নং বইটিয়ে ভিক্টর স্টেংগার এইসব ব্যক্তিদেরকেই নব্য-নাস্তিক্যবাদের প্রধান লেখক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। উল্লেখ্য, নব্য নাস্তিকরা প্রায় প্রতিটি ধর্মের সরাসরি বিরোধিতা করে। তারা ধর্মকে প্রমাণহীন বিশ্বাস বলে আখ্যায়িত করে; এ ধরনের বিশ্বাসকে সমাজে যে ধরনের মর্যাদা দেয়া হয় সেটারও নগ্ন সমালোচনার মাধ্যমে কঠোর বিরোধিতা করে।
[ সূত্র ]
‘Fundamentalism’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘মৌলবাদ'; যা হচ্ছে গোঁড়া ধর্মীয় মতবাদগুলোর কঠোর অনুগমনের চাহিদা; যা দ্বারা সাধারণ ভাবে উদার ধর্মতত্ত্বের বিরুদ্ধে একটি কঠোর প্রতিক্রিয়া বুঝায়। ‘মৌলবাদ’ শব্দটির সাধারণ অন্য অর্থ হল – ‘মূলজাত’। এখানে মূল শব্দটি দ্বারা ‘ধর্ম’ বোঝানো হচ্ছে। অর্থাৎ আদি কাল থেকেই ধারনাটি ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে; আর সে ধর্ম হলো – ‘খ্রিস্টধর্ম’। খ্রিস্টান বিশ্বে মৌলবাদ নিয়ে তর্ক শুরু হয়েছিলো ঊনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দির দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত প্রবল প্রতাপে তা চালু ছিলো। তর্কের শিকড় একটি জায়গায় – বাইবেলে যা লেখা আছে সে সব আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে মান্য করতে হবে, নাকি পরিবর্তিত পৃথিবীর বাস্তব প্রেক্ষাপট ও মানব ইতিহাসের অগ্রগতির নিরিখে ও যুক্তিবাদ প্রয়োগ করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পর মান্য করতে হবে? মৌলবাদীরা আক্ষরিক অর্থের সব কিছু গ্রহণ করে থাকেন।
[ সূত্র ]
বর্তমান পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মহাদেশে প্রায় সব ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই মৌলবাদ নতুনভাবে নতুন মাত্রায় যোগ হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই বর্তমানে মৌলবাদ একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার, রাজনৈতিক উদ্দ্যেশ্যেই তা সৃষ্টি করা হয়, আর রাজনৈতিক এই রূপের উদ্দেশ্য রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল। প্রকৃতপক্ষে সব ধর্মের মৌলবাদিরা এখন নিজ ধর্মের বিষফোঁড়া সম। এইসব মৌলবাদিদের জন্যই ধর্ম অজ বিতর্কিত হচ্ছে। নাস্তিকরা এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই ধর্মের কঠোর সমালোচনা করছে।
‘Materialism’ মানে ‘বস্তুবাদ’ হলো দর্শণের সবচেয়ে প্রাথমিক মতবাদগুলোর একটি। বস্তুবাদী মতবাদ ধারণ করে যে – আমাদের চারপাশের জগতে অস্তিত্বশীল যে সব জিনিস আছে তার সবই হয়তো বস্তু নয়তো শক্তি । বস্তুবাদ অনুযায়ী – সব জিনিসই বস্তু দ্বারা গঠিত এবং সব প্রপঞ্চ চেতনাসহ বস্তুর পারস্পরিক আন্তক্রিয়ার ফলাফল। অন্য কথায় – বস্তু হচ্ছে একমাত্র সারবস্তু, বাস্তবতা হচ্ছে শক্তি ও বস্তুর প্রকৃত ঘটনা-অবস্থার পরিচায়ক। এই মতবাদ অনুসারে – পৃথিবী বস্তুগত, তার অস্তিত্ব আছে বিষয়গতভাবে, চেতনার বাহিরে ও চেতনা নিরপেক্ষভাবে। বস্তুবাদের সূত্র মতে – বস্তুই মুখ্য, তা কারো দ্বারা সৃষ্ট হয়নি যা আছে বাহ্যিকভাবে; চিন্তা চেতনা হলো বস্তুরই একটি গুণধর্ম। বস্তুবাদ মতে – পৃথিবী ও তার নিয়মগুলো জ্ঞেয়। বস্তুবাদ ভাববাদের বিরোধী এবং বস্তুবাদীদের সংগ্রামই ঐতিহাসিক- দার্শনিক প্রক্রিয়ার আধেয়। বস্তুবাদ কথাটি সপ্তাদশ শতাব্দীতে ব্যবহৃত হয়েছিল প্রধানত: বস্তু সম্বন্ধে পদার্থবিদ্যাগত ধারণাগুলোর সার্বিক অর্থে এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে তা ব্যবহৃত হয়েছে দার্শনিক অর্থে; যা সম্পূর্ণরূপে ভাববাদের বিপরীত।
‘Science’ বা ‘বিজ্ঞান’ হচ্ছে – বিশ্বের যাবতীয় ভৌত বিষয়াবলী পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, যাচাই, নিয়মসিদ্ধ, বিধিবদ্ধ ও গবেষণালদ্ধ পদ্ধতি, যা জ্ঞানকে তৈরিপূর্বক সুসংগঠিত করার কেন্দ্রস্থল। ল্যাটিন শব্দ ‘Scientica’ থেকে ইংরেজী ‘Science’ শব্দটির উৎপত্তি, যার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান। বাংলা ভাষায় ‘বিজ্ঞান’ শব্দটির অর্থ বলতে আমরা বুঝি ‘বিশেষ জ্ঞান’। ধারাবাহিকভাবে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার ফলে কোন বিষয়ে প্রাপ্ত ব্যাপক ও বিশেষ জ্ঞানের সাথে জড়িত ব্যক্তি বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানবিদ কিংবা বৈজ্ঞানিক নামে পরিচিত হয়ে থাকেন। বিজ্ঞানীরা বিশেষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে জ্ঞান অর্জন করে থাকেন এবং প্রকৃতি ও সমাজের নানা মৌলিক বিধি ও সাধারণ সত্য আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। বর্তমান বিশ্ব ও এর প্রগতি নিয়ন্ত্রিত হয় বিজ্ঞানের মাধ্যমে; তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যাপক অর্থে – যে কোন জ্ঞানের পদ্ধতিগত বিশ্লেষণকে বিজ্ঞান বলা হলেও এখানে আরেকটি সূক্ষ্ম অর্থে শব্দটি ব্যবহার করা হয়। বিজ্ঞানের ক্ষেত্র মূলত দুটি: সামাজিক বিজ্ঞান এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞান । জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন-সহ এ ধরনের সকল বিজ্ঞান প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে মানুষের আচার- ব্যবহার এবং সমাজ নিয়ে যে বিজ্ঞান তা সমাজ বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। তবে যে ধরনেরই হউক না কেন, যে কোন কিছু বিজ্ঞানের আওতায় পড়তে হলে উক্ত জ্ঞানটিকে সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণিত হতে হবে; আর একই শর্তের অধীনে যে গবেষকই পরীক্ষণটি করেন না কেন, ফলাফল একই হতে হবে। অর্থাৎ ব্যক্তি চেতনা অনুযায়ী বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষণের ফলাফল কখনও পরিবর্তিত হতে পারে না।
‘Mathematics’ বা ‘গণিত’-কে অনেকেই বিজ্ঞানের তৃতীয় একটি শ্রেণী হিসেবে দেখেন। অর্থাৎ তাদের মতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান ও গণিত এই তিনটি শ্রেণী মিলে ‘বিজ্ঞান’। ঐ দৃষ্টিকোণ থেকে গণিত হলো – আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞান, আর প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান হলো – পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞান। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানের সাথে গণিতের মিল-অমিল উভয়ই রয়েছে। গণিত একদিক থেকে পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে, উভয়টিই একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পদ্ধতিগত অধ্যয়ন করে। আর পার্থক্য হচ্ছে, পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞানে পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করা হলেও গণিতে কোন কিছু প্রতিপাদন করা হয় আগের একটি সূত্রের (প্রায়োরি) উপর নির্ভর করে। এই আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞান – যার মধ্যে পরিসংখ্যান এবং যুক্তিবিদ্যাও পড়ে; অনেক সময়ই পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞানে উন্নতি করতে হলে আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞানের প্রসার আবশ্যক। কিভাবে কোন কিছু কাজ করে (প্রাকৃতিক বিজ্ঞান) বা কিভাবে মানুষ চিন্তা করে (সামাজিক বিজ্ঞান) তা বুঝতে হলে আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞানের কাছে হাত পাতা ছাড়া কোন উপায়ই নেই।
উপরোল্লেখিত প্রতিটি বিষয় স্পষ্টভাবে তুলে ধরার মুল উদ্দ্যেশ্য – নাস্তিক্যবাদীরা কখনো বা বস্তুবাদ, কখনো বা বিজ্ঞান, কখনো বা অন্য কোন বিষয়ের উপর ভর দিয়ে নিজেদের মতামত যুক্তির মাধ্যমে তুলে ধরে। প্রকৃতপক্ষে তাদের মুলনীতি ‘বিবর্তনবাদ’ ও ভোগবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত; বস্তুবাদকে যুক্তির মাধ্যমে তুলে ধরাই নাস্তিকদের কাজ। এতে ধর্মবিশ্বাসীদের কোন ধরনের মাথা ব্যথা ছিল না, কিন্তু যখন তারা ধর্মজ্ঞানীদের দিকে তির্যক কটাক্ষ করে তখনই যত সমস্যা।
তাই-
ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন বিগলের সমুদ্রযাত্রা প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে প্রাকৃতিক নির্বাচন এর মাধ্যমে প্রথম বিবর্তনবাদের ধারণা উপস্থাপন করেন। বিবর্তনবাদ তত্ত্বানুসারে পৃথিবীর সমস্ত জীবজগতের আবির্ভাব হয়েছে একটি সরল এককোষী জীব থেকে – যা ‘সাধারণ পূর্বপুরুষ’ নামে পরিচিত। এই এককোষী ব্যাক্টেরিয়ার মতো জীবের আবির্ভাব নাকি হয়েছিল ‘কেমিক্যাল বিবর্তন’ প্রক্রিয়ায় । প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে যেখানে যারা যোগ্য তারা পরিবেশের সেখানেই উদ্দেশ্যহীনভাবে টিকে থাকে; অন্যদিকে দুর্বল বা অনুপোযুক্তদের বিলুপ্তি ঘটে। কালের প্রক্রিয়ায় (হাজার হাজার বছর) উদ্দেশ্যহীন ও দৈবক্রমে অজৈব পদার্থ থেকে জীবের মৌলিক উপাদান- ডিএনএ ও প্রোটিন তৈরী হয়। তারপর এগুলো হাজার হাজার বছর ধরে ট্রায়াল-এন্ড-এরর (Trial and error) প্রক্রিয়ায় কোনক্রমে হঠাৎ করে জোড়া-তালি লেগে হয়ে যায় এককোষী ব্যাক্টেরিয়ার মতো কোন জীব বা আমাদের ‘আদি-পিতা’! সেই এককোষী জীব থেকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে উদ্দেশ্যহীনভাবে ও দৈবক্রমে অপরিকল্পিত মিউটেশনের (জীনগত পরিবর্তন) মাধ্যমে ধাপে ধাপে তৈরী হয়েছে পৃথিবীর সমস্ত প্রজাতি। মোটামুটি এই হলো নাস্তিক্যবাদের মুল ভিত্তি বিবর্তনবাদ।
বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের সময়ে ( ১৮০৯ – ১৮৮২ খ্রি. ) বিজ্ঞানের উন্নতি অগ্রগতি আজকের মতো এত ব্যাপক ছিল না। সে সময় জীবকোষকে অত্যন্ত সরল একটি উপাদান হিসেবে ধরা হতো; ডিএনএ আবিষ্কার হয়েছে আরো অনেক পরে। তাই একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তার তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হিসেবে ডারউইন বলে গেছেন যে তার তত্ত্ব প্রমাণের জন্য জীব সৃষ্টির পর্যায়ক্রমিক ধাপ বা ‘ট্র্যানজিশনাল স্পিসিজ’ দেখাতে হবে। প্রায় ১৬০ বছর ধরে এই স্বপ্নের ট্র্যানজিশনাল স্পিসিজের ফসিলের সন্ধানে পৃথিবীর তাবদ বিজ্ঞানীরা ইচ্ছেমত যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি করে বেড়িয়েছেন, কিন্তু এ পর্যন্ত কল্পিত সেই ‘ট্র্যানজিশনাল স্পিসিজ’ বা ‘মিসিং লিঙ্ক’-এর টিকিটিও কোথাও সন্ধান করতে পারেননি। যুক্তিবাদের খ্যাতিরে বলা যায় – এদের সংখ্যা পৃথিবীতে বিদ্যমান প্রজাতির সংখ্যা থেকে অনেক অনেক গুণ বেশী থাকার কথা; কিন্তু বাস্তবে তার কোন অস্থিস্তেরই সন্ধান পাওয়া যায় না! আর এই কারনেই বর্তমান বিবর্তনবাদীরা ফসিল আলোচনা থেকে বিরত থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। আর ব্যাখ্যা হিসেবে দেখান – ‘নিও-ডারউইনিজম’-কে; এই তত্ত্ব মতে তারা দেখান বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে জেনেটিক সিকোয়েন্সের মিলের সামঞ্জস্যতাকে (genetic relatedness or homology)। মুলত: ‘মিসিং লিঙ্ক’ বা ‘ট্রান্সজিশনাল স্পিসিস’ নিয়ে বিবর্তনবাদীরা সব সময় বেশ বেকাদায় থাকেন। তাই, ‘Ida’ নামক ফসিল আবিষ্কারের (২০০৯) পর সমস্ত পৃথিবীর মিডিয়া জুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়; ‘ইডা’ আবিষ্কারের পরপরই এটাকে ‘Eight Wonder of the World’ বলে ঘোষণা করা হয়।
‘বিবর্তনবাদ’-কে মিডিয়ায় জনপ্রিয় করতে Sir David Attenborough এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ‘ইডা’ আবিষ্কারের পর তিনি অত্যন্ত আবেগ তাড়িত কন্ঠে বলেন – এখন থেকে আর কেউ বলতে পারবে না যে ‘মিসিং লিঙ্ক’ নেই! আর কেউ যদি প্রমান চায় তবে ‘ইডা’-কে যেন হাজির করা হয়। সাথে সাথে মিডিয়াতে এমনও বলা হলো – ‘ইডা’ ফসিল সব ধর্মকে মিথ্যা প্রমানিত করছে। পরে দেখা গেল ঐটি প্রকৃতপক্ষে কোন ‘মিসিং লিঙ্ক’ নয়, বরং ‘ল্যামুর’ নামক জন্তু ( Eighth wonder’ Ida is not related to humans, claim scientists )।
তাহলে এখন ধর্মের কি হবে?
প্রকৃতপক্ষে, বিজ্ঞান সব সময়েই পরিবর্তনশীল একটি বিষয়, অনেকটা প্রবাহমান নদীর মতো; সব বিষয়েই পরীক্ষা-নীরিক্ষা লব্ধ উপাত্ত দিয়ে সঠিক বা সার্বিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না; আর এটাই বিজ্ঞানের আসল সৌন্দর্য। এটি কোন ভাবধারার অন্তর্গত সম্প্রদায়ের তথা নাস্তিকের পৈত্রিক সম্পত্তি নয়। বিজ্ঞানের বিকাশে মুসলিম, খ্রীষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী, আস্তিক, নাস্তিক তথা সমগ্র মানব সভ্যাতার অবদান রয়েছে। যেখানে বিবর্তনবাদ তত্ত্বের-ই সদা বিবর্তন হচ্ছে, সেখানে এই পরিবর্তনশীল মতবাদকে মুল ভিত্তি ধরে বিবর্তনবাদী মৌলবাদী নাস্তিকদের এত আনন্দের কি আছে? সদা পরিবর্তনশীল বিজ্ঞানের খোলস পরে অপরিবর্তনশীল ধর্মকে ভুল প্রমাণের আপ্রাণ অপচেষ্টা করার কারণটাই বা কি? একি শুধুই বদান্যতা, নাকি অজ্ঞতা? জ্ঞানের যে যত গভীরে প্রবেশ করবে, আমার বিশ্বাস – সে ততবেশি ‘নাস্তিক’ নয়, ‘আস্তিক’ হবে।
বিজ্ঞান ও ধর্মের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোনভাবেই দুটোকে কখনো একই মাপ-কাঠিতে বিবেচনা করা যায় না; যা কিনা হবে মানুষ ও গাছপালাকে একই মানদন্ডে তুলনা করার সামিল। অতিসাধারণ অর্থে ‘বিবর্তন’ বলতে বুঝায় সময়ের সাথে সাথে কোন কিছুর পরিবর্তন। এ অর্থে এন্টিবায়োটিক সহনশীলতা (Antibiotic resistance) অথবা ভাইরাসের (যেমন ফ্লু বা এইচআইভি) মিউটেশনকে বিবর্তন (evolution) বলা যায়। কিন্তু এ-ধরণের বিবর্তন দিয়ে চার্লস ডারউইনের ‘বিবর্তনবাদ’-কে ফ্যাক্ট বা ধ্রুব-সত্য হিসেবে প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু বিবর্তনবাদীরা এ-ধরণের উদাহরণ দিয়েই জনসাধারণকে ‘বিবর্তনবাদ তত্ত্ব’ সম্পর্কে সম্যক ধরণা দিয়ে যাচ্ছে ! মজার ব্যাপার হচ্ছে ডারউইনের বিবর্তনবাদকে ‘সূর্য উঠা বা অস্ত যাওয়ার মতো সত্য’ প্রমাণে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করা হচ্ছে। বিবর্তনবাদকে স্রেফ বিজ্ঞান হিসেবে ধরলে সেখানে প্রশ্ন করার অবকাশ আছে। প্রসঙ্গত, ‘জড় পদার্থ থেকেই প্রাণের উৎপত্তি’ – এ বিশ্বাস প্রায় ২০০০ বছর পর্যন্ত বিজ্ঞানী মহলে প্রতিষ্ঠিত ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ডারউইনের ‘প্রজাতির উৎপত্তি’ প্রকাশের পাঁচ বছর পরে বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর একটি অতি সাধারণ পরীক্ষার (যা বকনল পরীক্ষা নামে পরিচিত) মাধ্যমে হাজার বছরের বিশ্বাসকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেন। কিন্ত বিবর্তনবাদ নিয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন করলে বিবর্তন মৌলবাদীরা তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন। রাগ প্রশমনে সাধারণত তারা প্রশ্নকারীর অজ্ঞতাকে ফুটিয়ে তোলার অপচেষ্টা করেন। তাদের কিছু কমন শব্দগুচ্ছ হচ্ছে- You are such an ignorant / You don’t know anything about biology / Are all those thousands of famous scientists wrong?
বিবর্তনবাদ যদি বিজ্ঞান-ই হয়ে থাকে তবে তো এত আবেগ-প্রবণ হওয়ার কোন কারণ নেই? তার মানে বিবর্তনবাদ কি নাস্তিকতা নামক ধর্মের ভিত্তি? – বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে বস্তুবাদী নাস্তিকরা যে সব বিবর্তনবাদী ভাবধারা প্রচার ও প্রসার করছে, তার মূলে রয়েছে মধ্যযুগীয় চার্চ (গির্জা) ও বাস্তুবাদী আইডিওলজিক্যাল সংঘর্ষ। চার্চের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণে বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তার অগ্রযাত্রা তখন ব্যহত হয়েছিল। গ্যালিলিওকেও তাঁর বৈজ্ঞানিক মতবাদের জন্য শাস্তিও দেয়া হয়েছিল।
নাস্তিকেরা বিজ্ঞানের নামে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গ্যালিলিওর ইস্যুটিকেই ব্যবহার করছে নাস্তিকতার ভাবধারা প্রচারে। খৃষ্টানদের চার্চ যখন-ই নড়াচড়া শুরু করে, বস্তুবাদীরা গ্যালিলিও, সমতল পৃথিবী, ভূ-কেন্দ্রিক মহাবিশ্ব, ছয় হাজার বছরের পৃথিবী ইত্যাদি ইত্যাদি দিয়ে তাদেরকে দাবিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। যার ফলে নাস্তিক সমাজে চার্চের বা ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের প্রভাব নেই বললেই চলে। এজন্য চার্চ বা খৃষ্টান ধর্ম তাদের কাছে কোন মুখ্য বিষয়ই নয়, গৌণ।
মজার কথা হলো – যে গ্যালিলিওকে নিয়ে নাস্তিকেরা এত ব্যবসা করেছে করছে, সেই গ্যালিলিও কিন্তু একজন বিশ্বাসী রোমান ক্যাথলিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন! বিবাহ বহির্ভূতভাবে জন্ম নেওয়া তার দুই কন্যাকে বিয়ে দিতে পারবেন না বিধায় তাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করেছিলেনন; পরবর্তীতে মেয়েরা চার্চের পাদ্রী হয়েছিল।
বিবর্তনবাদী মুক্তমনাদের বর্তমানে অন্যতম টার্গেট হচ্ছে ‘ইসলাম’। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে গ্যালিলিও বা খ্রিষ্টান ধর্মের ইস্যুকে এখন
তারা মুসলিমদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার এক অপচেষ্টা করছে। আবার অন্যদিকে সাধারণ মুসলিমদের অজ্ঞতাকে পুঁজি করে বিবর্তন-নামীয় ধর্ম-বিশ্বাসকে বিজ্ঞানের আবরণে ব্যবসা করার খ্যাতিরে কয়েকজন মুসলিম নামধারী আরব বিজ্ঞানীকে বিবর্তনবাদের কর্ণধারও বানিয়ে দিয়েছে; কেননা তারা নাকি ডারউইনের অনেক আগে এই বিবর্তনবাদ তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছিলেন! ইদানিং কোন ধরনের রাখ-ঢাক না করেই নাস্তিক মৌলবাদীরা তাদের বিবর্তনবাদ নামক ধর্মের প্রচার ও প্রসারের জন্য কোমর বেঁধে নেমেছে। আর এর নেতৃত্ব দিচ্ছে অক্সফোর্ডের বায়োলজির প্রফেসর রিচার্ড ডকিন্স। তিনি বিজ্ঞানের খোলসে নাস্তিকতার বাস ক্যাম্পেইন শুরু করেছেন – যার একমাত্র ভিত্তি হচ্ছে ডারউইনের ‘বিবর্তনবাদ তত্ত্ব’। বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপটে বিবর্তনবাদ নিয়ে প্রশ্ন করেন, এমন অনেক বড় মাপের বিজ্ঞানী এই পৃথিবীতে এখনো অনেক আছেন। বিবর্তন-মৌলবাদীরা এজন্য তাদেরকে চার্চ মিশনারিজ হিসেবে আখ্যায়িত করে বিশেষ বিনোদন লাভ করেন! যা একটি অতিপ্রাচীন ও সহজ অস্ত্র। বিবর্তনবাদ-মৌলবাদীদের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী বিবর্তনবাদে অবিশ্বাসী বা সংশয়বাদীরা হচ্ছে গডে বিশ্বাসী আস্তিক!
বিজ্ঞানকে তারা নিজেরদের পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করেন। এজন্য তারা অনেক সময় এতই আবেগী হয় – বিবর্তনবাদে প্রশ্নকারী বিজ্ঞানীদেরকে ক্রিমিনাল হিসেবেও গণ্য করতে তারা দ্বিধাবোধ করে না! তারা ভুলে যায় – বর্তমান সময়ের বিবর্তিত-বিবর্তনবাদ তত্ত্বের (নিও-ডারউইনিজম) ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে ক্যারোলাস লিনিয়াসের (Carolus Linnaeus) জীবজগতের শ্রেনীবিন্যাসের উপর। এই শ্রেনীবিন্যাস করা হয়েছে জীবের বাহ্যিক মিলের ভিত্তিতে। আর তিনি এই যথেষ্ট শ্রমসাধ্য কাজ করেছিলেন গডের মহিমা (The Earth’s creation is the glory of God, as seen from the works of Nature by Man alone. The study of nature would reveal the Divine Order of God’s creation, and it was the naturalist’s task to construct a “natural classification” that would reveal this order in the Universe) তুলে ধরার জন্য। [ সুত্র ]
বর্তমান বিশ্বে নাস্তিক্যবাদ ও ধর্মিয় গোড়া মৌলবাদ – এই দু’টোই সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া শ্রেণীর এক ধরনের রাজনৈতিক কূট-দর্শণ। তাদের সুবিধার্থেই এই দু’ই দলকে সৃষ্টি করা হয়েছে;, কূটচালে শান্তির ধর্মকে বিতর্কিত করে, মানুষে মানুষে বিবেদ বাড়ানোর উদ্দ্যেশ্যে। প্রকৃত সত্য বিবেক কখনো এই সব ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসী হতে পারে না।
পরিশেষে নিরীশ্বরবাদীদের উদ্দ্যেশে বলছি – স্টিফেন হকিংস-কে ধ্রুবক(!) ধরে, যুক্তিতর্কের খাতিরে হয়তো ভাবছেন ঈশ্বর নেই; পরকাল বলতে তো কিছু নেই-ই! যদিই-বা থাকে??
লেখক , ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট -মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ্
সূত্রঃ ঈশ্বরবাদ, নিরীশ্বরবাদ ও মৌলবাদ : মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ্
বিষয়: বিবিধ
১৮৬৮ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন