বিশ্বাস
লিখেছেন লিখেছেন সিমানা ২৫ এপ্রিল, ২০১৪, ০৫:২৪:৪৪ বিকাল
১
-ওমা খিদা লাগছে……… নিরুত্তর মায়ের খেয়াল অন্য দিকে প্রচন্ড জোরে ঝড় হচ্ছে, বাঁশে তৈরী দরোজা জানালা শক্ত করে বন্ধ করে দেয়া থাকলেও মাথার উপরে নড়েবড়ে টিনের ছাদটি বড়ই বেপরোয়া ভাবে ঝড়ের তালে তাল মিলিয়ে নড়াচড়া শুরু করে দিয়েছে, না জানি কোন যুদ্ধে যাবার নেশায় মেতেছে। সেদিকেই তাকিয়ে আছেন ক্ষুধার্ত ছেলেটির মা নিরুপমা দেবী, সিঁথিতে লাল টকটকে সিঁদুর, বিবর্ণ মলিন চেহারায় ফ্যাকাশে ভাবখানা স্পষ্ট। সামনেই পুতুলের মতো ছোট্ট দূর্গা দেবীর আসন, কিছু ফুল, পাতা দিয়ে যত্ন করে সাজানো। নিরুপমা দেবীকে এবার জোরে ঝাকালো নিরুপমা দেবীর ছেলে অতিশ কুমার,
-মা খিদা লাগছে, শুননা ক্যান? আশ্চর্যরকম ভাবে চমকে উঠলো নিরুপমা, এতোক্ষন তার ভাবখনা এমন ছিলো যে ছেলের কথা শুনেও না শোনার ভান করে আছে, কিন্তু না তা নয়। ছেলের কথা সে শুনতেই পায়নি, বড়ই বিমর্ষ সে মাথার ছাদ হারানোর আগমূহুর্তে শোকে বিহবল হয়ে পড়েছে। আর চমকে উঠেছে এই ভেবে যে, যাহ! টিনের চাল বুঝি উড়ে গেছে!আসল ব্যাপারটি খেয়াল করে, অতিশের গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিলো,
-খালি খাওন আর খাওন, যা বাপের কাছে গিয়া ক, আমি কই থিকা তরে খাওন দিমু। অতিশের কান্নার শব্দ আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে, কিন্তু তা ঘরের সীমার মধ্যেই থেকে গেলো। মেঘের থেকে থেকে গর্জন আর বৃষ্টি, ঝড়ের শব্দে অতিশের কান্না ঠিক আকাশ পর্যন্ত পৌছতে পারছেনা। নিরুপমা দেবীর রাগ মাথায় উঠেছে, -কতবার কইলাম চলো ভারত চইলা যাই ওইহানে গিয়া মন্দিরে তিনবেলা প্রসাদ অইলেও পাওন যাইবো কে শোনে কার কথা, আমি মরি তোগো লাইগ্যা, আর……… জোরে দরোজা ধাক্কানোর শব্দ শুনে থেমে গেলো নিরুপমা দেবী। উঠে দরোজা খুলে যে মানুষটিকে দেখলো, সে মানুষটির পুরো ঠোঁট জুড়ে বিস্তৃত হাসি, কিছু পেয়ে যাবার আনন্দ পুরো মুখমন্ডলে। অতিশ কান্না থামায়, খুশিতে আটখানা সে,
-কাকা!!
২.
বেশ কিছুদিন পর……
সেদিনের ঝড়ে টিনের ছাদটিকে উড়িয়ে নিয়ে যায়নি, বরং ঝড় শেষেই শক্ত করে মেরামত করা হয়েছে। অতিশ আজ বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে, গত কয়েকদিন তিন বেলা পেট পুরে খেতে পেয়েছে সে। রাস্তায় বন্ধুদের সাথে ছুটছে আর কথা বলছে,
-কাকাই আব্বারে ভারত পাঠাইয়া দিছে, আব্বা ভালো চাকরী করতাছে, দুই তিনমাস পর আমরাও যামু।
অবাক হয় বন্ধুরা, মনও খারাপ হয়ে যায়,
-আমাগো কথা মনে থাকবো?
গ্রামের শ্যামল ছায়ায় ছুটছে বালকগুলো, ছুটন্ত এই বালকগুলো নীড়ে ফেরার রাস্তা ধরেছে, নিষ্পাপ মনে হচ্ছে ওদেরকে। পাশাপাশি ছুটছে, এই কথা শুনে মলিন হয়ে যায় আট বছরের অতিশের মুখটি, থমকে দাঁড়ায় একটি গাছের নিচে, সাথে বাকী দুজনও,
-নারে ক্যামনে ভুইলা যামু ক? তরা যাবি আমার সাথে?
ওরা আর কিছু বলেনা, বাবা মা ভাই বোন ছেড়ে ওরা কী করে যাবে অতিশের সাথে? অতিশও ব্যাপারটা বুঝতে পারে, তাই এবার যে যার মতো নিজেদের বাড়ির পথে চলে যায়।
অতিশ দরোজা নক করলো, একটাই মাত্র রুম, বারান্দা নেই, নেই কোন আঙ্গিনা। সচরাচর দিনের বেলা এই দরোজা বন্ধ থাকেনা। অতিশ প্রায় পাঁচমিনিট ধরে নক করতে করতে বিরক্ত হয়ে জোরে ধাক্কা দেয়,
-মা, ওমা দরোজা খুলতাছনা ক্যান?
দরোজা খুলে গেলো, সামনে দাড়ানো সেই কাকাটি, রাগ নিমিষেই পড়ে গেলো অতিশের,
-কাকা কহন আসছ?
বিব্রত কাকার পুরোটা ঘেমে একাকার,
-এইতো তুমি কই গেছিলা?
-খেলতে, মা কই?
নিরুপমা দেবী শাড়ীর আঁচল ঠিক করতে করতে বেরিয়ে আসে,
-কীরে কহন গ্যাছস, সন্ধা পার অইছেনা?
কাকার উচ্ছসিত কন্ঠ, মুখে বিশ্রি হাসি, অতিশের কাছে কাকার এই হাসিটা সবসময় খুব বিরক্ত লাগ্ তাই ঐ সময় সে কাকার মুখের দিকে তাকায়না। বললো,
-নিরু বৌদী অতিশের খেলনা গুলা দিয়া দাও আমি আসতাছি।
অতিশ খুশিতে আটখানা, সে মাকে লক্ষ্য করে বললো,
-কাকাই খুব ভালা না মা?
নিরুপমা দেবী নিরুত্তর, আজ যা হলো তাতে এ পৃথিবীর সবকিছু যেন তার দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হাসছে এরকমতো হওয়ার কথা ছিলোনা, অতিশের বাবা কতোদিন হয়ে গেলো লা-পাত্তা। আর অতিশ যাকে খুব ভালোবেসে কাকা ডাকে সে এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, সরকার দলীয়, যে সরকার রাজাকার আর যুদ্ধাপরাধী নিধনে নেমেছে। এই চেয়ারম্যান আবুল হোসেন যুদ্ধাপরাধীর দলে পড়ে নাকী রাজাকারের দলে পড়ে নিরুপমা দেবী তা জানেনা, জানতেও চায়না ভাবতেও চায়না। কারণ আবুল হোসেন বিনিময়ে অনেক কিছু দিচ্ছে, তিনবেলা ছেলেকে নিয়ে পেট ভরে খেতে পারছে, এইতো ভালো। চলবে
বিষয়: বিবিধ
১২৯৫ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন