বিসিএসকে অন্তত স্বচ্ছ রাখা হোক
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ১৪ নভেম্বর, ২০১৪, ০৬:৫৬:৪৬ সন্ধ্যা
মানুষকে যখন বোবা করে রাখা হয় তখন বোবা অন্যকে তার মনের ভাব বুঝাতে চাইলে তাতে কেবল ঘ্যা-ঘ্যা অথবা ব্যা-ব্যা শব্দ হয় । বোবা মনে মনে ভাবে তার অভিব্যক্তি বাকসম্পন্ন মানুষগুলো বুঝেছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বোবার ধারণা প্রায়ই সঠিক হয়না । দেশের কতিপয় গোষ্ঠী বাদে দেশের অন্য সকলের অবস্থা ঘ্যা অথবা ব্যা এর পর্যায় । সাংবিধানিকভাবে বাকস্বাধীনতার স্বীকৃতি থাকলেও তা প্রয়োগের ক্ষেত্র দিন দিন সংকীর্ণ হয়ে আসছে । এ সংকীর্ণতার জন্য অন্যদের দোষ দিয়ে লাভ কী ? দোষটা নিজেদের । দূর্ভাগ্য জাতির, কেননা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যাদেরকে জাতির পাহারাদার নিযুক্ত করা হয়েছিল তারা তাদের দায়িত্ব শুধু এড়িয়েই যায়নি বরং কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত কিংবা দলীয় স্বার্থ রক্ষার নামে জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষা করেছে । তবুও প্রতিবাদ করা যায়নি কিংবা কখনো মৃদু প্রতিবাদ হলেও তাতে সফলতা অর্জিত হয়নি কারন শুধু প্রতিবাদকারীদেরকেই সকল খড়গ পোহাতে হয়েছে । যারা প্রতিবাদীদের সাহস দিয়েছিল কিংবা সাথে থাকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল তাদেরকে দুঃসময়ে পাশে পাওয়া যায়নি । জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তহীনতায় কাটাতে হয়েছে কেবল সীমিত সংখ্যক প্রতিবাদকারীকে । প্রতিবাদকারীরাও সুযোগবাদী মানুষের মত বুদ্ধিমান হচ্ছে ! যে কারনে প্রতিনিয়ত অন্যায় আচরণ কিংবা অমূলক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীর সংখ্যা লোপ পাচ্ছে । পরিবার, সমাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র কিংবা সর্বোচ্চ সীমা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অন্যায় সিদ্ধান্ত কিংবা অযৌক্তিক কথার বিরুদ্ধে পূর্বের মত প্রতিবাদী বক্তৃতা কিংবা স্লোগান উঠছে না । কাজেই অযুক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহনকারীরা তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তকে সঠিক মনে করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে । তারপরেও কিছু কিছু সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চুপ থাকলে গোটা সমাজ ব্যবস্থায় নৈরাজ্য নেমে আসবে ।
বৃটিশ শাসনামল কিংবা পাকিস্তান শাসনামালে এ বঙ্গের মানুষ অত্যাচারিত ছিল তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই । বৃটিশদের শাসনামলে ভারত উপমহাদেশের মানুষ কিংবা পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ তাদের মৌলিক ও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হত । শাসকগোষ্ঠীর সার্বিক অবস্থা থেকে প্রজা কিংবা সকল জনসাধারণের মধ্যে যোজন যোজন পার্থক্য ছিল । শাসকগোষ্ঠী সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করত অন্যদিকে সাধারণ জনসাধারণকে অবহেলা করে নির্যাতন করা হত । তবে তৎকালীন সময়ে যোগ্যরা যে প্রতিপদেই অবমূল্যায়িত হয়েছে এরকম ভাবার অবকাশ নাই । যোগ্য এবং দক্ষরা এমন অপশাসনের যুগেও মুল্যায়িত হয়েছে তবে সেটা সংখ্যায় অনেক কম হলেও । পাকিস্তান শাসনামলে বর্তমান বিসিএস পরীক্ষার নাম ছিল সিএসপি পরীক্ষা । ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে অনেক মেধাবী এবং যোগ্য শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করে সিএসপি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে পশ্চিম পাকিস্তানীদের পরাজিত করে উত্তীর্ণ হয়েছে । তবে যে সংখ্যক পূর্ব পাকিস্তানী সিএসপি পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার কথা ছিল তার চেয়ে অনেক কম উত্তীর্ণ করাত এবং প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে সুযোগ দিত । যে সকল কারনে পূর্ব-পাকিস্তানীরা একতাবদ্ধ হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বুনেছিল তাদের সে স্বপ্নে বুক বাঁধার অন্যতম কারন ছিল চাকরির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সৃষ্ট বৈষশ্য থেকে মুক্তি লাভ । পূর্ব পাকিস্তানীরা চেয়েছিল, তাদের যোগ্য সন্তানরা চাকরি পাবে । যেখানে কোন দুর্ণীতি কিংবা নৈরাজ্য থাকবে না । এ লক্ষ্যেই যুদ্ধ হল, দেশও স্বাধীন হল । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল কেননা পাকিস্তান শাসনামলে যে অন্যায় অনাচার সহ্য করতে হয়েছে হয়েছে তার কোন অস্তিত্ব এখানে থাকবেনা । রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তক্রমে কোটা পদ্ধতিতে বিসিএস চাকরির ক্ষেত্রে ৫৫শতাংশ আসন বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্ধ রেখে বাকী ৪৫শতাংশ উম্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে । নিশ্চয়ই এ পদ্ধতি পাকিস্তান আমলের পদ্ধতির চেয়ে অনেক উন্নত । তবুও কোটা পদ্ধতির অন্তরালে বর্তমানে কিছু সুযোগবাদী সিদ্ধান্ত চালু হওয়ায় কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা সোচ্চার হতে শুরু করেছে এবং জনমতও গঠিত হচ্ছে । তবুও কোটা পদ্ধতির বাইরেও ৪৫শতাংশ চাকরি সবার জন্য উম্মুক্ত থাকায় জনমনে স্বস্তি ছিল । এখানে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সমেয়র চেয়ে অন্তত সুযোগ বেশি । তবুও একটি স্বাধীন দেশের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন মানুষের জন্য এ অধিকার যথেষ্ট কিনা তা নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন রয়েছে ।
পাকিস্তান আমলে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে যে কয়জন মেধাবী, যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষার্থী সিএসপি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে কৃতকার্য হয়েছিল এবং এ বঙ্গের সুনাম বয়ে এনেছিল তাদের মধ্যে এইচ টি ইমাম অন্যতম । একজন দূরদর্শী ব্যক্তি হিসেবে তার অত্যন্ত সুনাম রয়েছে এবং বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্ষমতাধর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে তিনি সফলতার সাথে কর্মরত রয়েছেন । তিনি যখন সিএসপি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অফিসার হয়েছিলেন তখনকার শিক্ষার পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন । এইচ টি ইমামের মত যারা সে আমলে অফিসার হওয়ার সুযোগ পেয়েছে তাদেরকে ‘সোনার ছেলে’ বলে গর্ব করা হত । এমনকি দশ গ্রামের মানুষ এদেরকে দেখতে আসত । মেধা, যোগ্যতার বলে যিনি পাকিস্তান আমলে অফিসার হওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন সেই মানুষটি গত ১২ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে যে বক্তব্য দিলেন তা কি তার মুখে আদৌ শোভা পায় ? মানুষকে দলের অন্ধত্ব কি এতটাই পদস্খলিত করতে পারে যা ব্যক্তির সাথে মোটেই যায় না ? অতীতে বিশ্বাসযোগ্য না হলেও বর্তমানে বিশ্বাস না করে আর উপায় কি ? দলীয় অন্ধত্বের কারণে তিনি কি বাংলাদেশের বিসিএস পরীক্ষাকে তামাশায় নিয়ে যেতে চাইছেন ? বিভিন্ন বিতর্কে জড়িয়ে ঝড় তোলা ছাত্রলীদের ‘শৃঙ্খলার প্রশংসা’ করে দলীয় আনুগত্যের কোটায় বিসিএস ক্যাডারের চাকরির নিশ্চয়তাও দিচ্ছেন । তিনি বলেছেন, ‘তোমরা লিখিত পরীক্ষায় ভালো করো, ভাইবা (মৌখিক পরীক্ষা) আমরা দেখব’ । ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বক্তৃতা দেয়ার পরেই প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম নামটি এখন টক অব দ্য কান্ট্রি । বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর এতদিন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সুযোগ সুবিধা দেয়া ছিল ওপেন সিক্রেট । এইচ টি ইমামের এ বক্তব্যের পর মনে হচ্ছে, ওপেন সিক্রেট থেকে ‘সিক্রেট’ শব্দটি বাদ দিয়ে যেন ওপেন করার কথা বলা হলো ।
দেশের সর্বত্র ঘুষ দুর্ণীতির ছড়াছড়ি ও প্রভাব থাকলেও এতদিন অন্তত বিসিএসের প্রতি মানুষের আস্থা ছিল । এইচ টি ইমামের এ ঘোষণার পর আস্থার সে যায়গাটিও নষ্ট হয়ে গেল । দেশের সর্বত্র যদি এমন করে দলীয়করণ করা হয় তবে দেশের নিরপেক্ষ মানুষগুলো যাবে কোথায় ? এখন ক্ষমতাশীনরা পরবর্তীতে ভবিষ্যতের ক্ষমতাশীনরা যদি এভাবেই সর্বত্র তাদের দলীয় লোকদের ঘোষণা দিয়ে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় তবে মেধাবী ও যোগ্যদের পরিণাম কি ? এইচ টি ইমামের বক্তব্যের কারণে একদিকে যেমন মওসূম নির্ভর রাজনীতিকের জন্ম দেবে তেমনি দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীল মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চয় করবে । এ বৃহৎ জনগোষ্ঠী দলের উর্ধ্বে অবস্থান করে দেশকে ভালোবাসে । ছাত্রলীগের অনেক কর্মী আছে যারা যোগ্য এবং অনায়াসেই চাকরি পাবে কিন্তু যোগ্য-অযোগ্য নির্বিশেষে ঘো্ষণার মাধ্যমে সকল ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের আশ্বস্থ করতে গিয়ে দেশের রাজনীতি বিমূখ বৃহৎ ছাত্রসমাজকে উপেক্ষা করার অর্থ কি ? ছাত্রলীগকে এইচ টি ইমাম আশ্বস্থ করেছে, তাদের পাশে থাকবে বলে । কিন্তু তার এ বক্তব্যই কি পাশে থাকার নমুনা ? টিএসসিতে দেয়া তার এ বক্তব্য দেশবাসীর জন্য কি বার্তা দিচ্ছে ? ’৭৩-এর পর বাংলাদেশে প্রতিবছর বিসিএস পরীক্ষায় অন্যান্যদের মতো কোটা পদ্ধতি ও দলবাজির বাইরেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিসিএস পরীক্ষায় যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চাকরিতে যোগদান করছেন । পেশাগত জীবনে তারা প্রশাসনে যোগ্যতা দেখাচ্ছেন । প্রশাসনে অত্যন্ত চৌকস কর্মকর্তা হিসেবে সুনামও কুড়াচ্ছেন । প্রশ্ন জাগে, এইচ টি ইমামের এ বক্তব্যের পর এসকল যোগ্য কর্মকর্তাদের যোগ্যতাকে কোন মানদন্ডে দেখা হবে ?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ছাত্রলীগকে লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগী ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আদেশ দিয়েছে । দেশবাসী মনে করে, এ আদেশ সবার জন্য যথার্থ । কেউ যোগ্য হলে তাকে চাকরির জন্য কারো কাছে ধণ্যা দিতে হবে না । তবে এইচ টি ইমাম একটি ছাত্রসংগঠনের অনৈতিকভাবে স্বার্থ রক্ষার নামে দেশের অন্যান্য শিকার্থীদেরকে হতাশায় ডোবানোর অধিকার রাখেন কি ? পাঁচ বছর পর পর জনগণ নির্বাচিত প্রার্থীদের পরিবর্তন হয় কিন্তু বিসিএস উত্তীর্ণ অফিসারদের এমন কোন পরিবর্তন নাই । এরাই মূলত দেশকে সঠিকভাবে পরিচালিত করেন । সেই তাদের চাকরিতে নিয়োগ পদ্ধতি যদি এমন ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণার মাধ্যমে হয় তবে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকবে ? এইচ টি ইমামের এ বরক্তব্যের প্রতিবাদ এবং প্রতিক্রিয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেই কামনা করি ? তিনি নিশ্চয়ই এমন কোন সিদ্ধান্ত দিবেন না যা জনস্বার্থ বিরোধী । অন্যান্য ক্ষেত্রে না হলেও অন্তত বিসিএসের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হোক এবং দলীকরণের কবল থেকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এ সেক্টরটি মূক্ত রাখা হোক ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
বিষয়: রাজনীতি
৮৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন