পুত্রের কাছে বৃদ্ধাশ্রম থেকে একজন অসহায় বাবার চিঠি……
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ২০ অক্টোবর, ২০১৫, ১০:৫১:০৮ সকাল
প্রিয় সোনামানিক …
…..
তুমি কেমন আছ একথা জিজ্ঞাসা করা সম্পূর্ণ নিরর্থক মনে করছি । তুমি ভাবছ হয়ত তোমার বাবা আগের মত তোমায় ভালোবাসে না । যদি এটা ভেবে থাক তবে তোমার সেই ছোট্টবেলার মত আরেকটি ভুল করলে । আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি তুমি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালো আছ কেননা আমরা দোয়া যার সাথে সর্বদা জড়িয়ে থাকে সে খারাপ থাকতে পারে এটা আমি বিশ্বাস করিনা । আমরা বউমা এবং প্রিয় দাদুভাইয়েরাও ভালো আছে বলে বিশ্বাস । আমি কোন মেয়ের বাবা হতে না পারলেও তোমাকে বিবাহ দিয়ে যে লক্ষ্মী বউমাকে পেয়েছিলাম তাকে কোনভাবেই কষ্ট দিবে না । লক্ষ্মী মেয়েটি আমার মেয়ের শুণ্যস্থান পুর্ণ করে দিয়েছে ! আমার নাতী-নাতনীদের অনেক অনেক আদর দিও এবং তাদের কোন চাওয়া অপূর্ণ রাখবে না । তোমার হতভাগ্য-হতদরিদ্র জন্মদাতা তোমার চাহিদা তো দূরের কথা মৌলিক চাহিদাও সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ করতে পারেনি কিন্তু তুমি তো গরীব নও । সুতরাং ছেলে-মেয়ের কোন শখ যেন অপূর্ণ না থাকে । তোমাদের দোয়ায় আমিও অনেক ভালো আছি । পাশের রুমের গণি মিয়া আমার সূখ দেখে ঈর্ষা করে কেননা তুমি প্রতি বছর দু’ইবার আমার কাছে ছুটে আস । তোমার ব্যস্ততা রেখে তোমাকে আসতে বারবার নিষেধ করি তারপরও তুমি কেন আস তা আমি বুঝতে পারি না । এটা ভেবোনা যে, তুমি না আসলে আমি তোমায় ভুলে যাব কিংবা কম দোয়া করবো বরং তোমাদের প্রতি দোয়ার পরিমাণ দিন দিন বাড়তেই থাকবে । কেননা দিন দিন যেভাবে অক্ষম হয়ে যাচ্ছি তাতে আমার পৃথিবীটা সংকুচিত হতে হতে আমার এক চোখ ভাঙা চশমাটির মত হয়ে দাঁড়িয়েছে । আফসুস বেচারা গণি মিঞার জন্য ! ওর সন্তানগুলো ওকে এখানে রেখে যাওয়ার পর একবারও খোঁজ নেয়নি; শুধু টাকা পাঠানো ছাড়া ।
…..
প্রিয় পুত্রধন ! জীবন সায়াহ্নে এসে বারবার অনুশোচনা হচ্ছে । মনে হচ্ছে, কোথাও যেন আমি চরম ভুল করেছি । তোমাকে লালন-পালন করতে গিয়ে কোথায় যেন আমি আমার দায়িত্ব ঠিকমত পালন করতে পারিনি । তোমার মা আর আমি তোমাকে বাইরে রেখে জীবনের কোন পরিকল্পনা সাজাই নি অথচ আজ যেন নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে । তোমার কাছে হয়ত এটাই আমার শেষ চিঠি তাই কিছু কথা বলে যাওয়া আবশ্যক । এত তাড়াতাড়ি মরে যাবো সেটা মনে হচ্ছে না কেননা আমি চাইলেই তো আর মৃত্যু আমাকে ধরা দেবে না কিন্তু লিখতে বসলে চোখ যেভাবে ঝাপসা হয়ে আসে, হাত যেভাবে কাঁপতে শুরু করে কিংবা মস্তিষ্ক যেভাবে আমার বিরুদ্ধাচারণ করে তাতে তোমাকে আর লিখতে পারবো বলে মনে হয়না । তাই জীবনের শেষ কথাগুলো আজকেই বলে দিব । ভেবোনা, আমি তোমাকে কৈফিয়তের কাঠগোড়ায় দাঁড় করাবো । মরন সমুদ্রের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, সন্তান হিসেব তুমি সুসন্তানের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেও আমি পিতা হিসেবে মোটেও সফল নই । বৃদ্ধাশ্র্রম নিয়ে সমাজে বহু ধরণের খারাপ কথা প্রচলিত থাকলেও আমি সেটা মনে করিনা । তুমি আমাকে জোড় করে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাও নি বরং আমিই তোমার চোখের জলের বিরুদ্ধাচারণ করে এখানে আশ্রয় নিয়েছি । আব্বু, তোমার হয়ত মনে নাই কিন্তু শুধু তোমার লেখাপড়ায় যাতে ব্যাঘাত না ঘটে সেই কথা ভেবে আমার পক্ষের প্রায় সকল আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক শিথিল করে ফেলেছিলাম । তোমার মা তোমার নানা-নানীর একমাত্র মেয়ে হয়েও তাদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল শুধু তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চিন্তায় । আমি এবং তোমার মা-আমাদের উদ্দেশ্যে সফল হয়েছি । দেশের মাত্র কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম যদি উচ্চারিত হয় তবে সেখানে আমাদের সোনমানিকের নামটিও উচ্চারিত হয় । এটা কি আমাদের কম আনন্দের-কম পাওয়া । এত হিসেব করে তোমাকে মানুষের মত মানুষ করা এই বৃদ্ধ যদি আজ আমার দাদুভাইদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অন্তরায় ঘটায় তবে সেটা বেমানান বটে !
…….
এখানে যে ছেলেটা আমাদের দেখাশুনা করে সে ছেলেটার মত ছেলে খুব কম দেখা যায় । ওর সম্পর্কে বললে তোমার মনে হবে এই জগতেও এমন বোকা ছেলে আছে ! সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা কিংবা গভীর রাতে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞাসা করে, কাকা ! কিছু লাগবে ? ওর আচরণে তোমার অনুপস্থিতিতে বুকের মধ্যের শূণ্যতা কেমন যেন পূণ্য হয়ে যায় । ছেলেটা খুব গরীব । দিনরাত পরিশ্রম করে এখান থেকে যা মাইনে পায় তা দিয়েই ওর বাবা-মা এবং স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চলতে হয় । আমি মনোযোগ দিয়ে ওর কষ্টের কথা শুনি; আমার মত অক্ষম-অলসের এর বাইরে তো আর কোন কাজ থাকে না । আমার ইচ্ছা হয় ওকে কিছু বাড়তি টাকা দেই । কিন্তু আমার সে সাধ্য তো নাই । ছেলেটাকে বলেছিলাম ওর বাবা-মাকে এই বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে আসতে । এ কথাশুনে ছেলেটা হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে বলেছে, রক্ত বিক্রি করে হলেও বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখবে; কোনদিন বৃদ্ধাশ্রমে দিবে না । ছেলেটার কথা শুনে ভেতরটা হঠাৎ মুচড়ে গিয়েছিল কিন্তু ক্ষণিক পরেই বুঝলাম আমি হয়ত আবেগাপ্লুত হয়ে যাচ্ছি ! তাই এ নিয়ে আর ও ছেলেটার কাছে কিছু বলতে যাইনি । অল্পশিক্ষিত একটি ছেলে তার বাবা-মাকে নিয়ে যা ভাবছে সেটা কেবল আবেগের কথা ! তোমরা যারা উচ্চশিক্ষিত তারা আবেগকে প্রশ্রয় দিবে কেন ?
…..
আব্বু ! আগামী বার আমাকে যদি দেখতে আসো তবে আমার কলিজারটুকরো প্রাণপ্রিয় দাদুভাইদের নিয়ে এসো । আমি দেখতে চেয়েছি শুনলে ওরা আসতে চাইবে । বউমাকে এতদূর আনার দরকার নাই । মামনী আমার গরম সহ্য করতে পারে না । জানি দাদুভাইদেরও কষ্ট হবে । কিন্তু জীবনে এই শেষবার । আর কোনদিন ওদের দেখতে চাইবো না বলে নিশ্চয়তা দিতে পারছি না কেননা দিন যত সামনে এগুচ্ছে ততোই আমার আচরণগুলো শিশুদের মত হয়ে যাচ্ছে । পরবর্তীতে যদি কখনো দাদুভাই কিংবা বউমাকে দেখতে চাই তবে সেটা আমার শিশু সূলভ খামখেয়ালী ভেবে মূল্যায়নের বাইরে রেখো । আসার সময় বাসা থেকে কিছু রেঁধে আনবে না । এখানে যে খাবার দেয় তার তুলনায় বাসার খাবারগুলো অনেক খারাপ !
অনেক কথাই লেখার ছিল কিন্তু আর কিছুই লিখতে পারলাম না । কোথা থেকে একটা অন্ধ পোকা এসে আমার চোখের মধ্যে ঢুকে পড়লো ! কিছুটা যন্ত্রনাও হচ্ছে বটে । অক্ষমবাবাকে ক্ষমা করো । তোমার সন্তানদের জন্য তুমি যেন আমার মত অক্ষম বাবা না হও তার চেষ্টা করো । কয়েকদিন হল তোমার মা আমায় খুব জ্বালাচ্ছে । তাকে হারানোর ১৫ বছর পর এমনটা কেন ঘটছে তা বুঝতে পারছি না । স্বপ্নে সে কেবল ডেকেই যাচ্ছে । আমার আরও অনেকদিন বাঁচতে ইচ্ছা করে এবং বৃদ্ধাশ্রমের খালি ঘরগুলোতে কারা আমার বন্ধু হয় তা দেখতে সাধ হয় কিন্তু সে সৌভাগ্য আমার হবে না বোধহয় ! আমি মারা যাওয়ার পর, তোর মায়ের পাশেই আমাকে কবর দিও । এতে কিছুটা যায়গা নষ্ট হবে ঠিক কিন্তু তোমার মাকে ছেড়ে আমি দূরে থাকতে পারবো না । আমার এ আব্দারটুকু রেখো । রাখবে তো ? আমায় ক্ষমা করে দিও ।
……
তোমার অক্ষম জন্মদাতা
নতুনপল্লী বৃদ্ধাশ্রম,
……..
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
Facebook.com/rajucolumnist/
বিষয়: বিবিধ
১০৯৬ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
শরিয়ত সন্মতভাবে একটা বিশেষ পর্যায়ে গিয়ে স্বামী তার স্ত্রীকে প্রহার করতে পারে । বাবা মায়ের সেবা করা আল্লাহর নির্দেশ এবং তাদেরকে কষ্ট না দেওয়ার কথা আল্লাহ বলে দিয়েছেন ।
এর বিপরীত করাই শরিয়তপন্হী( যদি না বাবা মা বেশরিয়তী কথা / কাজ করে).
কিন্তু আমাদের মনুষ্য আইন নারীর (মূলত স্ত্রীর পক্ষেই) পক্ষে যে শরিয়তবিরোধী আইন বানিয়েছে সেটার কারণে নারীদের এই শরিয়ত বিরোধী কাজের কোন শক্ত জবাব দেওয়া পুরুষ তথা স্বামীদের পক্ষে সম্ভব হয় না মান সন্মান ও শাস্তি ও সামাজিকভাবে হেয়/হেনস্তা হবার ভয়ে।
এসব শরিয়ত পরিপন্হী মনুষ্য আইনই পরোক্ষভাবে বৃদ্ধাশ্রমের হার বাড়িয়ে দিয়েছে এবং পারিবারিক অশান্তিরও পরোক্ষ কারণ।
আজ যে স্ত্রী চুকলিবাজি করে তার শশুড় শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিল এর সবক সে পাবে তার ভাবীর কাছ থেকে বা তারই বৌমায়ের কাছ থেকে ।
আর বাবা .... তারা তো সব সময়ই অবহেলিত । সন্তানের জন্য হাজার করলেও তার ভাগ্যে ব্রোন্জ পদকও জুটে না
মন্তব্য করতে লগইন করুন