"শেষ চিঠি"
লিখেছেন লিখেছেন Medha ২৬ মার্চ, ২০১৪, ০১:০১:৪৬ রাত
“ খোকা,আবার কবে আসবি?
আমি জানি তুই বলবি –‘মা ১ মাস
আগে না আসলাম।!’ কিন্তু আমার
যে তোকে ছাড়া ভালো লাগে না।
পুরো বাড়িটা খালি খালি লাগে।
মিনু টা পাশে আছে বলেই
বেঁচে আছি।তুই তো আমার খবর ও
নিস না।! ছুটি পেলেই
তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসিস।
এবার এলেই তোর সাথে মিনুর
বিয়েটা সেরে ফেলব।
এতো ভালো মেয়ে তুই জীবনেও
পাবি না এই বলে রাখলাম। মিনুর
বাবার সাথেও কথা পাকাপাকি।
তারা তো পারলে আজই
বিয়ে সেরে ফেলেন এমন অবস্থা।
তুই তাড়াতাড়ি ফিরে আয় বাবা।
তাড়াতাড়ি আয় আমার আর
তোকে ছাড়া ভালো লাগে না। তোর
জন্য একটা জামায় ফুল তুলেছি,তুই
আসলে পড়ে বলিস তোর
ভালো লেগেছে কিনা। না লাগলেও
বলিস।আমি নাহয়
আরেকটা করে দিবো!
ইতি তোর মা”
চোখের কোনটা অজান্তেই
ভিজে উঠলো আসাদের।
“মা যে কি না!” হাতের
উল্টো পিঠ
দিয়ে চোখটা মুছে দ্বিতীয়
খামটা খুলল। মিনুর চিঠি।
মা লিখতে পারে না।মা বলে আর
মিনু লিখে দেয়। তার
সাথে লুকিয়ে নিজেও
একটা চিঠি পাঠায়।
চিঠিগুলো ভীষণ গুছানো আর
অভিমানে ভরা থাকে। চিঠির ভাঁজ
খুলল সে।
“শুনো, আমাদের জন্য
ভেবো না আমরা ভালো আছি।
মা তোমার কথা খুব বলে। তোমার
কথা খুব মনে পড়ে তো তাই। আর
কেউ তোমার কথা ভেবে জল
ফেলে এমনটা ভুলেও ভেবনা।!
তোমার কথা আমার একদমই
মনে পড়ে না।! মনে পরবেই
বা কেন?তুমি আমার কে?!
আর সেবার বিয়ের ব্যাপারে আমার
মতামত জানতে চেয়েছিলে।সেদিন
বলিনি আজ বলছি জেনে নাও।
কোনো বোকারামকে আমার
বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা নেই।
বিশেষ করে তাকে তো নয়ই
যাকে সব বলে বুঝাতে হয়!
একটা মেয়ে কেনো একটা ছেলের
পথ
চেয়ে বসে থাকে যে সে কবে শহর
থেকে বাড়ি ফিরবে,কেনো ছেলেটার
অনুপস্থিতিতেও তার
ঘরটা প্রতিদিন গুছিয়ে রাখে এসব
ও যাকে বলে বুঝাতে হয়
তাকে আমি কোনো ভাবেই
বিয়ে করব না এই বলে রাখলাম।
ভালো থেকো।
যদি পারো তবে জলদি বাড়ি ফিরে এসো।
মা বলেছেন।
আমি বলেছি ভেবো না আবার!
ইতি মিনু”
বুকের ভিতর এক ধরনের সুখের
বাতাস বইতে লাগলো আসাদের।
মিনুকে কখনোই মুখ ফুটে মনের
কথা বলা হয়নি,বলা হয়নি মিনুর
কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস
করে “আমি সব জানি,সব বুঝি”
= কিরে হাসছিস যে?কার চিঠি?
বাড়ি থেকে চিঠি এসেছে?
- হুম মায়ের চিঠি আর মিনুর চিঠি
= হুম হুম সেটা তো বুঝতেই
পেরেছি। শোন,
বিয়েটা সেরে ফেল।
-হুম চাকরিটা পেলেই
বিয়েটা সেরে ফেলব।
চাকরি না পেলে বউকে খাওয়াব
কি?
=হুম
দোয়া করি চাকরিটা জলদি পেয়ে যা।
আমিও যাতে দাওয়াত
খেতে পারি তাড়াতাড়ি ।কতদিন
ভাল-মন্দ খাই না।!হলের খাবার
আর ভালো লাগে না
-মন থেকে দোয়া কর।
=হ,এখন লাইট নিভা।রাত হইসে।
ঘুমে মরি!
-চিঠির জবাব
টা দিয়ে দি দাড়া একটু
অপেক্ষা কর।
=হুম।
...।মিনিট পাঁচেক এর মধ্যে পাশের
খাট থেকে নাক ডাকার শব্দ
আসা শুরু করলো! আসাদ
চিঠি লিখতে বসলো।
"
২৫/০৩/১৯৭১
মা,
সালাম নিও।আজ বিকেলেই তোমার
চিঠি পেলাম।
তোমাকে ছাড়া থাকতে আমারও
ভালো লাগে না মা।ফাইনাল
পরিক্ষার ফল টা দিলেই
বাড়ি ফিরব। আর মা, বিয়ের
কথা কিছু আমি এখন ভাবছি না।
তোমার পছন্দে আমার অমত নেই!
কিন্তু আমি এখনই
বিয়ে করতে পারব না।
আগে চাকরিটা তো পেতে দাও।
চাকরি না পেলে বউকে খাওয়াব
কি? চাকরী টা পাওয়া মাত্র
তুমি যখন বলবে আমি তখনই
বিয়ে করতে রাজি আছি।
আর তুমি আমার জন্য জামায়
যে ফুলটা তুলেছ সেটা অনেক সুন্দর
হয়েছে আমি না দেখেই
বলে দিতে পারি।
আমি ফিরে আসলেই ওটা পরবো।
যত্ন করে তুলে রাখ। ছুটি পেয়েই
আমি দৌড়ে চলে আসব মা ভেবো না।
আমি শিগ্রই আসছি মা ।
ভালো থেকো মা। ইতি তোমার
খোকা”
মায়ের চিঠিটা ভাঁজ
করে খামে ঢুকিয়ে আরেকটা চিঠি লিখতে বসলো।
মিনুর জন্য!
“অনেক ভেবেছি কি সম্বোধন করব।
যাই সম্বোধন করি তাই মনে হয়
বাহুল্যতা! আবার
না করলে মনে হয় কি যেনও নেই!
তবে ‘আমার মিনু’ দিয়েই
চালিয়ে দি,কি বলো?!
মিনু,তুমি কি ভেবেছ আমি আসলেই
কিছু বুঝি না? আমি সব বুঝি, শুধু
কখনো তোমায় বলা হয়নি।
তুমি জানো গ্রাম
থেকে ফিরে আসার সময় আমার
যে কাপড়গুলো তুমি গুছিয়ে দাও
সেগুলোতে নাক ডুবিয়ে আমি তোমার
হাতের ঘ্রান খুঁজি?
কখনো বলেছি তোমার
চিঠিগুলো আমি নিরবে-
নিভৃতে কতবার পড়ি, চিঠির
ভাঁজে ভাঁজে তোমার ছোঁয়ার
উষ্ণতা খুঁজি।?? বলিনি,
কখনো বলিনি । চাকরিটা পেলেই
তোমায় বউ করে ঘরে তুলবো। তখন
কানে কানে এসব বলার জন্য অনেক
সময় পাওয়া জাবে,তখনই বলব
নাহয়!
ভালো থেকো ।আমার মিনু ।
ইতি আসাদ”
চিঠিগুলো ভাঁজ করে বুক
পকেটে রেখে শুয়ে পড়তেই
আচমকা গলাগুলির
শব্দে চমকে উঠলো।
শফিকটা ঘুমিয়েই পড়েছিল
এতো বিকট শব্দে সে ও লাফিয়ে ঘুম
থেকে জেগে উঠলো।
-কিসের শব্দরে?
=জানি না।
গোলাগুলির শব্দ নিচ
থেকে আসছিল, মানুষের কান্নার
শব্দ ও পাওয়া যাচ্ছে। পাশের
রুমের জামিল দৌড়ে আস্ল।
ভয়ে আতঙ্কে মুখ সাদা হয়ে গেছে।
কোনো রকমে বলল “ভাই পালা।
মিলিটারি নেমেছে শহরে ।
হলে হলে গুলি চালাচ্ছে।নিচের
তলায় ও বোধ হয় আর কেউ
বেঁচে নেই।
আমি জানালা দিয়ে দেখেছি ক্যান্টিনের
করিম কাকাকে আমার
সামনে গুলি করে মারল।
সবাইকে মেরে ফেলবে পালা...। –
কথাগুলো বলে জামিল কোথায়
জানি দৌড়ে পালালো। মাথা কাজ
করছে না আসাদ আর শফিকের।
মাথায় শুধু এতটুকু কাজ
করছে পালাতে হবে!
দৌড়ে তারা নিচে নামতেই
বাতাসের ঝাপটায় তাজা রক্ত আর
বারুদের গন্ধ নাকে লাগলো। লাইট
বন্ধ থাকায়
অন্ধকারে ডুবে আছে নিচের তলা।
নিচের তলায় কোনো একটা রুম
থেকে গোলাগুলির শব্দ আসছে।
তাড়াতাড়ি দৌড়াতে দিয়ে কিছু
একটাতে ধাক্কা খেয়ে পিছলে পড়ে যায়
সফিক ।অন্ধকার হলেও
বুঝতে অসুবিধা হয়না জিনিসটা কি!
মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল
একটা স্রতধারা বয়ে গেল। আসাদ
দৌড়ে একটা রুমের
সামনে দিয়ে যেতেই ৪/৫
টা হানাদার বাহিনির
মুখোমুখি হয়ে গেলো।
রুমটাতে আলো জলছিল।
খলা দরজা দিয়ে রুমের
আলো সামনের করিডোর
টাতে এসে থমকে দাঁড়িয়ে আছে।
যেনও ঘটনার আকস্মিকতায় সেও
স্তব্ধ! সে আলোতে ৪/৫ টা সৈন্য
আর আসাদ দাঁড়িয়ে আছে। শফিক
অন্ধকারে নিঃশ্বাস আটকে ডুবে ওই
লাশটার পাশেই শুয়ে পরল।নিথর
লাশটার বুকের
ফুটো গড়িয়ে পড়া রক্ত
নিয়ে বেশি করে নিজের
গায়ে মেখে শুয়ে পরল।
রক্তে তখনো উষ্ণতা ছিল! শফিক
আধবোজা চোখ দিয়ে সেই
থমকে যাওয়া আলোতে ৪/৫
টা সৈন্যের গুলিতে আর
একটা প্রান
ঝাঁজরা হয়ে লাশে পরিনত
হতে দেখলো।আসাদ ঢলে পড়তেই
পশুগুলো আসাদের
বুকে পা দিয়ে লাথি হলের
বাইরের দিকে পা বাড়াল। দুইহাত
মুখে চেপে চিৎকার
আটকে অন্ধকারেই পড়ে রইল সফিক।
সেভাবেই মিনিট খানেক
পড়ে রইল।তারপর দৌড়ে আসাদের
লাশের কাছে আসলো। লাশের
রক্তে ফ্লোর পিচ্ছিল
হয়ে আছে। ...। আসাদ।।এই আসাদ...
এই উঠ, আসাদ তোর মায়ের
কাছে যাবি না এই আসাদ।।আরে উঠ
নাআআ......। আসাদের বুক পকেট
থেকে একটা কাগজ মুখ বের
করে আছে।
অর্ধেকটা রক্তে ভিজে গেছে...
চিঠিগুলো পড়ার চেষ্টা করে সে।
রক্তে ভিজে বেসির ভাগ শব্দই
অস্পষ্ট হয়ে আছে শেষের লাইন
দুটো আবছা আবছা বোঝা যায়
“ছুটি পেয়েই আমি দৌড়ে চলে আসব
মা ভেবো না।আমি শিগ্রই
আসছি মা”
চোখ মুছে আসাদের
নেতিয়ে পড়া মাথাটা বুকে চেপে ধরে হাউমাউ
করে কেঁদে উঠে শফিক। ...আসাদ
উঠ ,উঠ ভাই। তোর এই
চিঠি আমি তোর
বাড়িতে পাঠাতে পারব না।
খালার কাছে আমি কি বলব??
আসাদ... তোর কাছে আমি আর
কখনো কিছু চাইবো না।একবার চোখ
খুল............ ।
বাইরে দূরে কোথাও গোলাগুলির
শব্দ তখনো চলছে।।
বিষয়: বিবিধ
১০৪৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন