বিশ্বাস
লিখেছেন লিখেছেন সিমানা ২৬ এপ্রিল, ২০১৪, ০৮:৫০:১৯ সকাল
৩.
অনেক পথ হেঁটে আজ অনেকদিন পর ছেলেকে নিয়ে দুর গ্রামের এই মন্দিরে প্রবেশ করেছে নিরুপমা। মন্দিরে দাড়িয়ে মুর্তির দিকে হাতজোড় করে অপলোক তাকিয়ে আছে নিরুপমা দেবী, মনে মনে মনের সকল চাওয়া গুলো আওড়াচ্ছে। অতিশও পাশে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে, ও বিড়বিড় করে বলছে,
-ঠাকুর সেদিন গোপাল কাকার পোলা আমারে অর ব্যাটে হাত দিতে দ্যায়নাই, তুমি আমারে একটা ব্যাটের ব্যাবস্থা কইরা দ্যাও, আমার ব্যাট যেন ঐ নিলয় এর থ্যাইকাও সুন্দর হয়।
নিরুপমা দেবী অনেক্ষণ পর মন্দিরের ঠাকুরমশাইয়ের ডাকে স্বাভাবিকে ফিরে আসে, ঠাকুর মশাই উদ্বিগ্ন কন্ঠে,
-মারে তুই এখনও যাসনাই! সন্ধা হইয়্যা গেলোতো, আকাশটাওতো খুব খারাপ ঝড় আসতে পারে, সবাই চলে গেছে!
নিরুপমা অকস্মাৎ চমকে ওঠে,
-অমা তাইতো এহন?
অতিশ মায়ের নিরুপায় মুখের দিকে তাকিয়ে ভীত হয়ে যায়। ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে ঝড় আর বৃষ্টি ঠিক সেদিনের মতো, চারেদিকে রাত্রির মতো অন্ধকার মন্দিরের ঘন্টাগুলো ঝড়ের তোড়ে ঢং ঢং করে বাজছে।
নিরুপমা দেবী গুটিশুটি হয়ে ছেলেকে নিয়ে একটা পিলারের আড়ালে বসে পড়ে।
এভাবেই বসে থাকলো মা ছেলে, অতিশ বিরাট ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছে, এতো চুপচাপ সে থাকতে পারেনা।
মধ্যরাত।
ঝড় কমলেও বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর তুমুল জোরে বৃষ্টি পড়ছে। মন্দিরে ভালোমতো একটা ছাদ থাকায় ভিজতে হচ্ছেনা ওদের। নিরুপমা দেবী একটু যেন ঘুমিয়েই পড়লো।
হঠাৎ রনসাজে সজ্জিত হয়ে মন্দিরে ঢুকলো চার পাঁচজন যুবক সাথে একজন নির্দেশনা দিচছে, তার মুখ কালো কাপড়ে ডাকা। যুবকগুলোর মুখ ঢাকা নয়, তাদের হাতে মোটা মোটা লাঠি, ওরা আগে ঠাকুর মশাইয়ের মাথায় জোরে আঘাত করলো, অতিশ চিৎকার করতে চাইলে ওর মুখ চেপে ধরে নিরুপমা দেবী। লোকগুলো দুর্গা দেবী সাথে থাকা সমস্ত গহণা নিয়ে নিলো, আর মূর্তিগুলো ভেঙ্গে দিয়ে চলে গেলো, অতিশ মুখ ঢাকা লোকটির বিশ্রি হাসির শব্দ শুনতে পেলো, অতিশের মনে হলো এই মানুষের হাসিমুখ যতটা অসুন্দর হাসির শব্দটা তার চেয়ে বেশী অসুন্দর।
শেষ
সকালে অতিশকে নিয়ে বাড়ি ফিরছে নিরুপমা। চারেদিকে গাছের ভাঙ্গা ডাল, গাছের পাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কোথাও কোথাও আস্ত গাছ ভেঙ্গে পড়ে আছে। কোথাও কারো ঘরের টিনের ছাদ উড়িয়ে গেছে। এযেন ধ্বংসযজ্ঞ, এতোসব পেরিয়ে ঘরে আসতে অনেকটা সময় লেগে গেলো। নিরুপমা ঘরে ঢুকেই পাতিলে চাল নিয়ে ধুয়ে সরাসরি চুলায় বসিয়ে দিলো। চালের সাথেই কয়েকটা আলু আর কাঁচামরিচও সিদ্ধ দিলো। সন্ধার আগে সামান্য প্রসাদ ছাড়া সারা রাত আর কিছুই খাওয়া হয়নি। আর যা ঘটেছে তাতে মা ছেলে খুব ভীত, নিরুপমা অবশ্য কাউকেই চিনতে পারেনি, রাস্তায় কিছু লোক বলাবলি করছিলো,
- এইগুলা সব ঐ রাজাকারদের কাজ, রায় দেয়ার পরই এই কামডা করলো। তোরা কুরআন এতোই মানস তাইলে এইডা ক্যান মানসনা যে অন্য ধর্মের উপর যুলুম করা ঠিকনা……
নিরুপমাও মনে মনে সায় দিয়েছিলো ওদের কথায়।
নিরুপমা চুলা জ্বালিয়ে ছেলের দিকে তাকায়,
-কতা কসনা ক্যান?
অতিশের মুখটা ভার। মলিন কন্ঠে,
-কিছু অয়নাই, খিদা লাগছে।
-এইতো আর একটু পরই অইয়্যা যাইবো………
কথা শেষ না হতেই চেয়ারম্যান আবুল হোসেনর আগমন ঘটে। অতিশ সবদিনের মতো তার প্রিয় কাকাকে দেখে খুশি হতে পারলোনা। আবুল হোসেন অতিশের সামনে আস্ অতিশ তাকায়না তার দিকে আবুল হোসেন,
-অতিশ কী হইলো খুশি হওনাই? এই দ্যাখো কী আনছি ব্যাট, তোমার লাইগ্যা।
অতিশ ব্যাটটা হাতে নেয়, কিছুই বলেনা। আবুল হোসেন একটা মোড়া নিয়ে নিরুপমা দেবীর খুব কাছে বসে, অতিশ দেখলো কাকা ওর মায়ের একদম কাছে বসে মায়ের মুখমন্ডল, গলা ছুঁয়ে দিচ্ছে, যেমনটি অতিশের বাবা করতো । অনেক সুন্দর ব্যাটটিকে নেড়ে চেড়ে দেখে নিলো অতিশ, অনেক সুন্দর ব্যাট। ওর চাওয়া পূরণ হয়েছে। লাল হয়ে আসে অতিশের দুচোখ, চিৎকার করে দৌড়ে গিয়ে আবুল হোসেনের মাথায় ব্যাট দিয়ে আঘাত করলো শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে, মাথা ফেটে ফিনকী দিয়ে রক্ত বের হলো, আবুল হোসেন কিছু বলার আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো, অতিশ চিৎকার করে বলছে,
-কাল রাইতে এই কুত্তার বাচ্চা মা দুগ্গার গায়ে হাত দিয়া তারে ধ্বংস কইরা দিছে, আর আজ আমার মায়ের গায়ে হাত দিছে, চাইনা এই ব্যাট চাইনা। দুরে ছুড়ে দেয় ব্যাটটি।
ঘটনার আকস্মিকতায় নিরুপমা দেবী থ মেরে ছিলো, স্বাভাবিক হয়ে ছেলের মুখ চেপে ধরে, এবার শক্ত করে ছেলের হাত ধরে, ছুটতে শুরু করে দেয় প্রচন্ড জোরে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কেউ দেখার আগেই এই গ্রাম ছাড়তে হবে, এই দৌড় ঠিক কোথায় গিয়ে থামবে তা জানেনা নিরুপমা দেবী……(সমাপ্ত)
বিষয়: বিবিধ
১৩৮৫ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন