ফেসবুকাশ্রিত অপরাধ ও অপরাধীদেরকে রুখবে কে ?
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১১:৫৮:৩৯ রাত
পৃথিবীর সকল মানুষকে সম্পর্কের বন্ধনে জড়িয়ে আত্মীয় করেছে ফেসবুক । দূরকে এনেছে কাছে আর পরকে করেছে আপন । বিশ্বকে এনেছে হাতের মুঠোয় । দূর দেশের ছেলে মেয়ের মধ্যে ফেসবুক সূত্রে পরিচয় হয়ে তা পরিণয়ে রুপ লাভ করছে । আবার ফেসবুকের জন্যেই ভেঙ্গে যাচ্ছে অনেকের সংসার । ফেসবুক আসক্ত একদল তরুন-তরুনী তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়কে কাটিয়ে দিচ্ছে হেলায় ফেলায় । শুধু তরুন-তরুনীরা নয় বরং সব বয়সের ফেসবুক ব্যবহারকারীরাই কম বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছে এক ধরনের নেশায় । দিনের অন্যান্য কাজগুলো রুটিন অনুযায়ী না হলেও ফেসবুক ব্যবহার ঠিকই নিয়ম মাফিক হচ্ছে । ফেসবুকের পেইজে ঠিক সময়ে ঢোকা হলেও ঠিক সময়ে বের হওয়া অনেকের জন্যই অসাধ্য । বিভিন্ন কারনে অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ সাইটের তুলনায় ফেসবুকের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি । ফেসবুকের মাধ্যমে ছবি শেয়ার করা, খবর শেয়ার করা, বার্তা পাঠানো, দল ভিক্তিক নেটওয়ার্ক তৈরি করা, চ্যাট করাসহ বিভিন্ন কাজ করা যায় । ২০০৪ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী মার্ক জুকারবার্গের নেতৃত্বে একদল প্রযুক্তি মনস্ক প্রতিভাধারী ছাত্রের নিরলস চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত ফেসবুক তার যাত্রা শুরুর পর বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক আন্তসংযোগ যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি ওয়েবসাইটে পরিনত হয়েছে । ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধরাও ফেসবুকের কল্যানে তার বন্ধুদের সাথে মনের সবকিছু শেয়ার করছে । ফেসবুক আসক্ত অনেক পিতামাতা তাদের অনাগত সন্তানের নামে ফেসবুকে আইডি খুলে রাখেন যাতে তাদের সন্তানকে পৃথিবীর আলোয় এসে ফেসবুকের সদস্য হতে অতিরিক্ত সময় দিতে না হয় । ফেসবুকের প্রতি মানুষের এক ধরনের ম্যানিয়া সৃষ্টি হয়েছে । যে ম্যানিয়া উপকার যেমন করছে তেমনি অপকারও কম করছে না । যদিও ফেসবুকের নিয়ম অনুসারে নূন্যতম ১৩ বছরের কম বয়সী কোন শিশু ফেসবুকের সদস্য হতে পারবে না তবুও তা কেবল নিয়মেই সীমাবদ্ধ রয়েছে । বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ণ কার্যকরী ব্যবহারকারী এই ওয়েবসাইটি ব্যবহার করছে । অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের প্রচার এবং বিজ্ঞাপনের জন্য ফেসবুককে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে । নিমিষেই এখানে আনন্দ উপরকরণের সবকিছু পাওয়া যায় । তাই অন্যান্য সকল সামাজিক সাইটের তুলনায় ফেসবুকের অগ্রযাত্রার গতি দুর্বার । ফেসবুককে পত্রিকার চেয়েও শক্তিশালী মাধ্যম মনে করা হয় । গোটা বিশ্বের আনাচে কানাচের সকল খবর ফেসবুকের মাধ্যমে মূহুর্তের মধ্যে দিগ-দিগন্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে । রাজনৈতিক দল, নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সকল শ্রেণীর মানুষ তার স্বার্থ হাসিলের জন্য ফেসবুক ব্যবহার করছে । বিশেষ কোন বাধ্যবাধকতা না থাকার কারনে ফেসবুক অবর্ননীয় সুনাম কুড়িয়েছে । তবে ভালো মানুষেরা তাদের সৎ উদ্দেশ্যকে যেভাবে ফেসবুকের মাধ্যমে অন্যদের কাছে ছড়িয়ে দিচ্ছে তেমনি অসৎ কিছু মানুষ তাদের খারাপ উদ্দেশ্যকেও ফেসবুকের মাধ্যমে প্রসার ঘটাচ্ছে । ফেসবুককে ব্যবহার করেই তারা এমন কিছু অপরাধ করছে যার কারনে সমাজ হুমকির সম্মূখীন হয়েছে । আমাদের দেশে ফেসবুক বাধাহীনভাবে ব্যবহার করা গেলেও বিশ্বের কিছু দেশে ফেসবুক বাধার সম্মূখীন হয়েছে । সিরিয়া, চায়না এবং ইরানসহ বেশ কয়েকটি দেশে এটা আংশিকভাবে কার্যকর আছে । এ সকল দেশের কর্তৃপক্ষ ফেসবুক ব্যবহারে সময় অপচয় হয় আখ্যা দিয়ে কর্মচারীদেরকে এটা ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করে ফেসবুককে প্রায় নিষিদ্ধ করেছে ।
আমি ফেসবুকের সদস্য হয়েছি ২০১০ সালের ৫ই ডিসেম্বর । দীর্ঘ চলার পথে ফেসবুক আমার যা কেড়ে নিয়েছে তা না হয় গোপন রাখলাম । তবে ফেসবুক আমাকে কম কিছু দেয়নি । ফেসবুকে বন্ধুত্ব বানানো এবং বন্ধুত্ব হারানোর গল্পের মধ্যেও বন্ধুর সংখ্যা ১৬০০+ । গত কয়েকদিন চেষ্টা করেছি অকার্যকর বন্ধুদের রিমুভ করতে । যদিও এটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার তবুও হাল ছাড়িনি । তবে ফেসবুকের বন্ধুদের মধ্য থেকে কিছু অপসারণ করতে গিয়ে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে । এ অভিজ্ঞতার মধ্যে অন্যতম হল, কিছু পরিচিত-অপরিচিত বন্ধু তাদের ফেসবুকীয় লিঙ্গ পরিবর্তন করে জনপ্রিয় হওয়ার মেকি চিন্তায় পুরুষত্ব বিসর্জন দিয়ে অঙ্গহীন নারী সাজার চেষ্টা করেছে । তাদের জনপ্রিয়তাও দেখলাম ব্যাপক । তবুও তাদের এ রুচিকে ঘৃণা করতে পারিনি কেননা জনপ্রিয়তার খায়েশ কার না আছে ! সবচেয়ে আশ্চার্য লাগল যখন দেখলাম আমার প্রিয় বন্ধুর এক নিকটাত্মীয়ার ছবি দিয়ে তার নামের শেষে একটি অশ্লীল শব্দ যোগ করে ফেসবুক আইডি তৈরি করা হয়েছে । যখন আমি তাকে বন্ধুর তালিকায় যোগ করেছিলাম তখন এমনটা ছিল না । প্রোফাইলে ঘুরে যে অভিজ্ঞতা হল তা খুবই তিক্ত । প্রোফাইলে যে ছবিগুলো আপলোড করা হয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগ দেশী বিদেশী বিভিন্ন অভিনেত্রীদের অর্ধ উলঙ্গ ছবি । সেসব ছবিতে শত শত লাইক এবং উষ্ণ শব্দমালার মন্তব্য । প্রোফাইলে একটি মোবাইল নাম্বারও দেয়া আছে । আমি তাৎক্ষনাৎ ফোন দিলাম । ফোনটা রিসিভ করলেন একজন ভদ্রমহিলা । কণ্ঠ শুনে মনে হল সে আমার পরিচিত কিন্তু প্রথমে আমি তার কাছে পরিচয় না দিয়ে তার নাম্বারটা এখানে যোগ করার কারন জিজ্ঞাসা করলাম । তার বাক্যে স্পষ্ট বিরক্তির সুর এবং তিনি খুব রাগন্বিত অবস্থায় আছেন সেটা বুঝতে বাকি রইল না । অবস্থা বেগতিক দেখে আমি পরিচয় দিলাম । এরপর তিনি যা বলল তার সারাংশ হল, আমার ফোনটা লাইন পাওয়ার কয়েক মিনিট পূর্বে কাতার প্রবাসী বাংলাদেশী এক যুবক তাকে ফোন দিয়েছিল এবং এভাবে দিনের বেশিরভাগ সময়েই তার নাম্বারে দেশ-বিদেশ থেকে কল, মিসকল আসতে থাকে । ঠিকমত ঘুমাতেও পারেন না । তিনি যে সিম অপরাটেররের সদস্য সে অফিসেও যোগাযোগ করেছিলেন কিন্তু এক্ষেত্রে তাদেরও বিশেষ কিছু করার নাই বলে জানিয়ে দিয়েছে । এ ভদ্র মহিলার সন্তানেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং আত্মীয়-স্বজনেরা দূর দূরান্তে থাকার পরেও আমি তাকে সিমটি বন্ধ করে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে তার থেকে বিচ্ছিন্ন হলাম । এরপর ছবির এক অচেনা রুপবতীকে বন্ধুত্বের তালিকা থেকে রিমুভ করার আগে তার ওয়ালে একবার ঢুঁ মারলাম । তিনি ওয়ালে যে স্টাটাস দিয়েছেন তাতে শব্দমালা যাই হোক না কেন তাতেই হাজার লাইক এবং শত কমেন্ট । গোটা প্রোফাইল ঘুরে আমি নিশ্চিত হলাম এটা ফেক আইডি । সেখানেও একটি মোবাইল নাম্বার দেয়া আছে । সেটাতে ফোন দিলাম । যিনি ফোন রিসিভ করলেন তার কণ্ঠ শুনে মনে হয়েছে তিনি ষাটোর্ধ বৃদ্ধা । তাকে বিশেষ কিছু জিজ্ঞাসা করতে সাহস হচ্ছিল না কেননা তার ভাষায় যথেষ্ঠ অস্পষ্টতা রয়েছে এবং তিনি গ্রাম্য ভাষায় কথা বলছিলেন । তবুও অনেক অপ্রাসাঙ্গিক কথা বলে তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে চেষ্টা করছিলাম যাতে মূল কথায় আসতে পারি । অবশেষে অবস্থা যখন অনুকূল হল তখন তার কাছে ফেসবুকে তার নাম্বার কেমনে আসল তার কারন জিজ্ঞাসা করলাম । তিনি যা বললেন তার মূল বক্তব্য হল, মাস খানেক হল বিভিন্ন ছোকরার মাধ্যমে ফেসবুকের নাম শুনছেন । এটা আসলে কি সেটা তিনি জানেন না । তার ছেলে সৌদিতে যাওয়ার পূর্বে তাকে মোবাইল কিনে দিয়ে গেছে । ছেলে মাঝে মাঝে তার কথা বলেন । ছেলে যখন ফোন দিতে বিলম্ব করেন তখন তিনি ইচ্ছা থাকলেও ছেলেকে ফোন দিতে পারেন না । কেননা তিনি শুধু কল রিসিভ করতে পারেন কিন্তু কাউকে কল দিতে পারেন না । বিভিন্ন অপরিচিত নাম্বার থেকে প্রায়ই তাকে ফোন দেয় তবে তার সাথে কেউ বেশি কথা বলেন না । তিনি ঠিকমত নামাজও পড়তে পারেননা । নামাজে দাঁড়ানোর মধ্যেও ফোন আসে এবং তিনি তার ছেলের ফোন ভেবে দৌঁড়ে গিয়ে রিসিভ করে যখন বুঝেন অন্য কারো ফোন তখন কেটে দেন কিংবা তারাই কেটে দেন । ঠিকমত ঘুমাতেও পারেন না ।
এরপর বন্ধুত্বের তালিকা থেকে যাদেরকে রিমুভ করেছি তাদেরকে আর ফোন দেয়ার সাহস হয়নি । নিজের উপর ঘৃণা জন্মেছে কারন এদের মত কুলাঙ্গরদের বন্ধু হিসেবে গ্রহন করেছিলাম । যারা আমার মূর্খতার সুযোগ নিয়ে বন্ধু হয়েছিল । শুধু এ ধরনের অপরাধই নয় বরং আরও মারাত্মক কিছু অপরাধের মাধ্যম হিসেবে আজকাল ফেসবুক ব্যবহার হচ্ছে । বছর খানেক পূর্বে ফেসবুক সম্পর্কীয় সরকারের একটি খবর পাঠের পর ফেসবুকের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে সরকারকেও অসহায়ন মনে হয়েছে । খবরটি ছিল, সরকার দেশের কয়েক ব্যক্তির তথ্য চেয়ে ফেসবুকের কাছে চিঠি দিয়েছে । খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, পতিতাবৃত্তিসহ সকল অপরাধের একাংশ ফেসবুকের মাধ্যমে হচ্ছে । ফেসবুকের মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে নিরন্তর হুমকি দেয়া হচ্ছে । বিভিন্ন মহল সম্পর্কে মিথ্যা, বানোয়াট এবং কুরুচিপূর্ণ তথ্য ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্র হিসেবেও ফেসবুক প্রধান মাধ্যম । উত্যক্তসহ মেয়েদেরকে বিভিন্নভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা এবং বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কেও বিচ্ছিন্ন তথ্য ছড়ানোর জন্য ফেসবুকের অপব্যবহার করা হচ্ছে । অথচ ফেসবুকের নানাবিধ অপব্যবহার বন্ধে সরকার পুরোপুরি নিরুপায় । বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই কমবেশি ফেসবুকের সদস্য থাকলেও মাত্র ২৫টি দেশে ফেসবুকের আঞ্চলিক অফিস আছে । সম্প্রতি ফেসবুকের পক্ষ থেকে বাংলাদেশেও একটি আঞ্চলিক অফিস করার আলোচনা শোনা যাচ্ছে । ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এবং সরকারেরর যৌথ প্রচেষ্টায় এটি যত শীঘ্র স্থাপন করা যায় তত মঙ্গল । বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে ফেসবুক আসক্ত হয়েছে তাতে বাংলাদেশের প্রেক্ষপটে ফেসবুকের বিরুদ্ধে মারত্মক কোন বিধান চালু করা সম্ভব নয় । তবে এটার ব্যবহারকারীদেরকে একটি বিধানের আওতায় আনা আবশ্যক । সরকার যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয় তবে অসংখ্য বেকারের কর্ম সংস্থান যেভাবে সৃষ্টি করা যাবে তেমনি বিভিন্ন মারাত্মক অপরাধের হাত থেকেও পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র রক্ষা পাবে । বিশেষ করে বিভিন্ন কর্মকর্তা, বিশেষ সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গ, ভদ্র মহিলাদের মোবাইল নাম্বারের অপব্যবহার করে যেভাবে তাদেরকে বিরক্ত করা হয় তার কবল থেকে তারা মুক্ত থাকবেন । আমার মা কিংবা বোনকে কেউ বিরক্ত করলে আমার যেভাবে খারাপ লাগে অন্য কারো মা কিংবা বোনকে বিরক্ত করলে তারও ঠিক সেভাবে খারাপ লাগে । এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন সকলে নৈতিক বিবেক জাগ্রত হওয়া । তারপরেও বলতে হচ্ছে, প্রাকৃতিক ভাবে সকলের নৈতিক বিবেক জাগ্রত হবে না । কাজেই কঠোর আইনের মাধ্যমে অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে । ফেসবুক ব্যবহারের জন্য যদি নির্দিষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করা হয় তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কেউ হত্যার হুমকি দেয়ার সাহস পাবে না । কর্তৃপক্ষ যদি এ ব্যাপারে একটু ভাবেন তবে কৃতার্থ হব এবং সব মানুষের সব ধরনের নিরাপত্তা রক্ষা পাবে । দেশের মানুষকে অন্যান্য ক্ষেত্রে পূর্ণ নিরাপত্তা না দিতে পারলেও যেন তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক নিরাপত্তা দেয়া যায় তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী জানাচ্ছি ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ও সাংবাদিক ।
বিষয়: বিবিধ
৯৫৯ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন