সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে চামড়া শিল্প দেশের অগ্রগতির সহায়ক হবে
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ০৯ অক্টোবর, ২০১৪, ০৮:০৯:৫৬ সকাল
বাংলাদেশের অগ্রগতিতে যে সকল শিল্প সহায়ক ভূমিকা পালন করছে তার মধ্যে চামড়া শিল্প অন্যতম । অমিত সম্ভাবনার এ শিল্প সম্প্রসারণে সমন্বিত ভূমিকা আবশ্যক । স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় পৌঁছানোর পিছনে চামড়া শিল্প থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে । সরকার এবং বেসরকারি ব্যাংকসমূহ যদি চামড়া শিল্পে আরও বিনিয়োগ করে তবে দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় চামড়া শিল্প ব্যাপক অবদান রাখতে পারবে । বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশী পশুর চামড়া মান ভালো হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের চামড়ার ব্যাপক চাহিদা থাকাও সত্ত্বেও এদেশে থেকে উন্নত প্রযুক্তিতে চামড়া সংরক্ষন এবং প্রক্রিয়াজাত করে তা বিদেশে রফতানি করতে না পারায় দিনে দিনে বাংলাদেশী চামড়ার প্রতি বিদেশী ব্যবহারকারীদের আগ্রহ কমছে । ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের চামড়া শিল্পের বিকাশ শুরু হয়ে নব্বই দশকের মাঝামাঝি এ শিল্প ব্যাপক বিস্তার ও সম্মৃদ্ধি অর্জণ করলেও একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ক্রমাগত উন্নতির ধারাবাহিকতা বজায় থাকলেও তা যথেষ্ট ছিল না । চামড়া শিল্পের অনগ্রসরতার পেছনে সরকারের উদাসীনতা এবং ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি বহুলাংশে দায়ী । এ ছাড়াও বিভিন্ন চোড়াই পথে পার্শ্ববর্তী দেশ ছাড়াও কয়েকটি দেশে চামড়া পাচারের ফলেও এ শিল্পের বিকাশ ব্যাহত হয়েছে । তবে চামড়া শিল্পকে সবচেয়ে লোকসানীতে পড়তে হয়েছে স্থানীয় পর্যায় চামড়া সংরক্ষণ পদ্ধতিতে ত্রুটি থাকায় । স্থানীয় পর্যায় যারা পশুর চামড়ার ব্যবসা সাথে জড়িত তারা মাঠ পর্যায় থেকে চামড়া ক্রয় করে ঠিকই কিন্তু পশুর সে চামড়াগুলোকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংরক্ষন না করে গতানুগতিক পদ্ধতিতে সংরক্ষন করে । ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতিতে চামড়া সংরক্ষণ করার কারনে ট্যানারী শিল্পে চামড়া পৌঁছতে পৌঁছতে চমড়ায় গুনগতভাবে নানা সমস্যা দেখা দেয় । যে কারনে পরিশোধন করে সে চামড়া কিংবা চামড়াজাত দ্রব্য বিদেশে রফতানি করার পরে সে সকল চমড়া কিংবা চমড়াজাত দ্রব্যের স্থায়ীত্ব ক্ষমতা হ্রাস পায় । যে কারনে এ সকল দ্রব্য অল্প দিনের জন্য টিঁকসই হওয়ায় বিদেশী ক্রেতারা বাংলাদেশী চামড়া কিংবা চামড়াজাত দ্রব্য ক্রয়ে অনীহা প্রকাশ করে বলেও চামড়া শিল্পের সাথে জড়িতরা জানিয়েছে ।
ভারতীয় উপমহাদেশের বর্তমান বাংলাদেশে চামড়া শিল্পের ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয় । ১৯৪০ সালে রণদা প্রসাদ সাহা (আর পি সাহা) নারায়ণগঞ্জে প্রথম ট্যানারি স্থাপন করে চামড়া ব্যবসা শুরু করেছিলেন । পরবর্তী সময়ে সেখানে বেশ কয়েকটি ট্যানারি গড়ে ওঠে । ১৯৫১ সালের ৩রা অক্টোবর সরকারি গেজেট নোটিফিকেশনে ভূমি অধিগ্রহণ করে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার জনশূন্য হাজারীবাগে স্থানান্তার করা হয় ট্যানারি । বর্তমানে দেশে ট্যানারির সংখ্যা ২৭০টি । যার ৯০ ভাগই হাজারীবাগে । তবে ২০০৩ সালে পরিবেশ দূষণ ও এলাকাবাসীর দাবীর মূখে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি ঢাকার অদূরে সাভারের হরিণধারায় স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয় । সে ধারাবাহিকতায় ২০০ একর জমি অধিগ্রহন করে এ স্থানান্তরের কাজের ৮০-৮৫ ভাগ কাজ ইতোমধ্যে সমাপ্ত হয়েছে । সরকারের পক্ষ থেকে আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যেই স্থানান্তরের কাজ সমাপ্ত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে । ৬৩ বছর ধরে হাজারীবাগে চমড়া শিল্পের কার্যক্রম চললেও এ সময়ে চামড়া শিল্পের যে প্রসার হওয়ার কথা ছিল আসলে শেষ পর্যন্ত তা হয়নি । চমড়া শিল্পের যতটা অগ্রগতি হয়েছে তা কেবল ট্যানারি ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টদের একক ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় । তবে আশার কথা, সরকারের উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা না পেলেও তারা এগিয়ে চলছেন । আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদার তুলনায় দেশে চামড়া উৎসাপদন কম । চামড়া সংগ্রহের সবচেয়ে বড় মৌসুম কোরবানীর ঈদ । মোট চামড়ার ৬০-৭০ ভাগ আসে এ সময় । কোরবানীর সময় যে চামড়া সংগ্রহ করা হয় তা দিয়ে ট্যানারিগুলো সারা বছর চলে । চলতি বছর পবিত্র ঈদুল আযহায় কোরবানীর পশুর চমড়া কিনতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৫০০ কোটি টকা ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে । গত বছর এ খাতে তারা ঋণ দিয়েছিলে ৪৬১ কোটি টাকা । সে হিসাবে গত বছরের চেয়ে এ বছর ঋণের পরিমান বাড়লেও চাহিদার তুলনায় এ ঋণ অপর্যাপ্ত ।
১৯৯০-এর দশকে এ শিল্পে বার্ষিক গড় রপ্তানি আয় ছিল ২২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার । ২০০৯-১০ অর্থবছরে চমড়া রফতানি থেকে আয় হয় ২২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং চামড়াজাত পণ্য খেকে রফতানি আয় হয় ২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার । ২০১০-১১ অর্থবছরে চামড়া রফতানি থেকে আয় হয় ২৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং চামড়াজাত পণ্য থেকে আয় হয় ৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার । তবে ২০১১-১২ সালে এ খাতে মোট রফতানি আয় দাঁড়ায় ৭৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার । চামড়া শিল্পের এ খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করে নানামূখী পদক্ষেপ গ্রহন করেছে । তবে এ পদক্ষেপের কতটুকু বাস্তবায়িত হবে তা সরকারের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে । সুতরাং আমাদের অর্থনীতিতে নিঃসন্দেহে সম্ভাবনাময় বড় একটি খাত চমড়া শিল্প । ২০১২-১৩ অর্থবছরে চামড়া, জুতা ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে ৯৮ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ । বর্তমানে বিশ্বব্যাপী শুধু জুতার চাহিদা ছয় হাজার কোটি ডলারেরও বেশি । এর মধ্যে এককভাবে চীনের দখলে ৭৫ ভাগেরও বেশি । চীনের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান নাজুক হলেও চামড়া রফতানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় । বাংলাদেশ থেকে প্রধানত ইতালি, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ও যুক্তরাষ্ট্রে চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয় । এছাড়াও বেশি কিছু দেশে বাংলাদেশ থেকে চামড়া এবং চামড়াজাত দ্রব্য রফতানির সম্ভাবনার দ্বার খুলতে শুরু করেছে । গুরুত্বপূর্ণ খাত হলেও চামড়া শিল্প অনেকটা অবহেলা-অযত্ন ও অপরিকল্পিতভাবে এগিয়ে চলছে । এ ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টরা মত প্রকাশ করেছেন, যদি চামড়া শিল্পে সরকারের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা পায় তাবে দেশের উন্নয়ণের জন্য গার্মেন্টেস শিল্পের মত এ খাতটিও অগ্রগন্য ভূমিকা পালন করতে পারবে ।
ঢাকায় ব্যাপক ঘনবসতির কারনে মাত্র ৬৩ বছরের মাথায় একটি শিল্পকে স্থানান্তর করা হলো । আগামী ২০ বছরের মাথায় সাভারের হরিণধারা থেকে আবারও এ শিল্পকে স্থানান্তরের দাবি উঠবে না সে নিশ্চয়তা কে দিতে পারে ? শিল্প-কারখান স্থানান্তরের ঝামেলা এবং আর্থিকভাবে লোকসানীর দায়ভার কে গ্রহন করবে ? এ লোকসানীর খরচ এককভাবে যদি শিল্প মালিকদের বহন করতে হয় তবে ধুঁকতে থাকা এ শিল্পটি স্থবির হয়ে পড়বে না তার নিশ্চয়তা কে দিতে পারে ? ট্যারনারি শিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে । সুতরাং তাদের সার্বিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা শিল্প-কারখানার মালিকদের সাথে সরকারকেও দিতে হবে । চামড়া শিল্প বর্জিত বর্জ্যদ্রব্যের মারাত্মক দূষণ থেকে পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে । বাংলাদেশের সস্তা শ্রমকে ব্যবহার করে চামড়া শিল্পের বিকাশ এবং এর মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে সহায়ক করে তুলতে হবে । এ ক্ষেত্রে ট্যানারী ব্যবসায়ী এবং সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার যৌথ সমন্বিত উদ্যোগ জরুরী ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
বিষয়: বিবিধ
৯২০ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো- ব্যক্তি উদ্্যোক্তা যখন সাফল্যের পথ খুঁজে পায় তখন সরকার সেটির পথে বাধা সৃষ্টি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে! তারপর যখন সেটি সব বাধা ডিংগিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে তখন সরকারের হুঁশ হয় এবং পাশে দাঁড়ানোর খেলা শুরু করে!
মন্তব্য করতে লগইন করুন