দেশের স্বার্থে চিরতরে হরতাল বন্ধ হওয়া উচিত
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ৩১ অক্টোবর, ২০১৪, ১০:৫৩:০২ সকাল
দেশের স্বাধীনতার বয়স ৪৩ বছর । এই দীর্ঘ সময়ে দেশের আরও উন্নতি হওয়া উচিত ছিল । কিন্তু তা হয়নি । স্বাধীনতার পর দেশের ভঙ্গুর-নাজুক অবস্থা থেকে দেশকে স্বাবলম্বী করার জন্য ৪৩ বছর কম সময় নয় । তবুও দেশের শাসকগোষ্ঠী এবং জনসাধারণের ঐক্যমত্যের অভাবে লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারিনি । বিভিন্ন কারণে দেশের ততোটা উন্নতি হয়নি যতটা হওয়ার ছিল । যে সকল কারণে দেশ তার কাঙ্খিত গন্তব্য পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করা হয়, তার মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন দল কর্তৃক আহুত হরতাল অন্যতম । বিশ্বের উন্নত কিংবা অনুন্নত কোন দেশ বাংলাদেশের হরতালের মত এমন সহিংস আন্দোলন পালন করে না । কিন্তু চরম দূর্ভাগ্যের হলেও সত্য, বাংলাদেশটা আক্ষরিক অর্থে অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভরশীল না হলেও এটাকে পরনির্ভশীল করার জন্য আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে হরতাল আজ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছে । যদিও হরতালকে বিরোধীদল কিংবা সরকার বিপক্ষ দলসমূহ গণতান্ত্রিক দাবীসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্বার্থ আদায় কিংবা সরকার পক্ষকে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন হওয়ার হাত থেকে ফিরিয়ে রাখে কিন্তু বাংলাদেশে হরতালের নামে বিভিন্ন সরকারের আমলে বিরোধীদলসমূহ যে সহিংসতা চালায় তা আদৌ রাষ্ট্রের কল্যানের জন্য নয় বরং রাষ্ট্রকে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা থেকে ছিটকে ফেলে দেয়ার জন্য । একদিনের হরতালের ক্ষতি থেকে উঠে আসতে অনেক দিন লাগে । এভাবে বিভিন্ন সময়ে পালিত হরতালে যে ক্ষতি হয় তা কাটিয়ে উঠতে যুগ যুগ সময় লেগে যাবে । অতীতে শান্তিপূর্ণ হরতাল কর্মসূচী পালন করা হলেও বর্তমানে অসহিষ্ণু রাজনৈতিক মানসিকতার কারণে হরতালের নামে চরম সহিংসতা চালানো হয় । এসকল হরতালে সরকার পক্ষ কিংবা বিরোধী পক্ষ ততোটা ক্ষতিগ্রস্থ না হলেও রাষ্ট্রের ক্ষতির পরিমানটা অপুরণীয় হয়ে যায় । হরতালে বিরোধীপক্ষ যতটা কঠোরতা পালন করে তার চেয়ে বেশি কঠোর অবস্থানে থাকে সরকারী দল এবং তাদের নিয়ন্ত্রনাধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা । হরতালে পুলিশ-বিজিবি এবং র্যাবের গুলিতে এখন অহরহ মানুষ মারা যাচ্ছে । নিরপেক্ষ মানুষ, পুলিশ কিংবা বিজিবিও যে একেবারে নিরাপদ তাও নয় । অত্যন্ত বিস্ময়ের বিষয় হলেও সত্য, হরতালে রাষ্ট্রের ব্যাপক ক্ষতি হলেও স্বাধীনতার পর কোন রাজনৈতিক দল হরতাল বন্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহন করেনি কিংবা হরতাল বন্ধে বিন্দুমাত্র আগ্রহও প্রকাশ করেনি । রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে বৃহত্তর দলগুলো একটির ছায়া আরেকটি দেখতে না পারলেও হরতালের ব্যাপারে তারা একমত । এদের উভয় পক্ষই বিশ্বাস করে, রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য হরতালকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে হবেই । হরতালে দেশের যে অবস্থা হোক তাতে তাদের বিন্দুমাত্র চিন্তা নাই । সুতরাং হরতালের নামে দেশের যতই ক্ষতি হোক তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু যায়-আসে না । অন্যদিকে রাজনৈতিক দল কিংবা ব্যক্তির মধ্যে পারিস্পরিক বিশ্বাস-শ্রদ্ধা-ভক্তি না থাকার কারণে কোন দলই সাহসী হয়ে হরতালেরর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হচ্ছে না ।
হরতালের ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয় । ব্রিটিশ শাসনামালে মুক্তিকামী ভারত উপ-মহাদেশের পক্ষে সর্বপ্রথম ১৯১৯ সালের ৬ই এপ্রিল মহাত্মা গান্ধী হরতালের ডাক দিয়েছিলেন । ওই হরতালে ৩’শ ভারতীয়ের মৃত্যু এবং বিপুল সংখ্যক আহত হওয়ার কারণে তিনি আর দ্বিতীয়বার হরতাল ডাকেন নি । দেশ বিভাগের পর ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানীদের ৮৪ বার হরতাল পালন করতে হয়েছে । এরপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৪ই আগষ্ট পর্যন্ত হরতাল পালিত হয়েছে ২২ বার । ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট থেকে ১৯৮২ সালের ২৩শে মার্চ পর্যন্ত ৫৯ বার, ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩শ ২৮ বার, ১৯৯০ সালের ৭ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৬ সালের ৩০শে মার্চ ৪শ ১৬ বার, ১৯৯৬ সালের ৩১শে মার্চ থেকে ২০০০ সালের ১২ই জুন পর্যন্ত ২শ ৮৩ বার হরতাল পালিত হয়েছে । ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত হরতাল পালিত হয়েছে ১শ ৩০ দিন । ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত হরতাল পালিত হয়েছে ৫১ দিন । প্রশ্ন হল- কেন এই হরতাল এবং কার স্বার্থে ? স্বাধীন বাংলাদেশে কতগুলো হরতাল দেশের স্বার্থে পালিত হয়েছে ? বেসরকারি গেবষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ১৯৭৫ থেকে ২০১৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত হরতালের কারণ বিশ্লেষণ করে বলেছে, এ পর্যন্ত যত হরতাল হয়েছে, তার প্রায় ৯৫ শতাংশই ডাকা হয়েছে রাজনৈতিক কারণে । মাত্র ৫ শতাংশ হরতাল হয়েছে অর্থনৈতিক কারণ কিংবা জনস্বার্থে । রাজনৈতিক হরতালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে দেশের অর্থনীতির । দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী, একদিনের হরতালেই ক্ষতি হয় অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা । আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পোশাক শিল্প, ক্ষুদ্র উদ্যোগ ও পরিবহন । ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত হিসাব মতে, হরতালের কারণে ২০১৩ সালে অর্থ্যাৎ মাত্র এক বছরে প্রায় ৫৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ( ৭০০ কোটি ডলার) ক্ষতি হয়েছে । প্রতিদিনের ক্ষতি প্রায় এক হাজার ৫৪০ কোটি টাকা ( ২০ কোটি ডলার) । বালাদেশের হরতাল নিয়ে ২০০৫ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) গবেষণায় বলা হয়, ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর হরতালের কারণে দেশের জিডিপির ৩ থেকে ৪ শতাংশের সমান আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে । ঢাকা চেম্বারের হিসাবে, হরতালে পাইকারি বাজার, শপিংমল, শো-রুম, ক্ষুদ্র ও ছোট দোকান প্রতিদিন ৬০০ কোটি টাকা আর বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয় । বাংলাদেশের দোকান মালিক সমিতির দাবী, দেশের বিশ লাখ দোকানে প্রতিদিন হরতালে ক্ষতি হয় ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা । ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির মতে, প্রতিদিনের হরতালে দেশে প্রায় তিন লাখ বাস-মিনিবাস ও ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকে । যার কারণে ওই সব দিন ক্ষতি হয় ২৫০ কোটি টাকার বেশি ।
হরতালের ক্ষতি শুধু আর্থিক ক্ষতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না । হরতালে জীবনের ক্ষতিও কম হয় না । অকালেই ঝড়ে যায় অনেক জীবন । গণতান্ত্রিক সুরক্ষা পর্ষদের তথ্যমতে, নবম জাতীয় সংসদের শেষ চার বছরে (২০১০-১৩) মোট ৩২৮ জন হরতালের সহিংসতায় নিহত হয়েছে । এর মধ্যে ২০১০ সালে ৭৬, ২০১১ সালে ৫৮, ২০১২ সালে ৮৪ এবং ২০১৩ সালে ১১০ জন নিহত হয় । নিহতের এ সংখ্যার মধ্যে ১১জন আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও আছে । এসকল হরতালের দিনে আহত হয়েছে সহস্রাধিক এবং চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে অসংখ্য । হরতালের দিনগুলোতে রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিগত সম্পদেরও ব্যাপক ক্ষতি সাধণ করা হয় । গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নসংযোগ, বোম ফুটানো, ট্রেন লাইন উপড়ে ফেলাসহ রাষ্ট্রের আরও বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি করা হয় । এমনকি যাত্রীবাহী চলন্ত বাসে পেট্রোল বোমা মেরে জীবন্ত মানুষকে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মেড়ে ফেলা হয় । হরতালের দিনে বোমা ফুটানোর সংস্কৃতি অতীতে চালু না থাকলেও বর্তমানে এমন কোন হরতালের দিন নাই যেদিন বোমা ফুটিয়ে মানুষকে আতঙ্কগ্রস্থ করা না হয় । পুলিশ প্রশাসনসহ মাঠ প্রশাসনকে চরম দলীয়করণ করার কারণে বৃটিশ আমলের পুলিশদের মত তারা নির্বঘ্নে হরতাল সমর্থকদের উপর গুলি বর্ষণ করছে । কারা হরতাল আহ্বান করতে পারবে এবং কারা পারবে না- রাষ্ট্র কর্তৃক এমন কোন নীতিমালা না থাকার কারণে হুটহাট করে বৃহত্তর বিরোধীদলের মত অন্যান্য ভূঁইফোড় কিছু সংগঠনও হরতাল ডেকে বসে । যে পক্ষেই হরতাল ডাকুক না কেন তাতে মূলত বৃহত্তর ক্ষতিটা রাষ্ট্রেরই হয় ।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছে একবার হরতাল বন্ধের ব্যাপারে তার মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল । তাতে তিনি যা বলেছেন তাতে হতাশ হওয়া ছাড়া অন্যকোন উপায় ছিল না । তিনি বলেছিলেন, হরতাল বন্ধ করতে হলে জনমত গঠন করতে হবে । প্রধানমন্ত্রীর গণতান্ত্রিক এ মহৎ ভাষ্যে আনন্দিত হওয়া যেত যদি দেশের অন্যান্য কাজগুলো গণতান্ত্রিক পন্থায় হত । সুতরাং অগণতান্ত্রিক পন্থায় হলেও সরকারের হরতাল বন্ধ করা উচিত । দলীর স্বার্থের উর্ধে উঠে দেশেকে ভালোবাসার মানসিকতা কবে যে জন্মাবে ? রাষ্ট্রের কল্যানের স্বার্থে আইনের মাধ্যমে হরতাল বন্ধ করা উচিত । অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে হরতাল প্রতিহত করা সম্ভব নয় । হরতাল বন্ধের জন্য সর্বার্গ্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরমতহ সহিষ্ণুত । সুতরাং রাষ্ট্রের সার্থে হরতালের মত সহিংসতা ত্যাগ করে এর বিকল্প কিছু ভাবা দরকার । দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংকট নিরসনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে । হরতালের বিকল্প হিসেবে মানসিক চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী সংগীত, থিয়েটার, প্রতীকী আদালত চালু করা যেতে পারে । হরতালের বিকল্প হিসেবে গণস্বাক্ষর, পদযাত্রা, হাটসভা, গ্রামসভার আয়োজন কার্যকরী ভূমিকা পালন করাও সম্ভব । দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ যেখানে হরতালের বিকল্প কিছু চায় সেখান সরকার কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্তে আসতে পারবে না সেটা মেনে নেয়া যায় না । বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যদি দেশের মানুষের কল্যানে রাজনীতি করে তাহলে তাদের হরতাল পরিহার করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করা উচিত । হরতাল কোন বিচারেই রাষ্ট্রের মঙ্গল বহন করে না । তবে হরতাল বন্ধের পূর্বে সর্বপ্রথম সূষ্ঠু গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা দিতে হবে । দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলে হরতাল বন্ধ করা নিমিষেই সম্ভব । হরতাল বন্ধ করতে পারলে অচিরেই দেশ তার কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
বিষয়: রাজনীতি
৮৬৭ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
হরতাল ভালো কিছু বয়ে আনে না। এর বিকল্প ভাবা উচিত। আপনার লিখাটি পড়লাম। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন