আব্বুর গায়ের গন্ধটাও আর আগের মত নেই

লিখেছেন লিখেছেন সিমপল ০৯ এপ্রিল, ২০১৪, ০৮:১৫:৩৫ রাত



আমার আব্বু নেই আব্বুকে অনেক মিস করি । একেক সময় আব্বুর কথা মনে পড়ে এত বেশী কষ্ট হয় যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না ।আব্বুকে অনেক ভালবাসি আমার আব্বুও আমাকে অনেক ভালবাসত ।কারন আমি আমার আব্বুর একমাত্র মেয়ে ।আমার আম্মুর পর পর দুইটা ছেলে সন্তান আর আমার মায়ের কিছুটা শারিরীক সমস্যা থাকার কারনে ডাক্তার আমার মাকে তৃতীয় সন্তান নিতে বারন করে ।

আমার আব্বুর অনেক শখ একটা মেয়ের তাই প্রায় নয় বছর বিরতির পর আমার মা জীবনের ঝুকি নিয়ে তৃতীয় বারের মত গর্ভবর্তী হন । আল্লাহ আমার আব্বুর মনের ইচ্ছা পূরণ করেন আমার জন্ম হয় ।

আমার আব্বু নিজের নামের সাথে মিলিয়ে আমার নাম রাখেন ।যদিও আমার আব্বু আমাকে কখনো নিদৃষ্ট নামে ডাকেন নি কখনো মা কখনো শাশুরী ,মনি ,জানো ,পরাণ ,মানিক এরকম আরো অনেক কিছু যখন যা মনে আসত বাবা আমাকে তাই বলে ডাকতেন ।

আমার আব্বু ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আব্বু ছিলেন কড়া মেজাজের আমার ভাইয়ারা কখনো আব্বুর সামনে মাথা উচু করে কথা বলতে সাহস পেত না ।একমাত্র আমার বেলায় আব্বু ছিলেন ব্যাতিক্রম আব্বু কখনো আমার সাথে রাগ করতে পারতেন না। এই কারনে শেষ মেশ এমন অবস্থা হল বাসায় কেউ কোন ভুল করলে সেটা আব্বুর সামনে আমার নাম বলা হত ।যদি আমার আব্বুর বিচক্ষণতার কাছে সেটা বেশীক্ষন টিকত না ।

আব্বুর হাত ধরেই আমার সবকিছু শুরু হয় পড়া লেখা ,স্কুলে যাওয়া ,সাইকেল চালানো,সাতার শিখা । আব্বু কে প্রচন্ড ভালবাসতাম আর আব্ব্বুর সবকিছু ভাল লাগত আব্বুর বুদ্ধী ,বিচক্ষণতা ,হাটা চলার ষ্টাইল,কথা বলার ষ্টাইল, আব্বুর আত্বনির্ভরতা ।আমার আব্বু কখনো নিজের কাজ কাউকে করতে দিতেন না ,নিজের জামা কাপড় নিজে ধুতেন ,খাওয়ার পর নিজের প্লেট গ্লাস সব সময় ধুয়ে রাখতেন ।আব্বুর এসব দেখে এত ভাল লাগত সব সময় আব্বুকে অনুকরন করার চেষ্টা করতাম ।মনে মনে এও সিন্ধান্ত নিলাম পড়া লেখা শিখে আব্বুর মত আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হব ।

আব্বুর আর একটা জিনিস ভীষন ভাল লাগত যা একসময় নেশার মত হয়ে যায় ।আব্বুর গায়ের গন্ধ যা না হলে আমার ঘুমই আসত না ।৬বছর বয়স পর্যন্ত আব্বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতাম ।আরো দুই বছর বিছানা আলাদা হলে আব্বুই আমাকে ঘুম পারিয়ে রেখে যেতেন ।দিনের মাঝে যখনই এই নেশা চাপত আব্বুকে যেয়ে জড়িয়ে ধরতাম আর আব্বুর গায়ে নাক ঘসতাম ।

আস্তে আস্তে বড় হলাম আগের মত আব্বুকে জড়িয়ে ধরতে পারি না নিজের কাছেই সংকোচ লাগে কিন্তু নেশা তো যায় না ।কি করব আব্বুর শার্ট ,গেন্জি নিয়ে শুকতাম এভাবেই দিন চলে যাচ্ছিল ।

আমি ক্লাস ফাইব শেষ করে সিক্স

শুরু করেছি এই সময় আমার আব্বু বিশ্ববিদ্যায়রের চাকরি রিজাইন দিয়ে একটা সরকারি অফিসের বড়কর্তা হয়ে ঢাকায় চলে আসেন ।সাথে আমি আর আম্মু আমার ভাইয়ারা ওখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থেকে গেলেন ।

সময় গড়িয়ে যায় বড় ভাইয়া পড়া লেখা শেষ করে একটা ব্যাংকে জবে ডুকলেন ছোটভাইয়ার ও প্রায় শেষের দিকে আমি এস এস সি তে খুবই ভাল রেজাল্ড করে ঢাকাতেই একটা ভাল কলেজে ভর্তি হলাম ।

হঠাত করেই আব্বুর টয়লেটে সমস্যা দেখা দেয় প্রথমে মনে করা হল পাইলস । ঢাকায় অপারেশন করা হল তখন দেখা গেল এটা পাইলস নয় ক্যানসার ।আরো একটা অপারেশন করতে হবে ।যে ডাক্তার আব্বুর অপারেশন করলেন সে জানাল এর আগে সে এই রকম দুইটা অপারেশন করেছেন কিন্তু স্যাকসেসফুল হতে পারেন নাই ।তাই উনি আব্বুকে বলেন আপনি ইন্ডিয়া যেয়ে আপরেশন করে আসেন অনেকেই ভাল হয়েছেন ।

আব্বু ডাক্তারের পরামর্শে দেরী না করে এক সপ্তাহের মাধ্যেই চলে গেলেন ওখানে ১৫দিন অবস্থান করে স্যাকসেসফুল অপারেশন করে চলে আসেন ।

অপারেশন স্যাকসেস হলেও বদলে যায় আমার আব্বুর স্বাভাবিক জীবন যাত্রা ।অপারেশনের ম্যাধ্যমে আমার আব্বুর টয়লেটের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয় পরিবর্তে পেটের ডান পাশে একটা ছিদ্র করে পাইপ লাগিয়ে দেয়া হয় আর পাইপের মুখে পলিব্যাগ সেখানে সারাক্ষন টয়লেট জমা হত ।এটা ২-৩ ঘন্টা পর পর পরিবর্তন করতে হত এটা আমার আব্বু নিজে করতে পারতেন না আম্মুকে করতে হত । এভাবে আব্বু আম্মুর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন ।মাঝে মাঝেই বিছানা ,জামা কাপড় নোংরা হয়ে যেত তখন আব্বুর চেহারায় একধরনের অসহায়ত্ব ফুটে উঠত যা দেখে খুবই খারাপ লাগত।

৬ মাস পর আব্বু আবার ইন্ডিয়াতে গেলেন চেকাপ করাতে ডাক্তার চেকাপ করে বলেন আপনার শরীরে কোন ক্যানসার নেই আপনি সুস্থ্য আছেন । ৬ মাস পর পর আরো দুই বার গেলে ডাক্তার চেকাপ করে একই কথা বলেন আর আব্বুও খুশী মনে চলেন আসন ।

হঠাত করে আব্বুর ভীষন ঠান্ডা লাগে ঢাকায় ডাক্তার দেখানো হয় বলা হয় ল্যান্সে পানি জমেছে ঢাকাতেই পানি বের করা হয় ।এর পর আব্বু আবার ইন্ডিয়াতে গেলেন এবার দেখতে পেলেন ডাক্তারের ভিন্ন চেহারা ।আব্বুর মুখে শুনা প্রতিবার ইন্ডিয়া থেকে এসে আব্বু ওখানকার ডাক্তারদের খুব প্রসংশা করতেন ।কিন্ত এবার বললেন ভিন্ন কথা ডাক্তার নাকি তাকে ভাল মত দেখে নাই ব্যাবহার ও করেছেন খারাপ । আসলে হয়ত না এটা ছিল আব্বুর ভুল ধারনা ।

কারন আব্বুর সাথে যে লোক গিয়েছিল ডাক্তার তাকে বলে দেন উনার সারা শরীর ক্যানসারে ছেয়ে গেছে আমাদের আর কিছু করার নেই দেশে নিয়ে যান হয়ত আর ২৫দিন টিকবে।

তিনদিন পর আব্বু চলে আসেন ।

আমার আব্বু পুরাপুরি শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন ,আব্বু এত বেশী কষ্ট পাচ্ছিলেন কিন্ত আমরা তার সন্তান হয়ে কিছু করতে পারছিলাম না । আব্বুকে নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন ক্লিনিকে ক্লিনিকে ঘুরেছি কেউ ২-৩দিনের বেশী রাখতে চাইত না । আর আব্বু আসতে চাইত না বলত না আমি বাসায় যাব না এখানে থাকলেই আমি ভাল হব ।আমি দেখেছি আমার বাবার বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা । আমারা ছিলাম অসহায় আমাদের করার কিছু ছিল না ঠিক ২৪দিন পর আব্বু আমাদের ছেড়ে চলে যান চিরদিনের জন্য ।এই ২৪ টা দিন আমার জীবনের কিযে যন্ত্রনা দায়ক কষ্টকর ছিল । মনে হত পৃথিবীতে সুখ বলে কিছু নেই ।

আল্লাহ মানুষকে সবুর দেন কষ্ট ভুলিয়ে দেন তখন যে রকম কষ্ট ছিল সেই কষ্ট থাকলে দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে পারতাম না ।তবে এই বেঁচে থাকাটাও মনে হয় না বেঁচে থাকা ।বুকের ভিতর সব সময় একটা শূন্যতা অনুভব করি মনে হয় কি যেন নেই ।

আব্বুর অনেক শখছিল সবসময় বলতেন ছেলেদের বিয়ে দিবেন মেয়েকে বিয়ে দিয়ে পশ্চিম দিকে মানে মক্কা শরীফ চলে যাবেন আর আসবেন না ।কিন্ত আব্বুর সে আশা পূর্ণ হয়নি ।

প্রায় নয় বছর হয়ে গেছে লেখা পড়া শেষ করেছি ভাইয়ারা বিয়ে করেছেন আমাকেও উপযুক্ত ছেলে দেখে বিয়ে দিয়েছেন স্বামীর সাথে দেশ থেকে অনেক দুরে আছি । এখানেও আব্বুর একটা শার্ট সাথে নিয়ে এসেছি মাঝে মাঝে সেটা বের করে শুঁকে দেখি কিন্তু আব্বুর গায়ের সেই গন্ধটা আর আগের মত নেই ।

বিষয়: Contest_father

১৬৬৪ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

205335
০৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৮:৩৮
পটাশিয়াম নাইট্রেট লিখেছেন : আল্লাহ্‌ আপনার বাবাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন।আমার বাব ও গত হয়েছেন ঐ একই ক্যান্সারে। ৩ বার অপারেশন হয়েছিল। ঊনি ও ঐ কোলেষ্টমি ব্যাগ বয়ে বেরিয়েছেন ৫ বছর।
০৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:০৮
154292
সিমপল লিখেছেন : আল্লাহ্‌ আপনার বাবাকেও জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন আমীন ।
205347
০৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৮:৪৬
শিশির ভেজা ভোর লিখেছেন : পড়ে কষ্ট পেলাম ভাই। একদম দরদ দিয়ে লেখা। আল্লাহর অশেষ রহমতে এখনো পরিবারের কাউকে হারাতে হয়নি তাই তার নিকট কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
০৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:১২
154293
সিমপল লিখেছেন : এটা আপনার অনেক বড় সুভাগ্য ।ধন্যবাদ আপনাকে ।
205369
০৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৯:০৭
হারিয়ে যাবো তোমার মাঝে লিখেছেন : মনের গভীর থেকে তুলে আনা কিছু অব্যক্ত ভাবনা। সত্যি আপনার পিতৃবিয়োগে ব্যথিত হলাম।
০৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:১২
154294
সিমপল লিখেছেন : আপনাকে ধন্যবাদ ।
205394
০৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৯:৪৮
লন্ডন থেকে লিখেছেন : আব্বুর গায়ের সেই গন্ধটা আর আগের মত নেই ।
বাস্তব সত্য কথা । বাবা তো তাই এমন ...........
০৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:১৪
154295
সিমপল লিখেছেন : জী বাবা বলেই এমন হয় ।ধন্যবাদ
205423
০৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১০:৪২
ব্যর্থ জীবন লিখেছেন : শেষের লেখাগুলো পড়ে কান্না সংবরণ করতে পারিনি............
আল্লাহপাক আপনার বাবাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন.......
০৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:১৫
154296
সিমপল লিখেছেন : আল্লাহ আপনার দুয়া কবুল করুন আমীন ।ধন্যবাদ আপনাকে ।
206600
১২ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৮:১৯
জেদ্দাবাসী লিখেছেন : সুন্দর করে সহজ ভাষায় মূল্যবান কথাটি বলেছেন "আল্লাহ মানুষকে সবুর দেন কষ্ট ভুলিয়ে দেন তখন যে রকম কষ্ট ছিল সেই কষ্ট থাকলে দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে পারতাম না"

বাবাকে আল্লাহ জান্নাঁতের বাসিন্দা বানিয়ে দিন ।
১৪ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:২৩
156519
সিমপল লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকে ।
207019
১৩ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০২:০৭
১৪ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:২৩
156520
সিমপল লিখেছেন : আপনাকে ও ধন্যবাদ ।
207290
১৩ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৮:১৪
আলোর আভা লিখেছেন : আল্লাহ আপনার আব্বুকে জান্নাত নসীব করুন ।
১৪ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:২৪
156522
সিমপল লিখেছেন : আল্লাহ আপনার দুয়া কবুল করুন ।আমীন ।
208518
১৫ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:৩৯
জোনাকি লিখেছেন : May Allah unite all of u in Jannah. Good writing mashAllah!
১৩ জুন ২০১৪ রাত ০২:৫০
181096
সিমপল লিখেছেন : http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/2662/sottolikhon/44049#.U5oQLXJ_s0s
১০
209246
১৭ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:১৫
সুমাইয়া হাবীবা লিখেছেন : আপনার অনুভূতিগুলো ছুঁয়ে গেল..দোয়া করছি আল্লাহ জান্নাত দান করুন। Praying

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File