বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক পিতামাতার নিরাপদ আবাস

লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ০৪ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৮:২০:৪৯ সকাল

ছোট্ট একটা গল্প দিয়েই শুরু করি । বৃদ্ধ বাবা এবং তার তরুণ সন্তান এক সকালে পার্কে হাটছিলেন । হঠাৎ একটা পাখি দেখে বাবা তার সন্তানের কাছে জানতে চাইলেন, বাবা ওটা কি পাখি ? সন্তান বলল টিয়া । বাবা আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা ওটা কি পাখি ? ছেলে কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বলল, বললাম না ওটা টিয়া । বাবা আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, ওটা কি পাখি ? এবার সন্তান মেজাজ চড়া করে বলল শুনতে পাওনি ওটা টিয়া । বাবা পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা ওটা কি পাখি ? সন্তান এবার আর পাখির নাম বাবাকে বলে নি । বলেছে, তোমার সমস্যা কি । পাগল হয়ে গেলে নাকি । একটা কথা এতবার বললাম তারপরও তুমি বারবার জিজ্ঞাসা করছ, কি পাখি ! মেজাজ খারাপ করে কতক্ষন বাবাকে মন্দ বলে ছেলে পার্কের বেঞ্চে বসে পড়ল । বাবা ছেলেকে সেখানে একটু সময় বসতে অনুরোধ করে বাসায় এসে একটি ডায়েরী নিয়ে আবারও ছেলের কাছে ফিরে গিয়ে ডায়েরীটা তাকে পড়তে বলল । ডায়েরীটা পড়ে ছেলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল এবং বাবার কাছে বারবার ক্ষমা চাইতে লাগল । পাঠক এটা গল্পের প্রথম অংশ । অনুমান করতে পারছেন, ডায়েরীতে কি লেখা ছিল ? বাবা এই ডায়েরীটা তার ছেলের বয়স যখন ৪ বছর তখন লিখেছিলেন । তখনও বাবা তার কৌতুহলী ছেলেকে নিয়ে পার্কে বেড়াতে এসেছিলেন । ছেলে একটি টিয়া পাখি দেখে বাবার কাছে ৩২ বার জানতে চেয়েছিল বাবা ওটা কি পাখি । বাবা বিরক্ত হননি বরং প্রতিবার উত্তর দিয়েছিলেন । বাবা তার ডায়েরীতে লিখেছিলেন, আমার সন্তান আজ আমার কাছে একটি পাখি দেখে ৩২ বার তার নাম জানতে চেয়েছিল এবং আমি প্রত্যেক বার তাকে পাখিটির নাম বলেছি এবং আমার কলিজার টুকরা প্রত্যেকবারই আনন্দ পেয়েছে । পাঠক গল্পটা এখানে শেষ হয়নি । আমাদের সমাজে বারবর আবর্তিত হচ্ছে এই ধরনের গল্প । তবে সে সকল গল্পে বাবার কাছে সন্তানের ক্ষমা চাওয়ার দৃশ্য খুব কম বরং শেষ জীবনে এসে বাবা-মাকে সন্তানের কাছ থেকে দূরে সড়িয়ে দেয়া হয় । সন্তানের কাছে বাবা-মায়ের আশ্রয়ের স্থলে বাবা-মাকে আশ্রয় নিতে হয় কোন বৃদ্ধাশ্রমে । কিছু ব্যতিক্রমও অবশ্যই আছে যেখানে বাবা-মা ইচ্ছা করেই শেষ জীবনে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেন । তবে সে সংখ্যা খুব কম বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাধ্য হয়েই পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিতে হয় । সময় যত অগ্রসর হবে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যাও তত বাড়বে এবং পিতা-মাতার সাথে সন্তানদের দূরত্ব তৈরি হবে । উন্নত বিশ্বের যে সকল রাষ্ট্র মুনফাভিত্তিক সমাজ কাঠামো গড়ে তুলেছে সেখানে পিতা-মাতা বৃদ্ধ হলে তাদেরকে অনুৎপাদক জনসংখ্যা হিসেবে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়া হয় কিন্তু আমাদের দেশের কি ততোটা পরিবর্তন এসেছে ? যে সমাজে মাত্র কয়েক বছর পূর্বেও একান্নবর্তী পরিবারের অস্তিত্ত্ব ছিল কিংবা এখনো বড় পরিবার কেন্দ্রীক পারিবারিক কাঠামো বিদ্যমান সেখানে বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজনীয়তা কেন ? উন্নত বিশ্বে সন্তানের বয়স ১৮ পেরুলেই পিতা-মাতা তাকে স্বাবলম্বী করে নিজেরা আলাদ করে থাকতে পছন্দ করে কিন্তু আমাদের দেশের অবস্থা কি ততোটা পরিবর্তনে হয়েছে । যে সমাজে ৩০ বছর পর‌্যন্ত সন্তানকে পিতা-মাতা লালন করে সেখানে সন্তান একটু স্বাবলম্বী হলেই কেন পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমের দিকে পা বাড়াতে হবে ? দেশে যে হারে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ছে তাতে নচিকেতার বিখ্যাত বৃদ্ধাশ্রম গানটির বাস্তব অবস্থা দেখতে বোধহয় খুব বেশি অপেক্ষা করতে হবে না । আজ যে সন্তান তারা পিতা-মাতাকে জোড় করে কিংবা এমনভাবে অবহেলা করছে যাতে তারা বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বাধ্য হয় সেই সন্তানকেই যখন তার সন্তান এভাবেই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে তখন তার কেমন লাগবে ? সন্তান যখন বেশি সুখ ভোগ করার আশায় তার অসহায় বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায় তখন তার বিবেক ঘুমিয়ে থাকে কেমনে ? সময় বড় বেরসিক । আবর্তিত হয়ে বদলা নেবেই । বৃদ্ধ হলে মানুষ শিশুর মত আচরণ করে কিন্তু যে সন্তানটি আজ পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছে যে যখন দীর্ঘ কয়েক বছর পিতা-মাতাকে অসহ্য যন্ত্রনা দিয়েছে তখন তো পিতা-মাতার একবারের জন্যও সন্তানকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয়ার চিন্তা আসেনি । যে সন্তান পিতা-মাতাকে মানসিক কিংবা অন্যকোনভাবে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বাধ্য করে সে সন্তানের ভেবে দেখা উচিত তার পরিণতি কেমন হবে । পিতা-মাতাকে যতই কষ্ট দেয়া হোক না কেন তারা তাদের সন্তানদের জন্য অকল্যান কামনা করবে না কিন্তু সময় তো তার আপন ধর্মেই বদলা নেবে ।

বৃদ্ধাশ্রমের যাত্রার ইতিহাস বহু আগের । পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনে । খ্রিষ্টপূর্বে ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতারিত বৃদ্ধদের জন্য আলাদা আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করেছিল শান রাজবংশ । আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজনীয়তা যে একেবারে নেই তা বলব না । কিছু মানুষের জন্য বৃদ্ধাশ্রম দরকার । যে সকল পরিবারের কর্মঠ সদস্যসরা পিতা-মাতাকে ‍তিনবেলা আহারের ব্যবস্থা করে দিতে পারে না সে সকল পিতা-মাতার জন্য বৃদ্ধাশ্রম উত্তম আশ্রয় স্থল কেননা বৃদ্ধাশ্রমে তিন বেলা আহারের নিশ্চয়তা পাওয়া যায় । যে সকল বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সন্তান-সন্ততি কিংবা নিকট আত্মীয় স্বজন নাই তাদেরও বৃদ্ধাশ্রম উত্তম আশ্রয় স্থল । যাদের সন্তান সন্ততি কাজের প্রয়োজনে বিদেশে থাকে সে সকল পিতা-মাতার জন্যও বৃদ্ধাশ্রম উত্তম আবাসস্থল । যে সকল বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা শেষ বয়সে একটু নিরাবিলিতে থাকার জন্য স্বেচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেন তাদের ব্যাপারেও কিছু বলার নাই কিন্তু স্বচ্ছল সন্তানের পিতা-মাতাকে কেন বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো হয় । প্রতিটি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা চান জীবনের শেষ সময় নাতি-নাতনীদের সাথে হাসি-খুশিতে সময় কাটাতে । পরিবারের সদস্যদের থেকে একটু বাড়তি যত্ন পেতে । ঠিক সেই সময় যখন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে বাধ্য হয়ে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিতে হয় তখন এর চেয়ে বেশি কষ্টের আর কি হতে পারে ? অনেক সন্তানের ব্যাপারে শোনা যায় তারা তাদের পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসার পরে একটু দেখতেও যান না এমনকি মৃত্যু শয্যায় পতিত হওয়ার খবর শুনে একটু টেলিফোনও করেন না । বৃদ্ধাশ্রমে থাকাকালীন সময়ে সন্তান-সন্ততির চিঠি কিংবা টেলিফোন বৃদ্ধ পিতা-মাতার কাছে ঈদের আনন্দের মত অথচ সন্তান তার পিতা-মাতাকে সর্বনিম্ন সে সূখটুকু দেয়ারও প্রয়োজন মনে করে না । ঈদ কিংবা পরিবারের অন্য কোন বড় অনুষ্ঠানের খবর পিতা-মাতার অগোচরেই থেকে যায় । বাধ্য হয়ে পিতা-মাতাও মৃত্যুর ক্ষণ গুনতে শুরু করে । বিবিসিতে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেয়া কিছু বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সাক্ষাৎকার শুনে ছিলাম । তাদের মুখে ভালো থাকার খবর শুনেই অন্তরের ভালো থাকা পরিমাপ করতে চেয়েছি । এরাই তারা যারা জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও সন্তানের কল্যান কামনা করেন অথচ আমরা ?

কথায় বলে, আপনের চেয়ে পর ভালো, পরের চেয়ে বৃদ্ধাশ্রম । এক নির্ভেজাল সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি আমরা এবং আমাদের সমাজ । খুব বেশি বাকি নাই নচিকেতার বৃদ্ধাশ্রম গানের লাইনটির বাস্তবায়ন হতে, ‘খোকারও হয়েছে ছেলে, দু’বছর হল । আর তো মাত্র বছর পঁচিশ, ঠাকুর মুখ তোল’ ।.....‘আশ্রমের এই ঘরটা ছোট, জায়গা অনেক বেশি । খোকা আমি দু’জনেতে থাকব পাশাপাশি । সেই দিনটার স্বপ্ন দেখি ভীষণ রকম । মুখোমুখি আমি খোকা আর বৃদ্ধাশ্রম’ । বর্তমান প্রজন্মের মুখ থেকে শুনতে চাই, তারা যেন ‍দীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করে, আমাদের পিতা-মাতার জন্য কোন প্রয়োজন নাই বৃদ্ধাশ্রম নির্মানের । ক্ষনিকের সূখ পেতে কেউ যেন দীর্ঘস্থায়ী সূখ ও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ পিতা-মাতাকে নির্বাসনে না পাঠায় । যে গৃহে পিতামাত আছে সে গৃহের সুখ কোন পার্থিব সম্পদের বিনিময়ে বদল করা আদৌ সম্ভব নয় । কয়েকমাস পূর্বে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রিত এক মায়ের সন্তানের কাছে লেখা একটি চিঠি প্রকাশিত হয়ে অনেক মানুষের বিবেক নাড়িয়ে দিয়েছিল । যে বাবা-মা নিজেরা না খাইয়ে সন্তানের মুখে খাইয়ে দিয়েছেন তাদের খোঁজ নেওয়ার কিংবা সাথে থাকার সৌভাগ্য যদি কেউ ইচ্ছা করে নষ্ট করে তবে তার মত হতভাগা এই ভবে আর দ্বীতিয়টি আছে কিনা সন্দেহ । প্রতিটি সন্তানের কাছে বিনীত অনুরোধ, বাবা-মা যেন কোন ব্যাপারে কষ্ট না পায় । মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর‌্যন্ত যেন তারা তাদের সন্তানদের কাছ থেকে হাসি মুখ দেখতে পায় । আমাদের দেশের প্রতিটি পরিবার যেন বৃদ্ধাশ্রমে রূপ নেয় । কেননা পরিবারই কেবল পিতামাতার নিরাপদ আবাস স্থল হতে পারে ।

রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।



বিষয়: বিবিধ

১২০২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

299122
০৪ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ১০:০০
ইসলামী দুনিয়া লিখেছেন : খুববই---ভালো লেখা। সচেতনতা মূলক লেখার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
299160
০৪ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ১১:২১
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : লেখাটা পড়ে মন্তব্য করার ভাষা নেই! তবুও দোয়া করি মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক!

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File