নামে বেনামে চলছে যৌতুকের আদান প্রদান

লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ০৮ জানুয়ারি, ২০১৫, ১১:২১:৪৫ সকাল

নারী পুরুষের সম্পর্কের সবচেয়ে দৃঢ় বন্ধন সৃষ্টি হয় বিবাহের মাধ্যমে । অনেক রক্তের সম্পর্কের চেয়েও এ সম্পর্ক গভীর হয় বললেও অতিরঞ্জিত করা হবে বলে মনে হয়না । বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে নারী পুরুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় সু-গভীর আত্মীক সম্পর্ক । যে সম্পর্ক বলে বোঝানোর বিষয় নয় বরং উপলব্ধির বিষয় । ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা একটি ছেলে অন্য পরিবেশের একটি মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এতটা আপন হওয়া সত্যিই বিস্ময়ের বিষয় । দেশের সীমানা, জাতির পরিচয় কিংবা ধর্মের বাধা পেড়িয়েও এ সম্পর্ক তৈরি হয় । সম্পূর্ণ অচেনা দু’জন নারী পুরুষও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মূহুর্তের মধ্যে চির আপন হয়ে যায় । এদের একজনের প্রতি অন্যজনের আস্থা কিংবা বিশ্বাস পরিমাপ করার কোন যন্ত্র এখনো কোন বিজ্ঞানী আবিস্কার করতে পারেনি কিংবা পারবেও না কোনদিন । বিবাহের মাধ্যমেই শুরু হয় জীবনের দ্বিতীয় ধাপ এবং নতুন পথচলা । আমাদের দেশে বিবাহ পদ্ধতিতে আভিজাত্যের ছোঁয়া আছে । ধর্মীয় নিয়মাবলীর সাথে পালন করা হয় ঐতিহ্যগত অনেক প্রথা । বিবাহে অনেকগুলো সু-প্রথা অনুসরণ করা হলেও কয়েকটি কু-প্রথাও অনুসরণ করা হয় । এ কু-প্রথার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক এবং ঘৃণ্যতম যৌতুক প্রথা । বিবাহের মত একটি মধুর সম্পর্ককে যৌতুক প্রথা বিষিয়ে তোলে । স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তৈরি হয় দূরত্ব । স্ত্রীকে সহ্য করতে হয় অনেক গঞ্জনা । শারীরিক এবং মানসিক নির‌্যাতন তো আছেই । অনেক স্ত্রীকে জীবন দিতে হয় শুধু যৌতুকের কারণে । সমাজের নিম্নতম পেশাজীবি থেকে একেবারে সর্বোচ্চ শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে কম বেশি যৌতুক প্রথা বিদ্যমান । বর্তমানে যৌতুক আদান প্রদান আইনত নিষিদ্ধ হওয়ায় এবং এ কু-প্রথাকে কিছু সচেতন মানুষ ঘৃণা করতে শুরু করায় ভিন্ন নামে এর প্রচলন শুরু হয়েছে । মেয়ে-জামাই এবং জামাইয়ের পরিবারকে খুশি করার নামে গরীব কিংবা ধণাঢ্য পিতা-মাতা উপহার হিসেবে অনেক কিছু দিলেও তা যৌতুক হিসেবে বিবেচিত হয়না । ধণাঢ্যরা অনেক কিছু দেয়ার সামর্থ্য রাখলেও গরীব-পিতামাতা সামান্য কিছু দিতে বাধ্য হলেও অনেক সময় তাদের সর্বস্ব হারাতে হয় । অন্যদিকে যৌতুক আইনত নিষিদ্ধ হলেও সামাজিক কু-প্রথা হিসেবে অনেক গভীরে শেকড় দিয়ে আছে । যে কারণে মেয়ে পক্ষের পিতা-মাতা অনেক বাধ্য হয়েই সামাজিক পদ-মর‌্যাদা রক্ষা করা জন্য উপহারের মোড়কে যৌতুক দেন । ছেলে পক্ষের অভিভাবকরাও ওঁৎ পেতে থাকে কিভাবে কৌশলে মেয়ে পক্ষ থেকে কিছুটা আদায় করা যায় । মেয়ে পক্ষ থেকে ছেলে পক্ষ কখনো ছেলে বিদেশ যাবে বলে ধারের নামে অর্থ আদায়, কখনো চাকরিতে ঘুষ দিতে হবে বলে অর্থ গ্রহন কিংবা আরও বহু পদ্ধতি অনুসরণ করে ঠিকই ছেলে পক্ষ মেয়ে পক্ষ থেকে সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার সময় বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয় । সামাজিক রীতির কারণে মেয়েকে যেন শ্বশুড় বাড়ীতে গিয়ে ছোট হয়ে থাকতে না হয় সেজন্য বাবা-মা প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন তাদের সাধ্যমত মেয়ে-জামাইকে উপহার দিতে । উপহার হিসেবে কিছু দেয়া অন্যায় নয় কিন্তু এই উপহার যখন ছেলে পক্ষকে আরও বেশি কিছু পাওয়ার জন্য লোভী করে, উপহারের মান খারাপ হয়েছে কিংবা কিছু ঘাটতি রয়েছে বলে মেয়েকে কথা শুনতে হয় তখন সেটা আর উপহার না থেকে বরং যৌতুকের দিকেই নির্দেশ করে । একারণে শুরু হয় পারিবারিক অশান্তি । স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াঝাটি রুপ নয় দাম্পত্য কলহে । নষ্ট হয় মধুরতম সম্পর্ক । শুরু হয় নির‌্যাতন । কখনো কখনো যৌতুকের বলি হতে হয় অগণন নারীকে । পত্রিকার পাতা কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় প্রত্যহ এরূপ অসংখ্য ঘটনার স্বাক্ষী হতে হয় আমাদেরকে । মনে ধিক্কার আসে যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে তারপরেও আমাদের পরিবার থেকে উপহারের ছদ্মবেশী যৌতুক প্রথা বিদায় নেয় না । যৌতুকের সংজ্ঞা কিংবা এর অপরকারীতা প্রায় সকলের ঠোটস্থ থাকলেও প্রয়োগের সময় অর্থ আদায় ছাড়া কিছুই মনে থাকে না । বিবাহকেও বাজারে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের মতো আর্থিক লেনদেনে বিবেচনা করা হয় । অথচ যৌতুক দাম্পত্য জীবনে অসূখী করা এবং বিবাহ বিচ্ছেদের মত মারাত্মক ঘটনায় অন্যতম মূখ্য ভূমিকা পালন করে ।

যৌতুক প্রথার উৎপত্তির আদি উৎস নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে । তবে প্রায় সর্বজন বিদিতি যে, প্রতিবেশী হিন্দু সমাজ থেকেই যৌতুক প্রথার উদ্ভব । যেহেত অতীতের হিন্দু সমাজরীতি অনুযায়ী মেয়েরা তাদের পিতৃ-সম্পত্তি কিংবা স্বামীর সম্পত্তিতে কোন অংশ পেত না সেহেতু বিয়ের সময় মেয়েরা অভিভাবকরা মেয়েকে বিবাহের সময় যথাসাধ্য যৌতুক ও উপহার-উপঢৌকন দিয়ে দিত । যদিও যৌতুকের উদ্ভব হিন্দু সমাজ থেকে তবুও এর চর্চা মুসলিম সমাজেই প্রকট রুপ লাভ করেছে । যৌতুকের বিরুদ্ধে আইন থাকলেও তা প্রয়োগের অভাবেই যৌতুক সামাজিক অভিশাপে রুপ নিয়েছে । ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনে যৌতুক প্রদান ও গ্রহনকে নিষিদ্ধ করে আইন পাশ করা হলেও তার বাস্তবায়ণ হচ্ছে না বললেই চলে । যৌতুক আদান-প্রদানের মাধ্যমে কোন দম্পতি সুখী থাকলে সেখানে যৌতুকের লেনদেন অবৈধ হিসেবে পরিগণিত না হওয়ার সামাজিক রীতি প্রায় প্রচলিত হয়েই গেছে । অথচ যৌতুক কোন ভাবেই দাম্পত্য জীবনে কল্যান বয়ে আনেনা । কোন না কোন ভাবেই যৌতুক দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে রাখবেই । অনেক স্ত্রীরা স্বামীর সম্মান কিংবা পারিবারিক মর‌্যাদার কথা ভেবে অনেক অত্যাচার সহ্য করেও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন কিন্তু এতে সকলে সফল হয়না । অত্যাচারের মাত্রা জন্য সহ্যের সীমান ছাড়িয়ে যায় তখন সকল সম্পর্ক চুকিয়ে নারী বিচারকের দ্বারস্থ হয় । যৌতুকের এসকল বিচারে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিযুক্ত শাস্তি পেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আইনের ফাঁক গলিয়ে কিংবা প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়ে অভিযুক্ত বাবু বেশেই ‍মুক্তি পায় । ১৯৮০ সালে প্রবর্তিত যৌতুক নিরোধ আইনে বলা আছে, যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ করিলে অথবা প্রদান বা গ্রহণে সহায়তা করলে সে ৫ বছর পর‌্যন্ত (এক বছরের কম নয়, আবার ৫ বছরের বেশি নয়) কারাদন্ড বা ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডণীয় হবে । ’৮০ যৌতুক নিরোধ আইন কিংবা ২০০৩ সালের নারী ও শিশু নির‌্যাতন দমন আইন থাকলেও তার পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় যৌতুকের মত মারাত্মক অভিশাপ সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছে এবং দিবা-নিশি নারীরা নির‌্যাতনের শিকার হচ্ছে । ’৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনকে আরও সময়োপোযোগী করে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে দেশে প্রত্যক্ষ যৌতুকের লেনদেন কিংবা অন্য ছদ্মবেশে যৌতুকের লেনদেন কমে আসবে ও পারিবারিক শান্তি এবং দাম্পত্য সুখ নিশ্চিত হবে ।

তবে শুধু আইনের মাধ্যমে যৌতুক নির্মূল করা সম্ভব নয় । এক্ষেত্রে পিতা-মাতা এবং ছেলেরা অগ্রগন্য ভূমিকা পালন করতে পারে । নারী শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমেও যৌতুকের বিস্তার রোধ করা সম্ভব । অনেক সময় মেয়ে পক্ষের অভিভাবকরা উচ্চ যৌতুক দিযে মেয়েকে সম্ভ্রান্ত পরিবারে পাত্রস্থ করতে চায় অন্যদিকে ছেলের অভিভাবকরাও ছেলের বাজার দর ঠিক করতে কার্পণ্য করে না । বর্তমান সভ্য সমাজে যৌতুকের লেনদেন অতীব লজ্জার এবং গর্হিত কাজ হলেও অনেকে তা গ্রাহ্য করেন না । কাজেই সর্বপক্ষকে সচেতন হতে হবে । মেয়ে পক্ষের উচিত যে টাকা যৌতুক দিয়ে মেয়ে বিবাহ দেয়ার বাসনা করে আছে সে টাকা কিংবা তার চেয়ে বেশি খরচ করে মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা । মেয়ে সু-শিক্ষিত হলে ভালো পাত্র পেতে যৌতুক দিতে হবে না । অন্যদিকে ছেলে পক্ষের লজ্জা থাকা উচিত । ছেলেকে বাজারের সস্তা পণ্যের মত বিক্রয় করার ঘৃণ্য মানসিকতা ত্যাগ করা উচিত । যে ছেলে যৌতুক নিয়ে বিবাহ করে সে ছেলে কোনদিন সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর নৈতিক যোগ্যতা রাখে না এমনকি স্ত্রীর সামনেও সারা জীবন ছোট মানসিকতায় থাকতে হয় । প্রশাসনকে আইনের প্রয়োগে আরও যত্নশীল হতে হবে । যৌতুক লোভীরা এবং দাতারা যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায় তবে যৌতুক বিস্তারের কলেবর ছোট হয়ে আসবে এবং তা সমাজের জন্য কল্যান বয়ে আনবে । যৌতুকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে ছেলেদেরকে । জীবনে শপথ করতে হবে এক পয়সাও যৌতুক গ্রহন করা যাবে না এমনকি সুস্পর্ক রেখে যতটা সম্ভব শ্বশুড়বাড়ীর উপহার সামগ্রী গ্রহনও এড়িয়ে চলতে হব । আগেও বলেছি উপহার প্রদান করা কিংবা গ্রহন করা দোষের নয় তবে কোন উপহার যদি আরও পেতে লোভী করে তবে তা এড়িয়ে চলাই উত্তম । তরুণদের আরও সচেতন হতে হবে এবং যৌতুকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে । আজকের তরুণরাই তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশের মাধ্যমে সচেতন হয়ে যৌতুকের মত একটি অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করতে পারে । কাজেই ভবিষ্যতে যেন সকলের স্লোগান হয় যৌতুক দেব না, যৌতুক নেব না । যৌতুক মুক্ত একটি সমাজ নির্মান করা যুব সমাজের কাছে সময়ের বড় দাবী ।

বিষয়: বিবিধ

১২৬১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

299811
০৮ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ১২:১৪
হতভাগা লিখেছেন : একজন ছেলে যার কি না বয়স ২৫-২৬ বছর এবং চাকরিতে ঠুকেছে সবে মাত্র সে কিভাবে ২৭-২৮ বছর ধরে চাকরি করা একজনের সমান লাক্সারী দিতে পারবে একজন ২৩-২৪ বছরের মেয়েকে তার বাবার মত একই স্পিডে?

দেন মোহর চাওয়ার সময় এমন ধরে এবং ছেলেপক্ষকে রাজি করায় এটা বলে যে এর চেয়ে কম হলে সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না , ওর আর বোনদের কাছে সে ছোট হয়ে যাবে।

এখন এই ২৩-২৪ বছরের মেয়ে সেই ২৫-২৬ বছর ছেলের সংসারে গিয়ে যদি তার বাবা তাকে যেরকম লাক্সারীরে রাখতো সেরকম না পায় তাহলে কি হয় ?

তার উপর শরিয়তে যেখানে তাকে স্বামীর অধীনে অনুগত থাকতে বলা হয়েছে উল্টো সে স্বামীর উপর বসিং করে ।

মুসলিম ফ্যামিলিতে এটা খুবই কমন যে স্ত্রীরা তাদের স্বামীর উপর বসিং করেই হোক সেটা বেশরিয়তী । স্ত্রী যাতে তার সংসারে অশান্তি না করে সেজন্য স্বামী বাধ্য হয়েই তার এই অযাচিত বসিং মেনে নেয় ।

স্বামী তার স্ত্রীকে সাধ্যাতীত দেনমোহর দেবে , ভরনপোষনও করবে আবার বসিংও করতে পারবে না - এসবই হচ্ছে আমাদের মুসলমান সমাজে ।

তাই স্ত্রীর বসিংয়ে যদি থাকতেই হয় তাহলে সেটা টাকা না নিয়ে নয় কেন?

সংসারে ঢুকে যাতে মেয়ের কোন সমস্যা না হয় সেজন্য মেয়ের বাবারই মেয়ের সংসারটাকে সাজিয়ে দেওয়া উচিত , জামাইকে তার মত তাতক্ষনিক স্টাবলিশ হতে সাহায্য করা যাতে জামাই তার মেয়েকে তার মত একই পেসে লাক্সারী দিতে পারে।

তা না হলে মেয়ে শশুরবাড়িতে গিয়ে তো অশান্তি করবেই , সাথে তার স্বামীকে কুপথে যেতে বাধ্য করবে ।

শুধু স্বামীই সংসারে টাকা ঢাললে স্ত্রীর কোন দায় দায়িত্ব থাকে না । পান থেকে চুন খসলেই সংসারে আগুন জালায় , ঝামেলা পাকায় এবং বাপের বাড়ি চলে যাবার হুমকি দেয় । সংসারে সব ইনভেস্ট তারই বলে স্বামীকেই নত হতে হয় ।

যদি সংসারে স্ত্রীরও ইনভেস্ট থাকতো তাহলে জিনিস পত্রের মায়ায় হলেও সে সংসারে আগুন জালাতে চাইতো না বা ভাঙ্গতে চাইতো না ।

বর্তমানে যে তালাক হয় তাতে মেয়েরাই বেশী তালাকের জন্য আবেদন করে । সেটা কোন পিছুটান না থাকার ফলে ।

এসব দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় যে যৌতুক প্রথা কি আসলেই খুব খারাপ ছিল?

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File