মানবাধিকার সনদ ও প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৪, ১২:৫২:২৩ রাত
জাতিসংঘের নির্দেশনায় বিশ্বের সকল দেশে প্রতিবছর ১০ ডিসেম্বর পালন করা হয় মানবাধিকার দিবস । ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মানবাধিকার সনদ ঘোষিত হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর নির্ধারিত তারিখে এ দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে । এছাড়াও, ‘সার্বজনীন মানব অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাকে’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ তারিখকে নির্ধারণ করা হয়েছে । সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী নবরূপে সৃষ্ট জাতিসংঘের অন্যতম বৃহৎ অর্জন । সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের মূখবন্ধে বলা আছে, ‘যেহেতু মানব পরিবারের সকল সদস্যের সহজাত মর্যাদা ও সম-অবিচ্ছেদ্য অধিকার সমূহের স্বীকৃতি বিশ্বে স্বাধীনতা, ন্যায়-বিচার ও শান্তির ভিত্তি; যেহেতু মানবিক অধিকার সমূহের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা মানবজাতির বিবেকের পক্ষে অপমানজনক বর্বরোচিত কার্যকলাপে পরিণতি লাভ করেছে এবং সাধারণ মানুষের সর্বোচ্চ আশা-আকাঙ্খার এমন একটি পৃথিবীর সূচনা ঘোষিত হয়েছে যেখানে মানুষ বাক ও বিশ্বাসের সাধীনতা এবং ভয় ও অভাব থেকে নিস্কৃতি ভোগ করবে; যেহেতু চুড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে মানুষকে অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে বাধ্য করা না হলে মানবিক অধিকার সমূহ অবশ্যই আইনের শাসনের দ্বারা সংরক্ষিত করা উচিত; যেহেতু জাতিসংঘভূক্ত জনগণ সনদের মাধ্যমে মৌল মানবিক অধিকারসমূহ, মানুষের মর্যাদও মূল্য এবং নারী ও পুরুষের সম-অধিকারের প্রতি আস্থা পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং সামাজিক অগ্রগতি ও ব্যাপকতর স্বাধীনতা উন্নততর জীবনমান প্রতিষ্ঠাকল্পে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ; তাই সে লক্ষ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি ও সমাজের প্রত্যেক অঙ্গ মানবিক অধিকার সমূহের এই সার্বজনীন ঘোষণাপত্রটিকে সর্বদা স্মরণ রেখে শিক্ষাদান ও জ্ঞান প্রসারের মাধ্যমে এ সকল অধিকার ও স্বাধীকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রগতিশীল ব্যবস্থাদি দ্বারা সদস্য-রাষ্ট্রসমূহের জনগণ ও তাদের অধীনস্থ অঞ্চলসমূহের অধিবাসীবৃন্দ উভয়ের মধ্যে উপরোক্ত বিষয়গুলোর সার্বজনীন ও কার্যকর স্বীকৃতি এবং মান্যতা অর্জনের জোর প্রচেষ্টা চালাবে’ ।
উইকিপিডিয়া প্রদত্ত মানবাধিকারের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এক ধরনের অধিকার যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য । মানুষ এ অধিকার ভোগ করবে এবং চর্চা করবে । তবে এ চর্চা অন্যের ক্ষতিসাধন ও প্রশান্তি বিনষ্টের কারণ হতে পারবে না । মানবাধিকার সব জায়গায় এবং সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য । এ অধিকার একই সাথে সহজাত ও আইনগত অধিকার । স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম দায়িত্ব হল এসব অধিকার রক্ষণাবেক্ষণ করা । যদিও অধিকার বলতে প্রকৃতপক্ষে কি বোঝানো হয় এখন পর্যন্ত তা একটি দর্শনগত বিতর্কের বিষয়’ । বিশ্বের সর্বত্র কমবেশি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে । তবে ক্ষেত্র বিশেষ তার মাত্রাভেদ রয়েছে । যেখানে পূর্ণ গণতন্ত্র এবং পরমত সহিষ্ণুতার চর্চা হয় সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা অনেক কম । কিছু ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক চাপমূক্ত মানবাধিকার কমিশনের সক্রিয়তার কারণে মানবাধিকার রক্ষা পাচ্ছে । বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষার স্লোগান বিরাজমান থাকার পরেও শক্তিমান কর্তৃক দূর্বলের অধিকার খর্বিত হচ্ছে । উন্নত দেশগুলোর চেয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় বেশি । আবার কখনো কখনো বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর চাপের মুখে সামগ্রিকভাবে অনুন্নত কিংবা উন্নয়ণশীল দেশগুলো তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । রাষ্ট্র যখন কোন অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তখন সে চাপ স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের জনগণের উপর পতিত হয় । বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের হিড়িক চলছে । সংখ্যাগুরুদের দ্বারা সংখ্যালগুরা প্রতিনিয়ত অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে এবং নির্যাতনের শিকার হচ্ছে । সবল প্রতিবেশী রাষ্ট্র দ্বারা দূর্বল প্রতিবেশি রাষ্ট্রের অধিকার হরণ তো নিত্য-দিনকার রুটিনে পরিণত হয়েছে । যারা মানবাধিকার রক্ষার মিছিল দিয়ে বেড়ায় তারাও ক্ষেত্র বিশেষ চুপ থাকতে কার্পণ্য করে না । অবস্থা দৃষ্টি মনে হচ্ছে, মানবাধিকারের স্লোগান দিন দিন বুলি সর্বস্ব হয়ে যাচ্ছে । আন্তর্জাতিক বিশ্ব এবং দেশের শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বাংলাদেশের মানুষের প্রকৃত কিছু অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে । বিবিসিসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংবাদ সংস্থার মতে, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক । সাধারণ মানুষের মানবাধিকার তো রক্ষা পাচ্ছেই না সাথে বিভিন্ন বেসরকারি মানবাধিকার কমিশনের প্রধান কিংবা এর সাথে জড়িত ব্যক্তিদের উপরও বিভিন্ন সময় নেমে আসে জুলুম নির্যাতনের খড়গ । আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে উল্লেখিত শর্তসমূহের সাথে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটের তুলনা করলেই দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি স্পষ্ট হয়ে উঠবে ।
মানবাধিকার সনদে লিপিবব্ধ ৩০টি অনুচ্ছেদের মধ্যে ১ম অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘যেহেতু বন্ধনহীন অবস্থায় এবং সম-মর্যাদা ও অধিকারাদি নিয়ে সকল মানুষ জন্মগ্রহন করে । সুতরাং ভ্রাতৃত্বসূলভ মনোভাব নিয়ে তাদের একে অন্যর প্রতি আচরণ করা উচিত’ । বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্বসূলভ কোন আচরণ কি আদৌ হচ্ছে ? বিশেষত ধনবানদের সাথে গরীবদের যোজন যোজন পার্থক্য করা হয়েছে । ক্ষমতাশালীরা দূর্বলদেরকে কেবল পেষণ করেই যাচ্ছে । সম্পদ হরণ থেকে শুরু করে নানা ঝামেলা চলছেই । সর্বত্র কেবল দ্বন্দ্ব আর বিশৃঙ্খলা । ভ্রাতৃসূলভ আচরণের উপস্থিতি খুব সামান্ই । সনদের ২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘যে কোন প্রকার পার্থক্য যথা- জাতি, গোত্র, বর্ণ, নারী-পুরুষ, ভাষা, ধর্ম, রাজনৈতিক বা অন্য মতবাদ, জাতীয় বা সামাজিক উৎপত্তি, সম্পত্তি, জন্ম বা অন্য মর্যাদা নির্বিশেষে কোন পার্থক্য করা চলবে না’ । অথচ সোনার বাংলাদেশের কিছু মানুষ রাজনৈতিক হানাহানিতে লিপ্ত । একটি রাজনৈতিক দলের প্রতি অন্য রাজনৈতিক দলের কোন শ্রদ্ধাবোধ নাই । ধর্ম নিয়েও চলছে বাড়াবাড়ি । উপসনালয় ভাঙ্গা হচ্ছে । নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিয়ে আন্দোলনের পর আন্দোলন করেও কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না । গোত্র বা বংশ গৌরব নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি না থাকলেও পরিস্থিতি একেবারে শান্ত নয় । জাতীয়তা বোধ নিয়ে রাষ্ট্রে ফাটল সৃষ্টির দ্বারপ্রান্তে । একপক্ষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বাড়াবাড়িতে অন্যপক্ষ শীথিলতায় । এ নিয়ে পারস্পরিক ঝগড়ার কোন শেষ নাই । এভাবে চললে মানুষের পূর্ণ অধিকার রক্ষা পাওয়া দুস্কর । সনদের ৩য় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকেরই জীবন-ধারন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে’ । বাংলাদেশে মানুষ কি পূর্ণ স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাচ্ছে ? প্রতিদিন সড়ক দূর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে । দেশব্যাপী গুম-খুনের রাজত্ব কায়েম হয়েছে । আইনের রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছে । শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, রাজনীতিক, মজুরসহ অসংখ্য মানুষ গুপ্ত হত্যার শিকার হচ্ছে । গুম যেন ট্রাডিশন হয়ে দাঁড়িয়েছে । নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডের কারণে নারীর পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে । এভাবে চলতে থাকলে মানবাধিকার পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে । মানবাধিকার সনদের ৭ম অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘আইনের কাছে সকলেই সমান এবং কোনরূপ বৈষম্য ব্যতিরেকে সকলেরই আইনের দ্বারা সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার রয়েছে’ । আইনের শাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা কী ? সর্বত্র আইনের চোখে সবাই সমান-এ কথা বলা হলেও আইনের প্রয়োগ সেভাবে হচ্ছে না । প্রকৃত অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন । আইন প্রয়োগে শাসকগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে যেভাবে ব্যাখ্যা হচ্ছে বিরোধী দলের ক্ষেত্রে সে ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন । আবার সাধারণ জনগণের জন্য আইনের প্রয়োগ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় । যে মামলায় বিরোধী পক্ষের জেল হয়ে যায় সে একই মামলায় সরকারী পক্ষের বেকসুর খালাস ! আইনে যদি এমন বহুরূপিতা থাকে তবে মানবাধিকার রক্ষা পাবে তা ভাবাও অযৌক্তিক । সনদের ৯ম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কাউকে খেয়াল-খুশিমত গ্রেফতার, আটক অথবা নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে না’ । বাংলাদেশে মানবাধিকার সনদের এই ধারাটির প্রায় সম্পূর্ণটাই উপেক্ষিত হচ্ছে । শুধু সন্দেহের বশে মানুষকে গ্রেফতার করে বিনা বিচারে দীর্ঘদিন আটক রাখা হচ্ছে । আবারও কখনো কখনো আটক করেও তা শিকার করা হয়না । নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত মার্ডারের ঘটনায় র্যাবের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে । ঝালকাঠীর লিমনকে বিনা অপরাধে গুলি করে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে । বিচার বহির্ভূত ক্রস ফায়ারের মাধ্যমে মানুষ মারা হচ্ছে । পরিবারের দাবী অনুযায়ী, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেফতার করলেও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছেনা বহু মানুষের । মানবাধিকার সনদের ১৪নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্যাতন এড়ানোর জন্য প্রত্যেকেরই আশ্রয় প্রার্থনা ও আশ্রয় লাভ করার অধিকার রয়েছে’ । এ ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের বহু মানুষ প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় পেয়েছিল । বর্তমানে মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর বর্বরোচিত নির্য্যাতন চলছে । তাদের কিছু সংখ্যক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়েছিল । কিন্তু প্রশাসন তাদেরকে বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকতে দেয়নি । মানবাধিকার সনদের ১৯তম অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকেরই মতামতের ও মত প্রকাশের স্বাধিকার রয়েছে; বিনা হস্তক্ষেপে মতামত পোষণ এবং যে কোন উপায়ে ও রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে তথ্য ও মতামত সন্ধান, গ্রহন ও জ্ঞাত করার স্বাধীনতা এই অধিকারের অন্তভূর্ক্ত’ । অথচ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন । দিগন্ত টেলিভিশন, আমাদের পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বহুদিন পূর্বে । মানবাধিকার সংস্থা অধিকার প্রধান আদিলুর রহমানকে জেলে আটক রাখ হয়েছিল দীর্ঘদিন । যত্রতত্র মানুষকে রাজাকার উপাধি দেয়া হচ্ছে । দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ডা. পিয়াস করিমকে মতপ্রকাশের কারণে মৃত্যুর পর তার মরদেহ শহীদ মিনারে নিতে দেয়া হয়নি । এমন কিছু ব্যক্তিদেরকে শহীদ মিনারে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়েছে যারা দেশের শীর্ষ স্থানীয় বুদ্ধিজীবি হিসেবে পরিচিত । মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত বাহিনীর উপ-প্রধানকে রাজাকার আখ্যা দিতেও কার্পণ্য করা হয়নি । এই যদি হয় অবস্থা তবে মানবাধিকার রক্ষা পাবে কোন পথে ?
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
বিষয়: বিবিধ
৮১০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন