এক তালবে এলেমের কাহিনী
লিখেছেন লিখেছেন টুটাফাটা মানব ২৩ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৬:৩৪:৫৬ সকাল
আমার লেখা ইসলামী চেতনায় ভরপুর একটি গল্প... আশা করি পড়ে দেখবেন । নাম তার খালিদ, একটি কওমী মাদ্রাসায় লেখাপড়া করছে।তালবে এলেম হিসেবে তার মধ্যে রয়েছে প্রচুর শ্রদ্ধাভক্তি এবং স্নেহশীল আচরণের বহিঃপ্রকাশ। এছাড়া পরহেযগার ছেলে হিসেবেও নিজ এলাকায় তার যথেষ্ট প্রশংসনীয় অবস্থান রয়েছে, এখন তার বয়স মোটে ১৯ এর গোড়ায় পৌছেছে। আজ সে রমজানের ছুটি উপলক্ষ্যে বাড়িতে যাবে এবং মা বাবার সাথে আনন্দে ঈদ করবে। সহপাঠীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে রওনা দিয়েছে বাস স্টেশনে। ঝটপট একটি বাস পেয়ে উঠে পড়ল, তার গন্তব্য দিনাজপুর বীরগঞ্জের দিকে। দুরন্ত গতিতে বাস ছুটে চলেছে কিছুক্ষণ যাবত্ দাড়িয়ে থেকে অবশেষে একটি বসার ছিট পেয়ে সেখানেই কোনমতে বসে পড়ল বেচারা খালিদ। তার পাশেই বসেছে দাড়িপাকা একজন মানুষ। তাকে দেখে খালিদের একটু মায়া হল কারণ লোকটির চেহারায় রয়েছে কিছু দুশ্চিন্তার ছাপ এবং অসহায়ত্বের ছিটাফোটা যা লোকটির ফর্সা মুখে লালবর্ণের মতো ফুটে উঠেছিল, তা পরখ করে খালিদের অন্তরাত্না একটু খুতখুত করা শুরু করেছিল। এমনিতে খালিদ এমন এক বেকায়দা স্বভাবের ছেলে যে কিনা অপরিচিত যে কারও সঙ্গে অতিসহজেই মিশে যেতে পারে এবং আপন করে নিতে পারে। সে রাস্তাঘাটে যার তার সাথে গল্পজুড়ে দেয় অবশ্য সেটি অনর্থক গল্প নয় বরং সে অপরিচিত ব্যক্তিটির কাছ থেকে নানা বৈচিত্রময় ঘটনা বা বিষয় জানতে চায় এবং এতে করে সে অনেক আত্নতৃপ্তি ও অভিজ্ঞতা লাভ করে বটে। আজ সেই লোকটির সাথেও এর ব্যতিক্রম কিছু হল না। প্রথমেই মুরুব্বী লোকটিকে সালাম দিয়ে হালকা পাতলা কথাবার্তা শুরু করল খালিদ। পরিচয় বিনিময়ের পর খালিদের হাজারো প্রশ্ন কোথায় যাচ্ছেন? বাড়ি কোথায়? কি করেন? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন করছে এবং লোকটি হাসিমুখে তার জবাবও দিচ্ছে। এতক্ষণে খালিদ লোকটিকে গলিয়ে ফেলেছে ও আপন সীমারেখায় নিয়ে এসেছে। খালিদও তার নিজ সম্পর্কে তার পিতা মাতার সম্পর্কে অনেক কথা বলল। লোকটির নাম আব্দুর জব্বার লোকটির বাড়ি বালিয়াডাঙ্গিতে এবং সে যাচ্ছে জামাইয়ের বাড়ি ঘোড়াঘাটে। এতক্ষণে খালিদ এটাও বুঝতে পেরেছে লোকটির দুশ্চিন্তার কারণ। লোকটি মূলত কৃষিকাজ করে নিজের গুটিকয়েক জমি আছে।লোকটির আছে এক ছেলে ও তিন মেয়ে, সন্তানদের মা অর্থাত্ তার স্ত্রী সন্তানদের ছোট অবস্থাতেই মারা গিয়েছেন। তিনিই অতিকষ্টে সন্তানদের বড় করেছেন এবং বড় ছেলে ও দুই মেয়ের বিয়েও দিয়েছেন বটে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যযে তার বড় ছেলেটা সেপারেট হয়ে গেছে, একদম অন্য এলাকায় চলে গিয়েছে এখন খোজখবরও আর নেয় না। তার দুশ্চিন্তা ছোট মেয়েটিকে নিয়ে যার বয়স এখন ১৩ বছর হয়েছে আর কিছুদিনের মধ্যে হয়তবা তাকেও বিয়ে দিতে হবে কিন্তু আসল শঙ্কাটা তো ঐ জায়গাতেই সেটা হল. তার সর্বকনিষ্ঠ মেয়েটি শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। বলা চলে সে জন্মান্ধ, পৃথিবী জিনিসটা সে কোনদিন সত্যিকারে পরখ করতে পারতে পারেনি। বিশেষত মেয়েটির করুণ অবস্থার কথা শুনে খালিদের কোমল হৃদয়টি একটু নড়েচড়ে উঠল। হায়রে! আল্লাহ পাকের এই সৃষ্টি কত বৈচিত্র্যময়,আমিআজ কি সুন্দরভাবে আমার এই দুটি চোখ দিয়ে পৃথিবীর বিচিত্রময় বিষয়বস্তু উপভোগ করছি অথচ মেয়েটি এ থেকে বঞ্চিত। যাই হোক খালিদ মনোযোগ সহকারে তার করুণকন্ঠে ভেসে আসা কথা দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সাথে হজম করছিল। তিনি তার মেয়ের বিয়ে নিয়ে একটু চিন্তায় থাকেন যখনই সেই চিন্তা হাজিরা দেয় তখনই তা মারাত্নক দুশ্চিন্তায় পরিণত হয়।খালিদের কাছে যখন এ ব্যাপারে বলছিলেন যে তার মেয়ের বিয়েশাদী না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তখন তিনি ভারী আবেগাআপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন, খালিদও কিছুটা মনোক্ষুণ্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং তার নয়নদুটিতে পানি টলমল করছিলোও বটে। আর যাই হোক বেচারা খালিদের হৃদয় খুবই প্রশস্ত এবং কোমল। অতিসহজেই অন্যের দুঃখকষ্টে নিজেকে শামিল করে নিতে পারে। তাদের এই অবস্থা দেখে বাসের যাত্রীরা তাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। খালিদ ও লোকটির আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তারা বুঝি কতদিনের পরিচিত, কতদিনের মনে হয় সম্পর্ক তাদের এবং তার মনে হয় কত আপন মানুষ বা কত কাছের মানুষ অথচ তাদের পরিচিতি তো মাত্র দু ঘন্টা হলো কিন্তু এই সময়টুকুতেই দুজন বড়ই আপন মানুষে পরিণত হয়ে গেছে। আসলে খালিদের যে এরকমই স্বভাব, অতিঅল্পসময়ে অন্যকে আপনজন বানিয়ে ফেলা। এরপর খালিদ তাকে চাচা সম্বোধন করে কিছুটা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল। সেই সাথে সে মনে মনে ভাবছে এবং স্মরণ করছে জনৈক এক সাহাবীর কথা যিনি কিনা একজন অসহায় এরকমই এক শারীরিক প্রতিবন্ধীকে (লুলা) মেয়েকে বিবাহ করেছিলেন যার জন্য তাকে অনেক কষ্টের স্বীকার হয়েছিল তবুও তিনি ধৈর্যহারা হননি বরং একটি দেশের গভর্নরের মতো বিশাল পদটির দায়িত্ব খুব নিশ্চিন্তমনে পালন করেছেন এবং সফলও হয়েছেন বটে। খালিদ সেই আদর্শিক চেতনা নিজের বুকে ধারণ করে মেয়েটাকে সে নিজেই বিয়ে করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় তবে সেটা এখন নয় কারণ লেখাপড়া তার এখনও বাকী রয়েছে তাই সে খুব কৌশলের সাথে তাকে বলে দিল যে চাচা আপনি আমার ফোন নাম্বারটা নিয়ে রাখেন পারলে নিয়মিত আমার সাথে যোগাযোগ রাখিয়েন আর আপনার মেয়ে বা আমার বোনটির বিয়ে দেওয়ার সময় হলে আমাকে জানাবেন হয়তবা আমি একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারব ইনশআল্লাহ। এরপর আব্দুর জব্বার সাহেব খালিদকে বললেন “আইচ্ছা বাজান কমু নে তোমার ব্যবহারে মুই হুবই খুশি অইছি তয় বাজান মোর মাইয়াডারে কেডা বিয়া করবো” খালিদ তো এই মুহূর্তে জানাতে চাচ্ছে না যে সেইই তার মেয়েকে বিয়ে করবে তাই একটু কৌশল খাটিয়েই সে বলল আহা! চাচা আমিতো বললাম ইনশআল্লাহ একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার চেষ্টা করব শুধু শুধু এত টেনশন করছেন কেন বলুন তো? আমি বলছি যেভাবেই হোক আমার বোনটিকে ভাল কোথাও বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেব। আব্দুর জব্বার সাহেব কিছুটা আশ্বস্ত হলেন এবং কিছুটা স্বাধীন অনুভূতি তার অন্তরে প্রবেশ করল কারণ একটি দায়িত্বশীল যুবক তার থেকে কিছুটা দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, তিনি খালিদকে অল্প কিছুক্ষণের বাক্যালাপেই ভালোবেসে ফেলেছেন। তাই তার সাথে কথা বলে ভালই মজা অনুভব করছেন।তার কাছে থাকা ব্যাগে রয়েছে তার ছোট মেয়েটির হাতে বানানো কিছু লাড্ডু যা তিনি জামাইবাড়ির উদ্দেশ্যে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে এমন কারও সাথে পরিচয় হবে যে কিনা স্বল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই তার নিকটআত্নীয় বা ঘনিষ্ঠ কোন আপনজন বণে যাবে সেটা তিনি কল্পনায়ও ভাবেননি। এখন যেহেতু কল্পনাহীন বাস্তব তার সম্মুখে দৃশ্যমান তখন নতুন মানুষটিকে কিছু প্রতিদান বা আপ্যায়ন না করলেই নয়। সেই হিসাবেই তিনি ব্যাগে থাকা লাড্ডু থেকে কিছু লাড্ডু খালিদের হাতে দিয়ে বললেন ‘”লও বাজান এল্লা মোর ছোট মাইয়া বানাইছে এনা খাইয়া দেহো” তাই নাকি! তালবে এলেমের চোখেমুখে অবাকের চিহ্ন।বাহ! তাহলে তো একটু খেয়ে দেখতেই হয়। খালিদ হৃদয়ের গহীনে ভেবে চলেছে সে তো তাকেই বিবাহ করবে যে লাড্ডুগুলো বানিয়েছে তাই খুব উচ্ছল মনে সে লাড্ডুগুলো মচত মচত শব্দ করে খাওয়া শুরু করে দিল। সেই সাথে লাড্ডুর গুণগান গেয়ে চলেছিল।হঠাত্ গাড়ির হেলপার হাঁকপাড়া শুরু করল বীরগঞ্জ! বীরগঞ্জ! অমনি খালিদের অন্তর কেপে উঠল এবার তো চলে যেতে হচ্ছে, যাই হোক সে লোকটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসল, গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। তার বাড়ি অবশ্য বেশি দুরে নয় হেটেই যাওয়া যায়। তার বাবা এলাকার একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য এছাড়া তাদের জায়গা জমিরও অভাব নেই। বাড়িতে পৌছানোর পর মা বাবার সাথে সাক্ষাত হল খালিদের। তারপর দেখতে দেখতে রমজান মাসটা শেষ হয়ে আসল এরপর ঈদ আসল ঈদে খুব আনন্দ উচ্ছ্ব্যাসের সাথেই দিন কেটেছে খালিদের, এদিকে তার প্রায়ই কথাবার্তা হয় বাসযাত্রায় পরিচয় হওয়া আব্দুর জব্বার চাচার সাথে। ঈদ শেষে মাদ্রাসার কার্যক্রম আবার শুরু হয়ে যায় খালিদও মাদ্রাসায় চলে আসে এভাবেই চলতে থাকে দিনকাল। দিন সপ্তাহ মাস বছর হতে হতে ধীরে ধীরে ৪টি বছর দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায় সকলের জীবন থেকে। ইতিমধ্যে অবশ্য খালিদ তার পিতামাতাকে সবকিছু খুলে বলেছে এবং সেই অন্ধ মেয়েকেই সে বিয়ে করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা তার পরিবারকে সে জানিয়েছে। প্রথমে তার পিতামাতা আপত্তি জানিয়েছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে খালিদের কুরআন হাদীস সম্বলিত যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে রাজী হয়েছেন। তবে সে এখনও এ প্রস্তাবটা তার হবু শ্বশুরকেই বলে নি তাই সে চিন্তা করল আজ কালের মধ্যেই প্রস্তাবটা দিতে হবে। সেই সুযোগটি খালিদের এসে পড়ল!! একদিন তিনি ফোন দিলেন এবং খালিদকে বিয়ের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বললেন, এরপর খালিদ নিজেই লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বলে দেয় “আমিই আপনার মেয়ে করতে চাই” প্রথমে তিনি বিশ্বাস করতে চাননি কারণ এতবড় ঘরের ছেলে কিভাবে একটা অনাথ অসহায় প্রতিবন্ধী মেয়েকে বিয়ে করবে!! তবে পরবর্তীতে যখন খালিদ তার পিতা মাতার সাথে আলাপ করিয়ে দেয় তখন তার কাছে বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য হয় এমনকি তিনি আনন্দে আত্নহারা হয়ে যান একারণে যে তার অসহায় মেয়ের একটি বড় ঘরে বিয়ে দিতে পারছেন। তারপর দু পরিবারের মধ্যে কথা পাকাপাকি হয়ে যায় এরপর খালিদ তার ঘরে এক অন্ধ নারীকে বিবাহ করে নিয়ে আসে। সারাজীবনের সঙ্গিনী হিসেবে সে গ্রহণ করে এক দৃষ্টিশক্তিহীন মেয়েকে।
বি দ্রঃ বিয়ের পরে কি কাহিনী ঘটবে তা লেখার চেষ্টা করছি...............।
বিষয়: সাহিত্য
১১৩৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন