আমার প্রবাসের দিনাতিপাত

লিখেছেন লিখেছেন বিন হারুন ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৯:৩০:৫৯ রাত

সকালে ঘুম ভাঙতো মায়ের ডাকে. অনেক সময়তো ঘুম থেকে যতক্ষণ মায়ের গর্জন শুনতাম না, ততক্ষণ ঘুমিয়েই থাকতাম. অনেক সময় মায়ের বেতের মৃদু প্রহারে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাযের জন্য মসজিদের দিকে দৌড়ে যেতাম. নামাজ শেষে কুরআন তেলাওয়াতের পর নাস্তা খেয়ে আবার পড়তে বসা, ঘন্টা দেড়েক পড়াশুনার পর গোসল করা, শীতকালে তো মায়ের বকুনি না খাওয়া পর্যন্ত গোসলই করতাম না. তারপর সকাল দশটার আগেই গরম গরম ভাত. শিক্ষালয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের নাস্তা, শিক্ষালয় থেকে এসে ব্যগ কাঁধ থেকে নামিয়ে অনেক সময় খানা না খেয়ে মায়ের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে খেলতে চলে যেতাম. সন্ধায় মাগরিবের নামাযের পর ঘরে ফিরলে মায়ের বকুনি শুনতে শুনতে খাবার খেতে হত বিকেলের খাবার খেতে সন্ধা হয়ে গেছে বলে. খাবার খেয়ে উঠতে না উঠতে গৃহ শিক্ষক উপস্থিত. শিক্ষক চলে যাওয়ার পরও রাত দশটা পর্যন্ত পড়তে হত. শীত গরম কোন পার্থক্য ছিল না. রাত দশটার আগে খাবার নেই, কারন খাবার খেলে ঘুম পায়.

খাবার শেষে মশারি টাঙানো পরিপাটি বিছানা. খাটে কম্বলও খোলা যাতে খুলতে আমার কষ্ট না হয়. আহা বেচারি মায়ের আদর-যত্ন, তাঁর কষ্টের কথা কখনো অনুভব করিনি. বরং উল্টো মনে করতাম: মা হলে এসব করতেই হয়.

কোনদিকে বড় হয়ে গেলাম Love Struck অতীতের দিখে দেখলে মনে হয় দু'বছর আগেই মা গোসলের সময় আমার পিঠ ডলে গোসল করায়ে দিচ্ছেন. অথচ মধুর সেই ছাত্র জীবন হারিয়েছি আরো দশ বছর আগে.

ছাত্র-জীবন শেষ করে বেকার থাকতে বড়ই লজ্জাবোধ করতাম. তাই একটি প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্টানে চাকুরি নিয়ে ছিলাম. শিক্ষকতা করেছিলাম আট বছরের কিছু কম. শিক্ষকতায় বেতন কম তাতে কি, পথে-ঘাটের সালাম, সম্মান, দামী টিউশনির কারনে বেতনের কথা মনেই হতো না. ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে কোনদিকে আট-টি বছর শেষ করে ফেললাম নিজেও বুঝিনি.

এখন প্রবাসী: প্রবাস জীবন ঠিক তার উল্টো. প্রবাসে যারা ব্যবসা করেন তারা স্বাধীন আছেন. আর যারা চাকুরি করেন চাকুরিতে কত কষ্ট তা একমাত্র চাকুরিজীবিরাই বলতে পারবেন. (হয়তো দু'একটি ভাল আছে)

আমার প্রবাস জীবন: আমি একটি অফিসে কর্মরত আছি, মন্দের ভাল'র মধ্যে আছি. একটি বিশ মিটার কক্ষে কখনো নয়জন কখনো দশজন থাকি (দেশে নিজের খাটে ছোট ভাই থাকতে চাইলেও রাখতাম না). কারন পাঁচ/ছয়জনের রুমে থাকলে বেতনের সাথে পোষাবে না. আমার দিন যায়: ফজরের নামাযের পর গোসল সেরে সকাল সাতটার দিকে ঘুম থেকে উঠে টয়লেটে লাইন ধরা কারণ পঁচিশ ত্রিশ জনের জন্য দু'টি বাথরুম. আর প্রায় সবার অফিস শুরু হয় আট থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে. তাড়াহুড়ো করে দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে চা'য়ের দোকানে গেলে সেখানেও থাকে লোকজট কারণ সবার ডিউটির সময় হয়ে যাচ্ছে. কোন রকমে নাস্তা করে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অফিস খুলতে কোন কোন সময় গ্রাহক বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে. মনে যতো যন্ত্রণা থাকুক সবকিছু চাপা দিয়ে গ্রাহকের সাথে মুচকি হাঁসি দিতে হয় ব্যবসার স্বার্থে. শুরু হয় কর্ম, কখনো কখনো বিশেষ করে বৃহস্পতিবার বিকেলে, শুক্রবার, শনিবার সকালে ব্যস্ত থাকি না কারন তখন সরকারি অফিস গুলো বন্ধ খাকে, সরকারি অফিস বন্ধ খাকলে আমাদের কাজের চাপ কম থাকে. আর তখন অনলাইনে খবর দেখা, পেইজ বুক ঘাটা বেশির ভাগ ব্লগেই থাকি. অফিসে কাজ না খাকলেও অফিসে বসে খাকতে হয় এটাও কম বিরক্তিকর নয়. ছুটি হয় দুপুর দেড়টায় মাঝখানে জামাতে নামাজের সুযোগ পাই এটাও কিন্তু কম নয়. দেড়টার সময় রুমে গিয়ে ভাত রান্না করে খেতে হয়. বেশিরভাগ সময় একটা তরকারি দিয়েই খেতে হয় কারন দু'টি পাকানোর সময় কোথায়? চারজন মিলে মেস খাই, তাই চারদিনের মাথায় একবার তরকারি পাকাতে হয়, মেসে সবাই চায় গোস্ত রান্না করতে, কারন তাতে কাটা-কাটির ঝামেলা নেই. কাটা-কাটির ঝামেলার কারনে কেউ শাক-সব্জি বানাতে চায় না. অথচ সব্জি সবাই পছন্দ করি. মাঝে মধ্যে বিশেষ করে শুক্রবারে বা অফিস ছুটি পেলে দুই তিন ধরনের খাবার রান্না করা হয়, অথচ আমাদের দেশে একটি গরিবের ঘরেও বেশির ভাগ সময় দুই-তিন রকমের তরকারি থাকে. খাবার খেয়ে ঘুমতো যেতে বাজে দুপুর তিনটা, ঘন্টা দেড়েক ঘুমিয়ে আসরের নামাজ পড়ে একটা খালি চা নিয়ে আবার অফিসে. রাত দশটা সাড়ে দশটা বাজে অফিস শেষ করে রুমে এসে আবার ভাত রান্না করা, তরকারী বানানো, খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বসে আড্ড়া মারা, অথবা স্কাইপিতে কথা বলা, অথবা ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে স্যাটিং করতে করতে রাত সাড়ে বারটায় ঘুমুতে যাওয়া. শুক্রবার এলে কাপড় ধোয়া, কাপড় ইস্ত্রী করতে করতে সময় চলে যায়.

এসব কষ্ট মা যদি দেখতেন হাসতেন কিনা কাঁদতেন জানি না. তবে চাচী দেখলে বলতেন "জীবনে মাকে অনেক জালিয়ে খেয়েছিস এখন মঝা বুঝ".

আসলে মানুষ অনেক স্বপ্ন পূরণের আশায় প্রবাসী হয়. প্রবাসী হওয়া যত কঠিন তার চেয়েও কঠিন প্রবাস থেকে দেশে ফিরতে. প্রবাসে এসে দেশকে কত অনুভব করি তা কি করে প্রকাশ করব? পরিশেষে বলব দেশের মানুষ যতটা দেশকে ভালবাসে তার চেয়েও বেশি ভালবাসে প্রবাসিরা.

বিষয়: বিবিধ

১২৯৬ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

177069
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০৯:৫০
জেদ্দাবাসী লিখেছেন : মাশাল্লাহ বাস্তব অভিজ্ঞতার সুন্দর সাবলীল বর্ননা ভালো লাগলো । আরও লিখুন ।
যাজাকাল্লাহ খায়ের
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ১০:৩৩
130228
বিন হারুন লিখেছেন : মূল্যবান সময় ব্যয় করে পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ. ইনশা-আল্লাহ আরও লেখার আশা আছে. ভাল থাকুন এই প্রত্যাশায় Good Luck
177085
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ১০:৩৩
প্রবাসী আব্দুল্লাহ শাহীন লিখেছেন : এসব কষ্ট মা যদি দেখতেন হাসতেন কিনা কাঁদতেন জানি না. তবে চাচী দেখলে বলতেন "জীবনে মাকে অনেক জালিয়ে খেয়েছিস এখন মঝা বুঝ".

প্রবাস জীবনের ইতিহাস একমাত্র প্রবাসী ছাড়া কেউ বলতে পারেনা। আপনার প্রবাসে আসা সফল যেন হয় সেই দোয়া করি আল্লহর কাছে।
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ১০:৩৭
130229
বিন হারুন লিখেছেন : আ-মীন. মহান রব আমাদের সবাইকে কামিয়াব করুন. Good Luck Good Luck
177094
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ১১:০৪
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ১১:০৯
130240
বিন হারুন লিখেছেন : Good Luck Good Luck Good Luck :Thinking Good Luck Good Luck Good Luck
177116
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ১১:৫৫
প্যারিস থেকে আমি লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ১০:১৭
130359
বিন হারুন লিখেছেন : মূলবান সময় ব্যয় করে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ. Happy
177117
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ১১:৫৬
আলোর আভা লিখেছেন : দেশের মানুষ যতটা দেশকে ভালবাসে তার চেয়েও বেশি ভালবাসে প্রবাসিরা আপনার এই কথাটার সাথে ১০০% একমত ।

লেখাটা কষ্টের হলেও ভাল লেগেছে ধন্যবাদ ।
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ১০:১৯
130360
বিন হারুন লিখেছেন : মাস শেষে যখন দেশের জন্য টাকা পাঠাতে ব্যাংকের লাইনে দাঁড়াই তখন সব কষ্ট, সুখ হয়ে ধরা দেয়. সাথে থাকার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ Happy
177172
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ০৬:৫৫
ফাতিমা মারিয়াম লিখেছেন : নিজস্ব অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা পোস্টটি বেশ ভালো হয়েছে। লিখতে থাকুন। ধন্যবাদ Rose
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ১০:২৩
130366
বিন হারুন লিখেছেন : প্রবাসী হওয়ার আগে এসব কষ্ট কখনো কল্পনা করিনি. দু'একটি কষ্টের কথা পুরনোদের থেকে শুনলেও তা পুরোপুরি বিশ্বাস করতাম না. আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ Good Luck
177267
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ১১:৫৮
বৃত্তের বাইরে লিখেছেন : প্রবাসীর কষ্ট একমাত্র প্রবাসীরাই বুঝে। ভালো লাগলো। আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ Good Luck Rose
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ১২:২৪
130416
বিন হারুন লিখেছেন : "প্রবাসীর কষ্ট একমাত্র প্রবাসীরাই বুঝে" ধন্যবাদ আপনাকেও অনেক অনেক Good Luck Good Luck
177716
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ১১:১২
সায়েম খান লিখেছেন : 'অভাব নামের দানব আমায়
আনলো এ প্রবাসে,
ভাগ্যের চাকা ঘোরাই মাগো
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে।
পড়েছ মা ছিন্ন শাড়ি
আমি কি তা দেখতে পারি?
বিদেশ এলাম তাই...
দুঃখী মায়ের মুখে সুখের হাঁসি
ফোটাতে যে চাই '

আসলেই প্রবাদ জীবন অত্যন্ত কষ্টের ...।
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ১১:১৫
130843
বিন হারুন লিখেছেন : Thumbs Up অনেক সুন্দর Rose
179335
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ১১:১৫
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : দেশের মানুষ যতটা দেশকে ভালবাসে তার চেয়েও বেশি ভালবাসে প্রবাসিরা - খাঁটি কথা Thumbs Up Thumbs Up Thumbs Up Rose Rose Rose
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০৩:২৫
132385
বিন হারুন লিখেছেন : অনেক অনেক ভাল লাগল সহমত-পোষণ করার জন্য Happy

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File