নিছক আবেগ নাকি গভীর ষড়যন্ত্রের পূর্বাভাস
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ০১ মার্চ, ২০১৫, ০৫:৩৭:৩৪ বিকাল
‘দুই বাংলার স্বপ্ন এক, ইচ্ছেও এক । সব কিছুই যখন এক, তাহলে আমরা দুই সরকারকে বলি যে প্লিজ, এপার বাংলা, ওপার বাংলাকে এক করে দাও’-পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল নেত্রী ও মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সফর সঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশ সফরে এসে চিত্রনায়ক ও তৃণমূলের পক্ষে ভারতীয় লোকসভার সদস্য দেব এ অভিপ্রায়ের কথা বলেছেন । গত শুক্রবার ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন কর্তৃক আয়োজিত ‘বৈঠকী বাংলা’ নামক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় তিনি একথা বলেন । অনেকটা স্বপ্রণোদিত হয়েই পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী তার ৩৬ সদস্যের ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক সফরসঙ্গী নিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের উদ্দেশ্যে ঢাকায় আগমন করেছেন । ২১ ফেব্রুয়ারী পালনের উদ্দেশ্যে মমতা ব্যানার্জি এখানে আগমন করলেও বাংলাদেশ সরকার মূলত বহুল প্রত্যাশিত তিস্তা পানি বন্টন চুক্তি নিয়ে খোলামেলা আলোচনাকেই প্রধান্য দিয়েছে । সদ্য সাবেক হওয়া ভারতের সাবেক ক্ষমতাশীন কংগ্রেসের হয়ে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং অনেকটা অনুনয় করেও তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে মমতা ব্যানার্জিকে রাজি করতে না পারা এমনকি ভারত সফরের সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসির সাথে মমতা সৌজন্য সাক্ষাত না দেওয়ার পরেও মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে তার ঢাকায় সফর দেশবাসীর জন্য অনেকটা আশার আলোর মতই একটি বিষয় । পানির অভাবে গোটা উত্তরবঙ্গ যখন মরভূমিতে রূপ নিয়েছে তখন মমতা দেবীর বাংলাদেশ সফর অনেকটা ‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মত’ । সরকারসহ এদেশের সকল জনসাধারণ মনে প্রাণে কামনা করছিল যেন মূখ্যমন্ত্রী তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে রাজি হন । বাংলাদেশ সরকার ও নাগরিকদের সে অর্থে তিনি নিরাশও করেননি । তার দেয়া বক্তৃতায় মাত্র দু’টো শর্ত জুড়ে দিয়েছেন । প্রথমতঃ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চাহিদা পূরণের পর অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশকে দেয়া হবে এবং দ্বিতীয়তঃ দেশের বিখ্যাত ও সুস্বাদু রুপালি ইলিশ পশ্চিমবঙ্গে গেলে পানি আসবে । সর্বোপরি আশার কথা যেটুকু বলেছেন তা হল, ‘আমরা তার উপর আস্থা রাখতে পারি’ । মমতা ব্যানার্জি কর্তৃক বাংলাদেশীদেরকে দেয়া আশার স্বপ্নে যে কতটুকু আশা অবশিষ্ট আছে তার চিত্র সময় উম্মোচন করবে কেননা যদি পশ্চিমবঙ্গের চাহিদা পূর্ণ করে বাংলাদেশকে পানি দেয়ার নীতি গ্রহন করা হয় তবে তাতে এদেশ কতটুকু পানি পাবে তা নতুন করে ভাববার বিষয় । তবে তার প্রতি আস্থা রাখার যে নিশ্চয়তাটুকু দিয়েছে, আমাদেরকেও সেটুকু বুকে আঁকড়ে ধরে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে কেননা সম্বলহীনরা কেবল সম্পদশালীদের প্রতি আস্থাই রাখতে পারে । সে আস্থা পূরণ করা হবে কি হবে না সেটা সম্পদশালীরাই নির্ধারণ করবে । তবে মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশে পা রেখে এখানকার মাটি ও তার জন্মভূমির মাটির মধ্যে তফাৎ পাননি কাজেই একটু আস্থা রাখতে আপাতত দোষ নাই । কিন্তু আমাদের জন্মভূমির প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের মানুষ কখন বাস্তব জগতে থেকে এবং কখন অভিনয় করে কথা বলে তার পার্থক্য বুঝতে পারা খুব সহজসাধ্য ব্যাপার নয় ।
বাংলাদেশের খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের সীমান্তবর্তী অঞ্চল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ । ১৯৫৬ সালের ১ লা নভেম্বর স্থাপিত হওযার পর এটি ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে পরিণত হয়েছে । পূর্ব ভারতে অবস্থিত এ রাজ্যে জনসংখ্যা প্রায় দশ কোটি । জনসংখ্যার ভিত্তিতে এটি ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম রাজ্য এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম অঙ্গরাজ্য । সর্বমোট ২৯৫টি বিধান সভার আসন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ গঠিত । যার ২৯৪টি আসনে নির্বাচন হয় এবং একটি আসনের প্রার্থী মনোনীত হন । পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল ও ভূটানের সীমান্ত রয়েছে । ভারতের বিধানসভার বিধায়ক হিসেবে দেব এ রাজ্যের একটি আসন থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের ব্যানারে নির্বাচিত হয়েছে । ত্রিশের কোঠার তরুণটির রাজনৈতিক প্রজ্ঞা যেটুকু তার চেয়ে ঢের বেশি রয়েছে অভিনয়ের দক্ষতা । অভিনয়ের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের বৃহত্তর গণতান্ত্রিক ভারতের একজন বিধায়ক নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন চাট্টিখানি কথা নয় । কিন্তু প্রথমবারের মত রাজনৈতিক সফরে বাংলাদেশে এসে দেব যে কথাগুলো বলেছেন তা কি নিছক আবেগের কথা নাকি এর অন্তরালে গভীর কোন ষড়যন্ত্রও লুকিয়ে রয়েছে । দেব পেশাদার একজন অভিনয় শিল্পী হওয়ায় তিনি সংস্কৃতির আদান-প্রদানে দুই বাংলায় বাধাহীন প্রচারের কথা বলতে পারেন কিন্তু মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কথায়ও যখন দেবের কথা প্রতিধ্বনিত হয় তখন কিছুটা ষড়যন্ত্রের পূর্বাভাস তো থেকেই যায় । দেবের মত করেই মমতা ব্যানার্জিও বলেছেন, ‘দুই বাংলার মধ্যে কোন বিভেদ তিনি রাখতে চান না’ । ২৯টি অঙ্গরাজ্যের সাথে যখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কিছুটা টানা পোড়েন সম্পর্ক তখন মমতা কিংবা দেবদের এমন আশাবাদ ভারতীয়দের শঙ্কিত না করলেও দূর্বল বাংলাদেশীদের শঙ্কিত করে । দেব যে মন্তব্য করেছেন তা নিশ্চিতভাবেই দেশদ্রোহীতার আওতাভূক্ত কেননা একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে অন্য একটি দেশের সাথে ভৌগলিকভাবে মিলিত হওয়ার আকাঙ্খা করা কোন যুক্তিতেই আইন সঙ্গত হতে পারে না । পশ্চিমবঙ্গবাসী দেবের এ উক্তির পর তাকে কিভাবে গ্রহন করবে তা নিতান্তই তাদের নিজস্ব ব্যাপার (অবশ্য স্বার্থাবাদী পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতীয়রা এটাকে ইতিবাচক ভাবেই গ্রহন করবে) কিন্তু বাংলাদেশী হিসেবে এখানকার প্রতিটি সচেতন নাগরিকের দেশপ্রেমের স্থানে আঘাত লেগেছে নিশ্চয়ই । দু’ই বাংলা মিলিয়ে যে সংখ্যক জনগোষ্ঠী বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহার করে তা বিশ্বের মোট ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠীল পঞ্চম বৃহৎ হওয়ায় বাংলা ভাষা বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ ব্যবহৃত ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে । ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন এবং এর অর্জনে পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীদের কোন অবদান না থাকার পরেও যেহেতু তাদের প্রধান মাতৃভাষাও বাংলা সেহেতু বিশ্ববাসীর কাছে তারাও কিছুটা সম্মানের চোখে মূল্যায়িত হচ্ছে । ২১ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি পাওয়ার পরে বিশ্বের সকল বাংলা ভাষা-ভাষী মানুষ আলাদা সম্মানপাবে সেটা স্বাভাবিক কিন্তু এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষীরা দু’ই বাংলাকে এক করে দেয়ার স্বপ্ন এবং দাবী উত্থাপন করবে সেটা ভাবতেই শরীর শিউরে ওঠে । তাদের স্পর্ধা দেখে অবাক হতে হয় ।
’৪৭ এ ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির সময় যারা পূর্ব-পাকিস্তানের অংশ হওয়ার আশা তো প্রকাশ করেই নি বরং ক্ষতি সাধনের জন্য ঘোরতর বিরোধিতা করেছে তারা এখন সুযোগবাদী স্বার্থ উদ্ধারের জন্য (হোক সেটা সাংস্কৃতিক, ব্যবসায়িক কিংবা সামগ্রিক) দুই বাংলাকে এক করে দেওয়ার কথা বলবেন এবং এ দাবী শুনে এদেশের বুদ্ধিজীবিরা যদি চুপ করে থাকেন তবে এর চেয়ে দূর্ভাগ্যের আর কিছু হতে পারে কি ? তাদের এ দাবি ভাষা শহীদ ও স্বাধীনতা অর্জনে আত্মত্যাগকারীদের প্রতি ঘোরতর অপমান । বাংলাদেশের সকল নাগরিকের জন্য এটা লজ্জারও বটে । ভাষার মাসে এসে পশ্চিমবঙ্গের একজন দুই বাংলাকে এক করে দেওয়ার মহত্তম বাণী(!) প্রচার করে যাবেন আর সেটার বিরুদ্ধে কেউ উল্লেখযোগ্য কোন প্রতিবাদ জানাবে না এটা মেনে নিতে কষ্ট হয় । মাসটা ফেব্রুয়ারী না হয়ে জানুয়ারী কিংবা এপ্রিল হলেও একটা কথা ছিল(!) কিন্তু ফেব্রুয়ারী, মার্চ কিংবা ডিসেম্বরে যারা টইটম্বুর থাকি ভাষা, স্বাধীনতা কিংবা বিজয়ের চেতনা নিয়ে সেই ভাষার মাসেই চেতনা বিরোধী আঘাত অথচ প্রতিবাদ নেই; এটা কিন্তু ভালো লক্ষণ নয় । কিছু কিছু অতি উৎসুক দেব কিংবা মমতা ব্যানার্জির আশার বাণীকে নিজেদের জন্যও আশার বাণী হিসেবে বেশ প্রচার চালাচ্ছেন বলে দেখছি । তাদের যুক্তি হল, বিনা পাসপোর্ট কিংবা বাধায় ভারতে যাওয়া যাবে । আহারে শখ ! নিছক শখ মেটাতে এ জাতি যে কত অন্যায় আব্দার মেনে নিবে কিংবা ভিন্ন দেশের নাগরিক কিংবা সংগঠন কর্তৃক কতটা জঘন্যভাবে এদেশের মানুষ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অপমান করার পরেও কতক্ষণ এরা রোবটের মত মুখ এঁটে থাকবে তা বিধাতাই ভালো জানেন । দেববাবু কিংবা মমতা ব্যানার্জির স্বপ্নকে অনেকেই নিছক আবেগের মোড়কে দেখে উড়িয়ে দিচ্ছেন কিন্তু এটা আবেগ না ষড়যন্ত্র সেটা নির্ভূলভাবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সর্বোচ্চ সচেতনতা অবলম্বন করা উচিত । ভারত থেকে তিস্তার পানি আমরা ভিক্ষা নেবনা বরং ওটা আমাদের ন্যায্য দাবী । সুতারং দাবী আদায় করতে গিয়ে শর্তপালনের জন্য যেন আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অপমান করার সুযোগ কাউকে দেওয়া না হয় কিংবা না পায় । সকল কিছুর ওপরেই দেশের স্বার্থ ও সম্মানকে স্থান দেওয়ার মানসিকতা সবার মধ্যেই সৃষ্টি এবং দেশপ্রেম হোক সবার ব্রত । একজন ভারতীয় ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে কিন্তু বাংলাদেশী হিসেবে যেন কারো অবৈধ, অন্যায় দাবী সমর্থণ কোন দিন-ই এ ভূমির কেউ না করে ।
বিষয়: আন্তর্জাতিক
৯৬৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এতটা সাহস উনাদের নেই ।
উনারা এসব ফাঁকা বুলি ছাড়ে । বাংলাদেশ থেকে ভাল আতিতেয়তা পায় তো সেজন্য এরকম বলে যাতে আতিতেয়তার যেন ব্যাঘাত না হয় ।
উনাদের দেশে তো '' দাদা খেয়ে এসেছেন , না কি গিয়ে খাবেন '' - এই স্টাইল ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন