বৃদ্ধাশ্রম মা-বাবার কোন অপরাধের শাস্তি? জন্ম দেওয়ার!
লিখেছেন লিখেছেন রেজাউলকরিম ২৩ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৭:৩৮:৩২ সন্ধ্যা
বৃদ্ধাশ্রমে এক বৃদ্ধ মহিলা সব সময় মন খারাপ করে বসে থাকতেন। তিনি কখনোই কারো সাথে কোনো কথা বলতেন না। বৃদ্ধাশ্রমের রেজিস্টার খাতায় লেখা না থাকলেও সবাই তাকে বোবা বলেই ধরে নিয়েছিলো। তিনি কাউকে কখনো কোনো কিছুর জন্য অনুরোধও করতেন না। দিনের বেশির ভাগ সময়ে তার দোলন চেয়ারে বসে দোল খেতেন।
বৃদ্ধাকে তার কোনো আত্বীয় কখনো দেখতেও আসতো না। কিন্তু প্রতিদিন সকালে এক সহৃদয় নার্স তার রুমে যেতো। সে কখনোই বৃদ্ধার সাথে কোনো কথা বলার চেষ্টা করতো না,কোনো প্রশ্নও করতো না। শুধু আরেকটি চেয়ার বৃদ্ধার পাশে টেনে নিতো এবং তার সাথে বসে থাকতো।
এভাবে সপ্তহের পর সপ্তাহ গেল, মাসের পর মাস গেল।বৃদ্ধা একদিন নার্সের দিকে তাকিয়ে অশ্রুসজল কন্ঠে বলে উঠলো, 'ধন্যবাদ','তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে সময় দেওয়ার জন্য।'
আপনার বৃদ্ধ মা-বাবা আপনার কাছে খুব বেশি কিছু চান না। তারা আপনার ব্যস্ত দিনের খুব ছোট একটা সময় চান।
বলা হয়ে থাকে ভালোবাসা দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে খুব আস্তে আস্তে কড়া নাড়তে থাকে। শোনার সময় কি আপনার আছে?
অথচ, আমরা সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যাস্ত, মা-বাবা কে দেখাশোনা করার সময় নেই, বড়ই দূঃখের ব্যাপার কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি যে, এর পরিনতি কি হবে? দেখুন কুরআন ও হাদীস মা-বাবার সম্পর্কে কি বলেঃ
পিতা-মাতার আদব, সম্মান ও আনুগত্যের গুরুত্বঃ
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
অর্থ-তাদের সামনে ভালবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বলঃ হে পালনকর্তা, তাঁদের উভয়ের প্রথি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। সূরা-বানী-ইসরাঈল/ইসরা-আয়াত-২৪
পিতা-মাতার আদব, সম্মান ও আনুগত্যের গুরুত্বঃ
ইমাম কুরতুবী বলেনঃ এ আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা পিতা-মাতার আদব, সম্মান এবং তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহার করাকে নিজের ‘ইবাদাতের সাথে একত্রিত করে ফরয করেছেন। যেমন, সূরতুল লুক্বমানে নিজের শোকরের সাথে পিতা-মাতার শোকরকে একত্রিত করে অপরিহার্য করেছেন। বলা হয়েছেঃ
أن اشكرلى ولوالديك* إلى المصير*-অর্থাৎ, আমার শোকর করা এবং পিতা-মাতারও। এতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাতের পর পিতা-মাতার আনুগত্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং আল্লাহ্ তা’আলার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার ন্যায় পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়াও ওয়াজিব। স’হীহ্ বুখারীর একটি ‘হাদসিও এর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়।
‘হাদীাসে রয়েছে, কোন এক ব্যক্তি রসূলুল্ল-হ্ স্বঃ-কে প্রশ্ন করলঃ আল্লাহ্র কাছে সর্বাধিক প্রিয় কাজ কোনটি? তিনি বললেনঃ (মুস্তাহাব) সময় হলে নামায পড়া। সে আবার প্রশ্ন করলঃ এরপর কোন কাজটি সর্বাধিক প্রিয়? তিনি বললেনঃ পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার।–(কুরতুব)
’হাদীসের আলোকে পিতা-মাতার আনুগত্য ও সেবাযত্নের ফযীলতঃ
মুসনাদে আ’হমাদ,তিরমিযী, ইবনে মা-জাহ, মুস্তাদ্রক ‘হাকেমে বিশুদ্ধ সনদসহ আবুদ্দার্দা- রদ্বিঃ থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, রসূলুল্ল-হ্ স্বঃ বলেনঃ পিতা জান্নাতের মধ্যবর্তী দরজা। এখন তোমাদের ইচ্ছা, এর হেফাযত কর অথবা একে নিষ্ট করে দাও। (মাযহারী) (১) তিরমিযী ও মুস্তাদ্রক ‘হাকেমে ’আব্দুল্ল-হ্ ইব্নে ’উমারের রেওয়ায়েতে বর্ণিত রয়েছে যে, রসূলুল্ল-হ্ স্বঃ বলেনঃ পিতা জান্নাতের মধ্যবর্তী দরজা। এখন তোমাদের ইচ্ছা, এর হেফাযত কর অথবা একে বিনষ্ট করে দাও (মাযহারী) (২) তিরমিযী ও মুস্তাদ্রক ‘হাকেমে ‘আব্দুল্ল-হ্ ইব্নে ‘উমারের রেওয়ায়েতে বর্ণিত রয়েছে যে, রসূলুল্ল-হ্ স্বঃ বলেনঃ আল্লাহ্র সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে এবং আল্লাহ্র অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যে নিহিত।
(৩) আবূ উমামার বাচনিক ইব্নে মা-জাহ্ বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি রসূলুল্ল-হ্ স্বঃ-কে জিজ্ঞেস করলঃ সন্তানের উপর পিতা-মাতার হক কি? তিনি বললেনঃ তাঁরা উভয়েই তোমরা জান্নাত অথবা জাহান্নাম। উদ্দেশ্য এই যে, তাঁদের আনগত্য ও সেবাযত্ন জান্নাতে নিয়ে যায় এবং তাঁদের সাথে বে-আদবী ও তাঁদের অসন্তুষ্টি জাহান্নামে পৌঁছে দেয়।
(৪) বায়হাক্বী শু’আবুল্-ঈমা-ন গ্রন্থে এবং ইব্নে ‘আসা-কির ইব্নে ‘আব্বাসের বাচনিক উদ্ধৃত করেছেন যে, রসূলুল্ল-হ্ স্বঃ বলেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহ্র ওয়াস্তে পিতা-মাতার আনুগত্য করে, তার জন্যে জান্নাতের দু’টি দরজা খোলা থাকবে এবং যে ব্যক্তি তাদের অবাধ্য হবে, তার জন্যে জাহান্নামের দু’টি দরজা খোলা থাকবে। যদি পিতা-মাতার মধ্য থেকে একজনই ছিল, তবে জান্নাত অথবা জাহান্নামের এক দরজা খোলা থাকবে। একথা তখনও প্রযোজ্য যখন পিতা-মাতা এই ব্যক্তির প্রতি জুলুম করে? তিনি তিন বার বলেনঃ যদি পিতা-মাতা সন্তানের প্রতি জুলুমও করে তবু পিতা-মাতার অবাধ্যতার কারণে সন্তান জাহান্নামে যাবে। এর সারমর্ম এই যে, পিতা-মাতার কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার সন্তানের নেই। তাঁরা জুলুম করলে সন্তান সেবাযত্ন ও আনুগত্যের হাত গুটিয়ে নিতে পারে না।
(৫) বায়হাক্বী ইব্নে ‘আব্বাসের বাচনিক উদ্ধৃত করেছেন যে, রসূলুল্ল-হ্ স্বঃ বলেনঃ যে সেবা-যত্নকারী পুত্র পিতা-মাতার দিকে দয়া ও ভালবাসা সহকারে দৃষ্টিপাত করে, তার প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে সে একটি মকবূল হজ্জের ছাওয়াব পায়। লোকেরা আরয করলঃ সে যদি দিনে একশ’বার এভাবে দৃষ্টিপাত করে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, একশ’বার দৃষ্টিপাত করলেও প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে এই ছাওয়াব পেতে থাকবে। সুব্’হা-নাল্ল-হ্। তাঁর ভান্ডারে কোন অভাব নেই।
পিতা-মাতার ‘হক্ব নষ্ট করার শাস্তি দুনিয়াতেও পাওয়া যায়ঃ
(৬) বায়হাক্বী শু’আবুল্-ঈমা-নে আবূ বাকার রদ্বিঃ-এর বাচনিক বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্ল-হ্ স্বঃ বলেনঃ সমস্ত গোনাহের শাস্তির ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলা যেগুলো ইচ্ছা করেন কিয়ামত পর্যন্ত পিছিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু পিতা-মাতার ‘হক্ব নষ্ট করা এবং তাঁদের প্রতি অবাধ্য আচরণ করা এর ব্যতিক্রম। এর শাস্তি পরকালের পূর্বে ইহকালেও দেয়া হয়। (এর সবগুলো রেওয়ায়েতে তাফসীরে-মাযহারী থেকে উদ্ধৃত হয়েছে।)
কোন কোন বিষয়ে পিতা-মাতার আনুগত্য ওয়াজিব এবং কোন কোন বিষয়ে বিরুদ্ধাচরণের অবকাশ আছেঃ এ ব্যাপারে ‘আলেম ও ফেকাহ্বিদগণ একমত যে, পিতা-মাতার আনুগত্য শুধু বৈধ কাজে ওয়াজিব। অবৈধ ও গোনাহ্র কাজে আনুগত্য ওয়াজিব তো নয়ই; বরং জায়েযও নয়। ‘হাদীসে বলা হয়েছেঃ-لاطاعة لمخلوق فى معصية الخالق- অর্থাৎ, সৃষ্টিকর্তার নাফরমানীর কাজে কোন সৃষ্ট-জীবের আনুগত্য জায়েয নয়।
পিতা-মাতার সেবাযত্ন ও সদ্ব্যবহারের জন্য তাঁদের মুসলমান হওয়া জরুরী নয়ঃ
ইমাম কুরতুবী এ বিষয়টির সমর্থনে বুখারী থেকে আসমা রদ্বিঃ-এর একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন।
আসমা রদ্বিঃ রসূল স্বঃ-কে জিজ্ঞেস করেনঃ আমার জননী মুশ্রিকাহ্। তিনি আমার সাথে দেখা করতে আসেন। তাঁকে আদর-আপ্যায়ন করা জায়েয হবে কি? তিনি বললেনঃ-صلى أمك-অর্থাৎ, “তোমার জননীকে আদর-আপ্যায়ন করা।” কাফের পিতা-মাতা সম্পর্কে স্বয়ং কুরআন পাক বলেঃ –وصاحبهما فى الدنيا معروفا- অর্থাৎ, যার পিতা-মাতা কাফের এবং তাকেও কাফের হওয়ার আদেশ করে এ ব্যাপারে তাদের আদেশ পালন করা জায়েয নয়, কিন্তু দুনিয়াতে তাঁদের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে চলতে হবে। বলাবাহুল্য, আয়াতে মা’রূফ’ বলে তাঁদের সাথে আদর-আপ্যায়নমূলক ব্যবহার বোঝানো হয়েছে।
মাসআলাহ্ঃ যে পর্যন্ত জিহাদ ফরযে ‘আইন হয়ে যায়, ফরযে কিফায়াহ্র স্তরে থাকে, সে পর্যন্ত পিতা-মাতার অনুমিত ছাড়া সন্তানের জন্যে জিহাদে যোগদান করা জায়েয নয়।
স’হীহ্ বুখারীতে ‘আব্দুল্লাহ্ ইব্নে ‘উমারের রদ্বিঃ বাচনিক বর্ণিত রয়েছে, জনৈক ব্যাক্তি রসূলুল্ল-হ্ স্বঃ –এর কাছে জিহাদের অনুমতি নেয়ার জন্যে উপস্থিত হয়। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার পিতা-মাতা জীবিত আছেন কি? সে বললঃ জ্বী হাঁ, জীবিত আছেন। রসূলুল্ল-হ্ স্বঃ বললেনঃ তাহলে তুমি পিতা-মাতার সেবাযত্নে আত্ননিয়োগ করেই জিহাদ কর। অর্থাৎ, তাঁদের সেবা-যত্নের মাধ্যমেই তুমি জিহাদের ছাওয়াব পেয়ে যাবে। অন্য রেওয়ায়েতে এর সাথে একথাও উল্লেখিত রয়েছে যে, লোকটি বললঃ আমি পিতা-মাতাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় ছেড়ে এসেছি। একথা শুনে রসূলুল্ল-হ্ স্বঃ বলেনঃ যাও, তাঁদের হাসাও; যেমন কাঁদিয়েছ। অর্থাৎ, তাঁদেরকে গিয়ে বলঃ এখন আমি আপনাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জিহাদে যাব না। (কুরতুবী)
এ রেওয়ায়েত থেকে জানা গেল যে, কোন কাজ ফর্যে-’আইন না হলে এবং ফর্যে কিফায়াহ্র স্তরে থাকলে সন্তানের জন্যে পিতা-মাতার অনুমিত ছাড়া সে কাজ করা জায়েয নয়। দ্বীনী শিক্ষা অর্জন করা এবং তাবলীগের কাজে সফর করাও এর অন্তর্ভুক্ত। ফর্য্ পরিমাণ দ্বীনী জ্ঞান যার অর্জিত আছে, সে যদি বড় ‘আলেম হওয়ার জন্যে সফর করে কিংবা তাবলীগ ও দা’ওয়াতের কাজে সফর করে, তবে পিতা-মাতার অনুমিত ব্যতীত তা জায়েয নয়।
পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ কুরআন ও ‘হাদীসে উক্ত হয়েছে, পিতা-মাতার আত্নীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সাথে সদ্ব্যবহার করাও এর অন্তর্ভুক্ত। বিশেষ করে পিতা-মাতার মৃত্যুর পর।
স’হীহ্ বুখারীতে ‘আব্দুল্লাহ্ ইবনে ‘উমারের রদ্বিঃ বাচনিক বর্ণিত রয়েছে, রসূলুল্ল-হ্ স্বঃ বলেনঃ পিতার সাথে সদ্ব্যবহার এই যে, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বন্ধুদের সাথেও সদ্ব্যবহার করতে হবে। আবূ উসাইদ বদরী (রদ্বিঃ বর্ণনা করেনঃ আমি রসূলুল্ল-হ্ স্বঃ-এর সাথে বসেছিলাম, ইতিমধ্যে এক আনসার এসে প্রশ্ন করলঃ ইয়া রসূলাল্ল-হ্! পিতা-মাতার ইন্তেকালের পরও তাদের কোন ‘হক্ব আমার যিম্মায় আছে কি? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ তাদের জন্যে দু’আ ও ইস্তেগ্বফার করা, তাঁরা কারো সাথে কোন অঙ্গীকার করে থাকলে তা পুরণ করা, তাঁদের বন্ধুবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং তাঁদের এমন আত্মীয়দের সাথে আত্মীয়তা বাজায় রাখা, যাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক শুধু তাঁদেরই মাধ্যমে। পিতা-মাতার এসব ‘হক্ব তাঁদের পরও তোমার যিম্মায় অবশিষ্ট রয়েছে।
আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে নিজ পিতা-মাতার সাথে স্বদাচারণ,সেবা-যত্ন ও তাঁদেরকে হাসি-খুশিতে রাখার তাউফীক্ব দান করুণ। আমীন
বিষয়: বিবিধ
২৪৮২ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যে বাবা মা তার ছেলেকে এত কষ্ট করে লালন পালন করলো কেন সেই ছেলে তাদেরকে শেষ সময়ে প্রবীন নিবাসে পাঠায় তা কি কখনও তলিয়ে দেখা হয়েছে ?
০ Diplomatic word ব্যবহার করেছেন ।
সোজা ভাষায় হবে ''স্ত্রীর কূটনামীর'' কারণে ।
সহজ কথা যায় না বলা সহজে
..কুরআন হাদীসের ভাষায় কোন ভাবে অবহেলা করার সুযোগ নাই।
০ কে করছে ?
দোষ তো শিক্ষার।
সন্তানকে সুশিক্ষা দিলে কখনই এমন হবে না।
মন্তব্য করতে লগইন করুন