ধর্ষণ প্রবনতা মনোবিকৃতির বহিঃপ্রকাশ
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১২:১৪:৩৭ রাত
মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই জৈবিক চাহিদাসম্পন্ন জীব । নির্দিষ্ট বয়সে এসে মানুষের এ প্রেষণার বিকাশ লাভ করে বিবাহের জন্য রাষ্ট্র কখনো ছেলেদের জন্য এটা ২১ এবং মেয়েদের জন্য ১৮ বছর কিংবা আবার কখনো ছেলেদের জন্য ১৮ এবং মেয়েদের জন্য ১৬ বছর নির্ধারণ করে দিলেও এ নীতি খুব বেশি কাজে আসে না । যারা মানসিকভাবে দূর্বল অর্থ্যাৎ কুপ্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে মনের আকাঙ্খাকে বিবেকের বিচার দ্বারা প্রশমিত করে রাখতে না পারে তাদের দ্বারাই সমাজ বিরোধী কাজ বেশি ঘটে । ধর্ষণও এমন একটি সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্মবিরোধী কাজ যা কোন সুস্থ মানুষ অনুমোদন করে না । তবুও অনেক কড়া নিয়ম-নীতির মধ্যেও এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার কারনে অপরাধীকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদসদ্যেরকে সামাজিক লজ্জায় ঘিরে ধরে । ধর্ষণকারী এবং তার পরিবারের সদস্যরা ধর্ষণের অকল্যানে যতটুকু ক্ষতিগ্রস্থ হয় তার চেয়ে হাজারগুন বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় ধর্ষিতা এবং আত্মীয় স্বজন । সমাজ ধর্ষিতাকে স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে তো দেবেই না বরং কিভাবে জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া যায় তার সবগুলো পথের সন্ধান দিবে । ধর্ষিতারা শুধু যে বাইরের লোক দ্বারা অপদস্ত হয় তাই নয় বরং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা এবং নিকটাত্মীয়রাও তাকে স্বাভাবিক চোখে দেখে না । ধর্ষিতাকে মনে হয় যেন এ গ্রহের সবচেয়ে ঘৃণিতজীব । অথচ একজন মেয়ে কিংবা স্ত্রী লোককে যিনি বা যারা ধর্ষণকরে সমাজের চোখের বিষে পরিণত করল সেই তারা সমাজের অনেকের বাহবা পায় । তারা যেন এই সমাজের বীর । সমাজস্থ মানুষের এমন ধ্যান-ধারণার কারনে ধর্ষণের সংখ্যা না কমে দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে । ধর্ষিতারা লম্পটদের দ্বারা ধর্ষিতা হয়ে অনেকক্ষেত্রে সুষ্ঠু বিচারও পায় না । ধর্ষিতা হওয়ার পর চিকিৎসা থেকে শুরু করে আদালত পর্যন্ত আরও হাজারবার মানসিকভাবে ধর্ষিত হতে হয় । আবার কোথাও কোথাও ধর্ষণকারীদের প্রভাব প্রতিপত্তির ভয়ে ধর্ষিতা কিংবা ধর্ষিতার পরিবার মূখ খুলতেও সাহস পায় না । আক্রান্ত তার সকল যন্ত্রনার কথা বুকের মধ্যে চেপে রেখে কেবল মৃত্যুর দরজা খোঁজে । ধর্ষিতার অভিশাপে আকাশ-বাতাস ভারী হলেও ধর্ষণকারীর তাতে কিছু যায় আসে না । নারীরা শুধু বাইরে ধর্ষিত হয় না বরং অনেক সময় পরিবারের মধ্যেও ধর্ষণের শিকার হয় । এ অবস্থায় নারী বলতেও পারে না তার অবস্থার কথা । নারীর সামাজিক প্রতিবন্ধকতা এবং সুষ্ঠু বিচার না পাওয়ার কারনে ধর্ষণের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে শুধু বেড়েই চলে ।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ধর্ষণের খবর নিত্য নৈমিত্তিককার ব্যাপার । ২৯টি অঙ্গরাজ্যের বিশাল দেশটিতে এমন কোন দিন যায় না যেদিন ধর্ষণের খবর মিডিয়ায় না আসে । গত বছর একজন মেডিকেল ছাত্রীকে গণধর্ষণ করে মেরে ফেলার পর সারা বিশ্ববাপী তীব্র নিন্দার ঝড় ওঠেছিল । স্থানীয় প্রশাসন সরব হলেও ধর্ষণের সংখ্যা না কমে বরং বৃদ্ধি পেয়েছে । বিভিন্ন সংঘঠন ধর্ষণ রোধে বিভিন্ন উপায় অবলম্বনের কথা বললেও কাজের কাজ কিছুই হয় নি । ধর্ষণ বন্ধে বিভিন্নভাবে প্রচারণা চালানোর ফলে ধর্ষণের খবরও বেশি করে মিডিয়ায় আসতে থাকে । ভারতে বিদেশী পর্যটক থেকে শুরু করে সকল বয়সের নারীরা প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে । ভারতের ধর্ষণের হার বৃদ্ধি পাওয়ার পিছনে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকাকে কারন হিসেবে উল্লেখ করেছে । ধর্ষণ বলতে সাধারণত এক পুরুষ দ্বারা একজন নারীর উপর পাশবিক নির্যাতনকে বুঝায় । তবে যে সকল পাশবিক নির্যাতনে পুরুষের সংখ্যা একাধিক থাকে তাকে গণধর্ষণ হিসেবে অভিহিত করা হয় । সাধারণত মিডিয়ায় ধর্ষণ বিষয়ক যে খবরগুলো আসে তাতে গণধর্ষণের খবর বেশি থাকে । আমাদের দেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ স্থানে এক পুরুষ দ্বারা এক নারী ধর্ষিত হলে স্থানীয় মাতব্বরদের বা প্রশাসনের সহায়তায় তাদেরকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করিয়ে দেয়া অথবা স্থানীয়ভাবে বিচার করে দেয়ার কারনে এ ধরনের খবর খুব বেশি মিডিয়ায় আসে না । ধর্ষনের অবস্থা বহুমাত্রিক হতে পারে । পুরুষ দ্বারা যেমন নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয় তেমনি নারী দ্বারাও পুরুষ পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে পারে । এক নারীকে যেমন একাধিক পুরুষ পাশবিক নির্যাতন করতে পারে তেমনি একপুরুষকে একাধিক নারীও পাশবিক নির্যাতন করতে পারে । উন্নত বিশ্বে বিশেষ করে আমেরিকায় নারীরা যেমন ধর্ষিত হয় তেমনি পাল্লা দিয়ে পুরুষরাও নারী কর্তৃক ধর্ষিত হয় । তবে ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধর্ষণ বলতে শুধু পুরুষ কর্তৃক নারীকে পাশবিক নির্যাতনের অবস্থাকে বুঝায় ।
সম্প্রতি বাংলাদেশে ধর্ষণের সংখ্যা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে । চলতি বছরের প্রথম ছয়মাসে সার্বিক নারী নির্যাতন পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবনতি না ঘটলেও ধর্ষণের হার বেড়েছে । বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের পরিসংখ্যানে এমন তথ্য জানা গেছে । পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জানুয়ারী-জুন এই ছয় মাসে মোট ২২০৮ টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে । এ সময়ের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি । এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়ে ৮২ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৫ জনকে । ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ৫১ জনকে । শ্লীলতাহানির শিকার ৭০ জন ও যৌন নির্যাতনের শিকার ২৫ জন । ২০১৩ সালে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ৪ হাজার ৭৭৭ টি । এর মধ্যে ধর্ষিত হয়েছে ৬’শ ৯৬ জন । গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৮৫ জন । ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৯৪ জনকে । ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৫৩ জনকে । পরিসংখ্যান বলছে, গতবছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে । তবে সকল পরিসংখ্যানকে ছাপিয়ে গেছে আগষ্ট মাসের ধর্ষণ পরিস্থিতি । চলতি বছরের আগষ্ট মাসে মোট ৫০৪ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে । আর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১০৭ টি । গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৩ জন । ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৯ জনকে । ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৭ জনকে । জাতীয় মহিলা পরিষদের বিবৃতি মতে, গত মাসে (আগষ্ট) অপহরণের ঘটনা ঘটেছে মোট ১৬ টি । এ সময় ১১ জন নারী ও শিশু পাচারের শিকার হয় । এরমধ্যে যৌন পল্লীতে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে ১০ জনকে । হত্যা করা হয়েছে ৯৯ জন নারী ও শিশুকে । যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫২ জন নারী । এদের মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ২৫ জনকে । ৮ জন গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের শিকার হয়েছে । উত্ত্যক্ত করা হয়েছে ৪৭ জনকে । উত্ত্যক্তের কারনে আত্মহত্যা করেছে ১ জন । এ ছাড়া বিভিন্ন নির্যাতনের কারনে ৩১ জন নারী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে এবং ২২ জনের রহস্য জনক মৃত্যু হয়েছে । বাল্য বিবাহের শিকার হয়েছে ২১ জন । শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে ২৫ জনকে । এছাড়াও সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২০ টি । উপরোক্ত তথ্যগুলো যদি গত একমাসের সমগ্র বাংলাদেশের চিত্র হয় তবে কেমন আছে বাংলাদেশের নারীরা তা আর বিশ্লেষণ করতে হবে কি ? তবে হ্যা-নারীরা এমন নির্যাতনের শিকার হওয়ার পিছনে এককভাবে পুরুষদেরকে দায়ী করার কোন যৌক্তিক কারন নাই । শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের শুধু জোর জবরদস্তির দিকটাই কেন ধর্ষণ হিসেবে বিবেচ্য হবে, আপোষেরটা নয় কেন ? যে পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে তা অত্যন্ত উদ্বেগের কিন্তু আরও অনেক উদ্বেগ গোপন রয়েছে ।
যারা ধর্ষণ করে এবং যারা ধর্ষণে মদদ দেয় তাদের উভয় পক্ষের মনোঃবিকৃতি ঘটেছে । নৈতিক চিকিৎসা ছাড়া এদের বিকল্প কোন ঔষুধ নাই । সুষ্ঠু সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে ধর্ষণের সংখ্যা কমিয়ে আনা যায় । আকাশ সংস্কৃতির অবাধ প্রবাহ রোধ, পর্ণোগ্রাফীর সহজল্যভতা কমিয়ে আনার মাধ্যমে ধর্ষণ প্রবণতা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব । ধর্মীয় অনুশাসন এবং সামাজিক সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতে না পারলে মানুষের নৈতিক পদশঙ্খলন রোধ করা সম্ভব নয় । আইনের কঠোরতা সর্বাগ্রে দরকার । ধর্ষণকারীরা যদি আইনের অপব্যবহার করে পার পেয়ে যায় তবে ধর্ষণের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতেই থাকবে । সুতরাং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে ধর্ষণকারীদেরকে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে । সামাজিক সচেতনতা এবং পারিবারিক শিক্ষা ধর্ষণ রোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে । সর্বোপরি নারীর প্রতি পুরুষের শ্রদ্ধাবোধ এবং ভালোবাসার মনোভাব সৃষ্টি করাও জরুরী । একটি নারী ধর্ষিত হলে গোটা সমাজ ধর্ষিত হতে বাকী থাকে কী ? সুতরাং নৈতিকতাবোধ উদয়ের মাধ্যমে সমাজবিরোধী সকল কর্মকান্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখার দায় শুধু একজন পুরুষের নয় বরং নারীরও উচিত তার প্রতি জৈবিক আকর্ষণ সৃষ্টি হয় এমন কোন পোশাক পরিধান করা থেকে বিরত থাকা কিংবা এমন অঙ্গভঙ্গিও না করা যা পুরুষকে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হতে উদ্ধুদ্ধ করে । এক্ষেত্রে নারী পুরুষ উভয়ের মনোভাবের পরিবর্তনের মাধ্যমে ধর্ষণমুক্ত একটি নির্ঝঞ্ঝাট সমাজ নির্মান করা সম্ভব ।
বিষয়: বিবিধ
৮৫৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন