আমি অধম বলিয়াই তুমি উত্তম !
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ২৫ এপ্রিল, ২০১৫, ০৭:০০:৫৫ সন্ধ্যা
শেখ সাদীর কবিতার চরণ,‘…………কামড় দিয়েছে পায়, তাই বলে কি…..কামড়ানো মানুষের শোভা পায়’ কিংবা ‘আমি অধম বলিয়াই তুমি উত্তম’ এমন উপমাগুলো বর্তমানে শুধু উপমাতেই সীমাবদ্ধ । অন্ধকারাচ্ছন্ন আরবে যেমন ‘খুনকা বদলা খুন’ নীতি প্রচলিত ছিল তেমনি আজকের পৃথিবীটাও প্রায় সে নীতিতে বিশ্বাসী । সর্বক্ষেত্রে কেবল ক্ষমতাধর কর্তৃক সংখ্যালগুদের নিপীড়ণের প্রমাণ । ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর মোহ ক্ষমতালোভীদেরকে রীতিমত অন্ধ করে দিচ্ছে । ন্যায়-অন্যায়, কল্যান-অকল্যানের বিচার বিবেচনার সময় যেন কারো নাই । সুদৃঢ় প্রসারী পরিকল্পনার খুব অভাব । সবাই শুধু দ্রুত ফলাফল প্রত্যাশা করে । যেকারণে শান্তির ছিঁটে-ফোঁটাও অবশিষ্ট নাই । জ্ঞানীদের একাংশ ঘোষণা করছে, টাকার বিনিময়ে আর যাই হোক সূখ কেনা যায় না অথচ যারা এ বাণীর ঘোষক এবং যারা শ্রোতা তাদের বেশিরভাগই টাকার পিছনে ছুটছে । ‘অর্থ সকল অনর্থের মূল’ এ বাক্য মূখে উচ্চারণ করার পরেও অর্থকে দেয়া হয়েছে স্রষ্টার পরের স্থান অর্থ্যাৎ অর্থ নাকি দ্বিতীয় স্রষ্টা ! অর্থ উপার্জনের মাধ্যম বৈধ কি অবৈধ; এ বিষয়ে কারো খুব বেশি ভাবার যেন সময় নাই । টাকা পেলেই হল, তা অর্জনর পথ যেমন হোক । টাকা থেকে গরীবের রক্তের গন্ধ বের হলেও যেন কিছু আসে যায় না ! টাকা আর ক্ষমতার মোহে মানুষের মনুষ্যত্মবোধ কিছুটা লোপ পেয়েছে এতে সন্দেহের সুযোগ নাই । সমাজে কাকে সম্মানিত করা হবে, কে বেশি মূল্যায়ণ পাবে তার নির্ধারক হয়েছে অর্থ । অর্থের কাছে শিক্ষা-সংস্কার একেবারেই উপেক্ষিত । সমাজের বিদ্বানদের একাংশ ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ ধরণের অর্থ-বৃত্তশালীদের চাটুকারীতায় ব্যস্ত । যার ধন আছে তার মান হবেই; এমন বদ্ধমূল বিশ্বাস মানুষের মূল্যবোধে রূপ নিয়েছে । সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের সম্মানিত আসনে কে বসবে, রাষ্ট্র পরিচালনায় কারা দক্ষ তার সীমারেখাও নির্ধারণ করে দিচ্ছে অর্থ । অন্যদিকে প্রাচীনযুগে দাসদেরকে যেমন অমানবিকভাবে ব্যবহার করা হত তেমনি বর্তমানেও সাধারণ মানুষ ব্যবহৃত হচ্ছে । সেসময় প্রভূর ইচ্ছানুযায়ী দাস শ্রেণী ব্যবহৃত হত আজ শুধু সেখানে চিত্রিত করা হয়েছে, খেঁটে খাওয়া মানুষেরা তাদের জীবিকার তাগিদেই প্রভূদের সেবা করছে । এখানে যে ‘স্বেচ্ছায় বাধ্যতামূলক’ নামক এক তত্ত্বকে সুকৌশলে কাজ করানো হচ্ছে তার খবর খুব বেশি মানুষ রাখছে বলে অনুমিত নয় ।
সামান্য ব্যাখা-বিশ্লেষণে দেখা যাবে গোটা বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের নিয়্ন্ত্রক এখন দেশের চরম বিবাদমান দুটি রাজনৈতিক বৃহৎ দল । এদের একটি দল যদি কোন কাজকে রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক বলে প্রচার চালায় তবে অন্যদলটি যে কোন ভাবেই তা রাষ্ট্রের ক্ষতিকর হিসেবে ব্যাখা করবে । গণশৌচাগার স্থাপণ থেকে শুরু করে বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে দেশের চুক্তির ব্যাপারে তাদের একই অবস্থা । রাজনৈতিক দল দু’টোর বিপরীত ধর্মী মেরুকরণের ফলে সাধারণ মানুষ দিনে দিনে দু’টো অংশে বিভক্ত হয়ে পড়েছে । নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে কথা বলা কিংবা কোন ঘটনাকে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করার মত অভিভাবক লোপ পেতে পেতে সংখ্যাটা মাত্র দু’একজনে নেমেছে । যারা নিরপেক্ষ তারা হয় কৃত্রিমভাবে মূক এবং কালায় পরিণত হয়েছে নতুবা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কারো ছত্র-ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে । শঙ্কার কথা হল, নীতিবান মানুষ যখন কারো তোষামোদে স্বেচ্ছায় অথবা বাধ্য হয়ে নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলে তখন তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক হুমকিতে পরিণত হয় । কেননা মূর্খদের চেয়ে পদলেহনের ক্ষমতা ও কৌশল তাদের বেশি নখদর্পণে থাকাটাই যৌক্তিক । বিশ্বাস, দেশের বৃহৎ দু’টো রাজনৈতিক দলই দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করে । তবে সংশয় ও শঙ্কা তৈরি হয় যখন প্রধান এবং দ্বিতীয় বৃহত্তর রাজনৈতিকদল দু’টি সর্বদা পরস্পর বিরোধপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করে । বিশ্বের অন্যদেশগুলোর যেগুলোতে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু আছে সেগুলোতেও সরকারী দলের সাথে বিরোধীদলের মতপার্থক্য থাকে কিন্তু কিছু কিছু স্বার্থে তারা সর্বদা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে । দূর্ভাগ্যের হলেও, এ দেশে পালাক্রমে যারাই ক্ষমতায় এসেছে তারা কখনোই বিরোধী দলের ছায়া পর্যন্ত তাদের কাছে সহ্য করতে পারে নি । অবশ্য এর পিছনে যৌক্তিক কতগুলো কারণও রয়েছে । দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকে এদেশের রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরা এমণভাবে বিষিয়ে তুলেছে যার ফলে বিরোধীদল যখন তাদের ভূমিকা (প্রথমে শান্তিপূর্ণ পরবর্তীতে সহিংস) পালনে ব্যর্থ হয় তখন সরকারী দল ফলাও করে প্রচার চালায় বিরোধী দলের কর্তৃত্ব শেষ ! তারা আর মেরুদন্ড সোজা করতে পারবে না । কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় যে, বিরোধীদলকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে । অন্যদিকে সরকারী দল যখন বিরোধীদলের কোন যৌক্তিক দাবীতে নমনীয়তা প্রকাশ করে তখন বিরোধীদল ভাবে যে সরকার দূর্বল হয়ে পড়েছে এবং প্রচার চালায় সরকার ব্যর্থ এবং তাদেরকে ক্ষমতার মসনদ থেকে টেনে না নামিয়ে ঘরে ফেরা হবে না এমনকি পানিও ছোঁয়া হবে না ( অথচ পানির মগ হাতে এবং কেটলি সামনে) । রাজনৈতিক দল দু’টির পরস্পর বিরোধী এমন অবস্থান দেশের মানুষের শান্তির শেষ ফোঁটাও কেড়ে নিতে চাইছে । উচ্চপর্যায়ের নেতা-নেত্রীদের পারস্পরিক অশালীন ও সম্মাননা বিবর্জিত সম্বোধণ সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে বেশ গভীরভাবে প্রভাব ফেলছে । ইউনিয়ন পরর্য্যায়ের একজন সামান্য রাজনৈতিক কর্মীও প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিরোধীদলীয় নেত্রীর নাম গালির সুরে সম্বোধন করছে । সংবিধান প্রদত্ত বাকস্বাধীনতায় এমন সম্বোধন দোষণীয় নয় তবে এমনটা না হয়ে সম্মান ও বিনয়ের সুরেও উচ্চারণ হতে পারত ।
৫ জানুয়ারী যেভাবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে তা দেশের বৃহদাংশের কাছে প্রশ্ন তুলেছে । এমন একটি নির্বাচন ’৯৬ সালে বিএনপিও করেছিল । অবশ্য সে যাত্রায় একমাসের পূর্বেও তৎকালীন বিরোধী জোটের আন্দোলনে শতাধিক মানুষের জীবনের বিনিময়ে বিনপিকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল । ৫ জানুয়ারীর নির্বাচিত সরকারের এক বৎসর পূর্ণ হওয়ার পর আওয়ামীলীগ বিরোধী-জোটও টানা তিন মাস সরকারী দলকে পদচ্যুত করতে আন্দোলন করেছে । তবে সে আন্দোলন সরকার বিরোধীদের জন্য ইতিবাচক তেমন কোন ফল তো আনেই নি বরং মামলার ঘানি টানতে টানতে সরকার বিরোধীরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে । অনেককে লোকালয় থেকে সংগোপনে হাওয়া বদলে বের হতে হয়েছে ! ’৯৬ এর থেকে এ বারের সরকার পতন আন্দোলনের তীব্রতা কোন অংশেই কম ছিল না, জীবন ও রক্তের দাগও কম লাগেনি তবে প্রশাসনকে চরম দলীয় করণের সুবিধা নিয়ে ক্ষমতাশীনরা টিকে গিয়েছে । ক্ষমতা স্থায়ী করতে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া দরকার বিশেষ করে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধিসহ নানা সুযোগ সুবিধা প্রদান এবং রাষ্ট্রে উন্নয়ণের চমক দেখিয়ে সরকার বিরোধী অনেক সমালোচকদের মূখও তা বন্ধ করে দিয়েছে । তবে সরকারী দল সবচেয়ে সাফল্য পেয়েছে, রাষ্ট্রের জঙ্গী ইস্যু দমনে বর্তমান ক্ষমতাশীনদের কঠোর অবস্থান বিশ্বের শক্তিধরদের কাছে উপস্থাপন করে । বাংলাদেশের জনগণের পরে যারা বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রনে মূখ্য ভূমিকা রাখে সেই শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো এবং আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থা মূখে মূখে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে যতই উৎকন্ঠা প্রকাশ করুক না কেন তাতে কিছুই আসে যায়না কেননা তারা অনেক ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের কাজকর্মে শুধু খুশিই নয় বরং বাহবা দিতেও ভূলছে না ।
যদি উত্তম হিসেবে পরিচিতি দিতে চাই অন্য কাউকে তো অধম হতেই হবে । অবশ্য এর ব্যতিক্রমটাও হতে পারে । অধম হয়ে অন্যকে উত্তম করার পথ ছেড়ে দেওয়াও যেতে পারে । ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট যারা আওয়ামীলীগের জনসভায় গ্রেণেড হামলা চালিয়েছিল তারা ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম কাজ করেছে-এটা যারা আওয়ামীলীগের চরম নিন্দুক তারাও স্বীকার করবে । তৎকালীন সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রীকে হত্যার উদ্দেশ্যে এমন জঘন্য হামলা দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণিত কাপুরুষতা । সেদিনের সে হামলায় ঘটনাস্থলেই ১২ জন এবং পরবর্তীতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ জন অর্থ্যাৎ মোট ২২ জন নিহত এবং বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট ৩০০ জন আহত হন । আহতদের মধ্যে অনেকেই চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে । এ হামলার জন্য হরকাতুল জিহাদ প্রধান মুফতি হান্নান, তৎকালীন স্বররাষ্ট্রমন্ত্রী লূৎফর জামান বাবরসহ ২২ জনকে আসামী করা হয়েছে এবং আদালত মামলার রায়ও দিয়েছে । দশম জাতীয় সংসদের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা যখন থমথমে ছিল তখন দেশের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ঘোষণা এবং বিএনপির এ নির্বাচনে অংশগ্রহনের সিদ্ধান্তে দেশের অধিকাংশ মানুষ নতুন করে আশার স্বপ্ন বুঁনতে শুরু করেছে । আশা করা যাচ্ছে, এ নির্বাচনই দেশের সকল অস্থিরতা দূর করে দেশবাসীকে নতুন করে শান্তির পরশ দিবে । কথায় বলে যেখানে আশার মাত্রা বেশি সেখানে শঙ্কাও বেশি । নির্বাচন নিয়ে দু’দলের মধ্যে বাক যুদ্ধ চলছে যা দোষণীয় নয় কিন্তু বিএনপি সভানেত্রীকে বহনকারী গাড়ি এবং তার নিরাপত্তা রক্ষীদের ওপর পরপর তিনদিন হামলা অবশ্যই ভবিষ্যত রাজনীতির জন্য ইতিবাচক বার্তাবাহী হবেনা । টানা তিনদিন যথাক্রমে কারওয়ান বাজার, ফকিরাপুল ও বাংলামোটরে বেগম জিয়াকে বহনকারী গাড়ী এবং তার সঙ্গীদের ওপর হামলা হয়েছে । সিটি নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের দুই প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ও মির্জা আব্বাসের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে বের হওয়ার পরেই এ হামলা হয়েছে । যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের দায়িত্ব শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা । বিগত তিন মাসের আন্দোলনে যদি বেগম জিয়া দোষী হন তবে দেশের আইনের আওতায় তার বিচার অবশ্যই হতে পারে । দেশের নাগরিক হিসেবে তিনি অবশ্যই আইনের উর্ধ্বের কেউ নন । ছোট বেলা থেকে যতগুলো সিনেমা দেখেছি তার প্রায় প্রত্যেকটিতেই সাধারণ একটি দৃশ্য হল-নায়ককে পুলিশ বলছে, আইন হাতে তুলে না নেওয়ার জন্য । আইন হাতে তুলতে পারে কেবল আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা । এ সংলাপ শুনতে শুনতে মনে গেঁথেছে আইন হাতে তুলে নেওয়া আইনসঙ্গত নয় । বেগম খালেদা জিয়া সিটি নির্বাচনের প্রার্থীদের পক্ষে আক্রান্ত হয়ে তিনদিন প্রচারণা চালানোর পূর্বেও আরও দু’দিন গণসংযোগ করেছে অথচ তখন তার গাড়ীবহরে হামলা হয়নি । কোন বক্তৃতার রেশ ধরে ছাত্রলীগের কতিপয় কর্মী প্রস্তুতি নিয়ে খালেদা জিয়ার গাড়ী বহরে হামলা করল তা খতিয়ে দেখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব । ক্ষমতা কারো চিরস্থায়ী নয় । আজ যাদের শরীর রক্তাক্ত তারাও একদিন সুযোগ পাবে প্রতিশোধের কিন্তু সেদিন প্রতিশোধ গ্রহন না করে যদি শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেয় তবে সেটাই হবে কল্যানের । যদি সে কল্যান ছড়ানোর মানসিকতা থাকে তবে, একজনকে অধম আর অন্যজনকে উত্তম হতে হবে । কে অধম আর কে উত্তম হবে তা নির্ধারণ করতে হবে নিজেদেরকেই । দেশবাসী চায়, সকলেই নিজেকে উত্তম বানানোর প্রতিযোগীতায় প্রতিযোগী ঘোষণা করুক । সোনার দেশ আবারও শান্তিতে ভরে উঠুক ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
বিষয়: রাজনীতি
৯৯৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন