শেষ রাতের স্বপ্ন যদি সত্য হত !
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৪, ১২:১৮:৫০ দুপুর
ছোট বেলা থেকে যে বিষয়ে খুব বেশি ভাবি সে বিষয়টি স্বপ্নে উপস্থিত হয় । স্বপ্নের বৈজ্ঞানিক ব্যাখা সম্পর্কে আমার খুব বেশি জ্ঞান নাই । তবে দু’একটি ব্যাখা যা জানি তা খুব বেশি মনঃপুত নয় । তাই স্বপ্নকে বাস্তবতার সাথে মিলানোর ভ্রান্তিবিলাসে কখনো গা-ভাসানোর প্রয়োজন বোধ করি না । তবে গত রাতে দেখা স্বপ্নটি নিয়ে কৌতুহলের শেষ নাই । বিজয় দিবসের রাতের স্বপ্নটি কেন যেন ভাবিয়ে তুলছে । ডিসেম্বর মাসটি বাংলাদেশীদের কাছে বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ । বিশেষ কয়েকটি কারণের মধ্যে এ মাসের ১৬ তারিখ বাংলাদেশীদের বিজয় অর্জনের মাধ্যমে নতুন পরিচয় লাভ অন্যতম । এছাড়াও শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবসের শোকাবহ দিন এবং মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে বাঙালীর প্রাণপন লড়াইয়ের স্মৃতির কারণে এ মাসটি সত্যিই বাংলাদেশীদের ইতিহাসের বিরাট এক অংশ । গোটা ডিসেম্বর জুড়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং এর পুর্বাপর রাজনীতি নিয়ে ভীষণভাবে ভাবছিলাম । বিশেষ করে দেশের বর্তমান সংকটপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে । দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল দু’টো রাজনৈতিক আদর্শের কারণে সম্পূর্ণ বীপরিতমূখী অবস্থান করায় দেশের ভাগ্য দোদ্যুল্যমান । একদল গণতন্ত্রহীন উন্নয়ণ বাস্তবায়ণে ব্যস্ত এবং অন্যদলটি উন্নয়ণের পূর্বে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিশ্বাসী । দু’টো দলের মত ভিন্ন হওয়ায় দেশের মধ্যে একটা ছন্নছাড়া পরিস্থিতি বিরাজমান । ক্ষমতাশীনদল তাদের পুলিশবাহীনিসহ বিভিন্ন বাহিনীর মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধ মতকে দমন করে এগিয়ে যেতে চাইলেও সেটা সফলভাবে পারছেনা । অন্যদিকে সাবেক বিরোধীদল দেশের জনগণের চেয়েও বিদেশীদের বিশেষ করে আমেরিকান প্রশাসনের উপর বেশি নির্ভর করে আছে । সরকারীদলও যে ক্ষমতায় আরোহনের জন্য শুধু জনগণের প্রতি আস্থা রেখেছিলেন তা কিন্তু নয় । বিভিন্ন গনমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জ্ঞাত হয়েছে, দেশের জনগণের চেয়েও বর্তমান ক্ষমতাশীনদের ক্ষমতায় আরোহন করাতে প্রতিবেশি ভারতের অবদান বেশি । ভারতের সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে হেরে যাওয়া কংগ্রেসের কল্যানেই গত ৫ই জানুয়ারী একটি বিতর্কিত ও অগ্রহযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান ক্ষমতাশীনরা ক্ষমতার চেয়ারে বসার সুযোগ পেয়েছে । জাতীয় সংসদের নির্বাচনী ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসন বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় লাভ করা এবং অতীতের জাতীয় নির্বাচনগুলোর মত ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ইউরোপীয়ান ইউনিয়ণ কিংবা অন্য কোন পশ্চিমা রাষ্ট্র পর্যবেক্ষক না পাঠানোয় বিশ্বব্যাপী এ নির্বাচনের গ্রহনযোগ্যতা প্রায় নাই বলেই অনেকে ধারণা করছেন । তাইতো বিভিন্ন সময় তাদের মূখ থেকে পরবর্তী নির্বাচন কবে হবে সে নিয়ে প্রশ্ন উচ্চারিত হচ্ছে । সার্কভূক্ত ৩টি দেশ থেকে যে কয়জন পর্যবেক্ষক এসেছিল তারা আসা আর না আসার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য আছে বলে দেশের অনেকেই মনে করেন না ।
৫ জানুয়ারীর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশী-বিদেশী চাপ কম ছিল না । বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশেষ করে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনও দেশের বৃহত্তর দু’ই দলের নেত্রীদ্বয়কে ফোন করে সংলাপের মাধ্যমে মীমাংস করে নির্বাচনে অংশগ্রহনের জন্য অনুরোধ করেছিলেন । এছাড়াও গত বছরের শেষদিকে তারানকোর বাংলাদেশ সফরও ছিল কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর বিবাদমান দূরত্ব দূর করার জন্য । কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি । সংলাপের শুরু হবে এই আশা দেখিয়ে কিছু নাটকের স্ক্রিপ্ট মন্থস্থ হয়ে সংলাপহীনভাবেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল এবং বিজয়ীদল বেশ দাপুটে ভাবে দেশ পরিচালনা করছে । মিডিয়ার মতে, ৫ই জানুয়ারী অনুষ্ঠিত প্রহসনের নির্বাচনের দিনকে ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ দিবস পালন করার কথাও বাতাসে ভাসছে । নবম জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধীদলসহ নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দল নির্বাচনের বাইরে থাকলেও মাত্র ১২টি দল নিয়ে নির্বাচন হয়ে গেল এবং এ নির্বাচনে জয়ী সরকারের মেয়াদ বর্ষপূর্তি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে । দশম জাতীয় নির্বাচনের অংশগ্রহনকারী বিরোধীদলের সদ্যস্যদের মন্ত্রিত্ব দান এবং বিরোধীদল প্রধানকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দুত মনোনীত করায় বেশ ভালোই অনুভূতি হচ্ছে কিন্তু সংসদের বিরোধীদলের সদস্যদের প্রাজ্ঞাংশ যদি সরকারের মন্ত্রী হয় তবে সরকারের সমালোচনা করে তাদের ভূল শুধরে দেবে কে ? তবুও আশার বাণী অন্তত রাজনৈতিক দলের মত পার্থক্য দূর হয়ে ভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতার এক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে শুরু করেছেন । কিন্তু বর্তমানে যাদেরকে প্রধান বিরোধী দলে বসানো হয়েছে তারা দেশের রাজনীতিতে কতটুকু অংশ জুড়ে আছে এবং এ দেশে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত ঠিক কোন পর্যায় ? আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি ছাড়া এদেশে অন্য যতগুলো রাজনৈতিক দল আছে তাদের কিছু দল জোটবদ্ধ হয়ে আওয়ামীলীগ কিংবা বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাতে পারে ঠিক কিন্তু এককভাবে কিংবা বৃহৎ জোটবদ্ধ অবস্থায় জোটের নেতা হয়ে সরকার গঠন করার সম্ভাবনা আদৌ কোন দলের আছে কিনা সেটা ভেবে দেখা জরুরী । যদি বলা হয় আগামী ১৫ বছরে এমন সম্ভাবনা নাই তবে কি খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবে ।
বিশ্বের শক্তিশালী দেশের কিছু এবং ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের অনেকেই বিএনপি এবং আওয়ামীলীগের মধ্যে সংলাপ আয়োজনের চেষ্টা করে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলেও দূর্ভাগার স্বপ্নে এমন একটি দুরুহ ঘটনা উপস্থিত হয়েছিল । যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পরস্পর মূখোমূখি বসে দেশের ভবিষ্যত এবং তাদের অবস্থান আলোচনা করে একমত হওয়ার চেষ্টা করছেন । দুই দলেরই সামন্য সংখ্যক সদস্য উপস্থিত থাকায় অনুষ্ঠানে খুব বেশি হইচই ছিল। অনুষ্ঠানের মধ্যস্থতা করছিলেন দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস এবং তাকে সহযোগিতা করছিলেন দেশের কিছু অস্পষ্ট গ্রহনযোগ্য ব্যক্তিবর্গ । ড. ইউনুসকে অনুষ্ঠানের মধ্যস্থতা করতে দেখে সত্যিই অবাক হয়েছিলাম । কারণ ইতোপূর্বে ড. ইউনুসকে রাজনৈতিক ব্যাপারে কোন আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখিনি । তৎক্ষনাৎ স্মরণ হলো, ড. ইউনুসকে তো শান্তিতে নোবেল দেয়া হয়েছে সুতরাং শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করাই তার কাজ । তবে স্বপ্নের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, দু’নেত্রীর সংলাপে মধস্থতাকারীদের মধ্যে কোন বিদেশী কিংবা বিদেশীদের ছায়া পরিলক্ষিত হয়নি । এটি একটি নিছক স্বপ্ন । বিজয় দিবসের রাত্রে স্বপ্নটি দেখার পর যখন ঘুম ভেঙ্গে গেল তখন মোবাইলের কোনে রাত ৩.৪২ মিনিট । মুহুর্তেই মনে পড়ে গেল স্বপ্ন সম্পর্কে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের উক্তি, ‘আকাশ-স্বপ্ন চিরকাল আকাশেই থাকে, মাটিতে নেমে আসে না কখনো’ । নাম বিস্মৃত হওয়া একজন মনীষী স্বপ্ন সম্পর্কে বলেছিল, ‘স্বপ্ন দেখা ভালো, তবে স্বপ্নের রাজ্যে বাস করা বোকামী’ । বিখ্যাত জনদের এমন উক্তিগুলো মনে পড়তেই নিজের উপর বিরক্তি অনূভব করলাম কেননা শীতের মওসুমে শেষ রাতের ঘুমটা বেশ গভীর হয় । অর্থহীন একটি স্বপ্ন দেখে সে ঘুমটাই সাঙ্গ হল । আমার মত কিছু দেশবাসীর কাছে এমন স্বপ্নের বাস্তবায়ন জরুরী কিন্তু যাদের দ্বারা এমন স্বপ্ন বাস্তবায়ণ হবে তারা কি কেউ এমন স্বপ্ন দেখেন কিংবা আমার মত অপাংক্তেয়দের মধ্যে যারা দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখে তাদের স্বপ্ন নিয়ে ভাবার সময় কি তাদের আছে ? তবুও বাঙালী আশায় বাঁচে । আমাদেরকেও বাঁচতে হবে ।
বইতে পড়েছি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা জিয়াউর রহমানের মত বীরদের কথা । দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি তাদের ভালোবাসা এবং ত্যাগের কথা । পত্রিকার পাতায় মাওলানা ভাসানীর ছাদ ও ছাউনিহীন রান্না ঘরে গেঞ্জী পরিহিত অবস্থায় নিজ হাতে রান্না করার দৃশ্য, গোপালঞ্জের মানুষের অভাবের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বাবার সাথে কথা বলার অজুহাতে ঘর থেকে দূরে নিয়ে গরীবদেরকে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের গোডাউন থেকে ধান, চাল নেয়ার সুযোগ করে দেয়া এবং তাদেরকে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেয়া কিংবা প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় দক্ষিনবঙ্গসহ দেশের বিভিন্নস্থানে কোদাল কিংবা মাটির ঝুড়ি মাথায় জিয়াউর রহমানকে দেখে বুকটা গর্বে ফুলে ওঠে । এই মহান নেতাদের দেশে এমন অবস্থা চলছে কেন, চলবে কেন ? দেশে নতুন কোন রাজনৈতিক দলের অলৌকিক উত্থান হয়নি যে তারা আদর্শহীনভাবে দেশকে অস্থির করে তুলবে । ’৯০ পরবর্তী সময়ে যারা সময়ের পালাবদলে দেশকে শাসন করেছে তাদের কেউ আদর্শ পিতার সন্তান কিংবা আদর্শ নেতার স্ত্রী । তারপরেও দেশটা এমনভাবে চলছে কেন ? বর্তমানে বৃহত্তর রাজনৈতিক দল দু’টোর মধ্যে পরমত সহিষ্ণুতার ছিঁটে ফোঁটাও নাই । সময়ের পালাবদলে একই দৃশ্য বারবার চিত্রিত হয়েছে । কেউ বেশি আবার কেউ কম । ইতোমধ্যে বিজয়ের ৪৩তম বার্ষিকি পালন করে ফেললেও কাঙ্খিত শৃঙ্খলা কিংবা স্থায়ী শান্তি আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি । গুম-খুন, সড়ক দূর্ঘটনাসহ বিভিন্ন দূর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত বহু মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে । দুর্নীতির কারণে দেশটা সামনে এগোতে হিমশিম খাচ্ছে । সংবিধানের অনেক কিছুই উপেক্ষিত হচ্ছে । মানবাধিকার লংঘনের চরম মহড়া চলছে । দেশের এমন চিত্র কি আদৌ কাম্য ছিল ? কোন সম্পদের অভাব আমাদের দেশে । প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে শুরু করে মানব সম্পদ পর্যন্ত-সবকিছুতেই পরিপূর্ণ আমার সোনার বাংলাদেশ । শুধু অভাব রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং পরিমত সহিষ্ণুতার । আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য না হোক অন্তত দেশের স্বার্থ বিবেচনায় বৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন দু’টো আন্তরিক হবে এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য এগিয়ে আসবে-এটাই কাম্য । দেশের মানুষ শুধু রাতে নয় বরং সার্বক্ষণিকভাবেই এমন স্বপ্ন বুঁনে । দেশের মানুষের সে স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ণ করাই বোধ হয় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান দায়িত্ব ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
বিষয়: রাজনীতি
১০৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন