তেল বিনে দেশ চলে না
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ১৪ অক্টোবর, ২০১৪, ০৮:১৭:০৩ রাত
কোথায় যেন শুনেছিলাম ‘তেল বিনে গাড়ী চলে না’ । অতীতে শ্রুত সেই পংক্তির মত বারবার মনে হচ্ছে ‘তেল বিনে বাংলাদেশ চলে না’ । তোষামোদিতে দেশের সর্বত্র পূর্ণ হয়ে গেছে । যখন যে দল ক্ষমতায় থাকবে তখন সে দলের নেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় কর্মীদের তৎপরতা-অপতৎপরতায় স্বাভাবিক কর্মকান্ড ব্যাহত হয় । বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে যারা জড়িত তারা তাদের ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়টাতে শক্তির জোয়ার প্রদর্শন করার সুযোগ পায় কিংবা যখন বিরোধীদলে থাকে তখন শুঁটকি মাছের মত কোনঠাসা হয়ে পড়ে থাকে । তবে এদেশে এমন কিছু সাধারণ মানুষ আছে যারা কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত নয় । এ শ্রেণীর মানুষের একমাত্র উদ্দেশ্য পরিবার-পরিজন নিয়ে তিনবেলার স্থানে দু-বেলা খেয়ে হলেও শান্তিতে বেঁচে থাকা । কিন্তু রাজনৈতিক আক্রমন-প্রতিআক্রমন কিংবা দলবাজী-দখলবাজীর ধাক্কায় এর সব সময় ভীতির মধ্যে থাকে । কখনও কখনও রাজনৈতিক দল কিংবা ব্যক্তির আক্রোশে পড়ে তাদের সর্বস্ব হারাতে হয় । এ জন্য ঢালাওভাবে সকল রাজনৈতিক দলকে দোষী সাব্যস্ত করা না গেলেও নিরপেক্ষ শ্রেণীর মানুষগুলোকে বহুবিধ অসুবিধার মধ্যে তাদের জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে কিংবা আজও হচ্ছে । সামাজবদ্ধ জীব হওয়ার কারনে নিরপেক্ষ মানুষগুলো যখন কোন পারিপার্শ্বিক সমস্যায় পতিত হয়ে ন্যায় বিচারের আশায় ক্ষমতাশীনদের দ্বারস্থ হয় তখন তাদেরকে মোটামুটিভাবে যে প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হতে হয় তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিতি প্রশ্নটাই হচ্ছে- বিচারপ্রার্থী কোন দলের সমর্থক । এ সময় যদি ভূলক্রমেও মূখ ফসকে বেড়িয়ে যায় যে, তিনি ক্ষমতাশীনদলের সদস্য নন তবে তার ন্যায় বিচার প্রাপ্তির সম্ভাবনার ওখানেই মৃত্যু ঘটে । ন্যায়-অন্যায়, অধিকার-অনধিকার, নৈতিকতা-অনৈতিকতা কিংবা সত্য-মিথ্যার পার্থক্যভূলে ক্ষমতাশীনদের বড় অংশ দলবাজিতে মত্ত । দলের স্বার্থ রক্ষার জন্য সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে দিতে কিংবা অন্যায়কে ন্যায় বলে চালিয়ে দিতে কারো বিবেকে বিন্দুমাত্র বাঁধে না । সূরর্য্যালোকের মত সত্য ঘটনাকেও শুধু দলীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য অস্বীকার করা হয় কিংবা ভিন্ন ভিন্ন ছলাকলার আশ্রয় নিয়ে দলের নেতাদের প্রিয়ভাজন হওয়ার জন্য এমন সব আজগুবি মিথ্যা কাহিনী বর্ননা করা হয় যা শুনে স্বয়ং মিথ্যাই লজ্জা পায় অবস্থা । এহেন কর্মকান্ডের কারনে ক্ষমতাশীনদল কিংবা তাদের বিরোধীপক্ষ কোন সমস্যায় পতিত হয় না কারন সময়ের বিবর্তনে বিরোধীপক্ষ ক্ষমতার মসনদের উঠে আসে আবার ক্ষমতাশীনরা বিরোধীপক্ষে যায় । তাদের এ আবর্তন চক্র নির্দিষ্ট সময়ে সীমাবদ্ধ হওয়ায় সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব নিয়ে তারা ততোটা হাউ-কাউ করে না । তবে বাঁশ যা যাওয়ার তা সাধারণ মানুষকেই উপলব্ধি করতে হয় । এদের কর্মকান্ডে নিরপেক্ষ শ্রেণীর মানুষগুলোর জীবনে নেমে আসে চরম অন্ধকার ও অস্থিরতা । কোথাওয় খুঁজে একটু নিরাপত্তা কিংবা নিশ্চয়তা পাওয়া যায়না । স্বাভাবিকভাবে বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে এ মানুষগুলো টিকে থাকতে চাইলেও সেটা আর হয়ে ওঠে না । নিরপেক্ষ শ্রেণীর মানুষগুলোর বাঁচার সকল রাস্তাই যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন এরা কেবল সুযোগ খুঁজে কিভাবে জীবন থেকে পালানো যায় ।
১৪ই অক্টোবর নিজ উপজেলা থেকে বাসযোগে গন্তব্যে এসেছি । পূজা ও ঈদপরবর্তী সময়ের তুলনায় বাসে যাত্রীদের ভীড় একটু কম হলেও বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে ভীড় ঢেড় বেশি । যে বাসটির যাত্রী হয়েছিলাম সে বাসটি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে সকাল ৯.৫০ মিনিটে ছেড়ে এসেছে । এ কাউন্টার থেকে প্রতি এক ঘন্টা অন্তর বাস ছেড়ে যায় । যে বাসটায় এসেছি তার পূর্ববর্তী বাসটায় যাত্রীদের ব্যাপক ভীড় থাকায় ইচ্ছা করেই সেটায় আসিনি । কাজেই যে বাসটায় ৫০টি সিটের মধ্যে আমার নম্বর ছিল ৪২ অথচ সিরিয়ালে ১০ থেকে ১২ জনের পরেই টিকেট কেটেছি । এটাও মেনে নেয়া যেত কিন্তু বাস ছাড়ার মিনিটি চারেক পূর্বে একজন যাত্রী এসে যখন টিকেট কাউন্টারে বলল আমি উপেজেলা চেয়ারম্যানের লোক তখন তার সিট নাম্বারটি হল ৮ ! দেশের সর্বত্র এভাবেই চলছে । যার যেটুকু ক্ষমতা আছে সে তা প্রয়োগ করছে যাচ্ছে । নীতি-নৈতিকতার কোথাও কোন বালাই নেই । গ্রাম পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সংঘ পর্যন্ত একই ছবির প্রতিরুপ । এভাবে চলতে থাকলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায় ? ন্যায়-অন্যাযের পার্থক্য করবে কে ? ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্য থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদের সদস্যরাও যদি একই পথে হাটেন তবে সমতা বিধান আর হল কই ? এটাই কি গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো ?
২০১৪ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশের দুই নক্ষত্রের বিদায় হয়েছে । স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৩ বছর পর যখন দেশ রাজনৈতিকভাবে গভীর সংকটে পতিত হয়েছে তখন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম রূপকার ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন এবং বুদ্ধিজীবি ড. পিয়াস করীমের মৃত্যু জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতি । ড. পিয়াস করীমের লাশ শহীদ মিনারে রাখা যাবে না বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি সংগঠন থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে । ড. পিয়াস করীমের লাশ শহীদ মিনারে রাখা হলে শহীদ মিনার অপবিত্র হবে বলে তারা জানিয়েছেন । এ অপবিত্রতার কথা শুনার পরে পবিত্রতা-অপবিত্রতা শব্দদ্বয়ের অর্থ নিয়ে একটা সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে । কারো পক্ষে বলতে না পারলে তিনি দেশের শত্রু আর পক্ষে বললে বাহ! বাহ! এরকমটা আর কতদিন চলবে ? রাজনৈতিক স্বার্থেই এ ধরনের সংস্কৃতিকে বিদায় জানানো আবশ্যক । যে দেশের ইতিহাস সরকার বদলের সাথে বদলে যায় সে দেশের ভবিষ্যতে খুব বেশি আলোকচ্ছটা নেই বলেই ধারনা । ব্যক্তি কিংবা দলের স্বার্থই যে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ সে সমাজে জ্ঞানীরা বাস করা আর না করা সমান । যে সমাজের বিজ্ঞ ব্যক্তিরা সমাজকে আলোর পথ দেখাতে না পারেন সে সমাজের উন্নতি হবে তা ভাবি কোন আশায় ? মিছে মিছে স্বপ্ন দেখা আর মরুভূমিতে মরীচিকার পিছনে ছোটার মধ্যে কোন পার্থক্য নাই ।
ছোটবেলায় শুনতাম, চাকরি পাওয়ার জন্য ‘হয় মামুর জোড় নয়ত টাকার জোড়’-এর মধ্যে কোন একটা থাকা চাই । সময়ের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে । এখন যোগ্যতার চেয়ে বিভিন্ন জোড়েই চাকরি হয় বেশি । সেটা সরকারী চাকরি হোক কিংবা অন্য কোন ক্ষেত্রে । তবে পূর্বের মত নির্দিষ্ট কোন একটা জোড় থাকলেই চাকরি পাওয়া যাবে না । মামু এবং টাকা-দুটোই থাকা চাই । এরপরও বিভিন্ন ধরনের কোটার মায়াজালে চাকরির বাজারকে পুরো দখলদারিত্বে রাখা হয়েছে । যেন বলতে চায়, যোগ্য শ্রেণীর এখানে প্রবেশ নিষেধ, যদি আসতেই হয় তবে শর্ত পূরণ কর । প্রতিটি অফিস আদালতে কাজ করাতে ন্যায় পন্থার চেয়ে অবৈধ পন্থা অবলম্বন করতে হয় বেশি । মানুষের বিবেক যেন দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে । এভাবে চলতে থাকলে কোন একদিন হয়ত বিবেক মরেও যাবে । তেল দিয়ে জোড়-জবরদস্তি করে স্বাভাবিক কাজকে কতদিন অস্বাভাবিকভাবে চালানো সম্ভব । সুতরাং ন্যায়ের পথে ফিরিয়ে আসলে সকল সমস্যার যেমন সমাধান হবে তেমনি সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রশান্তিও লাভ করা সম্ভব হবে ।
রাজনীতিতে লবিং এক অতি পরিচিত শব্দ । নেতা হতে চাইলে আরও বড় নেতাদের তোষামোদি করতে হবে, চাকরি পেতে হলে ঘুষ দিতে হবে, বাজার থেকে ভাল মাছ কিংবা অন্য কোন দ্রব্য ক্রয় করতে হলে দালাল ধরতে হবে, ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে হলে ডোনেশান দিতে হবে, ভালো রেজাল্ট পেতে হলে শিক্ষকের বাসায় মিষ্টি দিতে হবে আরও কত কী । এভাবে সমাজের প্রতিটি কাজকে অবৈধ চেইনে বদ্ধ করার কারনে সমাজ ব্যবস্থা আজ ধুঁকছে । মানুষের অপরাধবোধ লোপ পাওয়ার কারনে যে অন্যায় করছে কিংবা যিনি অন্যায়ের সুযোগ করে দিচ্ছেন তাদের কোন পক্ষের মধ্যেই কোন অনুশোচনা বোধ নেই । যান্ত্রিক বস্তুর মত মানুষ বিবেক শুন্য হয়ে একের পর এক অন্যায় করেই যাচ্ছে । সমস্যায় পড়তে হচ্ছে খেঁটে খাওয়া এক শ্রেণীর নির্লোভী মানুষকে । যারা সুস্থ থাকতে চায় তাদেরকেও যেন জোড় করে অসুস্থ করার পায়তাঁরা চলছে । এভাবে আর কতকাল চলতে পারবে ? কথার তেল কিংবা অর্থের তেল ব্যবহার বন্ধ করা না গেলে রাষ্ট্রকে বিরাট গচ্ছা দিতে হবে এবং সেটা নিকট ভবিষ্যতেই । সুতরাং এ বিষয়ে সকলের সচেতনতা সৃষ্টি হওয়া আশু আবশ্যক ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
বিষয়: রাজনীতি
১১৬৪ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আসলেই সমাজটা আজ পচে নোংরা ডাষ্টবিনে পরিণত হয়েছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন