দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশ ও উন্নয়নের যাত্রায় প্রাপ্তি
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৪, ১০:৩৭:৪৪ রাত
প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবস । মূলত দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠন এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই মহা ধুমধাম করে এ দিবসটি পালন করা হয় । প্রতিটি দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে দুর্নীতি অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক হওয়ায় সচেতন মহল দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন । তারপরেও বিশ্বের প্রতিটি দেশে কমবেশি দুর্নীতির উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় । উন্নত দেশগুলোর চেয়ে অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দুর্নীতির প্রভাব অনেক বেশি চিত্রিত হয় । মুখে সবাই দুর্নীতি বিরোধী স্লোগান দিলেও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গ । এসকল ব্যক্তিবর্গ তাদের অবস্থানকে দৃঢ় করার জন্য তাদের আশে পাশের কিছু মানুষকে তাদের সারিতে দাঁড় করায় । যে দেশে দুর্নীতির মাত্রা যত বেশি সে দেশে উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি তত কম । বিশ্লেষকদের মতে, গণতন্ত্র এবং সুশাসনের অনুপস্থিতির কারণে সবেচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় । যে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যত দুর্বল সে দেশে দুর্নীতির প্রভাব তত বেশি । দুর্নীতিগ্রস্থ দেশকে ফুটো কলসির সাথে তুলনা করা চলে । তলা ছিদ্র কলসিতে যত পানি ঢালা হোক তা যেমন স্থায়ী হয়না তেমনি দুর্নীতি কবলিত দেশে দেশী-বিদেশী অর্থ ব্যয় করে যতই উন্নয়ন করার চেষ্টা করা হোক না কেন তাতে কাজের কাজ কিছুই হয় না । যে দেশগুলোতে দুর্নীতির মাত্রা যত বেশি সে দেশের মানুষের মধ্যে নৈতিকতা বোধ তত কম । কাজেই নীতিভ্রষ্ট মানুষ দ্বারা যেমন অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব নয় তেমনি সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা রক্ষা করাও অসম্ভব । স্বাভাবিকভাবেই দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে প্রকৃত দেশপ্রেম না থাকায় দেশের উন্নয়ন কিংবা অগ্রগতি অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে না ।
দুর্ভাগ্যের হলেও সত্য, বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ অন্যতম একটি দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ হিসাবে পরিচিত । স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের বয়স দীর্ঘ ৪৩ বছর হলেও কেবল দুর্নীতির কারণে দেশ তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে আজও পৌঁছতে পারেনি । বিভিন্ন মেয়াদে দেশের শাসন-ক্ষমতায় যারা আরোহন করেছে তারা দেশবাসীকে রঙিন রঙিন স্বপ্নে বিভোর রাখলেও দুর্নীতির কারণে সে স্বপ্নের পূর্ন বাস্তবায়ণ হয়নি । বিশ্বের বুকে কোন মহৎ কাজে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ণ হতে না পারলেও দুর্নীতিতে দেশটি ধারাবাহিকভাবে পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে । বাঙালি জাতি প্রমাণ করেছে, ভালো কিছু অর্জন করার চেয়ে মন্দ কিছু অর্জন করা একেবারেই সহজ । যে রাজনৈতিক দল দেশবাসীকে তুলনামূলক বৃহৎ স্বপ্ন দেখাতে পেরেছে তাদেরকেই দেশবাসী ক্ষমতার মঞ্চে আরোহণ করার সুযোগ করে দিয়েছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি । বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করা হবে বলে আবারও দেশবাসীকে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে । স্বপ্ন দেখতে দোষ নাই কিন্তু স্বপ্নের রাজ্যে বাস করা সত্যিই বোকামী । বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের কিংবা উন্নত দেশে পরিণত হোক সেটা সবাই কামনা করে কিন্তু দেশে যেভাবে দুর্নীতির ভয়াল খেলা চলছে তাতে এ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার ন্যূণতম সম্ভবনা রয়েছে কী ? দেশের সর্বত্র দুর্নীতির মোড়কে আবদ্ধ । দুর্নীতির টাকা যদি দেশের মধ্যে থেকে দেশের উন্নয়ণে ব্যবহার হত তাতেও কিছুটা স্বান্তনার স্থান থাকত কিন্তু দুর্নীতির টাকা কিংবা সম্পদ তো আর দেশে থাকছে না । দুর্নীতিতে যারা রাঘব বোয়াল বলে চিহ্নিত হয়েছে তারা দেশের টাকায় বিভিন্ন দেশে প্রাচুর্য গড়েছে । দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে প্রায় পঙ্গু করে দেয়ার চক্রান্ত এখনো থামেনি । দুর্নীতিতে যারা চুনোপুঁটির ভূমিকায় আছে তাদের মাঝে মাঝে বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পাঁকড়াও করার চেষ্টা করে । কিন্তু যখন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়, দুদকের সাবেক বড় কর্মকর্তা কিংবা কমিশনারদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তখন আর আস্থার স্থান থাকে কোথায় ? আবার কখনো দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারারও অভিযোগ ওঠে । সরকার কিংবা প্রভাবশালী মহলের কাছে যদি দুর্নীতি দমন কমিশনকে নত শিকার করতে হয় তবে সে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে ইতিবাচক কিছু আশা করা যায় না । অন্যদিকে বিশ্ববাসী তথা গোটা দেশবাসীর কাছে যারা দুর্নীতিবাজ হিসাবে পরিচিত সেই তাদেরকে যদি দুদক নির্ভেজাল চরিত্রের সনদ দিতে মেতে ওঠে তবে দুর্নীতির জোয়ার রোধ করার সাধ্য আছে কার ? বিভিন্ন ক্ষেত্রে জালিয়াতি, ঘুষ বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, তদবির বাণিজ্যসহ যেভাবে বিভিন্ন অবৈধ বাণিজ্যের কাছে দেশের সর্বমহল নতজানু হয়েছে তাতে দেশের ভবিষ্যত যে কোন পথে যাচ্ছে তা সহজেই অনুমেয় । দুর্নীতির কারণে দেশের সর্বত্র অস্থিরতা বিরাজ করছে । ক্ষমতাওয়ালারা আরও ক্ষমতাশালী এবং অত্যাচারিতরা আরও নিরর্য্যাতিত হচ্ছে । একপক্ষ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে অন্যপক্ষ সর্বস্ব হারিয়ে রাস্তার ভিখারীতে পরিণত হচ্ছে ।
বিজয়ের মাসে দুর্নীতিগ্রস্থ কিংবা দুর্নীতিমুক্তদের কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারে না যে, স্বাধীনতাকামী বীর সেনানিরা দেশের এরূপ ভয়াল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল । যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মহান মুক্তিকামী মানুষেরা সোনার বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দেশকে স্বাধীন করেছিল সেই পাকিস্তানের চেয়েও দুর্নীতির সূচকে যখন বাংলাদেশের অবনতি প্রকাশ পায় তখন লজ্জায় মাথা নুয়ে আসে । কষ্টে বুক ফেটে যায় । আমাদের নিকট প্রতিবেশী নীতিহীন ভারতের চেয়েও যখন দুর্নীতিতে দেশের অবনমন দেখি তখন ভাষা হারিয়ে যায় । নিরবে কাঁদার চেয়ে উত্তম কোন পথ খুঁজে পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়ে । গত ৩রা ডিসেম্বর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) বিশ্বের ১৭৫টি দেশের মধ্যে দুর্নীতিগ্রস্থের ক্রমান্বয় করেছে । ০-১০০ স্কেলের মধ্যে ২৫ পয়েন্ট নিয়ে সে রিপোর্টে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম । ২০১৩ সালে যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল তাতে ১৭৭টি দেশের মধ্যে ২৭ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬তম । চলতি বছর প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গেছে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ ডেনমার্ক । তাদের পয়েন্ট ৯২ । ডেনমার্কের চেয়ে মাত্র এক পয়েন্ট কম নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে নিউজিল্যান্ড । অপরদিকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ সোমালিয়া । তাদের পয়েন্ট ৮ । এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান আফগানিস্থানের পরে অর্থ্যাৎ দ্বিতীয় । দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ ভূটান । জরিপে প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, গত বছরের চেয়ে চলতি বছর ৯২ টি দেশে দুর্নীতি হ্রাস পেয়েছে, ৪৭টি দেশে অপরিবর্তিত রয়েছে এবং ৩৬টি দেশে দুর্নীতি বৃদ্ধি পেয়েছে । দুর্ভাগ্যের হলেও সত্য, যে দেশগুলোতে দুর্নীতি বৃদ্ধি পেয়েছে বাংলাদেশ সে দলেই অবস্থান করছে ।
আমাদের দেশটা তো এমন পথে যাত্রা করার কথা ছিলনা । দেশের প্রতি ভালোবাসা রেখে এদেশের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগালে দেশটা স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৩ বছর পরে বর্তমানের মত এমন বেহাল অবস্থায় থাকত না । দেশের কর্মকান্ড যদি দুর্নীতিমু্ক্ত রাখা যেত তবে মাত্র এক দশকেই দেশকে বিশ্বের প্রথম সারির দেশে পরিণত করা অসম্ভব ছিল না কিন্তু তা হয়নি । ক্ষমতাশীনদের কেউ একজন দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসেনি । এদেশের আন্না হাজারিরমত কোন মানুষের উত্থান হয়নি । সবাই কেবল ক্ষমতার মসনদ রক্ষা ও স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টায় মশগুল থেকেছে । যেভাবে চলছে তাতে নিকট ভবিষ্যতে আহামরি পরিবর্তন ঘটবে সে আশাও করা বাতুলতা বরং নিসংকোচে অবনতির সংবাদের অপেক্ষায় থাকা যায় । ইচ্ছা জাগে, ক্ষমতাধরদের কোন একজনকে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করি কিন্তু কাকে দায়িত্ব নিতে আহ্বান করব ? সবাই যেন একই রথে যাত্রা রত । আমজনতার বদলে দেয়ার ক্ষমতা নাই । যাদের ক্ষমতা আছে তাদের বদলে দেয়ার মন নাই । এভাবে চললে মধ্যম আয় কিংবা উন্নত দেশের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে । স্বপ্ন পোষা মানুষগুলোর জন্য তেমন কোন সুসংবাদ না থাকলেও দুর্নীতিবাজদের জন্য অনেক আশার বাণী রয়েছে ! আমাদের দেশের সাথে পাল্লা দিয়ে অন্যান্য দেশেও দুর্নীতির রথ দুর্বার গতিতে ছুটছে । কাজেই তাদের সাথে তুলনা করে বাংলাদেশের অবস্থানকে খুব বেশি স্পষ্ট করা সম্ভব নয় । কিন্তু যে সকল সচেতন দেশপ্রেমিকরা দেশের বিভিন্ন মহলে টুকটাক যাতায়ত করেন তারা জানেন দুর্নীতিতে দেশের সার্বিক অবস্থা কতটা ভয়াবহ । এরপরেও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) এর রিপোর্টের প্রতি ইঙ্গিত করে বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন দাবী করেছে, রিপোর্টটির পুরোটা সঠিক নয় । সরকার বদলের সাথে দুদকের কর্মকান্ডের রূপ-রেখা যেভাবে পাল্টে যায় তাতে দুদকও এখন নির্ভরতার স্থানে নাই । স্বপ্ন দেখি একটি সোনার বাংলাদেশের । যেভাবে চলছে তাতে সোনার বাংলাদেশ বিনির্মান আদৌ সম্ভব নয় । দুর্নীতিকে যদি লাগামহীনভাবে ছেড়ে দেয়া হয় তবে প্রতি বছর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কেবল দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবনতি কিংবা কিঞ্চিত উন্নতির বার্তা প্রকাশ পাবে এবং ৯ ডিসেম্বর অন্যান্য দেশের মত আমরাও দুর্নীতি বিরোধী দিবস পালন করব কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হবে না । দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং পারস্পারিক সহযোগীতার মনোভাব রাখতে হবে । সর্বোপরি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে দেশের অগ্রযাত্রায় দুর্বার গতি দেয়া ক্ষমতাশীনদের দায়িত্ব । সেই তারাই যদি দুর্নীতিমূলক কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দেয় তবে দেশের ভবিষ্যত এবং উন্নতির খাতায় কেবল ‘শূণ্য’-ই বাকী থাকবে । কাজেই ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ থাকুক এটা দেশবাসী কামনা করেনা ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
বিষয়: রাজনীতি
১১৪১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কিন্তু প্রতিবেশী ভারত নীতিহীন কেন?
মন্তব্য করতে লগইন করুন