প্রেমতোপর
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ১১ জুন, ২০১৫, ০১:০২:২৬ রাত
নিলান্তির ঘোর যেন কিছুতেই কাটছে না । বাবা-মাকে নিয়ে রাতুলের বিদায়ের পর ২০ মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেছে । ক্ষনে ক্ষনে নিলান্তি শুধু তার অনামিকায় রাতুলের পরিয়ে দেওয়া হিরার রিংটি দেখছে ।মূহুর্তকাল পূর্ব থেকে নিলান্তির জীবনে নতুন পরিচয় যোগ হয়েছে । আসছে ১০ ফাল্গুন নিলান্তি-রাতুলের বিবাহ হবে বলে দুই পরিবারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে । দীর্ঘ ৫ বছরের প্রেমের পূর্ণতা পেতে আর কয়েকটি দিন মাত্র বাকি । আজ নিলান্তির চেয়ে বেশি খুশি বোধহয় এ ধরণীতে দ্বিতীয় কেউ নাই । বাসায় যতগুলো ক্যালেন্ডার ছিলো তার প্রত্যেকটির ১৫ জানুয়ারীর ঘরটি নিলান্তি নীল রং দিয়ে ইচ্ছামত আঁকিয়েছে । বিবাহ ঠিক হওয়ায় বাবা-মাকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট যতটা আচ্ছন্ন করার কথা তার ছিঁটে ফোঁটাও ওকে গ্রাস করেনি । এ পরিবার থেকে ও কেবল মুক্তি খুঁজছিল । পৃথিবীর বুকে নিলান্তি সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছে শাহানা বেগমকে । মায়ের ভালোবাসাই নিলান্তিকে বাঁচার প্রেরণা দিয়েছে । বাবা রায়হান মির্জা যে কতভাবে নিলান্তিকে তাচ্ছিল্য করেছে তা নিলান্তি মোটেই ভোলেনি । রায়হান-শাহানার বিবাহের ৮ মাসের মাথায় নিলান্তির জন্ম হওয়ায় রায়হান মির্জা নিলান্তিকে কিছুতেই তার মেয়ে বলে মেনে নেয়নি । নিলান্তি গায়ের রং শ্যামবর্ণের হওয়ায় শাহানা বেগম অন্য কারো পাপ শ্বেতবর্ণ রায়হান মির্জার কাঁধে চাপিয়েছে বলে বারবার খোঁটা দিত । এ নিয়ে শাহানা বেগমকে কত অত্যাচার যে মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছে তা একমাত্র তিনি আর বিধাতা জানেন । অনেকবার আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েও শুধু নিলান্তির মুখের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত বদল করেছে । মনে মনে কেবল আল্লাহকে বলেছে, আর কেউ না জানুক তুমিই তো সত্যটা জানো । মায়ের অফুরাণ ভালোবাসার পরেও বাবা-চাচা ও ফুফুদের বিমাতাসূলভ আচরণে নিলান্তিকে যেমন ক্ষনে ক্ষনে কষ্ট পেতে হয়েছে তেমনি অবজ্ঞা পেতে হয়েছে সহপাঠীদের কাছ থেকেও । ক্লাসের মধ্যে অন্যতম মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও কেউ সেভাবে নিলান্তির সাথে মিশতে চায়নি । নিলান্তি ছাড়া বন্ধুদের কোন আড্ডাই জমত না অথচ যখন আড্ডা জমে যেত তখন নিলান্তির আর কোন মূল্য থাকত না । তবুও নিলান্তি সব মেনে নিয়েছে এবং বন্ধুদের সাথে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দেখানোর চেষ্টা করেছে । শ্যামবর্ণের হওয়ায় স্কুল কলেজের বন্ধুরা নিলান্তিকে শুধু বন্ধু ভাবলেও কেউ ভালোবাসার দৃষ্টিতে হাত প্রসারিত করেনি । তবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নিলান্তির বদ্ধ মনের বন্ধ্যাত্ব দূর করে নতুনের দোলা দিয়েছিল সেই রাতুল যার সাথে আজ বিবাহ পাকা হল ।
লেখাপড়ার বাইরেও যে একটা জগৎ আছে তা নিলান্তির প্রায় অজানাই ছিল । বান্ধবীদের কাছে তাদের বহুমূখী প্রেমের অভিজ্ঞতার কথা শুনে শুনে নিলান্তির মনও চঞ্চল হয়ে উঠত কিন্তু কেউ সে চঞ্চলতাকে মনের বাইরে প্রকাশ হতে দেয়নি । প্রেমেরে ব্যাপারে কখনো যেচে আগ্রহ দেখায়নি । জীবনের ১৮ বসন্ত পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা দেওয়ার পর নোট নেওয়ার সূত্রে পরিচয় হয় দুই-ব্যাচ সিনিয়র রাতুলের সাথে । মেধাবী ছাত্র হিসেবে সর্বত্র রাতুলের জয়জয়কার । সব মেয়েরা রাতুল শুনতেই অজ্ঞান । রাতুলের সাথে সখ্যতা গড়তে, সময় কাটাতে উম্মূখ সবাই । নিজেকে গুটানো স্বভাবের ছেলে রাতুল যতটা পারে মেয়েদের এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে তবুও বন্ধুত্বের খাতিরে অনেক সময় ক্যাম্পাসে আড্ডায় অংশগ্রহন করতে হয় । চুপচাপ স্বভাবের জুনিয়র নিলান্তির সাথে রাতুলের পরিচয় হওয়ার সুযোগই ছিল না যদি নিলান্তির বান্ধবী শ্রেয়া সেমিনারের মধ্যে অসুস্থ হয় পড়ত । সেদিন ক্লাসের বিরতিতে শ্রেয়া ও নিলান্তি সেমিনারে বসে পূর্বের পাঠ মিলাচ্ছিল । অল্পদূরেই রাতুল তার সহপাঠীদের সাথে কথা বলছিল । হঠাৎ শ্রেয়া মারাত্মক অসূস্থ হয়ে পড়লে সোরগোলের সৃষ্টি হয় । কিছুসময় পার হলেও যখন শ্রেয়া সুস্থ হচ্ছিলনা তখন নিলান্তি শ্রেয়াকে হাসপাতালে নেওয়ার কথায় জানায় । নিলান্তিদের ব্যাচের কোন ছাত্র সেমিনারে উপস্থিত না থাকায় রাতুল নিলান্তির সাথে শ্রেয়াকে নিয়ে হাসপাতালে যায় এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করায় । এ পরিচয়ের সূত্রে পরবর্তীতে টুকটাক কথা হতে থাকে তবে তা স্বাভাবিক ছিল । অল্পদিনের ব্যবধানেই নিলান্তির নম্র ও মার্জিত ব্যবহার রাতুলের মনে দাগ কাটতে শুরু করে এবং তারা বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়িয়ে যায় । নোট আদান-প্রদান এবং ক্ষনিকের আড্ডায় রাতুল নিলান্তির প্রতি দূর্বলতা অনুভব করে । প্রথম দিকে রাতুল তার স্বাভাবিক অবস্থা ধরে রাখতে পারলেও ধীরে ধীরে ভালোবাসার মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে । অন্যদিকে নিলান্তিও রাতুলের আচার-ব্যবহারে মুগ্ধ তবে বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয় এবং গায়ের রঙের কারনে রাতুলকে নিয়ে স্বপ্ন আঁকাকে দুঃস্বপ্ন মনে করত । দিনে দিনে রাতুলে অসহ্য যন্ত্রনা অনুভব করায় একদিন সাহস করে নিলান্তিকে মনের কথা বলে দেয় । রাতুলের কথা শুনে নিলান্তির মনে হচ্ছিল স্বপ্নের শ্লোগান শুনছে তবুও চোখ-মুখ শক্ত ও স্বাভাবিক রেখে নিলান্তি রাতুলকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় । নিলান্তির কঠোরতায় রাতুল ভয় পায় এবং বাসায় গিয়ে ক্ষমা প্রার্থণা করে ক্ষুদে বার্তা পাঠায় । ফিরতি বার্তায় নিলান্তি জানায়, ক্ষমা গ্রহনযোগ্য নয় বরং অপরাধের জন্য মারাত্মক শাস্তি পেতে হবে । রাতুল আরও ভরকে যায় তবে পরের ক্লাসে নিলান্তির স্বাভাবিকতা ও হাসিমাখা মুখ দেখে যে সম্পর্কের শুরু হয়েছিল তাতে কখনো ভাটি লাগেনি । রাতুলের পছন্দ দেখে বন্ধুরা টিটকারী করলেও তাতে রাতুল কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় নি কিংবা নিলান্তির বান্ধবীরা রাতুলকে না পেয়ে নিলান্তিকে মনে মনে হিংসা করলেও তাতে রাতুল এবং নিলান্তি কোনদিন ভ্রুক্ষেপ করেনি । চিনাবাদাম, ফুচকা আর মামা হালিমের স্বাদেই অবিরাম চলেছে ওদের প্রেমের গল্প আর রঙিন স্বপ্নের বুনুনি ।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে মনে যে প্রেম দাঁনা বেঁধেছিল তা সময়ের পরিবর্তনে পাঁচটি বসন্ত যে কখন পার করেছে তা নিলান্তি টের পায়নি । রাতুলের চেয়ে নিলান্তিদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় রাতুলের বাবা ব্যতীত পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা নিলান্তিকে বউ করতে ঘোর আপত্তি জানিয়েছিল । মেয়েপক্ষ সামাজিক অবস্থানের তুলনায় পিছিয়ে এটা বড় বাঁধা ছিল না কিন্তু পাত্রীর অবয়ব যে শ্যামলা এখানেই ছিল রাতুলের মায়ের আপত্তি । রাতুলের মা নিজেও শ্যামবর্ণের অথচ আরেকটি শ্যামবর্ণের মেয়েকে পছন্দ করতে কিসের আপত্তি তার রহস্য নিয়ে রাতুলের মধ্যে প্রচন্ড বিস্ময় ছিল কিন্তু মায়ের সাথে কোনদিন উচ্চবাচ্য করেনি । রাতুলে বাবার কাছে রাতুল ছিল তার পৃথিবী সুতরাং রাতুলের পছন্দে আস্থা রেখে বিনাবাক্যে নিলান্তিকে বউ করতে রাজি হওয়ায় রাতুলের মায়ের দ্বিমত ধোপে টেকেনি । তবে বিভিন্ন আচণের মাধ্যমে তিনি বুঝাতে চেষ্টা করেছেন নিলান্তিকে পুত্রবধু হিসেবে মন থেকে তিনি মেনে নিতে পারবেন না । তবুও স্পষ্টত স্বামী-সন্তানের অসোন্তষের কারণ তিনি হতে চাননি।
বিয়ের আর মাত্র তিনদিন বাকি । উভয় পরিবারে সাজসাজ রব । রাতুলের বাবা মায়ের যেমন রাতুল একমাত্র সন্তান তেমনি নিলান্তির পরিবারের নিলান্তি বড় মেয়ে । যদিও রায়হান মির্জা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন তিনি মেয়ের বিয়েতে অতিরিক্ত খরচ করতে পারবেন না কারণ তার আরও দুটি মেয়ে রয়েছে । তবুও নিলান্তির দুই মামা শাহানা বেগমকে অভয় দিয়ে বলেছেন নিলান্তির বিয়েতে যত খরচ হয় তা যদি রায়হান মির্জা বহন না করেন তবুও কিছুই আটকে থাকবে না । মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহন ও বন্ধু-বান্ধবীদের নিমন্ত্রন দিতে রাতুল-নিলান্তিও ব্যস্ত সময় পার করছে । শত ব্যবস্থার মধ্যেও রাতুলের একান্ত ইচ্ছা বিবাহের আগের দিন নিলান্তির সাথে কিছু সময় ঘুরে কাটাবে । পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী বিবাহের আগের দিন রাতুল নিলান্তিকে নিয়ে দীর্ঘ সময় ঘুরতে বেড়িয়েছে । নিলান্তির মা বারবার ফোন দিয়ে বেশি সময় বাইরে না থাকার আদেশ দিলেও তা কেউ কানে তোলে নি । জীবনের পরম আনন্দের স্বাক্ষীকে ওরা যতটা সম্ভব দীর্ঘস্থায়ী করতে চায় । রাতুল নিলান্তিকে জুয়েলারির দোকানে নিয়ে একজোড়া স্বর্ণের কানের দূল কিনে দিতে দিতে দুষ্টামির স্বরে মৃদু সুরে বলেছে, বাসর রাতে কিন্তু ঘুমাতে দেব না; আগেই ঘুমিয়ে রেখো । নিলান্তি খোঁচা দিয়ে বলল, থামো তো ! মানুষে শুনলে কি বলবে ? বেড়ানো শেষে দু’জনেই রিকশায় নিলান্তিদের বাসায় ফিরছিল । নিলান্তি বারবার জানিয়েছে সে একাই বাসায় যেতে পারবে কিন্তু রাতুল কোন অবস্থাতেই নিলান্তিকে বাসায় পৌঁছে না দিয়ে তার বাসায় যাবে না বলে গো ধরেছে । মুখে এক যাওয়ার কথা বললেও নিলান্তি মনেপ্রাণে চাচ্ছিল যাতে রাতুল তার সঙ্গী হয় । রাতুলের পাশে বসে নিলান্তি রঙিন স্বপ্ন বুনতে বুনতে বাসায় ফিরছিল । হঠাৎ তারা রিকাশার অদূরে রাস্তায় কিছু মানুষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া দেখতে পেল । রাতুল রিকশাওয়ালাকে দ্রুত রিকশা অন্যদিকে ঘোরাতে নির্দেশ দিলেও শেষ রক্ষা হয়নি । প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে অপর পক্ষের ছোড়া দিকভ্রষ্ট ইটের খন্ড রাতুলের মাথায় আঘাত করে নিমিষেই রাতুলকে অজ্ঞান করে দেয় । এ দৃশ্য দেখে নিলান্তিও বাকরুদ্ধ । মনে হচ্ছিল নিলান্তির ধর থেকে প্রাণ বেড়িয়ে যাচ্ছে । আঘাতপ্রাপ্ত রাতুল রাস্তায় লুটিয়ে । ফিনকি দিয়ে লাল রক্ত নহর হয়ে এদিকে সেদিক ছুটছে । নিলান্তির চিৎকারে কিছু মানুষ মানুষ এগিয়ে এসে রাতুলকে হাসপাতালে নিতে সাহায্য করল । ডাক্তার দীর্ঘ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানালেন, রাতুল বেঁচে নাই । এ খবর শুনে নিলান্তির মুখ থেকে একবার মাত্র রাতুল বলে চিৎকার বেরিয়ে যে স্তব্ধ হয়েছে আর কোন কথা মুখ ফুটে বের হয়নি । অন্যের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া নিলান্তির আর কোন ক্ষমতা অবশিষ্ট নাই । উদাস দুটি চোখ সর্বত্র রাতুলের মুখ খুঁজে বেড়ায় । বাসর রাতে জেগে থাকার প্রতিশ্রুতি শুধু চোখের জল ঝড়ায় ।
রাজু আহমদে ।
facebook.com/raju69mathbaria/
বিষয়: বিবিধ
১২০৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন