উজ্জয়িনী সিরিজ -২ “স্মৃতিতে হিসেবের ক্যালকুলাস”

লিখেছেন লিখেছেন সিমানা ০২ নভেম্বর, ২০১৫, ০৪:৪৩:১৭ বিকাল



প্রায় তিন বছর পর আজ গ্রামীণ পথে হাঁটছে উজ্জয়িনী। সেই মেঠো পথ, পথের দু ধারে বিশাল বিশাল ইউক্যালিপ্টাস মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। গতকাল ঢাকা থেকে মাকে নিয়ে এসেছে। একসপ্তাহের ছুটি নিয়ে সম্পুর্ণ ব্যাস্তহীন জীবন কাটানোর জন্য। আছরের নামাজ পড়ে বের হয়েছে উজ্জয়িনী, চাচী চাচাতো ভাইবোনরা ঘিরে রেখেছিলো এতক্ষণ। এক ফাঁকে মায়ের সাথে সবাইকে মনোযোগী করে দিয়ে চুপি চুপি বেরিয়ে আসে উজ্জয়িনী। এবার সে সবার জন্য গিফট নিয়ে এসেছে, এখনও দেয়া হয়নি, রাতে দিয়ে দেবে। হাঁটছে উজ্জয়িনী, একটা গন্তব্য পর্যন্ত ও হাঁটবে, পরিচিত অনেকের সাথে দেখা হচ্ছে। এই সেই গ্রাম যেটার প্রতিটি আনাচে কানাচে উজ্জয়িনী হেঁটেছে, খেলেছে। দৌড়াদৌড়ি করে অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এই ছায়াঘেরা গ্রামেই বাবার হাতের আঙ্গুল ধরে স্কুল যেতো উজ্জয়িনী। বড় দুই ভাই কতো আদর করো ওকে! সেই ভাই, আজ অনেক দুরের কেউ, যেন দুর সম্পর্কের কাজিন হয়! দীর্ঘশ্বাস ফেলে উজ্জয়িনী, বসে পড়ে পাশেই বিস্তৃত এক কবরস্থানের সবুজ ঘাসে। বুনো ঘাসে ভরে গেছে পুরোটা, এ এক পরিচিত গন্ধ! কবরস্থানের গন্ধ…………………… খুব কান্না পাচ্ছে উজ্জয়িনীর, মন চাইছে বাবার কবরটা খুলে দেখতে, একাকী কথা বলে যায় উজ্জয়িনী,

-বাবা! কেমন আছো তুমি? আমাকে চিনতে পারোনা? আমি উজ্জল তোমার উজ্জল বাবা! ও বাবা একবার ডাকোনা উজ্জল বলে………… কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করে উজ্জয়িনী, থেমে গিয়ে পেছনে তাকায়, তানিয়ার মলিন চেহারা দেখে অস্পষ্ট স্বরে,

-তুই এখানে?

-তোকে খুঁজতে খুঁজতে, খালাম্মা খুঁজছিলেন। তানিয়া ওর পাশে বসে।

-তোর বর তোকে খুঁজবেনা?

-না ওতো কাল আসবে, মাকে বলে তোকে খুঁজতে এসেছি, চল যাই।

-তুই যা আমি এখন যাবোনা।

-আচ্ছা এভাবে একা একা থাকবি? উজ্জয়িনীর দুগন্ড বেয়ে অশ্রু ঝরছে, বললো,

-তুই কি কোন গন্ধ পাস তানিয়া?

-নাতো! কিসের গন্ধ?

-বুনো ঘাসের? জানিস এই গন্ধটা শুধুই কবরস্থানে হয়, মন কেমন করা গন্ধ! আমি এই গন্ধেই বলে দিতে পারি কোথায় কোথায় কবরস্থান আছে। তানিয়া মনোযোগী হয়, বলে,

-আংকেলকে খুব মনে পড়ছে তাইনা? আচ্ছা বলতো কী হয়েছিলো আংকেলের?

-সে অনেক কথা তানিয়া, প্রচন্ড রকমের কষ্ট নিয়ে বাবা দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। তখন ঢাকাতেই থাকতাম, বিবিএ ফার্স্ট সেমিষ্টার। আমার বিয়ের কথা চলছিলো। ভাইয়া দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। আমার বিয়ের কথা চলছিলো একজন ডাক্তারের সাথে। সে নাকী আমাকে কোথায় দেখে খোঁজখবর নিয়ে বাবাকে প্রস্তাব দেয়। কিন্তু এই বিয়েতে ভাইয়া আর ভাবীদের ঘোর আপত্তি, কারণ হিসেবে বলতো, উজ্জয়িনীকে সময় দিতে পারবেনা। কিন্তু বাবার কথা ছিলো, এটা একটা ছেলেকে রিজেক্ট করে দেয়ার মতো যথেষ্ট কারণ নয়। অনেক আলোচনা, সমালোচনা শেষে বাবা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে, ভাইয়ারা যদি বিয়েতে নাও থাকে তিনি নিজেই বিয়ে দিবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো ভাইয়ারা অন্য একটা কারণে এই বিয়ে আটকাতে চাইছিলো, কারনটা হলো এই ছেলেটার কোয়ালিটি তাদের থেকে বেশী, তারা চায় আমার বর হবে তাদের চেয়ে নিচু কোয়ালিটির……………

উজ্জয়িনীর দৃষ্টি আবারো ঝাপসা হয়ে আসে, রুদ্ধ কন্ঠে কথা চালিয়ে যায়,

-বাবা ব্যাপারটা জানতে পেরে মনে মনে খুবই দুঃখ পান। তখন মন থেকে ভেঙ্গে পড়েন, আর মাঝে মাঝেই বলতেন আমি না থাকলে এরা আমার মেয়েটাকে আর বউটাকেতো রাস্তায় নামাবে, বিয়ের কথা চলছিলো তখনও বাবার এই অত্যধিক টেনশনে বিয়ের ঠিক দুদিন আগে হার্ট এটাক করেন। আর ঐ দিনই চলে যান আমাদেরকে ছেড়ে। আর এই ফাঁকে ভাইয়ারা বিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার যথেষ্ট নোংরা কারণ বের করে ওকে বলেছিলো,

-বাবা নাকী আমার জন্য মারা গেছেন, আমার অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে……………. হাউমাউ করে কাঁদে উজ্জয়িনী, তানিয়াও নিজের অশ্রুকে বাঁধ মানাতে পারেনা, খুব প্রিয় বন্ধুটিকে জড়িয়ে ধরে শান্তণা দেয়!

অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়, পুরো আকাশজুড়ে তখন সূর্য অস্ত যাবার প্রস্তুতি চলছিলো, সান্ধ্য আয়োজনের কারণে নীড়ে ফিরছিলো পাখিরা, পুরো নিলীমা ভ্রমণ সম্পন্ন করেছে। মুখে খাবার মুখে নিয়ে কলকাকলীতে মুখর হয়ে পাখিরা নীড়ে ফিরছে। উজ্জয়িনী স্বাভাবিক হয়, অশ্রু মুছে তানিয়ার দিকে তাকায়,

-তোকে দেরী করায়ে দিলাম, আন্টি খুঁজবেনা?

-না, কিন্তু এখন যদি অন্যরা আমাদেরকে এখানে দেখে তো…. মেয়েদেরে নাকী কবরস্থানে আসতে নেই!

উঠে দাড়ায় উজ্জয়িনী ফেরার জন্য হাঁটা শুরু করে,

-হুম! মেয়েদেরতো সবখানে যাওয়া বারণ, মসজিদে কবরস্থানে…. এই কুসংস্কার গুলো দুর করতে হবে তানিয়া! কারণ রসুল (সঃ) এর সময় মহিলা সাহাবীগণ মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েছেন।

-ওমা! তাই নাকী! বিস্মিত কন্ঠ তানিয়ার।

-হ্যা! আর কবরস্থানে গেলে মানুষের মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়, ভালো কাজ করতে পারে, এজন্য কবরস্থানে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে, মৃত ব্যাক্তির জন্য দোয়া করতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারেতো কোথাও লেখা নাই যে মেয়েরা যেতে পারবেনা।

-তুই এতো কিছু কার কাছে জেনেছিস?

-বাবার কাছে। আর তুই বলছিলি না যে স্কার্ফ পরার কথা? ওটাও বাবাই বলেছিলেন। কিছু ছেলে রোজ খুব ডিস্টার্ব করতো, বাবা এই বুদ্ধিটা দিলেন, তুই বিশ্বাস করবিনা যেদিন থেকে আমি স্কার্ফ পরা শুরু করলাম সেদিন থেকেই ওদের টিজিং কমতে শুরু করলো, কেমন একটা ইতস্তত ভাব। তারপর তো বাবা মারা গেলেন, ভাইয়ারা বউ নিয়ে আলাদা আলাদা বাসা নিয়ে চলে গেলো,আগের বাসা বড় ছিলো, ভাড়া দিব কিভাবে, তাই বাসা চেইঞ্জ করে এখন যেখানে আছি সেখানে আসলাম। তখনও খুব কষ্ট করে চলেছি। তারপর বৃদ্ধাশ্রমের চাকরিটা পাই, আল্লাহ সহায় ছিলেন এখন আর সমস্যা হয়না।

-ডক্টর সাহেবকে কি দেখেছিস? কি নাম তার?

-হ্যা দেখেছিলাম, ভালো লাগতো! নাম ছিলো, আসিফ আরমান।

কথা বলতে বলতে ওরা পৌছে যায় বাড়িতে, তানিয়া নিজের বাড়ির রাস্তায় হাঁটা দেয়।

রাত্রির গভীরতায় গ্রামের পরিবেশগুলো অনেকটা ভুতুড়ে হয়ে যায়, কিন্তু উজ্জয়িনীর দাদুবাড়ী এখনও গমগম করছে। চাচারা কাজ থেকে ফিরেছে, রাতের খাবার খাওয়া শেষ হয়েছে। উজ্জয়িনী সবার জন্য আনা গিফটগুলো দেয়, বড় চাচা আব্দুল কাদের খুশিতে কেঁদে ফেলেন,

-মেয়ে হয়ে ছেলের কাজ করছে আমাদের মেয়ে দ্যাখো, উজ্জয়িনী বলনা মা তুই কী চাস?

শবনম মোস্তারী হাসিমুখে,

– আঃ কাদের ভাই, উজ্জয়িনীর খুব ইচ্ছে ছিলো তোমাদেরকে কিছু গিফট করবে…….. উজ্জয়িনী মাকে পুরো শেষ করে দেয়না,

-ওমা আমার একটা চাওয়াতো আছেই বড় চাচার কাছে! উপস্থিত সবাই অধির আগ্রহ নিয়ে তাকায় উজ্জয়িনীর দিকে, আব্দুল কাদের উৎফুল্ল কন্ঠে,

-চাচা সামনেতো ঈদ আসছে, আর তুমি ঈদের নামাজের ইমামতি করো, এবার যেন মহিলারাও ঈদগাহে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে পারে সেই ব্যাবস্থা তোমায় করতে হবে।

সবাই অবাক হয় মহিলারা অতি আগ্রহভরে হাসতে থাকে, আঃ কাদের চিন্তিত কন্ঠে,

-গ্রামের লোকজন কী রাজি হবে? উজ্জয়িনী দায়ি্বশীল কন্ঠে,

-সে তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও, আমি এই কদিনে সবাইকে বুঝিয়ে তারপর যাবো। সবাই মানবে, কিন্তু চার পাঁচজন গোঁড়া লোক ছাড়া………….

ঠিক আছে মা তাই হবে, কিন্তু এবার ঈদে তুমি কিন্তু তোমার মাকে নিয়ে আসবে!

-হ্যা আসবো তো, অবশ্যই আসবো।

খুশিতে ভরপুর উজ্জয়িনী মুখমন্ডলের আলো যেন রাতের অন্ধকারকে দুরে সরিয়ে দেয়, আবারো জমজমাট আড্ডায় ভরপুর হয়ে ওঠে উজ্জয়িনীর দাদুবাড়ী! আপনজনের মধ্যমণি হওয়ার মধ্যে আলাদা একটা তৃপ্তি উজ্জয়িনীর পুরো স্বত্তা জুড়ে শোভা পায়!

বিষয়: বিবিধ

১২৮২ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

348400
০৪ নভেম্বর ২০১৫ রাত ০২:১৬
বৃত্তের বাইরে লিখেছেন : উজ্জয়িনী নামটা প্রথম শুনলাম। আপনজনের সান্নিধ্যটাই এমন। ভাল লাগলো উজ্জয়িনীর স্মৃতিকথা Rose Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File