আব্বুর চলে যাওয়া

লিখেছেন লিখেছেন সিমানা ০৪ এপ্রিল, ২০১৪, ১০:৫৭:৫২ সকাল



সংগ্রামী মানুষের সারীতে আমি আমার আব্বুকে রাখি। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর সংগ্রাম করতে হয়েছে। মানুষের স্বপ্নগুলো যার যার কাছে বিশাল মূল্যবান, কেউ স্বপ্ন দেখে আকাশ ছোঁয়ার, কেউবা স্বপ্ন দেখে তিনবেলা পেট ভরে খাবার খাওয়ার। আব্বুর ও একটা স্বপ্ন ছিলো। ইংলিশে অনার্স পড়ার, কিনতু ডিগ্রী পড়েছেন। আমাকে যখন পড়াশুনার ব্যাপারে কিছু বলতেন তখন কথাগুলো শুরু করতেন এইভাবে, "পৃথিবীতে ভালো মানুষরা রুপের চেয়ে গুণের কদর করে বেশী। আমার একটা স্বপ্ন ছিলো, ইংলিশে অনার্স পড়বো, কিন্তু অর্থের অভাবে পড়তে পারিনি মা! সকালবেলা পান্তার ভাতুন খেয়ে (পান্তার পানি) সেই ৩ থেকে চার মাইল পরিমাণ হেঁটে স্কুল যেতাম, ফিরে এসে রেষ্ট নেয়ার সূযোগ ছিলোনা, হয়তো না খেয়েই জমির কাজে যেতে হতো। একটু থামতেন, পরে স্বাভাবিক কন্ঠে বলতেন, আমি ইংলিশে অনার্স করতে পারিনিতো কী হয়েছে আপনি আমার স্বপ্ন পূরণ করবেন! একটা প্রাণখোলা হাসিতে পুরো মুখমন্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠতো! আমি তাকিয়ে দেখতাম!

আব্বুকে হারিয়েছি মাত্র আট বছর বয়সে। আব্বুর প্রতিটি কথা আজও আমার কানে বাজে যেন! সাংগঠনিক কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। যদিও তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুটা ছিলো সেক্যুলার, কিন্তু পরবর্তীতে সব জেনে বুঝে যৌক্তিকভাবে এই পথে এসেছেন! আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ! শাহাদাতের তামান্না বুকে ধারণ করে পথ চলেছেন, জায়নামাজে বসে যখন মোনাজাত করতেন খুব কাঁদতেন, তাঁর সেই কান্না আমাকেও কাঁদিয়ে ছাড়তো! খুব বেশী সময় আব্বুকে কাছে পাইনি, যেটুকু পেয়েছি তাতে আদর্শগত দিক থেকে অনড় অটল ছিলেন! কোন ধরণের অন্যায়ের পক্ষে তাঁর আপোষ ছিলোনা, যে কারণে গ্রাম্য শালিস গুলোতে আব্বুকে সকলে প্রধান বিচারক হিসেবে আহবান করত লোকেরা। তবে বিচার শেষে ফিরে আসার পর তাকে খুব বিমর্ষ দেখাতো একদিন আম্মুকে বলতে শুনেছি, " এই বিচারের দায়িত্বগুলো পালন করা বড় কঠিণ, প্রতিটি সময় আমার ভেতরটা তটস্থ থাকে, আমি ঘাবড়ে যাই, যদি ভুল কোন ফায়সালা দিয়ে থাকি তাহলে!" এর বেশ কিছুদিন পর আব্বু আমাদেরকে বললেন, আমি আজ একটা খুব ভালো স্বপ্ন দেখেছি। আমি লক্ষ্য করেছিলাম আব্বুর আনন্দে মুখরিত মুখাবয়ব দেখে মনে হচ্ছিলো আব্বু পারলে যেন লাফালাফি করেন ছোট বাচ্চাদের মতো, আম্মু অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন, বলেছিলেন কী স্বপ্ন! আব্বু খুব ধীর স্থীর অথচ আনন্দিত কন্ঠে, "আমি একটা বিচার শেষ করে চুপচাপ বসে আছি, তখন হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এসে আমার পিঠ চাপড়িয়ে বললেন, চিন্তা করছো কেন, তুমি সবসময় ন্যায় বিচার করেছো, ভয় পেওনা!"

আমরা চার বোন আমাদের ভাই নেই। পরপর চারজন মেয়ে হওয়ায় প্রতিবেশীদের ঠাট্টা উপহাসের অন্ত ছিলোনা, এ নিয়ে আম্মুরও মন খারাপ ছিলো। আব্বু ছোট বোনটাকে আদর করতেন আর বলতেন, আমার এই মেয়েই দেখে নিও ঘর আলো করে রাখবে। চারটা মেয়েতো কী হয়েছে, আল্লাহর রসুলেরও তো চারজন মেয়ে ছিলো। ইনশাআল্লাহ চার মেয়ে চারটা জান্নাতের সুসংবাদ নিয়ে আসবে। আব্বু যখন খেতে বসতেন তখন দুইপাশে আমার মাঝখানের দুই বোনকে কোলে নিয়ে বসে খেতেন, আম্মুর রান্নার কাজে সাহায্য করতেন।

আব্বু আবার মুক্তিযুদ্ধও করেছেন, যদিও বয়স খুব বেশী ছিলোনা, অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলো আমি আমার ফুফুর কাছে শুনেছিলাম, আব্বুর সমবয়সী ১৭ জনের কমান্ডার ছিলেন! এখন ভাবি আব্বু বেঁচে থাকলে হয়তো যুদ্ধাপরাধীর অভিযোগে আটকে রাখা হতো!

আমি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আজ অব্দি আব্বুর কিছু কিছু কথা বারবারই বলে থাকি। এটা স্বাভাবিক যে একই কথা বারবারই বললে শ্রোতার শোনার আগ্রহ কমে গিয়ে বরং সেখানে বিরক্তি জমা হয়, কিন্তু কি করবো? আব্বুর সাথে নতুন গল্প, নতুন ঘটনা আর কখনোই তৈরী হবেনা যেগুলো তুলে ধরবো! তাই স্মৃতির ফ্রেমে বন্দী কথা, ঘটনাগুলোই বারবার বলি! আব্বুর শাহাদাতের দিনটি ছিলো, ১৯৯৭ সালের ২২শে জুলাই সোমবার। মসজিদের জমি লুটেপুটে খাচ্ছিলো একদল লোক, তাদের এই অন্যায় প্রতিহত করতে গিয়ে রক্তাক্ত হতে হয় আব্বুকে! খুনিদের পায়ে মল পরা ছিলো, আর হাতে ছিলো বিশাল বিশাল সাইজের অস্ত্র, আমি আব্বুর সাথে স্কুল থেকে ফিরছিলাম, নিজে চোখে দেখেছি অস্ত্রগুলো! গ্রামের সবাই আব্বুর পক্ষে ছিলো, কিন্তু এদের কোনই অস্ত্র ছিলোনা, সদ্য কেঁটে আনা কাঁচা বাশের লাঠি, গ্রামের মসজিদে মাইকিং,

"আব্দুর রাজ্জাক ভাইে ওরা আক্রমণ করেছে তোমরা কে কোথায় আছো চলে এসো!"

শত্রুরা চরেদিকে অন্ধকার করে ফেলে, আজ জানি ওটার নাম ককটেল পরে আব্বুকে পড়ে যেতে দেখে চিৎকার করে বলেছিলাম "আব্বু"! ওটাই ছিলো শেষ ডাক! আর ডাকতে পারিনি! মাঝেমাঝে মনে হতো আব্বু আছেনই কোথাও, কিন্তু ডাকতে গেলে আব্বুর অস্তিত্বের অনুপস্থিতি আমার কন্ঠনালীকে সবসময় রুদ্ধ করে দিতো! আব্বুর জন্য কিছুই করা হয়নি, অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম কিন্তু ইংলিশে করা হয়নি! একটা কাজই এখন করতে পারি, আব্বু যে সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে ছিলেন সে পথেই আমিও আছি, থাকবো ইনশাআল্লাহ! আর মহান স্বত্তার নিকট আকুতি "আব্বু যেন শাহাদাতের মর্যাদা পেয়ে জান্নাতের খাস মেহমান হতে পারেন, আমারও খুব ইচ্ছে করে শহীদ হতে, হযরত সুমাইয়া, আসমা বেলতাগী, হাওলাদর মতো নিষ্পাপ হতে! ও মালিক তুমি কবুল করো! সবশেষে আব্বু আম্মুর জন্য রব্বির হাম হুমা কামা রব্বা ইয়ানিস সগীরা" আমীন!!

বিষয়: Contest_father

১৩৭৪ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

202423
০৪ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ১১:১৬
রাইয়ান লিখেছেন : হৃদয় ছোঁয়া একটি লেখা .... আল্লাহ আপনার বাবাকে আখিরাতে সীমাহীন মর্যাদা দান করুন !
০৪ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:০৬
152022
সিমানা লিখেছেন : অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। আমীন!
202431
০৪ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ১২:০৩
শিশির ভেজা ভোর লিখেছেন : পড়ে কষ্ট পেলাম। আল্লাহ আপনাদের হেফাজত করুন আর আপনার বাবাকে জান্নাত নসিব করুন। আমিন
০৪ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:০৬
152023
সিমানা লিখেছেন : আমীন। জাজাকল্লাহ।
202433
০৪ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ১২:০৫
হারিয়ে যাবো তোমার মাঝে লিখেছেন : আপনারা চার বোন আর আমরা চার ভাই। Sad Sad অত্যন্ত দরদ দিয়ে লেখা। পরিবারের কেউ চলে গেলে ভীষণ কষ্ট লাগে।
০৪ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:০৭
152024
সিমানা লিখেছেন : হুম,বিপরীতমুখী মিল জেনে ভালো লাগলো।
সত্যিই তাই! অনেক ধন্যবাদ।
202441
০৪ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ১২:১১
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
০৪ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:০৮
152026
সিমানা লিখেছেন : মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
202467
০৪ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০২:৩০
নাবীল লিখেছেন : ধন্যবাদ । ভালো লাগলো ।
০৪ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:০৮
152027
সিমানা লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
202548
০৪ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১০:৪৮
ফেরারী মন লিখেছেন : আপনার বাবা জান্নাতের ফুল হয়ে সুবাস ছড়াক সেই কামনাই করি। Praying Praying
০৫ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ০৭:৫৭
152134
সিমানা লিখেছেন : আমীন! ধন্যবাদ, মন্তব্যের জন্য।
202686
০৫ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ১২:১৪
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : এখন ভাবি আব্বু বেঁচে থাকলে হয়তো যুদ্ধাপরাধীর অভিযোগে আটকে রাখা হতো!- বর্তমান পরিস্থিতিতে বিচিত্র নয়।
বাবার আদর্শ নিজের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করাই ভালোবাসার সবচেয়ে বড় নিদর্শন Happy
০৫ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০২:০৯
152219
সিমানা লিখেছেন : ঠিকই বলেছেন, এখন বিচিত্র বিষয়গুলোই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাজাকাল্লাহ খাইরুন!
202790
০৫ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৪:৪৪
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : হৃদয় ছুঁয়ে গেলো।
আল্লাহ আপনার আব্বুকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন।
০৫ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:৩১
152301
সিমানা লিখেছেন : অসংখ্য ধন্যবাদ, সুন্দর মন্তব্যের জন্য। আমীন।
206628
১২ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৯:০২
জেদ্দাবাসী লিখেছেন : আপনার বাবার ভিতর জান্নাঁতের ঘ্রান পাচ্ছি ।
আল্লাহ নিশ্চয় তাহাকে শহীদের মার্যাদায় রেখেছেন ।
রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা ।
জাযাকাল্লাহ খায়ের
১৪ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৮:১৯
156434
সিমানা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ। আল্লাহুম্মা আমীন
১০
226799
২৭ মে ২০১৪ রাত ০১:৩২
নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা লিখেছেন : আল্লাহ আপনার বাবাকে জান্নাত নসীব করুন।
২৭ মে ২০১৪ দুপুর ০১:১৯
173828
সিমানা লিখেছেন : আমীন। ছুম্মা আমীন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File