শিক্ষকরা সমাজের প্রাণ
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ০৪ অক্টোবর, ২০১৪, ০৯:০১:০০ সকাল
শিক্ষা যদি জাতির মেরুদন্ড হয় তবে শিক্ষকরা সে মেরুদন্ডের স্রষ্টা । পিতামাতা কেবল সন্তানের জন্ম দিতে পারে কিন্তু সে সন্তানকে প্রকৃত মানুষ করা, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে দায়িত্ববোধ ও সচেতন করে সামাজিক জীব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য । পৃথিবীতে যতগুলো সম্মানজনক পেশা আছে তার মধ্যে শিক্ষকতা সর্বোচ্চ সম্মানিত পেশা । সল্প পরিশ্রমের বিনিময়ে আবার কোথাও কোথাও বিনা পারিশ্রমিকে একজন শিক্ষক সমাজবদ্ধ কিংবা সমাজ বিচ্ছিন্ন মানুষের মধ্যে জ্ঞানের মশাল প্রজ্জ্বলিত করে দেন । শিক্ষক হতে হলে তাকে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হতে হবে এমন কোন ধরা-বাধা নিয়ম নেই । যার কাছ থেকে মানুষ সামান্য কোন বিষয়েও জ্ঞান অর্জন করে তাকেই শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করা যায় । শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের অন্তরালে বয়স কোন বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে না । স্বাভাবিকভাবে শিক্ষকের চেয়ে শিক্ষার্থীর বয়স কম হবে এমনটাই ধারনা করা হয় তবে শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষকের বয়স কম হলেও অবাক হওয়ার কিছু নাই । প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা থেকে শিক্ষকদেরকে অনেক সম্মানের চোখে দেখা হয় । গুরু-শিষ্যের মধ্যে সৃষ্ট সম্পর্কের সাথে অন্য কোন সম্পর্কের তুলনা করা প্রায় অসম্ভব । তবে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের কিছু দেশে শিক্ষকদেরকে প্রাপ্য সম্মান দেয়া হয়না । এক্ষেত্রে আমাদের চিন্তাশক্তির অবক্ষয় যেমন দায়ী তেমনি শিক্ষকরাও কিছু কিছু অংশে দায়ী । গতিশীল বিশ্বের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে অতীত সংস্কার থেকে মানুষ বের হয়ে আসতে শুরু করেছে । এ প্রবনতা আমাদের জীবনের বহুক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন সৃষ্টি করলেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে । তবুও বিনা প্রশ্নে বলা যায়, গোটা মনুষ্য সমাজের মধ্যে নৈতিক বিচারে শিক্ষকদের চেয়ে সম্মানিত এবং শিক্ষকতার চেয়ে মরর্য্যাদাপূর্ণ পেশা আর একটাও নাই । শিক্ষকরা এ সমাজের প্রাণ ।
প্রতিবছর ৫ই অক্টোবর বাংলাদেশসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে পালিত হয় বিশ্ব শিক্ষক দিবস । মূলত শিক্ষকদের কর্মকান্ডের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাদের অবদানকে স্মরণ করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষক দিবস পালন করা হয়ে থাকে । শিক্ষক দিবস পালনের ইতিহাস খুব বেশিদিন আগের নয় । এ দিবসটি উদযাপন শুরু হয় ১৯৯৫ সালের ৫ই অক্টোবর থেকে । এরপর থেকে প্রতিবছর নির্ধারিত দিনে শিক্ষকদের প্রতি বিশেষভাবে সম্মান এবং তাদের অবদানকে তুলে ধরার জন্য এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে । ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হয় । বিশ্বের ১০০টি দেশে এই দিবসটি পালিত হয়ে থাকে । এই দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল (Educational International-EI) ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে । দিবসটি উপলক্ষে ইআই প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মারন করিয়ে দেয় । বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির মত বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় শিক্ষক দিবস পালন করা হয়ে থাকে ।
সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও শিক্ষকতা একটি মহান পেশা হিসেবে স্বীকৃত । এ পেশাটি মহান পেশা হলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে শিক্ষকদের দুরাবস্থার কথা প্রকাশিত হয় । এ দেশের একজন শিক্ষক যখন তার জন্য নির্ধারিত সম্মানীর মাধ্যমে পরিবারের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে না পেরে হতাশায় আত্মহত্যা করে কিংবা এ মহান পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোন অসম্মানের পেশায় জড়িয়ে যায় তখন জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জিত হওয়ার কথা । শিক্ষকতা পেশা ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো পেশায় দুর্নীতির ছোঁয়া লেগেছে । অথচ শিক্ষকরা ইচ্ছা করলেও অসৎ পথে দু’টো টাকা রোজগার করতে পারে না ! শিক্ষকরা অসৎ উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করবেই বা কেন তারা তো সে শিক্ষা পায়নি কিংবা জাতিকে সে শিক্ষা দেয় না । অথচ সেই শিক্ষকরেদর জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক যে বরাদ্ধ রাখা হয়েছে তা কোন বিচারেই যুক্তিযুক্ত নয় । অন্যান্য পেশায় উচ্চ স্কেলের বেতনের সাথে উপরি কামাইয়ের যথেষ্ট সুযোগ রাষ্ট্র সৃষ্টি করে রেখেছে । শিক্ষকরা সৎভাবে জীবন যাপন করার শপথ নিয়ে এ পেশায় প্রবেশ করলেও শিক্ষকদেরকে উপযুক্ত বেতন প্রদানের মাধ্যমে ভালো থাকতে দেয়া হচ্ছে না । এ যেন রাষ্ট্র কর্তৃক অসহায়কে আরও অসহায় করে দেয়ার পায়তাঁরা । সুতরাং প্রাইমারী স্কুল থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল শিক্ষকের বেতন কাঠামো অন্যান্য পেশাজীবিদের বেতন কাঠামো থেকে আলাদা করে তাদের বেতন বৃদ্ধি করা উচিত । শিক্ষকরা যদি তাদের সকল দুশ্চিন্তা দূরে ঠেলে না দিতে পারেন তবে তাদের থেকে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত জ্ঞান আশা করতে পারে না ।
জাতি গঠনে শিক্ষকের ভূমিকাকে যারা অস্বীকার করবে তাদেরকে মানুষ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার কোন যুক্তি নাই । পৃথিবীতে যে যত মহৎ হোক না কেন, সে কোন না কোন শিক্ষকের অধীনে জ্ঞান অর্জন করেছে । রাষ্ট্র প্রধান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রে প্রতিটি স্তরের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গসহ অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন সকল মানুষ কোন এক বা একাধিক শিক্ষকের তত্ত্বাবাধানে তাদের ছাত্রজীবনে জ্ঞান অর্জন করে আজ সম্মানের পদে আসীন হয়েছে । মানুষের মধ্যে যারা কৃতজ্ঞ শ্রেণীর তারা সার্বিকভাবে না হলেও ব্যক্তিগতভাবে কোন না কোন শিক্ষকের কাছে ঋণী এবং বিভিন্ন সভা সেমিনারে তাদের সে অভিব্যক্তিও ফুটে ওঠে । তবে তাদের এ বাসনা যদি ব্যক্তিগতভাবে কার্যকরী না হয়ে সার্বিকভাবে কার্যকরী হয় তবে সকল শিক্ষকরা যেমন উপকৃত হবে তেমনি শিক্ষার্থীদের জন্যও এটা জ্ঞান অর্জনের পথে সহায়ক হবে । একটি রাষ্ট্রের বিচার বিভাগকে স্বাধীন রাখার জন্য যে বিচারকদের স্বাধীনতা এবং সার্বিক নিরাপত্তা দিতে হয় তেমনি একটি জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য শিক্ষকদেরকেও পারিপার্শ্বিক সকল চাপমুক্ত রাখতে হবে । কোন প্রকার রাষ্ট্রীয় চাপ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে হয়রানি থেকে মুক্ত রেখে শিক্ষকদেরকে গবেষণাধর্মী জ্ঞান চর্চা এবং জ্ঞান বিতরণের সুযোগ করে দিতে হবে ।
‘শিক্ষক মোরা শিক্ষক/ধরনীর মোরা পরমাত্মীয়/মানুষের মোরা দীক্ষক’ । সমাজের অন্যান্য পেশাজীবিদের মত শিক্ষদের একাংশ বিভিন্ন অনৈতিক কার্যকলাপের সাথে জড়িত হয়েছেন । একজন শিক্ষকের সাথে একজন শিক্ষার্থীর সম্পর্ক পিতামাতা সাথে সন্তানের সম্পর্কের মত । কাজেই শিক্ষকরা কোন রাজনৈতিক দলের ঝান্ডাবাহী কিংবা অন্যকোন অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে নিজেকে এবং নিজ সম্প্রদায়কে কলুষিত করতে পারেন না । শিক্ষকরা সমাজ, রাষ্ট্রের আলোকবর্তিকার মত কাজ করবে । সেই তারাই যদি অন্ধকার জগতে বিলীন হয়ে যায় তবে জাতিকে পথ প্রদর্শন করবে কারা ? এজন্য সকল শিক্ষককে আরও সচেতন হতে হবে । মহান সম্মানিত একজন শিক্ষক যদি নিজের সম্মান নিজেই বিলীন করে দেন তবে সে জন্য সমাজ রাষ্ট্র দায়ী করা যাবে না । সুতরাং শিক্ষক দিবসে কবি কাজী কাদের নেওয়াজের সাথে আমরাও যেন বলতে পারি, ‘আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির’ ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
বিষয়: বিবিধ
৯৮৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন