সোনালী সে দিনগুলো………

লিখেছেন লিখেছেন সিমানা ২৭ মে, ২০১৪, ০১:০৩:৩০ দুপুর



মাচাংয়ের উপরে কাঠের তক্তায় অনেকগুলো বড়ো বড়ো পাতিল, কাঁসার বড় বালতি, আর ছোট্ট একটা মাটির হাড়ি ঢাকনা সহ। প্রতি মাসে ঐ জিনিসগুলো নামিয়ে ভালোভাবে ধুলা বালি ঝেড়ে আবার নতুন করে সাজিয়ে রাখা হতো, আম্মু শুধু মাটির হাড়িটা না নামিয়ে মইয়ের উপর দাড়িয়ে ওটাকে ওখানেই মুছে রাখতেন কৌতুহলি মনে প্রশ্ন জাগতো কি আছে ওটাতে? মান্থলি এই ধোয়া মোছার কাজের সাথে আরো ছিলো-শোকেস এর জিনিসগুলো, সিরামিক্সের বাটি প্লেট। গোছানো কাপড়গুলো নতুন করে ঝেড়ে, নতুন করে গুছিয়ে রাখা। একটা আলমিরাতে অনেক মোটামোটা আব্বুর বইগুলো যত্ন করে মুছে আলমিরার তাকে সাজিয়ে রাখা। আব্বুর যে বইগুলো ছিলো সবই ইংলিশে, এমনকী ইন্টারমিডিয়েট লেবেলের ফিজিক্স কেমিষ্ট্রিগুলোও ইংলিশে। আব্বু না থাকায় সবকিছু জানার মাধ্যম সেই একজনই, আম্মু! জিজ্ঞস করলাম, সব ইংলিশে কেন? আম্মুর সংক্ষিপ্ত উত্তর, সেসময় সবই ইংলিশে ছিলো। বললাম ক্লাসের বই ছাড়াও যে বইগুলো সেগুলোওতো ইংলিশে……… প্রশ্ন করতে গিয়ে আমারই মনে পড়তো আব্বুতো ইংলিশে অনার্স করার স্বপ্ন দেখতেন, নিজে না করতে পেরে আমাকে করানোর স্বপ্ন দেখতেন! আরও ছিলো, আব্বু কুরআনের আয়াত মুখস্ত করার নেশা! অর্থসহ মুখস্থ করতেন, পকেটে সবসময় একটা করে চিরকুট থাকতো, সেটাতে কুরআনের আয়াত লেখা থাকতো অর্থসহ। রাস্তায় সাইকেল যখন চালাতেন, নিরিবিলি রাস্তা পেলেই চোখের সামনে ধরতেন চিরকুটটি। আম্মুকে মাঝে মাঝে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতেন, তুমি মাদ্রাসায় পড়েছো তাই তুমি বেশী আয়াত জানো, কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়িয়ে যাবো, আর পরে এতো এতো কুরআনের আয়াত তাঁর নখদর্পনে! আম্মুকে সত্যিই হারিয়ে দিয়েছিলেন! আব্বু ছাত্র জীবনে সেক্যুলার রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলেন। ( সে গল্প অন্যদিন শেয়ার করবো ইনশাআল্লাহ)

যাইহোক, পরে যখন বড় হলাম চেয়ারে উঠলে ঐ তাক ছুতে পারতাম তখন একদিন চুপিচুপি মাটির হাড়িটির ভেতরের জিনিস পর্যবেক্ষণ করে তো আমার অবস্থা খারাপ। এভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়া জিনিস আম্মু এতো যত্ন করে কেন রাখেন! হায় হায়!! আম্মুকে কিছুই বলিনি, নিজের মনে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতাম, কিন্তু উত্তরের কুল কিনারা পাইনি কখনো, অন্য কাউকেও জিজ্ঞেস করিনি, ভাবতাম তারা যদি আম্মুকে নোংরা ভেবে নেয় এই ভয়ে।

একদিন,

হন্তদন্ত হয়ে বড় চাচার ছেলের বউ, আমার ভাবী এসে আম্মুকে বললেন, আম্মা, জলি বিষ খাছে(খেয়েছে)! আম্মু দ্রুত ভাবীর সাথে গেলেন, আমার খুব কান্না পাচ্ছিলো কারণ জলি আমার চাচাতো বোন, আমি আমার ছোট বোনদেরকে নিয়ে ওখানে গেলাম। আম্মু জলির আপুর মাথা কোলের কাছে নিয়ে আমাকে বললেন দ্রুত কন্ঠে, সিমা তক্তার উপরের মাটির পাতিলটা নিয়ে আয়! আমি ইততস্ত করেই দৌড় দিলাম ওটা আম্মুর হাতে দিয়ে চুপচাপ আড়ালে দাঁড়ালাম, ওমা আম্মু দেখি ঐ নষ্ট হয়ে যাওয়া নোংরা জিনিসগুলো জলির মুখে জোর করে ঢুকিয়ে দিলেন, আর সাথে সাথে জলির নাড়ি ভুড়ি বের হয়ে আসার মতো বমি দেখে আমিতো হতবাক! আসলে ঐ নষ্ট হওয়া জিনিস হলো অনেকদিনের পুরনো, ফাঙ্কাস পড়ে যাওয়া তেতুল! যেগুলো এমনি কেউ খেয়ে নিলে বিষের কাজ করবে, কিন্তু বিষ খাওয়া কাউকে খাওয়ালে বমি করিয়ে দিবে! একই জিনিস অথচ দুই সময়ে দুই কাজ করে, কী অদ্ভুত! ব্যাপারটা আম্মুর কাছেই জেনেছি। পরে দেখি জলি একদম সুস্থ! মনে মনে আম্মুকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডাক্তার উপাধী দিয়ে দিলাম, আর মাকে সবচেয়ে বড় ডাক্তার উপাধি দিতে পেরে নিজের মনে কতো যে আনন্দ পেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই!

আর একদিনের ঘটনা,

গ্রামের অন্যপাড়ার একজন, সম্পর্কে ভাবী। কাঁদতে কাঁদতে আম্মুর কাছে ছুটে আসে! আমি পড়ার টেবিলে অংক করার নাম করে উপন্যাস লিখছিলাম। আম্মু ভাবীকে কাছে বসালেন, শান্ত হও মা কী হইছে বলো। ভাবী ফুঁফিয়ে কাঁদছেন, আম্মু তাকে কাঁদার সুযোগ করে দিলেন। ভাবী স্বাভাবিক হয়ে বললেন আপনির ছেলে (ভাতিজা, ভাগিনা সম্পর্কীয় দেরকে এভাবে সম্বোধন করা হয়) হামাক (আমাকে) তালাক দিবে, বাড়িত থাকে বার করে দিছে, হামি একন কী করমো? (বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, আমি এখন কী করবো)। আম্মু বললেন, তুমি কিছুক্ষণ বসো, দুপুরে খাওয়া দাওয়া করছো? ভাবী হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়। পরে আম্মু ভাবীকে নিয়ে ঐ বাড়িতে যান। আমাদেরকে বাড়িতে থাকতে বলে যাওয়ায় মিমাংসা হয়ে যাওয়া সে ঘটনা আর দেখা হয়নি, জানতেও পারিনি। তবে দুদিন পরে ঐ দম্পতিকে হাস্সোজ্জ্বল খুনসূটিতে ব্যাস্ত অবস্থায় রাস্তা দিয়ে যেতে দেখে মনে মনে বলেছিলাম, আমার মা আমার বাবার যোগ্য স্ত্রী। আব্বু যেমন গ্রামের মানুষের নানা সমস্যা, ন্যায় বিচারের মাধ্যে সমাধান করে দিতেন তেমনি!

এমনই অনেক ঘটনা অন্যপাড়ার কোন সে এক মহিলা বিপদে পড়ে ছুটে আসতো আম্মুর কাছে, “ও বু এই ঘটনা হামি একন কী করমো?” কোন এক চাচা এসে “ভাবী কনতো দেখি কী করা যায়” কোন তরুনী এসে “আম্মা এই অবস্থায় কী করি?” এইসব প্রশ্ন, সমস্যার সমাধান দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা আম্মু করেছেন! আমি গর্বিত আমার সেই মাকে নিয়ে। যার জীবনের রং বড্ড ফ্যাকাশে, অথচ আমাদের জীবনে সামান্য ফ্যাকাশে বর্ণ দেখলে যিনি অধৈর্য হয়ে যান! যিনি দিনের পর দিন অন্যের ফ্যাকাশে বর্ণকে রং তুলি দিয়ে বর্ণময় করে তোলার চেষ্টা করেছেন! আপনাকে সালাম মাগো, আমি আপনার জন্য কিছুই করতে পারিনা, জানি, আমাদের কাছে কিছু চওয়ারও নেই আপনার, শুধু একটা বাক্যই আশা করি আপনার জন্য যথেষ্ট “রব্বির হামহুমা কামা রব্বা ইয়ানিস সগীরা”!

বিষয়: বিবিধ

১২৯৬ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

226937
২৭ মে ২০১৪ দুপুর ০১:০৯
নিউজ ওয়াচ লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
২৭ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:৪৪
173854
সিমানা লিখেছেন : ব্লগে স্বাগতম।
226938
২৭ মে ২০১৪ দুপুর ০১:১৯
বিন হারুন লিখেছেন : আপনি অনেক ভাগ্যবান আপনার আদর্শ মা এর কারণে আপনার বাবা জেদ করে হোক আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে হোক অনেকগুলো কুরআনের আয়াত অর্থসহ মুখস্থ করেছেন. (সোবহান আল্লা-হ) দোয়া করি প্রতিটি মুসলিমের ঘরে ঘরে এরকম আদর্শ মা'এর জন্ম হোক.
226985
২৭ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:৪৫
সিমানা লিখেছেন : আদর্শে অণুপ্রাণিত হয়েই করেছিলেন।
ছুম্মা আমীন।
226994
২৭ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:৫৯
হারিয়ে যাবো তোমার মাঝে লিখেছেন : যিনি দিনের পর দিন অন্যের ফ্যাকাশে বর্ণকে রং তুলি দিয়ে বর্ণময় করে তোলার চেষ্টা করেছেন! আপনাকে সালাম মাগো, আমি আপনার জন্য কিছুই করতে পারিনা, জানি, আমাদের কাছে কিছু চওয়ারও নেই আপনার, শুধু একটা বাক্যই আশা করি আপনার জন্য যথেষ্ট “রব্বির হামহুমা কামা রব্বা ইয়ানিস সগীরা”!

পৃথিবীর সব মায়েরাই বুঝি এমন হয়। তাদের জন্য হাত তুলে দোয়া করতে হয় না এমনি এমনি অন্তর থেকে চলে আসে। আমার আর কিছু বলার নাই। Sad Sad
২৮ মে ২০১৪ সকাল ০৯:১৯
174150
সিমানা লিখেছেন : আপনি যা বলেছেন তাতেই আপনার অনুভূতির পুরোটা প্রকাশিত হয়েছে। অনেক ধন্যবাদ, সুন্দর মন্তব্যের জন্য!
227275
২৮ মে ২০১৪ সকাল ০৮:২২
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : অসাধারন এক মায়ের সৌভাগ্যবতী সন্তান আপনি! তাঁকে জীবনের প্রতিটি স্তরে অনুসরন করেই আপনি তাঁর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারেন।
২৮ মে ২০১৪ সকাল ০৯:২১
174151
সিমানা লিখেছেন : জাজাকাল্লাহ খায়ের, সে চেষ্টাই করে যাই, কিন্তু সবক্ষেত্রে হয়ে ওঠেনা।
228716
৩১ মে ২০১৪ বিকাল ০৪:৩৯
সূর্যের পাশে হারিকেন লিখেছেন : আপনিতো অসাধারন সুন্দর লিখেন। আগে পড়িনি কখনও...... Rose Rose Good Luck Good Luck Rose Rose অন্নেক ভালো লাগলো Good Luck Good Luck যাজাকাল্লাহু খাইর।
৩১ মে ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:০০
175412
সিমানা লিখেছেন : অসংখ্য ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File