সহশিক্ষার বিরুদ্ধে ভাবার সময় কি এখনো আসেনি ?
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ২১ নভেম্বর, ২০১৪, ০৯:৫৩:২১ রাত
লেখার শুরুতে সহশিক্ষা সম্পর্কে সাধারণ একটা ধারণা দেওয়া আবশ্যক মনে করছি । সহশিক্ষার প্রাথমিক সংজ্ঞায় বলা যায়, যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী-পুরুষ একত্রিত হয়ে একই ক্লাশরুমে পাশাপাশি বসে শিক্ষা অর্জন করে । প্রগতিশীলদের মতে সহশিক্ষা শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশে অনেক সহায়ক এবং এর বিরুদ্ধে যারা প্রচার চালায় তারা ধর্মান্ধ ও মধ্যযুগে বাস করে বলে মনে করা হয় । তাদের দাবী, আধুনিক যুগে সহশিক্ষার বিপক্ষে কোন মত গ্রহনযোগ্য নয় । লেখার শুরুতেই পাঠকদের জ্ঞাতার্থে নিশ্চয়তা দিচ্ছি ধর্মীয় কোন উদ্ধৃতি টেনে সহশিক্ষার বিরুদ্ধে কোন যুক্তি উপস্থাপন করা হবেনা । যদিও শুধু ইসলাম ধর্মেই নয় বরং অনেকগুলো ধর্মে সহশিক্ষার ব্যাপারে ভিন্নমত রয়েছে তবুও ধর্মের কাছে আপাতত যাচ্ছি না কারণ এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা ধর্মের কথা শুনলেই চুলকানী অনুভব করে । সহশিক্ষার পক্ষে যতগুলো যুক্তি আছে তার চেয়ে বিপক্ষের যুক্তি কম নয় এবং সেগুলো খুব দুর্বলও নয় । ২০শে নভেম্বর বিবিসি বাংলায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছেই’ মর্মে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় । সে প্রতিবেদনটির আলোকেই আজকে এ লেখার অবতারণা । যদিও প্রতিবেদনটিতে গত একবছরের পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে । বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, গত এক বছরে প্রায় ২০ টি মত যৌন হয়রানির ঘটনার অভিযোগ তারা পেয়েছে । এ সকল যৌন হয়রানির মধ্যে কখনো শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী, কখনো সহপাঠী কর্তৃক যৌন হয়রানি ঘটছে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যার বিচারে মাত্র ২০টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটলেও এটাকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নাই । বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির যদি এই দশা হয় তবে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কি অবস্থা চলছে ? বিবিসি প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, যৌন হয়রানির শিকার হবার পরেও অনেক শিক্ষার্থী লোক লজ্জার ভয়ে চুপ থেকে যান এবং অভিযোগ করেন না । বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেন দিন দিন যৌন হয়রানির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী কর্তৃক কেন এমন অসংলগ্ন আচরণ প্রকাশ পাচ্ছে এবং নারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে নিরাপদ বোধ করছে না ? নিশ্চয়ই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন ত্রুটি থাকায় এমন ঘটনা বারবার ঘটছে ।
একথা বলতে দ্বিধা নাই, সহশিক্ষাকে প্রায় অধিকাংশ মানুষ উন্নয়ন ও অগ্রগতির সোপান বলে মনে করেন । বিশেষ করে প্রগতিশীল মহাদেশগুলোর মধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকাতে সহশিক্ষাকে খুবই উপকারী মনে করা হতো । তবে সময়ের ব্যবধানে তাদের চিন্তা-চেতনায়ও আমূল পরিবর্তন এসেছে । ২০০৮ সালের মে মাসে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত জার্নাল অফ ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স স্টাডিজ দু’ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সফলতার ক্ষেত্রে এক চমকপ্রদ পরিসংখ্যান পেয়েছেন । পরিচালিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বালিকা বিদ্যালয়ে অধ্যয়ণরত ৮৫ শতাংশ বালিকা ও বালক বিদ্যালয়গুলো থেকে ৯৩ শতাংশ বালক কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান । পক্ষান্তরে সম্মিলিত স্কুল থেকে মাত্র ৭৩ শতাংশ বালিকা ও ৮৪ শতাংশ বালক কলেজে ভর্তি হতে পারে । তাছাড়া পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ণরত ৭৮ শতাংশ বালিকা এবং ৮৩ শতাংশ বালক উচ্চ শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পায় । পক্ষান্তরে সহশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাত্র ৫৭ শতাংশ বালিকা এবং ৬১ শতাংশ বালক উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ পায় । উপরন্তু পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৭৮ শতাংশ বালিকা এবং ৮১ শতাংশ বালক ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য নির্বাচিত হয় । পক্ষান্তরে সহশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাত্র ৩৩ শতাংশ বালিকা এবং ৬০ শতাংশ বালক ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য নির্বাচিত হন । এছাড়া পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩৭ শতাংশ বালিকা এবং ৬৪ শতাংশ বালক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার যোগ্যতা অর্জন করে । পক্ষান্তরে সহশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মাত্র ১৬ শতাংশ বালিকা এবং ৪৫ শতাংশ বালক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার যোগ্যতা অর্জন করে (তথ্য সূত্র-জার্নাল অফ ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স স্টাডিজ, যুক্তরাষ্ট্র) । শিক্ষার উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন এবং ভবিষ্যতে ভালো চাকরির করে পরিবারের হাল ধরা । অপরদিকে শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে মানুষের তৃতীয় নয়ন খুলে যায় এবং মানুষ সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বুঝে যেটা ব্যক্তি ও জাতির জন্য মঙ্গলের সেটাই গ্রহন করতে আগ্রহী হবে বলেই বিশ্বাস । যারা সহশিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সাড়া পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সেই তারাই আজ সহশিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন । অথচ আমরা নিজেদের ক্ষতিটা বুঝতে পেরেও এবং সমাজে নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে জেনেও কেবল ধর্মের বিরোধীতা করার জন্য আজও সহশিক্ষা নামক মরীচিকার পিছু ছুটছি ।
পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের তুলনায় সহশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অনেক পিছিয়ে পড়ার পেছনে ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স স্টাডিজের জার্নালের গবেষণায় অনেকগুলো কারণ বেরিয়ে এসেছে । এতে দেখা যায় সহশিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলে বন্ধু কিংবা শিক্ষকদের দ্বারা অনেকভাবে নির্যাতিত হওয়ার পাশাপাশি ছেলে মেয়েরা একে অপরের দ্বারা আকৃষ্ট হয় কিংবা হওয়ার পিছনে অনেক চিন্তা, সময় ও অর্থ ব্যয় করে । ফলে একাডেমিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় । অ্যদিকে পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশুনা ও অন্যান্য ব্যাপারে অধিক মনোযোগী হতে পারে । ইউরোপ ও আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্থায় সহশিক্ষার কুফলে নারী নির্যাতন, অপ্রাপ্ত বয়সে গর্ভধারণ, লিভটুগেদার, যৌনব্যাধির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল এবং এ কারনে শিক্ষার মানেও ক্রমে অবনতি হচ্ছিল । এ প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা নীতিনির্ধারক ও অভিভাবকেরা ছেলে-মেয়ের পড়াশুনার জন্য পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকতে থাকে । ১৯৫৮ সালে আমেরিকায় উচ্চ বিদ্যালয় (সহশিক্ষা) এর অধ্যক্ষদের মধ্যে একটি সমস্যায় প্রশ্ন করা হয়েছিল আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের প্রধান সমস্যাগুলো কি ? উত্তর ছিল- বাড়িতে যা কাজ দেওয়া হয় তা না করা, বই ছুঁড়ে ফেলা, ঘরের আলো জ্বেলে রাখা, ঘরে থুতু ফেলা এবং ঘরের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করা । ৩০ বছর (এক প্রজন্ম) পরে ১৯৮৮ সালে একটি সমীক্ষায় ঐ একই প্রশ্ন করা হয়েছিল । তাতে আশ্চার্যজনক ভাবে ভিন্ন উত্তর এসেছিল । সেদিনের শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো ছিল- গর্ভপাত, ধর্ষণ, সমকাম, মাদকাসক্তি, হিংসাত্মক আতঙ্ক, হত্যা এবং বন্দুকের ব্যবহার ।
বাংলাদেশের সহশিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা ঠিক এতটা অবনতিতে না পৌঁছলেও ঠিকই পচন ধরতে শুরু হয়েছে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত যৌন হয়রানির ভয়াল চিত্রই সে আলামত বহন করে । এছাড়াও অতীতে সহশিক্ষা এবং পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ফলাফলের পার্থক্য আমাদেরকে সঠিক পথে চলার নির্দেশ দেয় । যদিও সিদ্ধান্ত গ্রহনের দায়িত্ব আমাদের তবুও সত্য মাড়িয়ে চলা সত্যিই বোকামী । বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সহশিক্ষা ও পৃথক শিক্ষার মধ্যে তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পৃথক শিক্ষা ব্যবস্থার সাফল্যই বেশি । ছেলে ও মেয়ে আলাদা এমন স্কুলগুলো সহশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ঈর্ষনীয় ভালো ফল করেছে । ২০০৯ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, সারাদেশে ২০০০ টি স্কুলের মধ্যে মাত্র ৩৯টি স্কুলে সহশিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে । বাকি ১৬১টি স্কুল হয় বালক না হয় বালিকা বিদ্যালয় অথবা ছেলে-মেয়েদের পৃথক শিফট রয়েছে । ২০১১ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে ১০ বোর্ডের মধ্যে সেরা ১০টি কলেজের নয়টিই সহশিক্ষাবিহীন । সুতরাং সহশিক্ষার বিরুদ্ধে ভাবার এটাই উত্তম সময় । সহশিক্ষা ছেলে-মেয়েদের জীবনকে পুরোপুরি ধ্বংস না করলেও মারাত্মক ক্ষতি করে । তাছাড়া মোবইল ও টেলিভিশনের সংস্কৃতি তাদেরকে পরস্পরের পৃতি আকৃষ্ট হতে সাহায্য করে । যাতে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার প্রতি অমনোযোগী করে তুলে । দেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ব্যাপারে স্বঘোষিত কিছু সুশীল ও নারীবাদীদের একাংশ খোঁড়া আপত্তি জানালেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েদের পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ ঈর্ষণীয় সফলতা অর্জন করছে । তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী-পুরুষের আলাদা শিফট কিংবা পৃথক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে শিক্ষা ব্যবস্থার মান নিশ্চিত করা সময়ের দাবী ।
যদিও আমাদের নানা সীমাবদ্ধতার কারণে ছেলে-মেয়েদের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা কিংবা নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় । কাজেই সিস্টেমেটিক পরিবর্তনের কথা ভাবা যেতে পারে । ক্লাশ রুমে পার্টিশন দিয়ে ছেলে মেয়েদের আলাদা বসার ব্যবস্থা করা সুষ্ঠু শিক্ষার স্বার্থেই প্রয়োজন । শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিমলদের মত কালপিট, কুলাঙ্গারদের জন্ম হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করলে খুব বেশি ত্রুটি পাওয়া যাবে না । পরিমলরা বেশি জন্মায় না । মাত্র দু’একজন জন্মালেই তা গোটা জাতির দুর্ণামের জন্য যথেষ্ট । প্রকৃত শিক্ষার মান বজায় রাখা, নারীদের প্রতি যৌন হয়ারনি রোধসহ সকল প্রকার অপরাধ কমিয়ে আনার জন্য সহশিক্ষা ব্যবস্থা ত্যাগ করে পৃথক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ব্যতীত অন্য কোন সঠিক ও নিরাপদ পন্থা চালু আছে বলে আপাতত মনে হয় না । পৃথক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করলে, অভিভাবকরা যেমন তাদের সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে পারবেন তেমনি শিক্ষার্থীদেরও সফল ভবিষ্যত গঠনে সহায়ক হবে । ইভিটিজিংয়ের মত মারাত্মক সমস্যার সমাধানও এই পথে আসবে বলে বিশ্বাস ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
বিষয়: বিবিধ
১০১২ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
"ছেলে মেয়ে একযোগেতে করলে পড়াশোনা
পড়ার সাথে বাড়ে প্রায়ই কামের উপাসনা"
সম্ভবত ঠাকুর অনুকুল চন্দ্রের লিখা।
A PHP Error was encountered
Severity: Notice
Message: Undefined offset: 10348
Filename: views/blogdetailpage.php
Line Number: 764
আজকের হার্ভাট, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, সাংহাই, সিডনি, ব্যাঙ্গালোর......... বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারালাল কোন ইসলামিক বিদ্যালয় আছে কি? মদীনা/আলআজহার বিশ্ববিদ্যায় থেকে পাশ করে নিরেট ফাতোয়াবাজ হওয়া ছাড়া কয়জন সৌরবিজ্ঞানী হতে পেরেছে?
মন্তব্য করতে লগইন করুন