ফিরে দেখা আসামের নেলির মুসলিম গণহত্যা

লিখেছেন লিখেছেন এমরুল কায়েস ভুট্টো ২৯ এপ্রিল, ২০১৪, ১২:০৪:৩৯ দুপুর



উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য আসামে গত ২৪ এপ্রিল যে সব এলাকায় ভোটগ্রহণ হলো, তার মধ্যে রয়েছে নগাঁও কেন্দ্রটিও। এই কেন্দ্রেরই একটা অঞ্চল নেলি। আশির দশকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় যখন অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের আন্দোলন চরমে, সেই সময়েই নেলিতে সংঘটিত হয়েছিল স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণহত্যা। এক বেলাতেই হত্যা করা হয়েছিল তিনহাজারেরও বেশি বাঙালী মুসলমানকে। একত্রিশ বছর ধরে সেখানে নিয়মিতই ভোট নেয়া হচ্ছে। কিন্তু মৃতদের স্মৃতিসৌধ থেকে নলকূপ বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিছুই পায় নি গণহত্যার কবলে পড়া বসনতোরি, বুকডোবা হাবি বা বরবরি গ্রামগুলো।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে এমনটাই লিখেছেন কলকাতা প্রতিনিধি অমিতাভ ভট্টাশালী।

বিবিসির এই প্রতিনিধির সাথে বসনতোরিতে দেখা হয়েছিল যুবতী জোহরা খাতুনের। ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে তার বয়স ছিল মাত্র ছয়মাস। তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, ‘বড় হয়ে শুনেছি বাবার কাছে যে ছয়মাসের আমাকে কোলে নিয়ে পালাতে গিয়ে মা গুলি খেয়ে মাঠে পড়ে গিয়েছিল। আমি নাকি পাঁচ-ছয় দিন মরা মায়ের গায়ের ওপরেই পড়ে ছিলাম। পরে পুলিশ আমাকে নিয়ে গিয়ে বাবাকে খুঁজে বার করে।

১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে যখন অসমীয়া জাতীয়তাবাদী শক্তির সমর্থক কয়েক হাজার দুষ্কৃতকারী বসনতোরির একের পর এক বাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, তখন গ্রামের পুরুষ-মহিলা- শিশুরা বৃদ্ধ মুহাম্মদ আব্দুল হকের বাড়ির ঠিক পেছনেই চাষের ক্ষেতে জড়ো হয়েছিলেন। আব্দুল হক বলছিলেন, ‘সকাল সাতটা নাগাদ বাড়ি-ঘর জ্বালানো শুরু হয়েছিল। গ্রামের দুই প্রান্ত থেকেই ঘর জ্বালাতে জ্বালাতে এগচ্ছিল ওরা। সব মানুষ আমার বাড়ির ঠিক পেছনের ক্ষেতে জমা হয়েছিল। হঠাৎ দেখলাম অনেকগুলো গাড়ি থেকে অস্ত্র হাতে লোকজন নামছে। মুখে গামছা বাঁধা। তারপরেই শুরু হয়েছিল গুলি আর তীর ছোঁড়া।’

প্রাণে বাঁচার জন্য দিকবিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে দৌড়িয়েছিলেন পশ্চিমদিকের নদীর দিকে। সাঁতরে নদী পার হতে যারা পেরেছিলেন, তারাই এখনও জীবিত রয়েছেন সেই বিভৎসতার বর্ণনা দেয়ার জন্য।

আব্দুল হক নিজেও স্ত্রী, পুত্র, মেয়েকে হারিয়েছেন ওই পাইকারি হত্যাকাণ্ডে। ওই দুটি গ্রামেই মারা গিয়েছিলেন ২০০০ ছয়শোরও বেশি মানুষ।

পাশের গ্রাম বুকডোবা হাবির বাসিন্দা মোসলেমুদ্দিনেরও পাঁচ বছরের মেয়ে, স্ত্রীসহ প্রায় পুরো পরিবারই সেদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।

‘আমরা তো সব হারালাম, কিন্তু এতদিন পরেও তার কোনও বিচার পেলাম না। মৃতদেহ পিছু ৫০০০ করে টাকা আর কিছু ঢেউ-টিন দিয়েছে,’ বলছিলেন মোসলেমুদ্দিন।

বসনতোরি-বুকডোবা হাবি থেকে বেশ অনেক কিলোমিটার দূরে- পাহাড়ের কোলে চা বাগান ঘেঁষা গ্রাম বরবরি। একই দিনে সেখানেও হামলা হয়েছিল। সাড়ে পাঁচশো মহিলা-পুরুষ-শিশুকে সেদিন মেরে ফেলা হয়েছিল।

পরিকল্পনাটা ছিল একই রকম। চারদিক থেকে হাজার হাজার সশস্ত্র মানুষ দিয়ে প্রথমে বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দাও। তারপরে প্রাণভয়ে মানুষ যখন পালাবে, তখন গুলি বা তীর ছুঁড়ে মেরে ফেল। যদিও দুদিন আগেই থানায় ডেকে নিয়ে গিয়ে শান্তি কমিটি তৈরি করে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু ঘটনার দিন বেশ কয়েক ঘণ্টা কোনো পুলিশ আসে নি।

বসনতোরির মুহাম্মদ আব্দুল হক বলছিলেন, ‘কেন্দ্রীয় নিরাপত্তারক্ষীরা গন্ডগোল আঁচ করতে পেরেছিল, গুলির শব্দও হয়তো শুনেছিল। কিন্তু স্থানীয় থানার অফিসারেরা বাহিনীকে গ্রামে নিয়ে না এসে অন্যান্য দিকে টহল দেওয়াচ্ছিল। পরে কয়েকজন মহিলা কেন্দ্রীয় বাহিনীর গাড়িগুলোর পথ আটকালে তারা বুঝতে পারে কি ঘটছে ভেতরের গ্রামগুলোতে। দুষ্কৃতিরা তখনই পালাতে শুরু করে।’

বরবরির কয়েকজন নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামের কবরস্থানে, যেখানে গণকবর দেয়া হয়েছিল প্রায় ৫০০ মৃতদেহ। সেখানেই একটা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ ৩০ বছরেও গড়ে তোলার জন্য কেউ সাহায্য করে নি। শুধু কয়েকটা লোহার রড মাটিতে পোঁতা হয়েছে।

আর বসনতোরি গ্রামের বাইরে যেখানে কয়েকহাজার মানুষকে গণকবর দিয়েছিল নিরাপত্তা বাহিনী, প্রাণে বেঁচে গ্রামে ফিরে সেই জায়গাটার কি অবস্থা দেখেছিলেন, সেটাই বলছিলেন আব্দুল সোবহান।

তার কথায়, ‘দিন তিনেক পরে যখন গ্রামে আসতে পারলাম, দেখি যাকে যেভাবে পেরেছে, কবর দিয়েছে। কারো হাত বেরিয়ে আছে, কারও পা। রাত্রিবেলা নিরাপত্তাবাহিনীই কবর দিয়েছে। পরে আমরা সেগুলোর ব্যবস্থা করে মৃতদের শান্তিতে থাকার ব্যবস্থা করি।’

একত্রিশ বছর ধরে প্রতিবারই ভোট দেন বসনতোরি বা বরবরির মানুষ। ’৮৩-র গণহত্যা ঘটে যাওয়া গ্রামগুলোতে এবারের নির্বাচনের প্রচার চালিয়েছে কংগ্রেস, আসামের মুসলমানদের রাজনৈতিক দল এআইইউডিএফ, এমনকি যে অসমীয়া জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে গণহত্যা হয়েছিল, তাদেরই উত্তরসূরী অসম গণ পরিষদও। কিন্তু গত তিন দশকে তাদের অবস্থাটা পাল্টায় নি। কোনো সরকারই ফিরে তাকায় নি সব-হারা এই বাঙালী মুসলমান গ্রামগুলোর দিকে, যদিও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গিয়ানি জৈল সিং থেকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী- প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন সবাই।

বসনতোরি, বরবরি, বুকডোবা হাবির রাস্তা তিন দশক পরেও পাকা হয় নি, গ্রামের ১৮০০ মানুষের জন্য একটাই নলকূপ, কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, নেই কোনো কাজের সুযোগ। গ্রামের ছেলেদের কাজের খোঁজে যেতে হয়েছে দক্ষিণ ভারতের কেরালায়।

অথচ চোখে পড়ল বরবরির কয়েক কিলোমিটার দূরেই, জাতীয় সড়কের ওপরে ধরমতুলকে গড়ে তোলা হচ্ছে আদর্শ গ্রাম হিসাবে।

সূত্র: বিবিসি

বিষয়: বিবিধ

১১৭৬ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

214766
২৯ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ১২:২১
আহমদ মুসা লিখেছেন : আপনার বাড়ী কি কক্সবাজার জেলার অন্তর্ভূক্ত?
সম্ভব হলে আপনার ফেইস বুক আইডি দেন। আপনার সাথে কথা বলবো ফেবুতে।
২৯ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০২:০০
163048
এমরুল কায়েস ভুট্টো লিখেছেন : আমার বাড়ি কক্সবাজারের পার্শবর্তি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলাতে।
যদিও নাইক্ষ্যংছড়ি বান্দরবান জেলার অন্তরর্ভুক্ত তার পরও আমাদের তিন পাশে কক্সবাজারের অবস্থান এবং বান্দরবান থেকে দূরত্বের কারণে আমরা সধারনত মৌখিক পরিচয়ে কক্সবাজার বলে পরিচয় দিয়।
ফেইস বুক আইডি "Emrul Kayech Bhutto" দিয়ে সার্স দিলে যে আইডিটি আসবে ওঠা আমার আইডি।
214999
২৯ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৫৬
আহমদ মুসা লিখেছেন : আপনার ফেসবুক ইনবক্স চেক করেন। রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। একটি মেসেজও দিয়েছি। সময় থাকলে চেক করে দেখুন।
৩০ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ০৯:১১
163432
এমরুল কায়েস ভুট্টো লিখেছেন : ধন্যবাদ রিকোয়েস্ট পাঠানোর জন। একসেপ্ট করেছি।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File