রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর বহুবিবাহঃ বিভ্রান্তির অবসান

লিখেছেন লিখেছেন বিন হারুন ২৯ এপ্রিল, ২০১৪, ০১:৩০:২২ দুপুর

http://www.monthlymueenulislam.com/details.php?id=63

রচনায়- মাওলানা আরিফ মাহমুদ

ইসলামের প্রথম প্রভাত হতেই ঘোরতর ইসলাম বিদ্বেষী, ধর্মবেত্তা ও তাদের দালাল, কুলাঙ্গাররা চরম শত্রুতাবশতঃ ইসলাম ও ইসলামের নবীর ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টিতে লিপ্ত হয়। হীনস্বার্থ চরিতার্থের অন্ধ উন্মাদনায় মত্ত হয়ে মুসলিম ও মুসলমানদের নবীর ওপর প্রবল আক্রমণ চালিয়ে আসছে। তারা রাসূলুল্লাহ (সা.)এর অবমাননা ও তাঁর রেসালাতের প্রতি আক্রমণাত্মক মিথ্যা অপবাদ রটিয়ে আসছে। যেন ধর্মপ্রাণ মানুষ তাঁর (সা.) রেসালাতের ওপর ঈমান আনা থেকে বিরত থাকে এবং মুসলমানগণ তাদের ধর্মের ব্যাপারে সন্দেহে নিপতিত হয়।

সে সকল কুলাঙ্গারদের কালো থাবা থেকে রক্ষা পায়নি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর মহৎ উদ্দেশিত বহুবিবাহ বিধানটিও। এ ব্যাপারে ইসলাম বিদ্বেষী অনেকেই উচ্চস্বারে বহু কথাই বলেছে। তারা এ বিষয়ে সন্দেহের ধুম্রজাল সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছে। তারা চেয়েছে এর দ্বারা মহান রেসালাতের অধিকারী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)এর মান-সম্মান ও ইজ্জত-আব্রু লুণ্ঠন করতে। তারা বলে থাকে- অবশ্যই মুহাম্মাদ (সা.) ভোগী প্রকৃতির লোক; যিনি ছিলেন ভোগ, উত্তেজনা ও আনন্দ ফূর্তির ব্যাপারে তৎপর এবং আবেগের দ্বারা পরিচালিত হতেন। তিনি তাঁর অনুসারীদের ওপর এক থেকে চারজন পর্যন্ত স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছিলেন। অথচ তিনি নিজেই একজন থেকে চারজন স্ত্রীর ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। মনের বাসনা অনুযায়ী তিনি বহু সংখ্যক বিয়ে করেছিলেন। তাঁর স্ত্রীর সংখ্যা ছিলো এগার বা ততোধিক। (নাঊযুবিল্লাহ)।

প্রিয় নবী (সা.)এর ওপর এর চেয়ে বড় আঘাত ও অপবাদ পৃথিবীতে আর কি হতে পারে? সততা, পবিত্রতা, নিষ্ঠা, সংযম ও সাধনা ছিলো যাঁর জীবনের একমাত্র ভূষণ। ছলনা, মিথ্যা আর কপটতাকে করেছেন যিনি সারা জীবন ঘৃণা। তিনি যে এত খারাপ চরিত্রের অধিকারী হবেন, এটা নিছক মিথ্যা ও প্রতিহিংসার বেসাতি বৈ কিছুই হতে পারে না। যদি হুযূর (সা.)এর উদ্দেশ্য ভোগ-বাসনা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে চলা কিংবা শুধু নারী সঙ্গের আনন্দ লাভ করা হতো, তাহলে তিনি নিশ্চয় তাঁর পূর্ণ যৌবনেই একাধিক বিয়ে করতেন এবং বিগত যৌবনা ও পৌঢ়া বিধবা তালাক প্রাপ্তা নারীদেরকে বিয়ে না করে সুন্দরী যুবতী ও কুমারীদের বিয়ে করতেন।

পঁচিশ বছরের টগবগে যৌবনকালে চল্লিশ বছরের বৃদ্ধা মহিলা হযরত খাদিজা (রাযি.)কে বিয়ে করতেন না এবং ভরা যৌবনের শেষাব্ধি তাঁর সাথেই অতিবাহিত করতেন না। অথচ বাস্তব সত্য হচ্ছে এটাই যে, তিনি পঁচিশ বছর বয়সে চল্লিশ বছরের বৃদ্ধা হযরত খাদিজা (রাযি.)কে বিয়ে করে তাঁর সাথে যৌবনের মূল সময় তথা পঞ্চাশতম বছর পর্যন্ত অতিবাহিত করেন। এরপর একান্নতম বছর থেকে শুরু করে জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত তথা তেষট্টিতম বছর পর্যন্ত সময়ে (মোট তের বছর) বাকি স্ত্রীদেরকে বিয়ে করেন। তাঁরা আবার একজন তথা হযরত আয়েশা (রাযি.) ছাড়া সকলেই ছিলেন বিধবা। অনেকে আবার ছিলেন বৃদ্ধা। অথচ তিনি হযরত যাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাযি.)কে সুগন্ধিযুক্ত ও সজীব চেহারার দেখে বিয়ে করেছেন কি না প্রশ্নের উত্তরে বিধবা বিয়ের কথা শুনে কুমারী বিয়ে করা উচিৎ বলে মনোভাব প্রকাশ করে বলেন, কুমারী বিয়ে করলে না কেন? তাতে তোমরা দু’জনে মিলে আনন্দ করতে পারতে! (বুখারী শরীফ, কিতাবুন নিকাহ- ২-৭৬০)।

এ হাদীসে হুযূর (সা.) হযরত যাবের (রাযি.)কে কুমারী বিয়ে করার দিকে ইশারা করেছেন। কুমারী বিয়ে করা কামনা পূরণের বড় উপায় জানা সত্ত্বেও তিনি বিধবা বিয়ে করতেন কি? যদি তিনি নারী লোভী হতেন!

নবী কারীম (সা.) একাধিক বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন পবিত্র জীবনের পঞ্চাশটি বসন্ত কেটে যাওয়ার পর। তাহলে কি তিনি যৌবনের মূল সময় তথা পঞ্চাশতম বছর পর্যন্ত ছিলেন চরিত্রবান, আর জীবনের শেষ বয়সে এসে হয়ে গেলেন চরিত্রহীন? এটা কি কোন বিবেক প্রসূত কথা? অথচ তিনি চাইলে সে সময় মক্কার শ্রেষ্ঠ সুন্দরী আর ধনী কুমারীদের বিয়ে করতে পারতেন। অনেকেই তাঁকে এমন উপঢৌকনও দিতে চেয়েছে। যেমন- মক্কী জীবনে কাফিররা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)কে বহু বারই বলে ছিলো যে, ‘আপনি চাইলে আরবের সব চেয়ে সুন্দরী নারীদেরকে আপনার সামনে নিয়ে এসে হাজির করি’। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছিলেন- ‘আমার এক হাতে সূর্য আর অপর হাতে চন্দ্র এনে দিলেও আমি ইসলাম প্রচার থেকে একটুও পিছপা হবো না (ইন্শাআল্লাহ)’। সুন্দর নারীদের প্রতি যদি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর লোভই থাকত (নাউযু বিল্লাহ্), তাহলে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ঐ সময় মক্কার কাফিরদের কথা মেনে নিয়ে সুন্দরী নারীদের হস্তগত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সে দিকে চোখ তুলেই তাকাননি; বরং নিজ দায়িত্বেই ছিলেন অটল। এ থেকে কি প্রমাণিত হয় না যে, তিনি নারী লোভী ছিলেন না?

নিন্দুকরা যদি তাদের শত্রুতা ছেড়ে নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধির আশ্রয় গ্রহণ করে এবং নিরপেভাবে বিচার-বিবেচনা করে, তাহলে তারা অবশ্যই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর একাধিক বিয়ের তাৎপর্য ও মাহাত্ম স্বীকার করে নিতে বাধ্য হবে। তারা খুঁজে পাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর এ বিয়ের মধ্যে মহান মর্যাদাশীল মানুষদের জন্যে একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সাথে সাথে এটাও পাবে যে, বহু বিবাহে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর ব্যক্তিগত ন্যূনতম স্বার্থও ছিলো না; বরং তাতে কেবলই দ্বীনের স্বার্থ সংরণ নিহিত ছিলো।

অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনা নিয়ে বলতে হয় যে, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু পশ্চিমাপন্থী ও সাম্রাজ্যবাদী মহলের দোসর আমার সোনার বাংলার বুকে সুপরিকল্পিতভাবে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)কে নিয়ে ব্যঙ্গ, কটূক্তি ও উপহাস করে বক্তব্য প্রদান ও নাটক সম্প্রচার করছে।

গত ২৭ মার্চ ২০১২ খ্রীঃ মঙ্গলবার সাতীরার কালিগঞ্জের ফতেপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ‘স্বাধীনতা দিবস’ উপলে আয়োজিত নাট্যানুষ্ঠানে স্থানীয় নাট্যকার মীর শাহিনুর রহমান ও বিদ্যালয়ের সহকারী হিন্দু শিক্ষিকা মিতা রাণী কর্তৃক উপস্থাপিত “হুযূর কেবলা” নাটকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)কে নারী লোভী বলে আখ্যায়িত করে (নাউযুবিল্লাহ্)। কারণ হিসাবে বলে, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মুহাম্মাদ (সা.) ১১ জন নারী বিয়ে করলেন কেন? অথচ বহুবিবাহ কেবল রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর আদর্শ নয়; বরং সকল জাতিতেই এই প্রথা চালু ছিলো। গ্রীক, চৈনিক, ভারতীয়, ককেশীয়, আশেরীয়, মিশরীয় প্রভৃতি সব জাতিতেই এ প্রথা চালু ছিলো। এ জাতিগুলোতে বহুবিবাহ প্রথা চালু ছিলো শুধু তাই নয়; বরং তারা এর কোন সীমা সংখ্যাও মেনে চলতো না। চীনের ‘লেসকী’ আইনে তো একশ ৩০ জন পর্যন্ত স্ত্রী রাখার অনুমতি ছিলো। চীনের জনৈক শাসকের স্ত্রীর সংখ্যা প্রায় ত্রিশ হাজার ছিলো বলেও শোনা যায়।

পশ্চিম বাংলার একজন জনপ্রিয় উপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘প্রথম আলো’ উপন্যাসে ব্রিটিশ ভারতের সময়কাল ১৯০০ সালের দিকে ত্রিপুরার মহারাজ বীর চন্দ্র মানিক্যের স্ত্রী ব্যতীত যে আরো অনেক রীতা ছিলো, এ তথ্য খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই রীতাদের ঘরে বীর চন্দ্র মানিক্যের অনেক সন্তানও ছিলো, যাদেরকে বলা হতো- মহারাজার পৌরষত্যের প্রতীক। আর রীতাদেরকে ভদ্র ভাষায় উপ-পত্নী বলা হতো। তাদের যখন ৪০ বছর বয়স পেরিয়ে যেত, তখন রাজা মানিক্য লাথি মেরে তাদেরকে রাজপ্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দিতো। তাদের ছিলো না কোন সামাজিক স্বীকৃতি, আর ছিলো না কোন নিরাপত্তা। এমনকি তাদের সন্তানরাও পিতৃ পরিচয় ছাড়াই বড় হতো। ১৯০০ সালের দিকে যদি সমাজপতিরা বিয়ে বহির্ভুত উপায়ে কোন সামাজিক স্বীকৃতি ছাড়াই নারীদেরকে এভাবে ভোগ করে, তাহলে একটু চিন্তা করে দেখুন, ১৭০০-১৮০০ সালের দিকে ঐসব দেশে মেয়েদের অবস্থা কি ছিলো? এছাড়াও আদিকাল হতে আল্লাহ্র সেরা নবী-রাসূলগণও একাধিক বিবাহের আদর্শ পালন করে আসছেন। এ ব্যাপারে খ্রীস্টজগতের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলেও যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন- হযরত ইব্রাহীম (আ.)এর তিনজন স্ত্রী ছিলো। আদি পুস্তক (১৬=৪-১২)। হযরত ইয়াকূব বা ইসরাঈল (আ.)এর চারজন স্ত্রী ছিলো। হযরত মূসা (আ.)এর চারজন স্ত্রী ছিলো। তাওরাতে আল্লাহ্ তাআলা হযরত মূসা (আ.)কে সংখ্যা নির্ধারণ না করে যত ইচ্ছা বিবাহ করার অনুমতি দিয়ে ছিলেন। (দ্বিতীয় বিবরণ- ২১=১০-১৩)। হযরত দাঊদ (আ.)এর ১৯ জন স্ত্রী ছিলো। (বাইবেল ২ শামুয়েল ৩ অধ্যায় ২-৫) ২ শামুয়েল, ২০=৩)। তাওরাতে আরো বলা হয়েছে যে, হযরত সুলাইমান (আ.)এর ৭০০ স্ত্রী এবং ৩০০ দাসী ছিলো।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, বহুবিবাহ শুধু আমাদের মহানবী (সা.) করেছিলেন এমন নয়; বরং প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মানুষ যাদেরকে আল্লাহ্ প্রেরিত পয়গাম্বর বলে বিশ্বাস করে এবং অন্তর দিয়ে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে, তারাও বহু বিবাহ করেছিলেন। তাহলে কেন তাদেরকে বহু বিবাহের কারণে কামুক, লম্পট, কপট ও নারীলোভী বলা হয় না? অথচ মানবতার মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)এর ওপর তারা এ কারণে জঘন্য অপবাদ দিচ্ছে? এটা কি বিদ্বেষ নয়?

রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর বহুবিবাহের মাহাত্ম ও উদ্দেশ্যঃ পাপ-বিদগ্ধ তৃষিত এ বসুন্ধরায় রাহমাতুল্লিল আলামীনের আগমনে পাপাচারের সয়লাবে ডুবন্ত এ ধরণী ফিরে পেয়েছিলো নতুন প্রাণ। বিদূরিত হয়েছিলো তাঁর হিদায়াতের নূরানী রোশনীতে অজ্ঞতা ও ভ্রষ্টতার কালো আঁধার। হয়ে উঠেছিলো সারা বিশ্ব খুশীতে মাতোয়ারা ও আনন্দে আত্মহারা। তিনি ছিলেন সর্বোত্তম আখলাক, মহান চরিত্র, সুন্দর ও সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শের ক্ষেত্রে সমগ্র মানবতার ইমাম ও অগ্রনায়ক। তাঁর প্রত্যেক পদেক্ষেপই ছিলো আদর্শের রূপরেখা। তেমনি ছিলো তাঁর বহু বিবাহের মাঝে অসংখ্য আদর্শ ও হিকমত। নিম্নে তার কয়েকটি মৌলিক আদর্শের নমুনা দেয়া হলো-

১. শিক্ষাদানঃ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর একাধিক বিবাহের মূল উদ্দেশ্য ছিলো- ইসলামী আহকাম সম্পর্কে অজ্ঞ মেয়েদের জন্যে এমন কতগুলো শিক্ষিকা মহিলার ব্যবস্থা করা, যাঁরা ইসলামী হুকুম-আহকামের শিক্ষাদান করবে। কেননা, পুরুষদের ওপর যে সমস্ত আহকাম পালনের নির্দেশ রয়েছে, মেয়েদের ওপরও ঐ সমস্ত আহকাম পালনের নির্দেশ রয়েছে। বিশেষ করে নারী সম্পর্কীয় ও দাম্পত্য জীবনের গোপনীয় ব্যাপারে। যেমন- হায়েয, নিফাস ও পাক হওয়া, স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কীয় মাসয়ালা। এ ধরনের আহকাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে অধিকাংশ মেয়ে লজ্জাবোধ করতেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর নিকট উপরোক্ত মাসয়ালাসমূহ থেকে কোন একটা মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাদের লজ্জা হতো। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর স্ত্রীদের পক্ষেই এই সবের ব্যবস্থা করা এবং তাদেরকে শিক্ষা দেওয়া সম্ভব ছিলো। আবার অনেক সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা.) কিছু বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য পেশ করতে লজ্জা করতেন। তাই ইশারার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিতেন। কিন্তু অনেক মহিলা তা বুঝতে সম হতেন না। ফলে তাদের শিক্ষা দেয়ার জন্যে শিক্ষিকার প্রয়োজন ছিলো। যা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর বিবিগণের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করেছে। যেমন- হযরত আয়েশা (রাযি.) বলেন, আল্লাহ্ তাআলা আনসার মেয়েদের রহম করুন। যাদের লজ্জাবোধ দ্বীনের জ্ঞান অর্জনে বাধা দেয়নি। তারা রাতের আঁধারে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর কাছে দ্বীনের আহকাম জানার জন্যে আসতেন। হায়েয, নিফাস ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক সমাধান শিক্ষা নিতেন। এভাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর প্রত্যেক স্ত্রীই ছিলেন তাদের জন্যে উত্তম শিক্ষিকা ও পথপ্রদর্শিকা। তাদের বদৌলতে মেয়েরা ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করেছে। অন্যদিকে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর এমন অনেক কাজ আছে, যেগুলো তাঁর বিবিদের মাধ্যমেই আমরা পেয়েছি। অন্যথায় তা অর্জনে অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হতো।

২. সাম্য নীতি প্রতিষ্ঠা : ইসলাম মানবতার ধর্ম, গণমানুষের ধর্ম। একজন অপরজনকে বুকে টেনে নেয়ার ধর্ম। ইসলামে আমীর-প্রজা, দাস-প্রভু, পত্নী-দাসী সবাই সমান। মানুষ মাত্রই মানুষের নিকট সম্মানের অধিকারী। সমান মর্যাদার হকদার। ইহুদী-খ্রীস্টান, চামার, চন্দাল, কুমার, তাঁতী, জেলে, কৃষক প্রভৃতি সকলেই ইসলামের চোখে সমান মর্যাদার। তবে যে যত বড় আল্লাহ্ভীরু এবং যার মধ্যে যত বেশি গুণ আছে, সে তত বড় মর্যাদার অধিকারী। এ নীতি কাজে পরিণত করাও বহুবিবাহের অন্যতম কারণ। হযরত সাফিয়া ও জুয়াইরিয়া (রাযি.) দাসী রূপে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর হাতে এসেছিলেন। বিশেষতঃ হযরত জুয়াইরিয়া (রাযি.) বেদুঈন দস্যু দলপতির মেয়ে ছিলেন। আর হযরত সাফিয়া (রাযি.) ছিলেন ইহুদীর মেয়ে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁদেরকে বিয়ে করে হযরত আয়িশা (রাযি.), হাফসা (রাযি.), মায়মূনা (রাযি.) প্রমূখ অভিজাত শ্রেণীর পত্নীদের সমান মর্যাদা দান করেছেন। তাঁরা সকলেই আজ উম্মুল মুমিনীন মর্যাদায় অভিষিক্ত।

৩. ধর্মীয় বিধান জারিঃ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর বহুবিবাহের অন্যতম হিকমত হলো- ধর্মীয় বিধান জারি ও জাহেলী যুগের ঘৃণ্য অভ্যাসকে বাতিল করা। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে- ‘পালক আত্মীয়তার প্রথা’। ইসলাম আসার পূর্বে আরববাসীরা অন্যের ছেলেকে পালক নিতো। তারা নিজেদের ঔরসজাত সন্তান নয় এমন কাউকে পালন করত এবং নিজেদের উত্তরাধিকারী ছেলের মত গন্য করত। নিজের ছেলের ওপর আরোপিত সকল বিধান তার জন্যও প্রযোজ্য মনে করত। যেমন- উত্তরাধিকারী, তালাক, বিয়ে, মুহাররামাতে মুছাহারা এবং মুহাররামাতে নিকাহ ইত্যাদির ক্ষেত্রে। এটা তাদের বর্বরতার যুগের অনুসৃত দ্বীন হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। অপরদিকে ইসলাম আসেনি তাদেরকে বাতিলের ওপর অটল রাখার জন্যে। আসেনি তাদেরকে অজ্ঞতার অন্ধকারে পাগলামী করার উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেয়ার জন্যেও। তাই আল্লাহ্ তাআলা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর মাধ্যমে যায়েদ বিন হারিস (রাযি.)কে লালন-পালন করান এবং তাঁর পালক পুত্র হিসাবে প্রসিদ্ধ লাভ করান। এমনকি তাঁকে যায়েদ বিন মুহাম্মদ বলা হতো। এক পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর ফুফাত বোন হযরত জয়নাব (রাযি.)এর সাথে বিবাহ বন্ধনে অবদ্ধ করেন। তাদের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় হযরত যায়েদ (রাযি.) জয়নাব (রাযি.)কে তালাক দিলে আসমানে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। এর মাধ্যমে জাহেলী যুগের ঐ প্রথাকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করেন এবং ঘোষণা করেন, পালক পুত্র আপন পুত্রের মত নয়। পালক পুত্রের তালাক দেওয়া স্ত্রীর সাথে পালক শ্বশুরের বিয়ে বৈধ।

৪. নারীত্বের মর্যাদা দানঃ ইসলাম পূর্ব যুগে নারীদেরকে তদানীন্তন আরববাসী পশুতুল্য মনে করত। তাদের না ছিলো কোন মান-মর্যাদা, আর না ছিলো সুন্দরভাবে জীবনযাপন করার অধিকার। বিশেষ করে বিধবাদের দুর্গতি ছিলো সবচেয়ে বেশি। মানুষের মত বেঁচে থাকার অধিকার ছিলো না তাদের। এজন্যেই মানবতার নবী, গণমানুষের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বিধবা নারীদেরকে বিবাহ করে কুমারীদের সমান মর্যাদা দান করতঃ বিশ্বজগতের সম্মুখে একটা উন্নত আদর্শ তুলে ধরেছেন; যা মানবেতিহাসে নজিরবিহীন। হযরত সাওদা (রাযি.), হযরত উম্মুল মাসাকীন জয়নাব (রাযি.) ও হযরত উম্মে সালামা (রাযি.)কে তিনি এই কারণেই বিয়ে করেছিলেন।

৫. সমতা বিধানঃ একাধিক স্ত্রীদের কিভাবে রাখতে হবে এবং তাদের সাথে কিরূপ আচার-আচরণ করতে হবে, এই আদর্শ স্থাপন করাও ছিলো রাসূল (সা.)এর বহুবিবাহের একটি মহান উদ্দেশ্য।

৬. সামাজিক হিকমতঃ রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বংশগত সম্পর্ক স্থাপন এবং তা অটুট রাখার উদ্দেশ্যে বহুবিবাহ করেছেন। যেন একারণে তারা ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়েন। যেমন- সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর সবচেয়ে প্রিয় ও সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদাবান ব্যক্তিত্ব হযরত আবু বকর (রাযি.)এর আদরের কন্যা আয়িশা (রাযি.) ও আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর ফারুক (রাযি.)এর কন্যা হযরত হাফসা (রাযি.)কে বিবাহ করেন। যার ফলে তাঁদের অন্তর রাসূল (সা.)এর দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তাঁরা আল্লাহ্র মহত্ব ও সম্মানের প্রতি ঈমান আনার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর দাওয়াতের দিকে আকৃষ্ট হন।

৭. রাজনৈতিক হিকমতঃ মানবতার মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কোনো কোনো উম্মাহাতুল মুমিনীনকে বিয়ে করেছেন তাঁর গোত্রের সাথে সম্পর্ক ও আত্মীয়তা করার ল্েয। কারণ, এটা অবিদিত নয় যে, নিশ্চয় মানুষ যখন কোন এক গোত্রে কিংবা কোন এক সম্প্রদায় হতে বিয়ে করে, তখন তাদের উভয়ের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আর এরই মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে সেই ব্যক্তি নতুন সম্পর্কিত গোত্রের লোকদের সাহায্য ও সহযোগিতার আহ্বান করে। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি উপমা পেশ করা হলো-

রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর বনূ মুসতালাক গোত্রের নেতা হারেসের কন্যা জুয়াইরিয়া (রাযি.)কে বিয়ে করাঃ হযরত জুয়াইরিয়া (রাযি.) সম্প্রদায় ও আত্মীয়-স্বজনসহ বন্দী হয়ে আসার পর স্বীয় সত্ত্বাকে মুক্ত করার জন্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর কাছে আর্থিক সাহায্য প্রার্থনা করলে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে তাঁর মুক্তিপণ পরিশোধ করে নিজের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। হযরত জুয়াইরিয়া (রাযি.) এ প্রস্তাবে সম্মতি দিলে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে বিয়ে করে নেন। অতঃপর সাহাবাগণ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর শ্বশুর সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে আত্মীয়তার দিকে ল্য করে সকল বন্দীদের মুক্ত করে দেন। তারাও সাহাবাদের এই মহত্ব, উদারতা , বুদ্ধিমত্তা ও চুলজ্জা দেখে সবাই ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন এবং সবাই আল্লাহ্র দ্বীনের পতাকা তলে সমবেত হন ও মুসলিম হিসাবে আত্মপরিচয় লাভ করেন। জুয়াইরিয়া (রাযি.)এর সাথে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর এ বিয়েই তাঁর নিজের এবং তাঁর সম্প্রদায় ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্যে সৌভাগ্যস্বরূপ এবং ইসলাম গ্রহণ ও মুক্তি লাভের কারণ হয়।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বিয়ে করেন সুফিয়া বিনতে হুয়াই বিন আখতাবঃ যিনি খায়বারের যুদ্ধে স্বামীর মৃত্যুর পর বন্দী হয়ে এসেছিলেন এবং কোন মুসলমানের ভাগে পড়ে ছিলেন। তখন বুদ্ধিমান ও সমঝদার সাহাবাগণ বলেন, তিনি হলেন কুরায়যা গোত্রের নেত্রী, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)এর ভাগে পড়া ছাড়া অন্য কারো ভাগে পড়া উচিৎ হবে না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.)কে এ বিষয়টা জানানো হলে, তিনি সুফিয়া (রাযি.)কে দু’টি বিষয়ে এখতিয়ার প্রদান করেন-

(ক) তাঁকে মুক্ত করে নিজ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে নিবেন।

(খ) দাসত্বের বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেবেন। অতঃপর সে তাঁর পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে যাবেন। সুফিয়া (রাযি.) রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর উত্তম ব্যবহার, মহত্ব ও মর্যাদা দেখে আযাদ হয়ে তাঁর (সা.) স্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে বিয়ে করে নেন। যার ফলে তাঁর গোত্রের অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন।

একইভাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) উম্মে হাবীবা (আবু সুফিয়ানের কন্যা রমলা)কে বিয়ে করেনঃ যে আবু সুফিয়ান সে সময় ইসলামের ঘোর শত্রু ছিলেন এবং শিরকের পতাকাবাহী ছিলেন। তিনি যখন আপন মেয়ে রমলাকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর বিয়ের সংবাদ শুনেন, তখন তা স্বীকৃতি দেন। সাথে সাথে তিনি ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়েন। একপর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করে নামের সাথে যোগ করেন রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হয়ে যান ইসলামের এক বিপ্লবী সিপাহসালার।

সুতরাং এ থেকে বুঝা যায় যে, এই বিয়ে ছিলো তাঁর ও মুসলমানদের কষ্টকে লাঘব করার জন্যে এবং তাই ঘটেছে। এর চেয়ে উত্তম রাজনীতি আর কি হতে পারে? তার চেয়ে ভাল কোন হিকমত আর আছে কি? এ ছাড়াও রাসূলুল্ল্হ্ (সা.)এর বহুবিবাহের আরো অনেক হিকমত ও উদ্দেশ্য রয়েছে, যার বর্ণনা এই সংপ্তি পরিসরে সম্ভব নয়।

তথ্য সহায়কগ্রন্থঃ ১. সীরাতে মোস্তফা, ২. ইসলাম ও পাশ্চাত্য সমাজে নারী, ৩. মালফূজাতে আহমদ শফী (দা.বা.), ৪. শি’আরে ইসলাম (স্মারক ২০১২), ৫. মাদারিজুন নবুওয়াত, ৬. রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর একাধিক স্ত্রী সম্পর্কে সন্দেহ ও ভ্রান্তি মতবাদ।

[উচ্চতর হাদীস গবেষণা বিভাগ, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী-এর বিষয় ভিত্তিক মাসিক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত প্রবন্ধ]

তত্ত্বাবধানে- আল্লামা হাফেয মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী, প্রখ্যাত মুহাদ্দিস- দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী।

বিষয়: বিবিধ

১৯৬৮ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

214814
২৯ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০২:০৭
সুশীল লিখেছেন : Yawn Yawn Yawn Applause Applause
২৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৮:৪৯
163229
বিন হারুন লিখেছেন : Good Luck Good Luck Good Luck
214871
২৯ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৪:০৬
আহ জীবন লিখেছেন : উপকৃত হলাম। গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট এর জন্য আপনাকে সালাম জানাচ্ছি।
আসসালা মুআলাইকুম।
২৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৮:৫০
163232
বিন হারুন লিখেছেন : ওয়ালাইকুমুস সালা-ম, ওয়ারাহ্ মাতুল্লাহ্. ধন্যবাদ Good Luck
215018
২৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৮:৪৩
খেলাঘর বাধঁতে এসেছি লিখেছেন : সে সময়, বিবি খাদিজার খেয়েপরে ভবঘুরে, ভাউরা মোহাম্মদের পক্ষে আর কিবা কার ছিল?

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File