নির্বিঘ্নে কোরবানীর পশুর মাংস ভক্ষণের নিরপত্তা কোথায়

লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১০:৩০:০০ সকাল

মাস পেরুলেই ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আযহা বা বকরার ঈদ । মুসলিম মিল্লাতের জাতির পিতা হযরত ঈব্রাহীম (আঃ) এবং তার পুত্র হযরত ঈসমাইল (আঃ) এর স্মৃতি বিজড়িত উৎসব হিসেবে মুসললিম সম্প্রদায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পালন করছে এ পবিত্র উৎসবটি । মূলত ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে মুসলমানগণ আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রাপ্তির লক্ষ্যে স্রষ্টার নির্দেশে এবং মানবতার মুক্তির দুত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) প্রদর্শিত পন্থায় পশু কোরবানী দিয়ে থাকে । আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানী দেয়া পশুর মাংস কোরবানী দাতারা তাদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এবং গরীবদের নিয়ে তৃপ্তি সহকারে ভক্ষণ করে থাকে । অত্যন্ত বরকতময় মাংস হিসেবে কোরবানীর পশুর মাংসকে বিবেচনা করা হয় । অনেক মুসলমান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখে যে, কোরবানীর মাংস কেবল ‍উদরপূর্তির জন্য খাওয়া হয় না বরং এর মধ্যে মুসলমানদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অবারিত নেয়ামত ও অনেক রোগের প্রতিষেধক লুকিয়ে আছে । মুসলমানদের সে বিশ্বাসের মূলে আঘাত হানতে যাচ্ছে আসন্ন কোরবানীর ঈদ । মানুষের মনে ইতোমধ্যেই নানা শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে । বিভিন্ন গণমাধ্যমের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে মারাত্মক সব তথ্য । অসাধু ব্যবসায়ীরা কোরবানীর পশুকে মোটাতাজা করণের জন্য এমন কিছু বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করছে যা শুধু পশুর জন্যই মারাত্মক নয় বরং ঐ পশুর মাংস ভক্ষন করলে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও শতগুন ‍বৃদ্ধি পাবে ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রতি বছর প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ পশু কোরবানী দেওয়া হয় । এসকল পশুর মধ্যে গরু, ছাগল, মহিষ, উট, ভেড়া ও দুম্ভা অন্যতম । তবে আমাদের দেশে বেশিরভাগ মানুষেই গরুর মাধ্যমে কোরবানীর হুকুম পালন করে থাকে । কিছু অশুভ চক্র কোরবানীকে সামনে রেখে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় দ্রুত কোরবানীর পশুকে মোটাতাজা করনের জন্য নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যথেচ্ছভাবে পশুর শরীরে বিষাক্ত রাসয়নিক দ্রব্য প্রয়োগ করছে । যার কারনে তাদের আশানুযায়ী অল্প দিনের মধ্যেই গরুর ওজন ২০-৩০ কেজি বৃদ্ধি পেলেও এ মাংস ভক্ষনের ফলে মানুষের স্বাস্থ্যগত মারাত্মক সমস্যা হবে বলে ডাক্তাররা মত দিয়েছেন । কোরবানীকে সামনে রেখে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে সীমান্ত পথে বৈধ-অবৈধভাবে প্রতিনিয়ত শত শত গরু বাংলাদেশে প্রবেশ করানো হচ্ছে । এ সকল গরুগুলো কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করানোর কারনে দেশীয় গরু ব্যবসায়ীরা তাদের ভগ্ন শরীরের গরু বিক্রি করে মারাত্মক ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্মূখীন হন । এ কারনে দেশী ব্যবসায়ীরা ভারতের গরুর মত দেশীয় গরুগুলোকে মোটাতাজা করনের জন্য ব্যবহার করেন মারাত্মক রাসয়নিক দ্রব্য এবং উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ইনজেকশন । ভারত থেকে যে গরুগুলো বাংলাদেশে আসে তার বেশিরভাগও কৃত্রিম উপায়ে ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতিতে মোটাতাজা করানো হয় । যার কারনে উভয় দেশের গরুর মাংসের মধ্যেই মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর দ্রব্য মজুদ থাকে । অসাধু ব্যবসায়ীদের এ কর্মকান্ড সারা বছরব্যাপী চলমান থাকলেও কোরবানীর সময়কে সামনে রেখে তাদের এ কর্মকান্ড নতুন গতি পায় । দেশের বিভিন্ন স্থানে পশুর মোটাতাজা করনের জন্য নিষিদ্ধ ওষুধ উৎপন্ন করা হয় । দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসকল কারখানার কতগুলোর সন্ধান পেলেও বেশিরভাগ রয়ে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে । গত ৩রা আগষ্ট রাজধানীর ডেমরার মাতুয়াইলে গবাদি পশুর ওষুধ উৎপাদ কারখানায় তল্লাশি চালিয়ে ভ্রাম্যমান আদালত একজন অসাধু ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করে এবং তাকে ৩ লাখ টাকা জরিমানা করে । অনাদায়ে তিন মাসের কারাদন্ড প্রদান করে । সে কারখানাটির মধ্যে যে সকল ওষুধ উৎপাদন করা হচ্ছিল তার মধ্যে ডিজি লাইফ, বুষ্টার, লাইফভিট, হ্যামোজেন, ডারমা স্প্রে, টলমিক, এলডি পোস ও মাল্টিভেট ফোর্ট অন্যতম । এ সকল ওষুধ উৎপাদনের জন্য ঔষুধ প্রশাসনের অধিদপ্তরের কোন অনুমোদ নেই । উৎপাদিত এ ওষুধ পশুকে খাওয়ালে এবং ইনজেকশনের মাধ্যমে পশুর শরীরে পুশ করলে পশুর মাংস বিষাক্ত হয়ে যায় । শরীরে বিষ বহনকারী এ পশুর মাংস খেলে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ার আশংঙ্কা শতগুন ।

পশু মোটাতাজা করনের জন্য অতীতেও বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হত । এ পদ্ধতির মধ্যে গ্রোথ হরমোন ও স্টেরয়েড ড্রাগ ব্যবহার সনাতন পদ্ধতি । তবে বর্তমানে এ পদ্ধতির যথেচ্ছভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে । অসাধু ব্যবসায়ীরা অল্প আয়েশে অধিক মুনাফা লাভের আশায় মানুষের অধিকারকে ভূলে গিয়ে অনৈতিক উপায়ে অতীতের পদ্ধতির অনুসরণ না করে ইচ্চা মাফিক পশুর শরীরে বিষাক্ত রাসয়নিক প্রবেশ করাচ্ছে । তারা অল্প সময়ের মধ্যে গরুসহ অন্যান্য পশুর ওজন বাড়িয়ে অধিক মুনাফা অর্জন করে । অসাধু ব্যবসায়ীদের এ অনৈতিক পদ্ধতির কারনে তাদের স্বার্থ রক্ষা পেলেও দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার । অসাধু ব্যবসায়ীরা কম বয়সী গরু কিনে তাদের এ হীন স্বার্থ চরিতার্থ করে । বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজা করনের জন্য ৪-৬ মাস সময় লাগে । নির্দিষ্ট সময় অন্তর পুষ্টিমান খাবার খাওয়ানো, পশুকে রোগবালাই মুক্ত রাখার জন্য ভেটিরিনারি সার্জনের পরামের্শে ঔষুধ খাওয়ানোর মাধ্যমেই পশু মোটাতাজা করা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং এ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে মোটাতাজা করা পশুর মাংস মানব দেহের জন্যও উপকারী । কিন্তু অসাধু খামারীরা বিশেষ করে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা মাত্র ২০-৬০ দিনের মধ্যে মোটাতজাকরণ পদ্ধতি গ্রহন করে । আবার অনেক ব্যবসায়ী দ্রুত গরু মোটাতাজাকরণের উপায় হিসেবে মানুষের জন্য তৈরি বৃদ্ধিবর্ধক হরমন বড়ি ব্যবহার করেন । পশুর ওজন বৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত ত্বরান্বিত করার জন্য উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয় । পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে, রংপুর বিভাগের ৮টি জেলার বিভিন্ন স্থানে আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে ৩ লাখ গরুকে অবৈধভাবে মোটাতাজা করা হচ্ছে । পশু বিষজ্ঞদের মতে, বিষাক্ত হরমোন, ইনজেকশন ও রাসয়নিক ওষুধ প্রয়োগে মোটাতাজা করা এসব গরু ঈদের ১-২ সপ্তাহের মধ্যে জবাই না করলে মারা যায় । কারন গরুর শরীরের পরতে পরতে ঢুকিয়ে দেয়া হয় স্টেরয়েড কিংবা তারা চেয়েও অধিক মাত্রার মারাত্মক রাসায়নিক দ্রব্য । রিকমভিনেন্ট ভোবিন গ্রথ হরমোন প্রয়োগের ফলে গাভীর ২-৩ লিটার দুধ বেড়ে যায় । তবে অসাধু ব্যবসায়ীরা সামান্য মুনাফালাভের আশায় মানুষের শরীরের যেমন ক্ষতি সাধন করে তেমনি বাকহীন পশুকেও মারাত্মকভাবে কষ্ট দেয় । রিকমভিনেন্ট ভোবিন গ্রথ হরমোন ব্যবহারের ফলে গাভীর দুধের থলিতে ইনফেকশন হয় । এ ইনফেকশনের কারনে দুধে পুঁজ, রক্ত ও পানির পরিমান বেড়ে যায় । দুষিত এ দুধ পানে মানব শিশু ও পূর্ণ বয়স্কের জন্য ক্ষতিকর ।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, অল্প সময় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় মোটাতাজা করা পশুর গোস্ত ভক্ষনের ফলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় । এসব পশুর মাংস ভক্ষণের ফলে মানুষের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়, কিডনিতে সমস্যা সৃষ্টি হয় । এছাড়াও লিভার ফেইলিউর, টিউমার, বন্ধ্যাত্ব, হাড় ক্ষয়, শরীরে পানি যাওয়াসহ বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয় । মেয়েদের অল্প বয়সে পরিপক্কতা এবং শিশুদের অল্প বয়সে মোটা হয়ে যাওয়ার অন্তরালেও পশুর মোটাতাজাকরণের ওষুধের ক্রিয়া কাজ করে । সুতরাং নিয়মনীতি না মেনে উচ্চ মাত্রায় স্টেরয়েড ড্রাগ, ইউরিয়া, মাল্টি ভিটামিন, গ্রোথ হরমোন ব্যবহার দ্রুত বন্ধ করা উচিত ।

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পরাশক্তি আমেরিকায় প্রতিবছর খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে ৯ হাজার মানুষ মৃত্যুবরন করে এবং ৮০ মিলিয়ন মানুষ অসু্স্থ হয় । সে অর্থে আমাদের দেশের নির্দিষ্ট কোন পরিসংখ্যান নাই তবে খাদ্য বিষক্রিয়ায় আমেরিকার চেয়ে আমাদের দেশের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নাই । আমাদের দেশে শুধু গরুতেই নয় বরং সকল খাদ্য দ্রব্যেই অতিরিক্ত মাত্রায় বিষাক্ত রাসয়নিক দ্রব্য মিশ্রন করা হয় । কিছুদিন পূর্বেও দেশের আলোচিত ইস্যুছিল ফরমালিন আগ্রাসন । এ বছর কোরবানীর পূর্বে দেশের উত্তরাঞ্চলের কিছু জেলায় এ্যানথ্রাক্স রোগের আক্রমনের খবর মানুষকে কোরবানীর পূর্বে বিচলিত করে তুলেছে । এ্যানথ্রাক্স রোগের সাথে পশু মোটাতাজা করণে ব্যবহৃত ক্ষতিকর রাসয়নিক দ্রব্যের সংবাদ মানুষকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে । সুতরাং মুসলামনদের পবিত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে অতি দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদেরকে চিহ্নিত করে তাদেরকে শাস্তির মুখোমুখি করা আবশ্যক । যে কোন মূল্যে ঈদের খুশিতে অন্যকোন দুশ্চিন্তার অনুপ্রেবশ রোধ করতেই হবে । যে মাংস শরীর বর্ধকের জন্য ভক্ষন করা হয় তা যদি মানুষের মরনের কারন হয় তবে মুশকিল । কাজেই কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ, যেন অতিশীঘ্র ব্যবস্থা নিয়ে দোষীদের দমনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা দেয়া হয় । ঈদের খুশি সর্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ করে দিন । মানুষ যেন নির্বিঘ্নে কোরবানীর পশুর মাংস খেতে পারে তার নিশ্চয়তা চাই ।

রাজু আহমেদ । সাংবাদিক ও কলাম লেখক ।



বিষয়: বিবিধ

১২৯০ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

264482
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:৩২
মামুন লিখেছেন : প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই সময়োপযোগী এমন একটি পোষ্টের জন্য।
আসলেই খুবই উদ্বেগের সংবাদ। কিন্তু আমাদের করণীয় কি রয়েছে এ ক্ষেত্রে? কোরবানীর জন্য পশুতো কিনতেই হবে। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল এই অবৈধ এবং প্রাণঘাতী কাজের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। বিক্রীর জন্য বাজারে আনা পশুর শরীরে ক্ষতিকর রাসায়নিক সনাক্তকরার যন্ত্র দিয়ে সেগুলোকে আলাদা করে এর মালিকের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয়া উচিত। এ ব্যাপারে আইন এবং বিধিমালা না থাকলে সেগুলো দ্রুত করা উচিত। আর চীনের মত যদি প্রকাশ্যে এদেরকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদন্ড আইনের মাধ্যমে কার্যকর করা যায়, তবে হয়তো সকল পশু থেকে শুরু করে যে কোনো খাবারে বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানোর প্রবনতা কমে আসবে।
আপনার জন্য শুভেচ্ছা রইলো। Rose Rose Rose Good Luck
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০২:০৮
208122
রাজু আহমেদ লিখেছেন : ধন্যবাদ দাদা মহাশয় ।
264650
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৪৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : শুধু কুরবানির পশু নিয়ে সমস্যা নয়। বাজার নিয়ে যে অবস্থা হচ্ছে তাতে আদেী কিনা যাবে কিনা সেটাই চিন্তা।
264654
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৮:০৭
বুড়া মিয়া লিখেছেন : ব্যাপক তথ্যসমৃদ্ধ পোষ্ট, অনেক ধন্যবাদ রাজু ভাইকে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File