মা তুমিও বধূ ছিলে, বধূ তুমিও মা হবে
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ১৯ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৪:১০:০৩ বিকাল
পৃথিবীর ইতিহাসে যে সকল যুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে তার প্রতিটির সমাপ্তি ঘটেছে । কৌশল ও অস্ত্রের শক্তির কাছে একপক্ষ বিজয়ী হয়েছে এবং অন্যপক্ষ বিজিতের গ্লানি বহন করেছে । এ সকল যুদ্ধে কোটি কোটি মানুষের জীবনহানি, লাখ লাখ কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট কিংবা বছরের পর বছরব্যাপী মূল্যবান সময় ব্যয় হলেও একটি সময়ে সকল দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি হয়েছে । ইতিহাসের সর্ববৃহৎ দু’টো বিশ্বযুদ্ধও থেমে গেছে । শত্রু মিত্রে পরিণত হয়েছে আবার মিত্র শত্রুতে রুপ নিয়েছে । আচক্রবালভাবেই দু’চিরশত্রুর মধ্যকার কোন লড়াইও কখনো চিরস্থায়ী রূপ লাভ করেনি আবার করবেও না কভূ । তবে পৃথিবীর ইতিহাসে একটি মাত্র লড়াই কোনদিন শেষ হবে বলে মনে হয়না । শ্বাশুড়ী-পূত্রবধুর কথার ও কর্তৃত্বের দাবী প্রতিষ্ঠার এ লড়াইয়ে হয়ত জীবনহানি হয়নি কোথাও তবে পরিবার ভেঙ্গেছে অগণন । এ দ্বন্দ্বে পারিবারিক সূখ উবে যাওয়ার দৃষ্টান্ত গোটা সমাজ জুড়ে । কোথাও শ্বাশুড়ী-পূত্রবধুর মধ্যে সু-সম্পর্ক স্থায়ী হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত বিরল । মাঝে মাঝে এদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক দেখা গেলেও তা ক্ষনিকের মাত্র । অজ পাড়াগাঁও থেকে অভিজাত শহর পর্যন্ত একই চিত্র প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে । শ্বাশুড়ী-পূত্রবধুদের মধ্যকার এ লড়াইকে সাপে-নেউলে সম্পর্কের সাথে তুলনা করা চলে । সমাজের অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষিতেরও একই হাল । শ্বাশুড়ী-পূত্রবধুদের মধ্যে স্থাবর সম্পত্তির দখল নিয়ে খুব বেশি বিভেদ দেখা যায়না । অস্থাবর সম্পত্তির দাবী নিয়েই যত গণ্ডগোল । পারিবারিক কর্তৃত্ব কিংবা সমাজের চলমান প্রথা অর্থ্যাৎ ‘পর কখনও আপন হয়না’ সূত্রের প্রয়োগ যুগ যুগ ধরে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বহমান থাকায় শ্বাশুড়ী-পূত্রবধুর মধ্যে মধুর সম্পর্ক সেভাবে কখনই গড়ে ওঠে না । মনস্তাত্ত্বিক কারণেই এ সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয় এবং একসময় প্রবল আকার ধারণ করে পারিবারের শৃ্ঙ্খলা ভেঙ্গে দেয় । শ্বাশুড়ী ও পূত্রবধুদের মধ্যে সৃষ্ট খারাপ সম্পর্কের জন্য এককভাবে শ্বাশুড়ী কিংবা পূত্রবধুকে দায়ী করা যায়না । উভয়ের মানসিক অবস্থার কারণে মূলত এদের মধ্যে সে অর্থে সু-সম্পর্ক তৈরি হয়না । ছেলেকে বিবাহ দিয়ে পূত্রবধু ঘরে এনে শ্বাশুড়ী মনে ভাবে এই বার বুঝি সংসারের কর্তৃত্ব গেল ! দীর্ঘদিন আগলে রাখা দায়িত্ব হঠাৎ ঘরে আসা বধূ দখল করবে এটা শ্বাশুড়ী মানতেই নারাজ । অন্যদিকে একটি মেয়ে বধূ হয়ে এসেই চিন্তা করে স্বামী-সংসার সব-ই তো তার । এভাবে দু’জনের ভাবনার বিস্তর পার্থক্য তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে খুব বেশি সময় নেয় না । অল্পদিনের ব্যবধানেই দেখা যায় শ্বাশুড়ী-পূত্রবধুর মধ্যে মধুর মধুর কথা চালাচালির চেয়ে অভিমান কিংবা সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাটি বেশি হয় । দু’প্রজন্মের দুই নারীর একজন মায়ের অধিকার এবং অন্যজন স্ত্রীর দাবী নিয়ে যখন সন্তান ও স্বামীর কাছে পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানায় তখন এদেশের খুব কম সন্তানই তার মীমাংসা করতে পারে । একদিকে মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও অন্যদিকে দাম্পত্যজীবন স্থায়ী করার চিন্তায় বিভোর থাকা ছেলেটি সঠিক সমাধান দিতে পারে না । এমন সংকটময় অবস্থায় হয়ত পরিবারের ভাঙ্গন ধরে নতুবা শ্বাশুড়ী-পূত্রবধুর মধ্যে রুটিন মাফিক সকাল সন্ধ্যার ঝাগড়া-ঝাটিতে জীবন অতিষ্ট হয়ে ওঠে । শ্বাশুড়ী-পুত্রবধুর জেদ যদি সমপর্যায়ের হয় তবে ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে সমস্যার সমাধানে পাড়া-পড়শীকেও এগিয়ে আসতে হয় । তবে সমস্যার সমাধান মোটে হয়না বললেই চলে । কে তার দাবী থেকে পিছু হটবে (!)? মানবসভ্যতার ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে চলমান এ যুদ্ধ হয়ত কোনদিনই শেষ হবে না তবে মানসিকতার পরিবর্তনের মাধ্যমে অনেকটা সমাধান করাও খুব বেশি অসাধ্য নয় । পারিবারিক কাঠামোয় পরিবর্তন আসার মাধ্যমে সমস্যার কিছুটা সমাধান হলেও অনেকগুলো স্বার্থ তাতে রক্ষা পাবেনা । অনুপরিবারের সংখ্যা যত বাড়বে বৃদ্ধাশ্রম কিংবা সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও তত বাড়তে বাধ্য । তবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এখনও ৯০ ভাগের বেশি বড় পরিবার এবং এসকল পরিবারে শ্বাশুড়ী-পূত্রবধুদের দ্বন্দ্ব ৮০ ভাগেরও বেশি । এমন বহু পরিবার আছে যেখানে ধণ-দৌলতের অভাব নাই কিন্তু শ্বাশুড়ী-পুত্রবধুদের খারাপ সম্পর্কের কারণে পারিবারিক বন্ধনে ক্রমাগতভাবেই দূরত্বের সৃষ্টি হচ্ছে । অনেকেই শ্বাশুড়ী-পুত্রবধুর মধ্যকার খারাপ সম্পর্ককে খুব বেশি নৈতিবাচকভাবে নেয়না তবে এদের সম্পর্ককে ভিত্তি করেই যে পারিবারিক শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা পাওয়া নির্ভর করে তা অস্বীকার করার কোন যৌক্তিক কারণ নাই । যে সকল পরিবারগুলোতে শ্বাশুড়ী-পূত্রবধুদের মধ্যে সু-সম্পর্ক রয়েছে সেখানে উত্তরপ্রজন্মও এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে সচেষ্ট হয় এবং শান্তিতেই বসবাস করতে পারে কিন্তু যেখানে এর উল্টো তাদের দুঃখের সীমা নাই । প্রজন্মের পর প্রজন্মকে এর ধকল পোহাতে হয় । এ শ্রেণীর জন্য অবশ্য আশার বাণীও রয়েছে । বিশ্বায়ণ যেভাবে পারিবারিক কাঠামোর উপর আঘাত হেনেছে তাতে নিকট ভবিষ্যতে শুধু স্বামী-স্ত্রীকে নিয়ে শতভাগ পরিবার গঠিত হবে । সে সকল পরিবারে শ্বাশুড়ীদের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না ।
শ্বাশুড়ী-পুত্রবধুদের মধ্যে এমন বিষাদময় সম্পর্ক সৃষ্টির কারণ কি ? যিনি শ্বাশুড়ী তারও মেয়ে থাকে এবং তারা বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অন্যের ঘরে যায় এবং যে মেয়েটি বধূ হয়ে আসে সেও একটি পরিবার থেকে আসে যেখানে দীর্ঘদিন সে মায়ের কাছে লালিত পালিত হয়ে আরেক মায়ের কাছে আশ্রয় পায় । তবে কেন গর্ভের মেয়ে ও ছেলের বউয়ের সম্পর্কে পাওয়া মেয়ে এবং জন্মদাত্রী মা ও স্বামীর সম্পর্কে পাওয়া মায়ের মধ্যে এমন বিস্তর ফারাক । যিনি আজ শ্বাশুড়ী হয়েছেন তিনিও এককালে বধূ ছিলেন আবার যিনি নতুন বধু হয়ে এসেছে সেও সময়ের পরিবর্তনে মা হবে । সময়ের পরিবর্তনের এ ভাবনা কেন দু’প্রজন্মের নারীর মধ্যে আসে না ? শ্বাশুড়ী-পূত্রবধুদের সম্পর্কের অবনতি হওয়ার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে দু’পক্ষের অবস্থানই সমান দৃষ্টিতে দেখা উচিত । স্ত্রীর চেয়ে মাযের অবস্থান কোটি গুন উর্ধ্বে তবুও পারিবারিক সহাবস্থান ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য শ্বাশুড়ী ও পূত্রবধু উভয়কেই ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে । আমাদের সমাজের মায়েদের ক্ষেত্রে একটি কথা খুবই প্রচলিত আছে যে তারা বলতে চায়, ‘ছেলে আমার মস্ত পাঁজি/বৌউয়ের কথায় নাচে, জামাঈ আমার কত্ত ভালো/মেয়ের কথায় বাঁচে’ । পূত্রবধু ও মেয়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টির কারণেও পরিবারে অনেক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় । শ্বাশুড়ী যেমন নিজের পূত্রবধূকে স্বীয় অধীনে রাখতে চেষ্টা করেন তেমনি মেয়েকে যে পরিবারে বিবাহ দেন সে পরিবারের কর্ত্রীও তার পূত্রবধুকে তার মত রাখতে চান । আমাদের সমাজের অনেক মা এটা মেনে নিতে নারাজ । তারা একদিকে যেমন চায় পূত্রবধুকে নিজের মনের মত করে চালাতে তেমনি নিজের মেয়ে যেন তার শ্বশুড়বাড়ীতে স্বাধীনভাবে কর্তৃত্ব নিয়ে থাকতে পারে তার জন্যও পরামর্শ প্রদান করেন । সকল মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ঢালাওভাবে উপরোক্ত কথা বলছি না, তবে শ্বাশুড়ী-পূত্রবধুদের মধ্যে যেখানে যেখানে দ্বন্দ্ব আছে তার প্রত্যেক যায়গায় এমন কতগুলো সাধারণ সমস্যা রয়েছে । পূত্রবধুদেরও কিছু দোষ আছে । দীর্ঘ কয়েকবছর যে মা তার ছেলেকে হাজারো কষ্ট সহ্য করে লালন পালন করল সেই ছেলেটির বউ হয়ে এসে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই যদি স্বামীকে পূর্ণভাবে নিজের করে পেতে চায় তবে কোন মায়ের পক্ষে এমনটা সহ্য করা বোধহয় সম্ভব নয় । পুরুষের কম-বেশি সীমাবদ্ধতা আছে । এদেশের খুব কম সংখ্যক-ই মায়ের প্রতি সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং স্ত্রী সকল অধিকার পূরণ করার ক্ষমতা রাখে । স্ত্রী যখন লক্ষ্য করে স্বামী তার মাকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে তার কিছু চাওয়া অপূর্ণ রাখে তখনই বাঁধে বিপত্তি । অথচ এই মেয়েটাই তার ভাইয়ের কাছ থেকে জন্মদাত্রী মায়ের প্রতি সম্পূর্ণ কর্তব্য পালিত হওয়ার আশা করে । তাতে ভাইয়ের স্ত্রীর অধিকার রক্ষা পেল কি পেল না তাতে তার কিছুই যায় আসে না ।
মানসিকতার পরিবর্তনের মাধ্যমে শ্বাশুড়ী-পূত্রবধুদের দূরত্ব কমিয়ে পারিবারিক শৃঙ্খলা আনয়ণ করা সম্ভব । এক্ষেত্রে উভয়ের প্রতি উভয়ের ত্যাগের মানসিকতা থাকতে হবে । শ্বাশুড়ী যদি পূত্রবধুকে দাসী-বাঁদী করে রাখতে চায় কিংবা পূত্রবধুও শ্বাশুড়ীর সাজানো সংসারের পূর্ণ অধিকার নিমিষেই পেতে চায় তবে চলমান বিবাদ মীমাংসা করার সাধ্য কারো নাই । শ্বাশুড়ী যদি পূত্রবধুকে মেয়ের স্থানে এবং পূত্রবধু যদি শ্বাশুড়ীকে মায়ের স্থানে বসাতে পারে তবেই পারিবারিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব । শ্বাশুড়ীকে তার পূত্রবধু লালনের ক্ষেত্রে তার বধূ জীবনের শিক্ষা কাজে লাগাতে হবে এবং বধূও যাতে আগামী দিনের শ্বাশুড়ী হওয়ার সময়টাকে টেনে সামনে দাঁড় করিয়ে শ্বাশুড়ীর সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে পারে তার মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে । সমাজে শাশুড়ী-পূত্রবধুদের মধ্যকার বিভেদের জন্য যতগুলো কু-প্রথা বিদ্যমান আছে তা ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে । বিশেষ করে শ্বাশুড়ী ও পূত্রবধু উভয়কে শ্বাশুড়ী-পূত্রবধুদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব উসকে দেয়া ভারতীয় টিভি সিরিয়ালগুলো দেখা এবং এর চর্চা থেকে বিরত থাকতে হবে । শ্বাশুড়ী-পূত্রবধুর সম্পর্কের উপর একটি পরিবারের শান্তি নির্ভর করে এ কথা ভুলে করেও ভুলে যাওয়া উচিত নয় । আশা করি, এ প্রজন্ম থেকেই শ্বাশুড়ী-পূত্রবধুদের দ্বন্দ্ব বহুলাংশে বিলুপ্ত হয়ে অনাবিল শান্তির ফল্গুধারা প্রবাহিত হবে । শ্বাশুড়ী ও মা এবং পূত্রবধু ও মেয়ের পার্থক্য যদি ঘুচে যায় তবেই এটা সম্ভব ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
বিষয়: বিবিধ
১২৪৬ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
'' মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত''
আবার
'' তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম''
যেহেতু মা আর বউয়ের মধ্যে দা-কুমড়া সম্পর্কটা ধ্রুব সত্য - সেখানে এই দুটি একই সাথে কখনই ছেলে/স্বামীর পক্ষে পালন করা খুবই কঠিন ।
এই মায়েরাই কিন্তু এক সময়ে যখন বৌ মা ছিল তখন তার শাশুড়ি ও স্বামীকে অস্থির করে রেখেছিল । এখন সে নিজে যখন মা হয়েছে এখন তার বৌ মা তাকে আর তার ছেলেকে দৌড়ের উপর রাখছে ।
মেয়েদের এই সিলসিলা কোন দিনও শেষ হবে না যেটার ভুক্তভোগী কোন অন্যায় না করেও ছেলেরাই ।
কখনও তো জামাই-শশুড় দ্বন্দ্বের কথা শোনা যায় না , বরং এটাকে মজার সম্পর্ক হিসেবেও দেখানো হয় ।
দেখা যায় যে , যে মা তার সন্তানকে ৩০ বছর ধরে কষ্ট করে লালন পালন করেছে বউ এসে ৩০ দিনের মধ্যেই সেটার উপরে থাকতে চায় । এখানে তাদের যুক্তি হল :
''বউয়ের কাজ কি মাকে দিয়ে হয় ? ''
কি রকম মানসিকতা নিয়ে তারা চলে ? এটা যদি তার ভাবী তার ভাইকে বলে তাহলে কি সে সেটা মেনে নেবে ?
মন্তব্য করতে লগইন করুন