একজন জুনায়েদ জামশেদ, আঁধার থেকে আলোর পথে...
লিখেছেন লিখেছেন সত্যের বিজয় ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০৭:৫২:৪০ সকাল
জুনায়েদ জামশেদ ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের
রাওয়ালপিন্ডিতে জন্ম গ্রহণ করেন। লাহোর
বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
গ্রাজুয়েশন করার পর শখের বশে বন্ধুদের নিয়ে
একটি ব্যান্ড দল গড়েন। প্রথম এ্যালবাম “দিল
দিল পাকিস্তান” রিলিজ হওয়ার পর ঝড় ওঠে
সঙ্গীত অঙ্গনে। সফলতার সর্বোচ্চ সীমা স্পর্শ করে ২০০২
সালে সঙ্গীত ক্যারিয়ার ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে
২০০৩ সালে স্থায়ীভাবে বিদায় জানান
মিউজিক্যাল সঙ্গীতকে।
শুরু হল নতুন গল্প। ২০০৩ সালের কথা।
শুনুন তার মুখ থেকে—
"একদিন জুন মাসের প্রচণ্ড গরমে করাচীর রাস্তা দিয়ে গাড়ী চালিয়ে
যাচ্ছিলাম। বাইরে তখন লু-হাওয়া বইছে। রাস্তায় পায়ে হাঁটা
মানুষের সংখ্যা খুব কমই পরিলক্ষিত হচ্ছিল। এমন সময়
দেখি, তাবলীগের কিছু ভাই গাশতে বের হয়ে রাস্তা দিয়ে
হেঁটে যাচ্ছেন। আর তাদের শরীর দিয়ে ঝর ঝর করে ঘাম
ঝরছে। জামা-কাপড় সব ভিজে গেছে। তাদেরকে দেখে মনে
মনে বললাম, লোকগুলো পাগল ছাড়া আর কি! নিজেদের
আরামও নষ্ট করছে, অন্যদেরকেও বাড়ী থেকে বের করে
কষ্টের মধ্যে ফেলার ফিকির করছে। পরে চিন্তা করলাম,
আমি এই এসি গাড়ীতে কত আরামে বসে আছি। কিন্তু এরা
কিসের জন্য নিজেদেরকে এই কষ্টের মধ্যে ফেলছে? কেন তারা
এই ত্যাগ স্বীকার করছে? এ কথা চিন্তা করে তাদের প্রতি
আমার ভক্তি-শ্রদ্ধা জন্মালো। তখন আমি তাদের দু’আ
নেয়ার জন্য গাড়ী ঘুরিয়ে একেবারে তাদের আমীর সাহেবের
সামনে গিয়ে ব্রেক কষলাম। আমীর সাহেব হতচকিত হয়ে
গেলেন। আমি গাড়ী থেকে তাকে সালাম দিলাম। তারপর
বললাম, আপনারা অত্যন্ত ভাল কাজ করছেন। আমার জন্য
দু’আ করবেন। আমীর সাহেব কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে এক
দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ইনশাআল্লাহ!
দু’আ করবো। এরপর আমি চলে এলাম। তারা মসজিদে চলে
গেলেন। উল্লেখ্য যে, আমীর সাহেব সবার পিছনে ছিলেন
বিধায় আমাদের এই সংক্ষিপ্ত মুলাকাত জামা’আতের
দু’চারজন সাথী ছাড়া অন্যরা দেখতে পায়নি। মসজিদে
যাওয়ার পর আমীর সাহেব তার সাথীদের কাছে বললেন,
জুনায়েদ জামশেদের সাথে আমার দেখা হয়েছে। এরপর তিনি
কিভাবে আমার সাথে দেখা ও কথা হল, তা বললেন। ওই
জামা’আতে আমার স্কুল জীবনের এক সহপাঠী ছিল। সে
আমার নাম শুনে বললো, আরে, সে তো আমার সহপাঠী।
তার পিছনে মেহনত করা দরকার। তারপর সে কিভাবে যেন
আমার মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করলো এবং আমার সাথে
যোগাযোগ করলো। অতঃপর আমার বাড়ীতে এল এবং
সেদিন থেকে শুরু করে দীর্ঘ তিন বছর আমার পিছনে মেহনত
করলো। কখনো আমার হাত ধরলো, কখনো আমার পা
ধরলো, কখনো মাথার পাগড়ী খুলে আমার পায়ের কাছে
রেখে দিল, বললো-জুনায়েদ! এখন তুমি যে সম্মানের মধ্যে
আছো, এটা চিরস্থায়ী নয়, এটা একদিন শেষ হয়ে যাবে। এই তিন বছরে না বুঝে বিরক্ত হয়ে আমি বেশ
কয়েকবার তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বাড়ী থেকে বের করে
দিয়েছি। কিন্তু আল্লাহর এই বান্দা কিছুতেই আমাকে
ছাড়লো না। তিনবছর মেহনত করার পর আমাকে সে
একদিনের জন্য তাবলীগে যেতে রাজী করালো। আমি
একদিনের নিয়তে বের হলাম। একদিন শেষ হল, আরেকটি
দিনের জন্য অনুরোধ করলো।। সেখানে গিয়ে আমার ভাল
লাগলো। তাই তার কথা মেনে পরদিন থাকলাম। এরপর
আবার আরও একদিনের জন্য থাকতে অনুরোধ করলো।
আমি থেকে গেলাম। এভাবে একদিন একদিন করতে করতে
আমার চিল্লা পুরো হয়ে গেল। চিল্লা থেকে ফিরে এসে
দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। গান-বাদ্য তো আল্লাহর
নাফরমানীর কাজ। তাই গান গাইতে ভালো লাগলো না।
আবার চিন্তা করলাম, না গাইলে সংসার চলবে কি করে? এসব
চিন্তা করে মনের সাথে লড়াই করে যেতে লাগলাম। এ সময়
মাওলানা তারিক জামিল সাহেব বারবার আমাকে অভয় দিতে
লাগলেন। হিম্মত যোগাতে লাগলেন। ফলে আমি গান
গাওয়া একেবারে বন্ধ না করলেও সংখ্যা কমিয়ে দিলাম। সেই
সাথে বন্ধু মহলে আস্তে আস্তে ঘোষণা করতে লাগলাম যে,
গানের জগত থেকে আমি সম্পর্ক ছিন্ন করতে যাচ্ছি। এরপর
আমি আগের পোশাক পরিত্যাগ করে ইসলামী লেবাস
ধরলাম। দাড়ি একবার রাখি, একবার কাটি- এভাবে চলতে
লাগলো। ২০০৬ সালের কথা। একদিন পাকিস্তানের তৎকালীন
প্রধানমন্ত্রী জনাব জাফরুল্লাহ জামালী আমাকে ফোন
করে বললেন, টিভিতে তোমাকে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত
গাইতে হবে। আমি বললাম, আমি তো গান গাওয়া ছেড়ে
দিয়েছি। তিনি বললেন, সেটা কেমন কথা, আমার অনুরোধ
রাখবে না? আমি বললাম, আপনার অনুরোধ রাখতে পারি,
কিন্তু আপনাকেও আমার একটা শর্ত মানতে হবে। তিনি
বললেন, কী শর্ত? আমি বললাম, শর্ত হলো, এই গাওয়াই
হবে আমার জীবনের শেষ গাওয়া। টিভিতে জাতীয় সঙ্গীত
পরিবেশন করার পর আমি গোটা জাতির সামনে ঘোষণা করে
দিব যে, আজ থেকে এই জগতের সাথে আমি সম্পূর্ণরূপে
সম্পর্ক ছিন্ন করলাম। তিনি আমার শর্ত মেনে নিলেন।
সেদিন আমি গানের জগত থেকে সরে দাঁড়াবার কথা টিভিতে
ঘোষণা দিয়ে দিলাম। তখন আমার মনের অবস্থা যে কি
হয়েছিল, তা আমি ভাষায় ব্যক্ত করতে পারব না। এদিকে
শয়তান কিন্তু বসে থাকল না। আমার সংকল্প থেকে আমাকে
টলাবার জন্য বিভিন্নভাবে সে জাল ফেলতে লাগলো। বড় বড়
অফার আসতে লাগলো। একট মাত্র গান গাওয়ার জন্য,
একটা মাত্র শোতে অংশ নেয়ার জন্য লাখ লাখ টাকার
প্রস্তাব আসতে লাগলো। কিন্তু আল্লাহ আমাকে সব গুনাহ থেকে হেফাজত করেছেন।
l
তাঁর মায়াবী কন্ঠের নিবেদনে
মুগ্ধ ইসলামী সঙ্গীতের অঙ্গন। ২০০৫ সালে
রিলিজ হয় তার প্রথম ইসলামী এ্যালবাম
“জালওয়া-ই-জানা”। ২০০৬-এ আসে, পৃথিবী ব্যাপী
ননমিউজিক্যাল হামদ নাত শ্রোতাদের কাছে
জনপ্রিয় একটি নাম জুনায়েদ জামশেদ। একদিন মুফতি তাকী
উসমানী সাহেবের খিদমতে
হাজির হলে তিনি একটা হামদ তার হাতে তুলে দিয়ে
বললেন, এটা রেকর্ড করিয়ে ফেল। হামদ রেকর্ড করিয়ে
বাজারে ছাড়ার সাথে সাথে হৈ চৈ পড়ে গেল। এরপর হামদ
নাতের এলবাম তৈরী করে বাজারে ছাড়লে২০
পৃথিবীতে উর্দু এলবামের সর্বোচ্চ বিক্রির রেকর্ড ভঙ্গ
করলো। এভাবে বাজারে তার ইসলামী গজলের
যখন মুফতি তকী উসমানীর লেখা “এলাহী তেরী
চৌকাট পর ভিখারী বানকে আয়া হো” আথবা
“মুঝে জিন্দেগী মে এয়া রব” গেয়ে মানুষের অন্তরে জায়গা করে নেন পবিত্র ভাবে।"
আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই।গত
৭/১২/২০১৬ তারিখ পাকিস্তানে এক বিমান দুর্ঘটনায় স্বপরিবারে ইন্তেকাল করেন।আল্লাহ্ পাক ওনাদের জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন।
আমীন!
বিষয়: বিবিধ
১৪৪৪ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সকলের অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী প্রার্থনায় আমীন! আমীন! আমীন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন