ইলিয়াস পরিণতিতেই সালাউদ্দিন ?
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ১৬ মার্চ, ২০১৫, ০১:১৩:২১ দুপুর
আইন-আদালত উদ্ভবের অন্যতম কারণ অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা । সমাজ কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধের সাথে কেউ জড়িত হলে তাকে দেশের চলমান আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব । অপরাধীকে শাস্তির দেয়ার অর্থ শুধু এই নয় যে, এটা শুধু অভিযুক্ত অপরাধীকেই শুধরে দেয়ার প্রচেষ্টা বরং অপরাধীকে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে অন্যান্য অপরাধীচক্রকে কিংবা যারা অপরাধ সংগঠনের চিন্তা পোষণ করে তাদেরকেও কঠোর হুঁশিয়ারী স্বরুপ বার্তা প্রদান । ছিন্নমূল কিংবা সাধারণ মানুষ শুধু অপরাধ করবে এমনটা ভাবার কোন যৌক্তিক কারণ নাই । অপরাধের সাথে যে কোন স্তরের যে কেউ জড়িত হতে পারে । তবে সবার জন্যই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা ও মান্য করার সীমা একই । মূল কথা, আইন সবার জন্যই সমান । তবে পেশাগত সম্মানের খাতিরে কখনো কখনো আইনের প্রয়োগের কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় । তবে সকল কিছুর পরেও কেউ আইনের উর্ধ্বে নয় । দেশের সর্বোচ্চ সম্মানীয় ব্যক্তি মহামান্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন পেশার মানুষটিও সাংবিধানিক ভাবেই রাষ্ট্রীয় আইন মানতে বাধ্য । তবে নৈতিক দায়িত্বশীলতার কারণে সাধারণ মানুষের চেয়ে উচ্চসম্মানীয় ব্যক্তিবর্গকে আইনের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল থাকা আবশ্যক । তবুও ক্ষমতার মসনদ কিংবা আভিজাত্যের তকমায় কখনো কখনো কিছুটা ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় । সে ব্যতিক্রমেরও অবশ্য সীমা বেঁধে দেওয়া হয় । রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা কিংবা কোন ধরণের অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির পূর্ব পর্যন্ত ক্ষমতাধরের কিছুটা ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করতে পারেন । সাংবিধানিকভাবে যদিও সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিতের কথা বলা আছে তবুও সমাজ ও রাষ্ট্রসৃষ্ট সামান্য ব্যতিক্রম সবার কাছেই সহ্যের মাত্রায় পৌঁছেছে । ইহা আইনত বেআইনি হলেও সমাজের রীতিনীতি এটুকুকে বৈধতা দিয়েছে ।
গত ১০ মার্চ রাত থেকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন আহমেদ নিঁখোজ । তিনি উত্তরার যে বাসায় অবস্থান করছিলেন সেই বাসার দারোয়ান, পরিবার এবং বিএনপির পক্ষ থেকে সালাউদ্দিন আহমেদকে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক উঠিয়ে নেয়া হয়েছে বলে দাবী করা হয়েছে । যদিও সালাউদ্দিনের আহমেদের স্ত্রী সাবেক এমপি হাসিনা আহমেদ কর্তৃক আদালতে তার স্বামীর সন্ধান চেয়ে দায়েরকৃত অভিযোগের কারণে আদালত প্রদত্ত রুলের জবাবে পুলিশ, এসবি, ডিবি, রর্য্যাবসহ ৫টি সংস্থা লিখিতভাবে আদালতে জানিয়েছে তারা সালাউদ্দিন আহমেদকে গ্রেফতার করেনি এবং এখনো তার খোঁজ পাওয়া যায়নি । সরকারী দলের সর্বোচ্চ মহল থেকে বলা হয়েছে, বিএনপি নেত্রীর গুলশান কার্যালের ৮ বস্তা ময়লার সাথে সালাউদ্দিন আহমেদকেও চালান করা হয়েছে । অন্য এক বক্তৃতায় বলা হয়েছে, খালেদা জিয়া সালাউদ্দিনকে মহাসাগরের পানির নিচে লুকিয়ে রেখেছেন । যে বাহিনীর ওপর বিএনপি এবং পরিবার থেকে সালাউদ্দিন আহমেদকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছিলো তারা যখন এ বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত নয় বলে আদালতে জানিয়েছে তখন তার খোঁজ উদঘাটন করার জন্য তাদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে । এটা কৌতুকের সময় নয় । সালাউদ্দিন কোথায় আছে, কিভাবে আছে তার রহস্যের জট উম্মোচন করে পরিবারকে যেমন স্বস্তি প্রদান দরকার তেমনি এমন একটি বিতর্কিত-আলোচিত বিষয়েরও সুরাহার চেষ্টা আবশ্যক । বিএনপির অন্য কতিপয় নেতার মত তিনিও যদি গুম হয়ে থাকেন তবে রাজনৈতিক কারণেই এটা খারাপ নজির স্থাপন করবে । গুমের সংস্কৃতি কখনোই বর্তমান কিংবা ভবিষ্যত রাজনীতিকদের জন্য কল্যান বয়ে আনবে না । সকল আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীকে জোড় তৎপরতার মাধ্যমে সালাউদ্দিনের পরিবার বিশেষ করে তার স্ত্রী ও সন্তানদের চোখের পানি এবং বুকের হাহাকার বন্ধ করতে সাহায্য করা আবশ্যক । ইলিয়াস আলী কিংবা চৌধুরী আলমদের মত যেন সালাউদ্দিনের পরিণতও না হয় । ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এপিএস হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন সালাউদ্দিন আহমেদ । পরবর্তীতে সে চাকরি ছেড়ে তিনি সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহন করেন এবং কক্সবাজার থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন । বিএনপির আরেক যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি এ দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন । বিএনপি-জোটের মূখপাত্র হিসেবে তিনিই হরতাল ঘোষণা করতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে দলীয় বিবৃতি দিতেন । গত মঙ্গলবার রাতে তিনি নিঁখোজ হওয়ার পর থেকে এ লেখা অবধি তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি ।
২০১০ সাল থেকে অপরাধীদের অপরাধকর্মে নতুন কৌশল হিসেবে যোগ হয়েছে গুম । খুনের চেয়েও ভয়াবহ আতঙ্ক হিসেবে এ অপরাধ গুরুত্বের সাথেই আলোচিত হচ্ছে । তবে সমাধান হয়নি আজও । সাধারণ মানুষের চেয়ে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাই বেশি গুম হওয়ায় এটাকে অনেকে রাজনৈতিক অপকৌশল হিসেবে উল্লেখ করেছেন । কখনো কখনো নিজস্ব দলীয় কোন্দলের কারনেও গুম হয়ে খুন হওয়ার খবর প্রকাশ হয়েছে । ধীরে ধীরে গুম হওয়া মানুষের ক্রমবাচক সংখ্যাটি স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠেছে । ২০১০ সালের ২৫ জুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমের খোঁজ আজও মেলেনি । দেশের সবচেয়ে আলোচিত গুমের ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল বনানীর ২ নম্বর সড়কের সাউথপয়েন্ট স্কুল এন্ড কলেজের সামনে । সিলেটের বিশ্বনাথের জনপ্রিয় নেতা এবং বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর সে গুম রহস্য আজও উম্মোচিত হয়নি । ইলিয়াস আলীকে ফিরে পেতে বিএনপির কয়েক দফা আন্দোলনেও কোন ফল আসেনি । আইন শৃঙ্খলাবাহীনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভারের ভাগ্যে কি জুটেছে তা হয়ত রহস্যই থেকে যাবে । ইলিয়াস আলীকে তো ফেরত পাওয়া যায়নি বরং তাকে ফিরে পেতে বিএনপি ঘোষিত আন্দোলনে গুলিতে তিনজন নিহত হয়েছে । সালাউদ্দিন আহমেদের ১৭ বছরের কিশোরী মেয়ে রাইদার মত বাবাকে হারানোর ব্যাথা ততোট না বুঝলেও ইলিয়াস আলীর শিশু সন্তান সাইয়ানা নাওয়ালা আজ বুঝতে শিখেছে বাবাকে হারানোর যন্ত্রনা । বাবাকে ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন চোখে আজও প্রতিক্ষণ চেয়ে থাকে মেয়েটি । দেশবাসীর মত নাওয়ালাও জানে না তার বাবার পরিণতি কি হয়েছে তবুও বুকভরা বিশ্বাস নিয়ে আজও বাবার ফেরার পথ চেয়ে বসে আছে । প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক যতদ্রুত সম্ভব ইলিয়াস আলীকে তার স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেয়া হলেও সে আশ্বাস আশ্বাসেই আটকে গেছে । পরিবেশ বিষয়ক আইন সংগঠন ‘বেলা’র নির্বাহী পরিচালক রেজওয়ানা হাসানের স্বামী ব্যবসায়িক আবু বকর সিদ্দিক গুম হওয়ার দীর্ঘ ৩৫ ঘন্টা পর ছাড়া পেলেও নারায়ণগঞ্জের গুম হয়ে আলোচিত সেই ‘সেভেন মার্ডারের’ কথা কি খুব দ্রুত ভূলে যাওয়া যাবে । কয়েকজনের রর্য্যাব কর্মকতার অনৈতিকতার বলি উপজেলা মেয়র নজরুলসহ অন্যরাও গুম হয়ে খুন হয়েছিল । তখনকার সাদা পোশাক ও মাইক্রোবাস ভীতিতে গোটা দেশবাসী তটস্থ হলেও ধীরে ধীরে সে ভয় কেটে যাচ্ছিল কিন্তু সর্বশেষ সালাউদ্দিন আহমেদের পরিণতি দেশবাসীর সে ক্ষতে আবারও নতুনভাবে আঘাত দিয়েছে । মানুষের মনে আবারও পুরণো সে ভীতি নতুনকরে সঞ্চারিত হচ্ছে । এভাবে অনিরাপত্তাহীনভাবে বেঁচে থাকা যায় ?
সালাউদ্দিন আহমেদ নিঁখোজ হওয়ার ৬ দিন অতিবাহিত হলেও তার কোন হদিস না মেলায় আবারও দেশের বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন জাগতে শুরু হয়েছে, চৌধু্রী আলম কিংবা ইলিয়াস আলীর পথেই কি সালাউদ্দিন আহমেদেরও গন্তব্য হয়েছে ? কেউ কোন অপরাধ করলে তাকে আইনের মাধ্যমে বিচার করা হোক । যদি কোন তৃতীয়পক্ষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে সালাউদ্দিন আহমেদকে গুম করে তবে তার রহস্যও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেই উম্মোচন করতে হবে । দেশের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তাদের । দেশবাসী বিশ্বাস করে, অপরাধীদের দমনে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ । অপরাধী চক্র যত বিশাল হোক তাদের দমনে দেশের ঐতিহ্যবাহী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সুনাম ছিল এবং আজও আছে । সালাউদ্দিন আহমেদসহ যারা ইতোপূর্বে গুম হয়েছে তাদের পরিবারের কান্না থামাতে পারে একমাত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই । গুমের সংস্কৃতি যেন কোন অবস্থাতেই শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে না পারে তার জন্য সব মহলকেই সচেতন থাকতে হবে । যে কোন মূল্যে এ ধরণের অপরাধের সাথে জড়িত অপরাধীদের মূল উৎপাটন করে মানুষের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সময়ের দাবী । সকল রাজনৈতিক দলকেই মনে রাখা উচিত, গুমের সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দিলে ক্ষমতার পালাবদলে এটা আত্মগাতীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে । কেননা এদেশের রাজনীতির কৌশল কেবল প্রতিশোধ গ্রহনের । কাজেই সবার স্বার্থেই মঙ্গলের পথে হাটা উচিত । আজ যাদের পরিবারের সদস্যরা চোখের জ্বলে ভাসছে তাদের মত যেন আর কাউকে কখনোই বুক ফাটা আর্তনাদ নিয়ে চোখের জ্বলে ভাসতে না হয় । বাবা তার সন্তানদেরকে বুকে নিয়ে নিরাপদে নিশ্চিতে সময় কাটানো নিশ্চয়তা যেন রাষ্ট্র থেকেই পায় । কেউ কোন অপরাধ করলে তাকে দেশের আইনানুযায়ী দন্ড প্রদান করা হোক । সংবিধানে যেভাবে সকল নাগরিকের নিরাপত্তা প্রদানে রাষ্ট্রকে বাধ্য করেছে তেমনিভাবেই যেন মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
facebook.com/raju69mathbaria/
বিষয়: রাজনীতি
৯০৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন