‘"চাকমারা মানুষ মারলে এই দেশে বিচার অয় না, বিচার অয় চাকমাদেরকে কেউ গালি দিলে"ঃ - পাকুয়াখালী গণহত্যা থেকে একমাত্র জীবিত বেঁচে আসা ইউনুস মিয়া

লিখেছেন লিখেছেন এমরুল কায়েস ভুট্টো ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০১:১৬:২৩ দুপুর



বাংলাদেশের পার্বত্যচট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তি সাক্ষরের পূর্ব এবং পরে অজস্র হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। গুয়েন্দা সুত্র মতে ভয়ঙ্কর সব সমর অস্ত্রে সজ্জিত তাদের ২০ হাজারের মত আর্মস রয়েছে। তাদের রয়েছে মহিলা আর্মসও ।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পোশাক পরে আছে সন্তু লারমার জেএসএস'র স্বশস্ত্র নারী সদস্যরা
যাদের পোশাক পরিচ্ছেদ অবিকল বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর মত।



শান্তিবাহিনী ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তি সাক্ষরের পূর্ব এবং পরে অজস্র হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।

এগুলোর মধ্যে কোন কোন হত্যাকান্ডের নৃসংশতা ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যাগুলোকেও হারমানায়। পাকুয়াখালী ট্রাজেডি এই নৃসংশ গণহত্যাগুলোরই একটি। আরো রয়েছে ভূষণছড়া গণহত্যা

১৯৯৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়িতে ঘটে বর্বরতম এই ঘটনা। এই দিন পাকুয়াখালীতে শান্তিবাহিনী ঘটিয়েছিল পার্বত্য ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ড। ৩৫ জন নিরীহ বাঙালি কাঠুরিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করে বিকৃত করেছিল তাদের প্রতিটি লাশ। সেদিন ঘটনাস্থল থেকে সৃষ্টিকর্তার অসীম করুণায় পালিয়ে আসতে পেরেছিল মুহাম্মদ ইউনুছ মিয়া নামের এক ভাগ্যবান। সেদিনের সেই মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসা ইউনুছ মিয়ার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- সৈয়দ ইবনে রহমত।

প্রঃ কি করছিলেন?

উঃ গায়ে জ্বর, শুইয়া আছিলাম।

প্রঃ কতদিন যাবৎ জ্বর? ওষুধপত্র খাচ্ছেন না?

উঃ দুইদিন ধইরা জ্বর। ভাই, ওষুধপাতি খাইয়া কি অইব। জ্বরের লাগি ওষুধ খাইলেই কি আর না খাইলেই কি। এই বাড়ে-এই কমে, ওষুধ খাওন লাগব না, দুই দিন পরে এমনেই সাইরা যাইব।

প্রঃ আপনার কাছে আসার উদ্দেশ্য হলো পাকুয়াখালী হত্যাকান্ড সম্পর্কে কিছু কথা জানা।

উঃ এইসব কইয়া লাভ কি? কতই তো কইলাম। আর্মি, পুলিশ, সিআইডির অফিসার, সাংবাদিক, আরো কতজনের লগে কইছি। কই, কিছুইতো অইল না। এইসব কইয়া আর মনের জ্বালাটা বাড়াইয়া লাভ কি?

প্রঃ আপনারা তো জানতেন যে, পাহাড়ে শান্তিবাহিনী আছে, তারা বাঙালির দেখা মাত্রই গুলি করে। তারপরও পাহাড়ে যাওয়ার সাহস পেলেন কিভাবে?

উঃ ভাই, শখ কইরা কেউ কী আর মরণের সামনে যায়? পেটের দায়ে যাওন লাগে। পাহাড়ে যাওন ছাড়া আর তো বাঁচনের পথ নাই। সামান্য জমি-জমা যা আছে এইডাও তো কোন বছর চাষ কইরা ঘরে তোলা যায় না। কাপ্তাই বান্ধের পানি আইসা ডুবাইয়া দেয়। তাই বাধ্য অইয়াই পাহাড়ে যাওন লাগে। আর পাকুয়াখালীর ঘটনার সময়তো কোন ভয় আছিল না। তখন শান্তিবাহিনীর লগে আমাদের চুক্তি আছিল। আমরা তাদেরকে ১ ফুট (এক ঘনফুট) গাছের বিনিময়ে ৪০/৫০ টাকা কইরা চান্দা দিতাম।

প্রঃ শান্তিবাহিনীর সাথে কখন থেকে টাকার বিনিময়ে গাছ কাটার চুক্তি হয়েছিল?

উঃ পাকুয়াখালীর ঘটনার ৫/৬ বছর আগে একদিন বড় মাহিল্যার তক্তা নজরুল (লম্বা এবং হালকা পাতলা গড়নের কারণে তাকে লোকজন তক্তা নজরুল নামে চিনত) আমাদের কইল, পাহাড়ে গাছ কাটতে গেলে শান্তিবাহিনীরা আর বাঙালিরে গুলি করব না। কিন্তু তাদেরকে চান্দা দিতে অইব। তারপর থাইক্যা শুরু অইল গাছ কাটা। আগের থাইক্যাই চাকমাদের লগে নজরুল ভাইয়ের বালা সম্পর্ক আছিল। চাকমাদের বাড়ীতে মাঝে মধ্যে হে যাইত, আবার চাকমারাও হের বাড়ীতে আসা যাওয়া করত। এদের মধ্যে কেউ কেউ শান্তিবাহিনীও আছিল। তারাই তক্তা নজরুলরে দিয়া চান্দার মাধ্যমে গাছ কাটার খবর দিছিল।

প্রঃ চাঁদা দিয়া যখন গাছ কাটতেন, তখন আপনাদের সাথে শান্তিবাহিনী কেমন আচরণ করত?

উঃ এমনিতে তারা কোন খারাপ আচরণ করত না। তবে তাদের আইন কানুন আছিল খুব কড়া। যেই দিন যা কইতো, তাই করতে অইতো। কেউ কথা না হুনলে মাইর-ধোর করতো, পাহাড়ে যাওন বন্ধ কইরা দিত।

প্রঃ আপনারা যেখানে গাছ কাটতে যেতেন, সেখানকার চাকমাদের সাথে আপনাদের সম্পর্ক কেমন ছিল?

উঃ আমরা যেখানে গাছ কাটতে যাইতাম সেখানে অনেক চাকমা বসবাস করত। এদের কেউ কেউ শান্তিবাহিনীও আছিল। তবে বেশির ভাগই ছিল আমাদের মতই সাধারণ মানুষ। তারাও আমাদের সাথে গাছ কাটত। স্থানীয় এইসব চাকমাদের লগে আমাদের বালা সম্পর্ক আছিল। তারা আমাদের ঈদ-পরবের সময় বেড়াইতে আইত। আমরাও বিজুর (চাকমাদের বাৎসরিক উৎসব) সময় তাদের বাড়ীতে বেড়াইতে যাইতাম। অনেক সময় পাহাড়ে কোন গন্ডগোলের ভাব থাকলে তারা আমাদেরকে আগেই জানাইয়া দিত।

প্রঃ শান্তিবাহিনীর সাথে স্থানীয় চাকমাদের সম্পর্ক কেমন ছিল?

উঃ শান্তিবাহিনীরা স্থানীয় চাকমাদের উপরেও অত্যাচার করতো, ওদের কাছ থাইকয়াও চান্দা নিত। সামান্য ভুল-ত্রুটি অইলে বা তাদের কথামতো না চললে মাইর-ধোর করতো। কতজনরে তো গুলি কইরা মাইরাও ফালাইছে। শান্তিবাহিনীর খাওন-খোরাক অনেক সময় বাজার থাইক্যা কিইন্যা পাহাড়ে গিয়া দিয় আইতে অইতো। তাই স্থানীয় চাকমারা কৌশলে শান্তিবাহিনীর কালেক্টরদেরকে বিপদে ফালাইয়া তাড়ানোর চেষ্টা করতো। কোন কোন সময় মদ-টদ খাওয়াইয়া মাইয়া সংক্রান্ত ঝামেলায় ফালাইতো, আবার কোন কোন সময় টাকা-পয়সার হিসাবে গোলমাল লাগাইয়া শান্তিবাহিনীর বড় অফিসারের কাছে নালিশ করতো। এমনও সময় গেছে যখন এক মাসের মধ্যে তিন-চারজন কালেক্টর বদল হইছে।

প্রঃ দুই মাসের চাঁদা বাকি পড়ায় শান্তিবাহিনী ব্যবসায়ীদেরকে একটা মিটিংয়ে ডেকেছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীরা না যাওয়ায় তারা ক্ষেপে গিয়ে এই হত্যাকান্ড চালিয়ে ছিল বলে অনেকে মনে করে। আপনারও কি তাই মনে হয়?

উঃ এইডা একটা ফালতু কথা। ব্যবসায়ীরা পাহাড়েও যায় না। পাহাড়ে গিয়া কখনো চান্দা দেয় না। পাহাড়ে যাই আমরা। কাঠ বলেন, বাঁশ বলেন, তার চান্দা প্রত্যেক দিন সন্ধ্যার সময় দিয়াই আনতে হইত। কোন দিনের চান্দাই বাকি থাকত না।

প্রঃ ব্যবসায়ীদের কথা বলছি-

উঃ ব্যবসায়ীরা তাদের মাল (কাঠ, বাঁশ) নেওনের সময় রাস্তায় রাস্তায় চান্দা দেয়। চান্দা ছাড়া ১ ফুট গাছ নেওনের ক্ষেমতাও ব্যবসায়ীদে নাই। চান্দা বাকী রাইখ্যা শান্তিবাহিনী গাছ নিতে দিছে এই কথা জীবনেও শুনি নাই। ব্যবসা করতে চাইলে তাদেরকে চান্দা দেওনই লাগবো। আর হেগোর লাইগ্যা আমাদের মতন গরীব মানুষেরে মারব ক্যান্?

প্রঃ এতগুলো মানুষকে নির্মমভাবে মেরে ফেলার পিছনে কি কারণ আছে বলে আপনার মনে হয়?

উঃ জানি না ভাই। কি জন্য যে মারল, হেইডাই তো কইতে পারি না। ওরা ভাই বিশ্বাসঘাতক, মীরজাফর, তক্তা নজরুলরে পর্যন্ত মাইরা ফালাইল। যে নিজে না খাইয়াও হেগোরে খাওয়াইছে, কত বিপদ থাইক্যা উদ্ধার করছে।

প্রঃ ঘটনার দিন পাহাড়ে গিয়ে সন্দেহজনক কিছু দেখেছিলেন?

উঃ ঐদিন আমার পোলাগো মোসলমানির (খৎনা করার) কথা আছিল। তাছাড়া শরীরটাও বেশি বালা আছিলনা। কিন্তু আলাল ভাই (স্ত্রীর বড় ভাই) কইল, পাহাড়ে যাওনের লাগি। একরকম জোরের মধ্যেই আমি আলাল ভাইয়ের লগে রওনা হইলাম। অফিস ছড়া দিয়া পাহাড়ে ঢুকলাম। কেচিং (একটা জায়গার নাম) থাইক্যা সামান্য উপরে একটা দোকান। দোকানে দেখলাম তিনজন শান্তিবাহিনী অস্ত্র নিয়া বইসা আছে। এইডাতে অবশ্য সন্দেহ করি নাই। এই রকমতো মাঝে মধ্যেই দেখতাম। আলাল ভাইয়ের সাথে গ্যানো চাকমার ছোটখাট ব্যবসা আছিল। আলাল ভাই তার জন্য কিছু টাকা নিয়া গেছিল। টাকা দেওনের লাগি আলাল ভাই যখন গ্যানো চাকমার সাথে কথা কইতেছিল তখন কালু চাকমা এবং তার সাথের কয়েকজন আইসা কইল, মিটিং আছে, ভিতরে যাইতে অইব। তখন আলাল ভাই কইল, গ্যানো বদ্দা, তোমার টাকা মিটিং থাইক্যা আসার সময় দিব। কিন্তু গ্যানো চাকমা, টাকাটা তখনই লইতে চাইছিল। কালু চাকমা আলাল ভাইরে কইল, যাওনের সময় দিয়া যাওনের লাইগ্যা।

প্রঃ প্রথম কখন বুঝতে পারলেন যে, কোন দুর্ঘটনার সম্ভাবনা আছে?

উঃ কালু চাকমার সাথে কিছুদূর যাইতেই দেখি রাস্তার দুই পাশে চার জন করে মোট আট জন এসএম জি নিয়া বইসা আছে। আমরা কাছে যাওন মাত্রই আমাদেরকে ঘিরে ফালাইল। এই অবস্থা দেইখ্যাই আমার প্রথম মনে অইল যে, আজকে আমাদেরকে মাইরা ফালাইব। পকেট থাইক্যা টাকা পয়সা সব রাইখ্যা কালু চাকমা আর তার লগের একজন আমাদের হাত পিছ-মোড়া কইরা গাছের লতা দিয়া বানল। বান্ধার সময় কইল মিটিংয়ের জায়গা নিয়া বান ছাইড়া দিব। তখন আমি কইলাম ছাইড়াই যখন দিবা, তখন অত শক্ত কইরা বান্ধনের দরকার কী, আমরাতো পালাইতেছি না। আমিও হাত এমন ভাবে রাখলাম যাতে বান বেশি শক্ত না হয়।

প্রঃ আপনাদের বেঁধে যেখানে নিয়ে গেল সেখানে গিয়ে কি দেখলেন?

উঃ ১৫/২০ মিনিট হাইট্টা ভিতরে যাওনের পর দেখলাম একাটা মেড়া গাছের লগে তক্তা নজরুলসহ ৪ জন বান্ধা। সামনেই অন্যান্য গাছের লগে আরো মানুষ বান্ধা। গুনে দেখলাম আমিসহ ২৯ জন। এলএমজি ও এসএমজি হাতে পাহাড়া দিতেছে ১৯ জন শান্তিবাহিনী। আর লাঠি, দা, কুইচ্যা মারা শিক হাতে আরো ১২ জন চাকমা আছে, এদের মধ্যে কয়েকজনরে আমি চিনি। তারা হল- লাম্পায়া চাকমা, ছিক্কা কারবারী, বলি চাকমা, শান্তিময় চাকমা, বাবুল চাকমা, গুলুক্যা চাকমা, তরুন চাকমা(কালেক্টর), কবির চাকমা, বাশি চাকমা, বিমল চাকমা এবং সমিতি রঞ্জন চাকমা। এক সময় শান্তিবাহিনীর একজন একটা খাতা ও কলম নিয়া আমাদের সবার নাম লিখল এবং কার কাছ থাইক্যা রাস্তায় কত টাকা এবং কি কি জিনিস পত্র রাখা হইছে তা লিখল।

প্রঃ বাঁধা অবস্থা থেকে আপনি পালালেন কিভাবে?

উঃ কিছুক্ষণ পর কালাপাকুইজ্যার ৫ জনরে গাছের থাইক্যা দড়ি খুইল্লা আরো সামনের দিকে লইয়া গেল। তাদের সাথে গেল ২ জন অস্ত্রধারী আর ৩ জন গেল দা, লাঠি, কুইচ্যা মারার শিক নিয়া। ১০/১২ মিনিট পর নজরুল ভাইসহ আরো ৫ জনরে নিয়া গেল। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম নজরুল ভাই আর যাইতে চাইতেছে না। তখন একজন তারে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়া নিয়া গেল। তখনই বুঝলাম যে, লোকজনেরে সামনে নিয়া মাইরা ফালাইতেছে। কারণ নজরুল ভাইরে ঘাড়ে ধরা দূরের কথা. তার লগে গরম অইয়াও চাকমাদেরকে কথা কইতে কোন দিন দেহি নাই। তখন আমি একজনরে কইলাম, দাদা আমি একটু পেশাব করব। উনি এবং আরেক জন আমাকে একটু দূরে নিয়া গেল। পেশাবের ছল কইরা কিছুক্ষণ বইসা থাইক্যা মনে মনে ঠিক করছিলাম খাড়াইয়াই দৌড় দিমু। কিন্তু যখন খাড়াইলাম, তখন ঠাস কইরা বাঁকা একটা বাঁশের লগে মাথাটা বাড়ি লাগল। তখন আমার সাথের শান্তিবাহিনী দুইজন সর্তক হইয়া গেল। আমি মাথা হাতাইতে হাতাইতে আবার আগের জায়গায় আইলাম। আমারে আবার অন্যদের লগে বানল। তখন খুব লুকাইয়া লুকাইয়া আমি আমার হাতের বান খুইলা ফালাইলাম এবং কেউ যাতে বুঝতে না পারে সেই জন্য হাতের নিচে চাইপ্যা রাখলাম। তারপর আল্লাহর নাম লইয়া দিলাম এক দৌড়।

কিন্তু সামনেই দেখি এলএমজি নিয়া একজন খাড়াইয়া রইছে। আমারে কইল, দৌড় দিবিনা, ব্রাশ কইরা দিমু, তখন আমি ডান পাশের ছড়ার দিকে লাফ দিলাম। লাফ দেয়ার সাথে সাথে ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শুনলাম, আর শব্দ শুনতে শুনতেই গড়ায়ে পড়লাম নিচের দিকে। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা গাছের গুড়ির দিকে গর্তমতো জাগা পাইলাম। সেইখানে বইসা মাথার উপরে জঙ্গল টাইন্যা ধইরা রাখলাম। ভয়ে তখন আমার বুকের মধ্যে এমন জোরে আওয়াজ অইতেছিল যে, মনে হইছিল এই শব্দ না জানি শান্তিবাহিনী শুইনা ফালায়। রাত হওয়ার পর ছড়া দিয়াই বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। ছড়ার মধ্যে কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও গলা পানি, আবার কোথাও সাঁতার। ঘন জঙ্গলে ভরা ছড়া দিয়ে চলবার মত কোন পথ নাই। তার উপর আবার নিশি অন্ধকার। ছড়ার মধ্যে ঠান্ডা পানি, বেতের কাঁটা, বিষাক্ত সাপ, হিংস্র প্রাণীর ভয়ও ছিল। কিন্তু তখন এক শান্তিবাহিনী ছাড়া আর কিছুকেই ভয় হচ্ছিল না। সারা রাত হেঁটে হেঁটে অবশেষে ভোরের দিকে পাহাড় থেকে বের হই।

প্রঃ ১১ তারিখ সেনাবাহিনীর লাশ উদ্ধারের কথা কিছু বলুন।

উঃ বাড়িতে আসার পর আর্মিরা যহন জানল যে আমাকেও শান্তিবাহিনী ধরে নিয়া গেছিল। তহন তারা আমাকে সাথে নিয়া গেল পথ দেখানোর জন্য। আমি তাদের পাহাড়ে নিয়া গেলাম। তক্তা নজরুলরে যেইখানে ঘাড়ে ধাক্কা দিছিল, সেইখান থাইকা আরেকটু সামনে গিয়া দেখলাম, বাম দিকে প্রায় এক-দেড়’শ গজ পাহাড়ের নিচে একটা বেড়া। নিচে নাইমা সেই বেড়া পার হইলাম। কিন্তু তারপর আর রাস্তার কোন চিহ্ন নাই। একটু দূরে দেখলাম, একটা কাঁচা বাঁশের কঞ্চি আধা ভাঙ্গা অবস্থায় ঝুইলা রইছে। কঞ্চিটা সরানোর পর একটা ছোট পথ পাইলাম। এই পথ দিয়া সামনে গিয়া দেখি সরাফদ্দি ভাইয়ের টুপিটা একটা কঞ্চির লগে বাইজ্যা রইছে। এরপর সেন্ডেল, মদের টেংকি, বেশ কয়ডা লাঠিও দেখলাম। তারপর দেখলাম আলাল ভাইয়ের লাশ। আরেকটু সামনে গিয়া দেখি বিশাল জায়গা জুইড়া লাশ আর লাশ। কেউরে চিনা যায় না। বন্দুকের সামনে যে চাকুটা (বেয়নেট) থাকে এইডা দিয়া খোঁচাইয়া খোঁচাইয়া মারছে। লাঠি দিয়া পিটাইয়া, দা দিয়া কুবাইয়া, কুইচ্যা মারার শিক দিয়া পারাইয়া, চোখ তুইলা, আরো কতভাবে যে কষ্ট দিয়া মারছে তা কইয়া শেষ করুন যাইব না। ঐকথা মনে অইলে আইজো শরীরের পশম খাড়াইয়া যায়। ঐখানে লাশ পাওয়া যায় ২৮ জনের।

পাকুয়াখালিতে নিহত কয়েকজন কাঠুরিয়ার লাশ





প্রঃ মানুষ মারা গিয়েছিল ৩৫ জন, আপনি বলছেন লাশ পাওয়া যায় ২৮ জনের। বাকিদের সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?

উঃ ঘটনার দিন আমি যাদেরকে বান্ধা অবস্থায় দেখছিলাম তাদের মধ্যে আমার পরিচিত আলী, দুলু দুই ভাইসহ ৪ জনের লাশ ঐখানে ছিল না। আর এমন তিনজনের লাশ পাইছি যারা ঐ দিন ঐখানে বান্ধা ছিল না। আমার মনে হয়, আমি পালানোর পরে আরো সাত জনরে শান্তিবাহিনীরা ধইরা নিয়া গেছিল। সাত জনরে মনে হয় অন্য কোন খানে নিয়া মারছে, আমরা তাদের লাশ খুইজ্জা বাইর করতে পারি নাই। আর বালা কইরা খুজবার মতো পরিস্থিতি তখন ছিল না।

প্রঃ শান্তিবাহিনী এতগুলো মানুষকে একসাথে হত্যা করল, অথচ তাদের কোন বিচার হল না। আপনারা কি সরকারের কাছে এর বিচার চান নাই?

উঃ আমরাতো বিচারের দাবী করছিই, আমি নিজে বাদী অইয়া মামলাও করছিলাম। তখন সরকারের মন্ত্রীরাও কইছিল বিচার করব। তদন্তও করছিল। হুনছি তদন্তের রিপোর্ট সরকারের কাছে জমা দিছে। কিন্তু সেই রিপোর্ট সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। দেখতে দেখতে আজ ১৪ বছর পার অইয়া গেল। কই, কিছুই তো অইল না। শুধু এইডাই না, শান্তিবাহিনী তো আরো অনেক বাঙালিরে মারছে। কোনডারই তো বিচা অয় নাই। চাকমারা মানুষ মারলে তো এই দেশে বিচার অয় না। বিচার অয় চাকমাদেরকে কেউ গালি দিলে, তার। আর অহন তো চুক্তি কইরা শান্তিবাহিনীরাই সরকার (সাবেক শান্তিবাহিনীর প্রধান সন্তু লারমা চুক্তির পর থেকে পার্বত্যচট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন) অইছে। তাইলে আর বিচার করব কেডা?

তারপরেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার দাবী, আপনার বাবাকেও মাইরা ফালাইছিল। বাবা হারানোর ব্যথা আপনি বুঝেন। আর আপনি সেই হত্যাকারীদের বিচার করেছেন। এই জন্য আপনাকেই বলি- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পাকুয়াখালীতে যেসব সন্তান তাদের বাবাকে হারিয়েছে তারাও তাদের বাবা হত্যার বিচার চায়, যারা সেখানে ভাই হারিয়েছে তারা তাদের ভাই হত্যার বিচার চায়, যেসব মা-বাবা তাদের সন্তান হারিয়েছে তারা সন্তান হত্যাকারীর বিচার চায়, যেসব মহিলা স্বামী হারিয়েছে তারা স্বামী হত্যার বিচার চায়। কিন্তু তারা তো আর প্রধানমন্ত্রী হইয়া আত্বীয়-স্বজনদের হত্যাকারীর বিচার করতে পারব না। তাই এই হত্যাকান্ডের বিচার আপনাকেই করতে হইব।



পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশে আদিবাসী বিষয়ে আরো পড়ুন:

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশে আদিবাসী

বিষয়: বিবিধ

৩৩৪২ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

263238
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০১:৩৮
আমজনতার কথা লিখেছেন : এ বর্বর হত্যাকান্ডের পর যাদের নির্মূল করা ছিল দায়িত্ব সেসব বর্বর সন্ত্রাসীদের সাথে করা হল শান্তিচুক্তি। শান্তি চুক্তিতে শান্তি আসেনি, সন্তু লারমার সন্ত্রাসী বাহিনীর দৌরাত্ব বেড়েছে।
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০১:৪৮
206876
এমরুল কায়েস ভুট্টো লিখেছেন : শান্তি চুক্তিতে শান্তি আসেনি, শান্তি যে আসবেনা সেটা বাঙ্গালীরাও জানত। এই চুত্তির বিরোদ্ধে অনেক আনন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু জনগনের বিরোদ্ধে গিয়ে তৎকালিন সরকার শান্তি চুক্তি নামক করে মুলত তাদের চাদা বাজি এবং সন্ত্রাস কে বৈধতা দিয়েছিল।
263239
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০১:৩৯
আমজনতার কথা লিখেছেন : আমি আজ প্রথম মন্তব্য সুবিধা পেলাম। এবং আপনার পোস্টে মন্তব্যের মাধ্যমে শুরু করলাম। Happy Happy Happy
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০১:৫০
206880
এমরুল কায়েস ভুট্টো লিখেছেন : স্বাগতম জানায় আপনাকে। আপনার প্রথম কমেন্টই করেছেন নির্যতিত মানুষের পক্ষ হয়ে। আশা করব সব অন্যায় অবিচাররের বিরোদ্ধে আপনি সচ্চার থাকবেন।
263244
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০১:৪২
মু. মিজানুর রহমান মিজান (এম. আর. এম.) লিখেছেন : ধুরো মেয়া! এইডা একটা কতা কইলেন? আমনেও চাকমা অইয়া যান। ঝামেল খতম।
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০১:৫৩
206881
এমরুল কায়েস ভুট্টো লিখেছেন : হ..ভাই। পরামর্শটা মন্দ না। আমার বিপদটা কেটে যাবে। কিন্তু আপনি কি করবেন?? আমি তখন আপনাকে....মারুম
263252
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০২:০১
মামুন লিখেছেন : একটানা পড়লাম।
যাদের নাম শান্তিবাহিনী, এই যদি এদের কর্মকান্ড হয়, তবে শান্তি আসবে কি ভাবে? আর এদের সাথে কিসের শান্তিচুক্তি? আমাদের সেনাবাহিনীকে 'চিরুনি অপারেশন' চালাবার অনুমতি দিয়ে দেয়া হোক- এদেরকে একেবারে জড় থেকে উৎপাটন করেই তাঁরা ঘরে ফিরবে। যারা শান্তি চুক্তির পরও এরকম জঘন্য হত্যাকান্ড ঘটায়, তাদেরকে কোনো ধরণের সুযোগই দেয়া উচিত নয়।
ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর একটি পোষ্ট উপহার দেবার জন্য।
অনেক শুভেচ্ছা.. Rose Rose Rose Good Luck
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০২:০৬
206884
এমরুল কায়েস ভুট্টো লিখেছেন : আপনি বলতেছেন "মাদের সেনাবাহিনীকে 'চিরুনি অপারেশন' চালাবার অনুমতি দিয়ে দেয়া হোক"। অন্যদিকে তারা দাবী করতেছে পার্বত্য অঞ্চল থেকে সেনাবাহিনী এবং অধাসামরিক বাহিনীর ক্যাম্প গুলো সরিয়ে নিতে। যাতে তারা অবাদে চাদাবাজি এবং হত্যা চালাতে পারে। তাদের কথা মত সরকারও ইতিমধ্যে অনেক ক্যাম্প সরিয়ে নিয়েছে।
263261
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০২:১০
মামুন লিখেছেন : একটি স্বাধীন দেশের সরকার ক্ষুদ্র একটি নৃ-গোষ্ঠীর দাবীর কাছে মাথা নত করবে!!! এটি শুনলে কেমন হাস্যকর মনে হয় না?
সমগ্র দেশের স্বার্থে প্রয়োজনে এই নৃ-গোষ্ঠীটিকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিলেই বা কি?
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০২:৩৩
206891
এমরুল কায়েস ভুট্টো লিখেছেন : তাদের দাবী গুলো যদি যৌক্তিক হত তাহলে কোন কথা ছিল না। আমরা শুধু মাত্র সমঅধিকারের দাবী করতেছি। তারা বলে পাবর্ত চট্টগ্রাম নাকি তাদের। আমরা নাকি চেটেলার!!! হাউ ফনি!!!
নিজ দেশে যেন আমরা পরবসি

263282
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:১৩
হতভাগা লিখেছেন : বাংলাদেশ থেকে এটাকে বের করে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায় ।
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:০৪
206909
এমরুল কায়েস ভুট্টো লিখেছেন : তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন বাংলাদেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতীদের কে দিয়ে দিতে??
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:০৬
206910
হতভাগা লিখেছেন : জ্বী
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:০৯
206913
এমরুল কায়েস ভুট্টো লিখেছেন : ৩০লক্ষ শহিদের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন দেশ কে সন্ত্রসীদের কে দিয়ে দেব??
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:১৬
206914
হতভাগা লিখেছেন : এদের সাথে মায়ানমার আছে , ভারত আছে আর আছে পশ্চিমা বিশ্বরা - পারবেন এদেরকে ট্যাকল করে তা ধরে রাখতে ?

রাখতে পারলেও চাকমারা প্রতিনিয়ত জ্বালাতন করে ছাড়বে ।

তার চেয়ে আপদ বিদায় করে দেওয়াই ভাল ।
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:৩৫
206918
এমরুল কায়েস ভুট্টো লিখেছেন : "হতভাগা লিখেছেন : এদের সাথে মায়ানমার আছে , ভারত আছে আর আছে পশ্চিমা বিশ্বরা "

আমরা ঠিক থাকরে এরা কিছুই করতে পারবেনা। সমস্যা হচ্ছে যে বাংলাদেশের মিড়িয়াও তাদের পক্ষে সাফাই গায়। যার জন্য দেশে অধিকাংশ মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কি হচ্ছে তা জানে না।
263300
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:৪৯
েনেসাঁ লিখেছেন : সন্ত্রাসী সর্বদা সন্ত্রাসীই, তাদের কোন ধর্ম,বর্ন বা জাত নেই। বাংলাদেশের অখন্ডতার স্বার্থে সকল সন্ত্রাসের বিচার হওয়া জরুরী। কারন আইনের চোখে সকল মানুষ সমান।
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:০৭
206911
এমরুল কায়েস ভুট্টো লিখেছেন : আমরা তো সমঅধিকারের জন্যই আন্দোলন করতেছি। স্বাধীন দেশে বাস করতে কেন উপজাতীদের চাদা দিতে হবে??
263341
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৫:৩৬
কালো পাগড়ী লিখেছেন : নিজ ভুমে পরবাসী মোরা।
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৫:৪৭
206943
এমরুল কায়েস ভুট্টো লিখেছেন : হ ভাই..৩০লক্ষ শহিদের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন দেশে আজ আমরা পরবাসী
263424
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:২০
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চাকমারা কোন ভাবেই এই অঞ্চলের ভুমপুত্র বা আদিবাসি নয়। তবুও মিডিয়া তাদেরকে আদিবাসি বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি হিসেবে তারা অবশ্যই তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধিনতা দাবি করতে পারে। কিন্তু সেটা তাদের আছে। শান্তিবাহিনির কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯২থেকে আলোচনা চলছিল ভাল ভাবেই কিন্তু ১৯৯৮ সালে তারাহুড়া করে চুক্তি করে শান্তি প্রক্রিয়ার তেরটা বাজান হয়েছে।
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ০৯:০৫
207103
এমরুল কায়েস ভুট্টো লিখেছেন : সমস্যা হচ্ছে যে বাংলাদেশের মিড়িয়াও তাদের পক্ষে সাফাই গায়। যার জন্য দেশে অধিকাংশ মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কি হচ্ছে তা জানে না। সরকারের দেওয়া বির্দেশনা অমান্য করে উপজাতিদের আদিবাসী বলে উপস্থাপন করে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File