দোষারোপের সংস্কৃতিমুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া জরুরী

লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ৩০ আগস্ট, ২০১৪, ১০:৪৪:২১ রাত

দেশের স্বাধীনতার বয়স চার দশক পেরিয়েছে । কয়েক দশক পূর্বের একটি ভঙ্গুর, বিভক্ত দেশ স্বনির্ভরতার পানে যাত্রা পথে । অনেক চড়াই-উৎড়াই, বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে পাল্লা দিয়ে দেশ তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে একদিন পৌঁছবেই । দেশের অগ্রযাত্রার পথের বাধাগুলোর ভিত্তিমূল পোক্তভাবে প্র্রথিত হওয়ায় উন্নয়নের জোয়ার ততোটা বইছে না যতোটা ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছে । তবুও দেশের অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধির গতিকে ছোট করে ব্যাখ্যা করার কোন উপায় নাই । আমরা যদি আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত কিংবা অন্য কোন উন্নত রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সামগ্রিক রুপের তুলনা করি তবে নিজেদের অবস্থানকে একটু অসহায় বলে মনে হয় এবং বিভিন্ন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে না পারার ব্যর্থতার বিবেচনায় খানিকটা আফসুসও লাগে । তবে যখন আমাদের চেয়ে নিম্নমানের রাষ্ট্রগুলোর সাথে নিজেদের অবস্থান মেলাই তখন নিজেদেরকে অনেকটা বাবু বাবু মনে হয় । আজ বাংলাদেশের মানুষের যে অবস্থা তার পিছনে অনেকগুলো অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত দায়ী । আমাদের দেশের এ বেহাল অবস্থা থাকতো না যদি আমাদের নেতৃত্বদানকারী বিভিন্ন মতাদর্শের ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সমন্বয়ী মনোভাব কিংবা আস্থা থাকত । এক্ষেত্রে শাসকদের চেয়ে দূর্ভাগ্য জনগণের বেশি কেননা জনগণ এ যাবৎ যাদেরকে তাদের শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত করেছে তাদের অনেকেই জনগণ কিংবা রাষ্ট্রের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি কিংবা দলের স্বার্থকে বড় করে দেখেছে । আবার অনেকে দেশের উন্নয়নের চেয়ে নিজেদের আখের গোছানোর কাজকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে । সকল শাসকের ক্ষেত্রে এমন অধঃপতন না হলেও যাদের খোঁজ পাওয়া গেছে কিংবা যাচ্ছে তাদের সম্পত্তির উর্ধ্বগতির যাত্রা দেখলে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক হুঁশ না হারিয়ে গত্যন্তর নেই । শাসনক্ষমতার কোন অংশে দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়া কিংবা জনগণের ভাগ্য বদলানোর জন্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশের কর্তৃত্ব পাওয়ার পরে জনগণের ভাগ্য বদলাতে না পারলেও নিজেদের ভাগ্য রাতারাতি বদলে ফেলেছেন অনেকেই । কয়েক যুগে যে কাজ সম্ভব হয়নি তা ক্ষমতালাভের মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তাদের সম্পত্তি বেড়ে গেছে হাজার গুনেরও বেশি । ছোট্ট বেলায় ঠোটস্থ করা ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ বাগধারাটিও যেন এদের সাথে বেমানান । কলাগাছের তুলনায়ও এরা অনেক বেশি হৃষ্টপুষ্টতা অর্জন করেছে । যাদের ভাগ্য বদলানোর শপথ নিয়ে শাসনক্ষমতায় আরোহন করেছেন তারা দুই বেলা খেতে না পারলেও এ সকল সৌভাগ্যবানরা! ঠিকই গলায় গলায় খেয়ে নিজেদেরকে খোদা প্রদত্ত জীবনকালের চেয়েও যেন আরও বেশিদিন পৃথিবীতে রাখার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে শক্তি অর্জন করছে । সুযোগ আসলে হয়ত অমরত্বও গ্রহন করবে ! এসকল ব্যক্তিরা যে সব সময় খাদ্য খাচ্ছেন তাও নয় বরং কখনো সখনো কু-খাদ্য খেয়ে সমাজকে একটু আধটু প্রগতির ছোঁয়াও দিচ্ছেন !

আমার দূর্ভাগ্য মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি আবার সৌভাগ্য যে ঐ সময় আমার জন্ম হয়নি । তাহলে এখন অনেক মিথ্যা গল্প শুনতে হত এবং নাটক দেখতে পারতাম না। দেশের স্বাধনীতার জন্য এদেশের আপামর জনগোষ্ঠির বৃহৎ অংশটি তাদের সর্বস্ব উজাড় করেছে । কেউ রণাঙ্গনে বীর বেশে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছে আবার কেউবা গাজীর খেতাব নিয়ে আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছে । দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পর পর্যন্ত স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস হয়ত জানা যেত । কিন্তু সময় বদলেছে । মাঝে মাঝে সরকারও বদলাচ্ছে । সরকার বদলের সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও বদলে যাচ্ছে । অন্যান্য দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির কথা ভূলেও শুনতে পাওয়া না গেলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গল্পে অনেক পরিবর্তন এসেছে । ইতিহাস বিকৃতির এ জঘন্য কার্যক্রম যে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিদের উদ্যোগে হচ্ছে তাও নয় বরং যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ করেছে সেই তাদের পক্ষ থেকেই ইতিহাসের বিকৃতি হচ্ছে । ইতিহাসের এ পরিবর্তনকে বিকৃতি না বলে স্বাধীনতাকে নিজেদের করে নেয়া বললে সম্ভবত একটু শ্রুতি মধুর হয় । দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসকে দু’ব্যক্তির কাছে বন্ধি করে রাখা হচ্ছে । এটাও দোষের নয় যদি সেটা সঠিকভাবে রাখা হত । সরকার বদলের সাথে মুক্তিযুদ্ধের গোটা কৃতিত্ব ঐ দলের প্রাণ পুরুষের নামে উৎসর্গ করা হচ্ছে । সাধারণ নাগরিক হিসেবে ঐ দুই মহান ব্যক্তির অবদানকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই এবং তাদের অবদানের মাত্রায় কমবেশি আছে তাও অজানা নয় কিন্তু যখন একজন ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অন্যজনকে ধুলায় ধূসরিত করা হয় তখন মনে নানা প্রশ্ন জাগে । যাদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের সঠিক গল্প জানা যাবে তারাও দলকানা হয়ে যাওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসের একাংশ দিনে দিনে আড়ালে চলে যাচ্ছে । এভাবে চলতে থাকলে দেশের মুক্তিযুদ্ধ থাকবে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য যারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে তাদের অস্তিত্ব থাকবে কিনা সন্দেহ । দেশের দু’টো রাজনৈতিক দলের দু’জন মহৎ ব্যক্তিকে নিয়ে এমনভাবে টানাহেচড়া করা শুরু হয়েছে, যার কারনে যখন যে দল ক্ষমতায় আরোহন করে তখন সেই দলের প্রাণ পুরুষকে মুক্তিযুদ্ধের সকল গরিমা পরিয়ে দেয়া হয় এবং অন্য ব্যক্তিটিকে বিতর্কে জড়িয়ে খলনায়কে পরিনত করা হয় । এ ক্ষেত্রে দু’টো দলের কেউ কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই ।

যারা দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করেছে তাদেরকে না হয় বাদ দিলাম কিন্তু দেশের মধ্যে যারা বিভিন্ন মতাদর্শের আলোকে রাজনীতি করে তাদের অবস্থা কি ? সরকারী দল, বিরোধী দল কিংবা বৃহৎ দলের কেউ কাউকে ছাড়িয়ে যাবার নয় । যারা রাজনীতির মাঠে সক্রিয় আছে তার একজনের সমালোচনা অন্যজন গণতান্ত্রিকভাবে অবশ্যই করতে পারেন এবং এ প্রকার সমালোচনা গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রের উন্নয়ণের জন্য আবশ্যিক । তবে সমালোচনায় যখন অশ্লীল শব্দের প্রয়োগ কিংবা ভাষার মাধুর্য্যরে খেই হারিয়ে তা গালির পর্যায়ে চলে যায় তখন এ ধরনের শব্দ কিংবা বাক্য ব্যবহৃতরা বিব্রত না হলেও সাধারণ মানুষকে বিব্রত হতে হয় । আমাদের মত সাধারণ মানুষের বুদ্ধির গন্ডিও সাধারণ পর্যায়ের । যার কারণে বিশাল জনপ্রিয় নেতা-নেত্রী সম্পর্কে এমন কিছু ধারণার সৃষ্টি হয় যা থেকে বের হয়ে নিরপেক্ষ মতামত ব্যক্ত করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে । যারা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির সাথে জড়িত তাদের অনেকেই অনেক জনপ্রিয় এবং সর্বদা দেশের কল্যানের কথা চিন্তা করেন । তবে এ সকল নেতাদের একজনও বঙ্গবন্ধু কিংবা জিয়াউর রহমানের মত জনপ্রিয়তা কোনদিনই পাবেন না । রাজনৈতিক বিচারে বঙ্গবন্ধু কিংবা জিয়াউর রহমানের চেয়ে অনেকেই প্রজ্ঞাবান হতে পারেন । কেননা সক্রেটিসের পরেই প্লেটোর জন্ম হয়েছিল । রাজনীতিতে এমন ক্রমান্বয় অস্বাভাবিক নয় । তবে বঙ্গবন্ধু কিংবা জিয়াউর রহমান রাজনীতির সাথে দেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক অবদান রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন । এ দু’জন মহান নেতার রাজনৈতিক সফলতা বিফলতা বাদ দিয়েও যদি এদের শুধু দেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাপকাঠিতে বিচার করা হয় তবে এদের গুন ও অবদানের সাথে পাল্লা দেয়া যাবে এমন নেতা জীবিত অবস্থায় কে আছে ? অথচ এই মহান নেতাদের রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষের কিছু নেতা নামধারী পাতি নেতা সময়ে অসময়ে এমন সব সমালোচনা করেন যার মাধ্যমে সমালোচকদের জ্ঞানের দৌরত্ম সহজেই অনুমেয় হয়ে পড়ে । যে মহান নেতাদের রাজনৈতিক শিষ্য হওয়ার যোগ্যতা নেই অথবা যাদের কাছ থেকে রাজনীতির হাতেখড়ি কিংবা যাদের একটু সহচর্য পেয়ে রাজনীতি শুরু করেছে তাদের সমালোচনা করে নিজের বুদ্ধির এবং নেতৃত্বের পরাঙ্গমতা দেখিয়ে নিজের কাছে যোগ্য হওয়া যায় কিংবা চামচাদের কাছে থেকেও হাততালি এবং উষ্ম সম্ভাষণ পাওয়া যেতে পারে তবে তা যৌক্তিক বিচারে কোন অবস্থাতেই ভালো কাজের মানদন্ডে পড়ে না । সহজ ভাবে বললে বলতে হবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সমালোচনা করার মত কোন গুনী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশে জীবিত নেই এবং এমন কোন ব্যক্তি ভবিষ্যতে আসবে কিনা তাও সন্দেহ ।

গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকার বদল করে বিভিন্ন সময়ে যারা দেশের জনগণের রায়ে দেশের সরকার গঠন করেছে অর্থ্যাৎ ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত যে দলগুলো সরকার গঠন করেছে তাদের বাইরে নতুন কোন দলকে দেশের শাসনক্ষমতায় দেখার সম্ভাবনা ক্ষীন এবং আপাত দৃষ্টিতে দরকারও নেই । তবে এ সময়ে যারা সরকার গঠন করেছে তাদেরকে অতীতেকৃত ভূলগুলো নিজ প্রয়োজনে না হলেও অন্তত দেশের প্রয়োজনে শোধরাণো উচিত । অযথা বিতর্ক সৃষ্টি করা কিংবা বিতর্কহীন মানুষকে বিতর্কে টেনে আনার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে নিজেদের অর্জন এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনার আশার বানী শুনিয়ে জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নেয়াই গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধর্ম। এমন কোন ভাবে কাউকে সম্মোধন করা উচিত নয় যাতে নিজের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে । একজন ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা অবলীলায় যখন দেশের প্রধানের সমালোচনা করে তখন ধরে নেয়া হয় ঐ নেতার জ্ঞান গরিমার সীমাবদ্ধতার কারনে এমনটা হচ্ছে কিন্তু যখন দায়িত্বশীলরা দায়িত্বশীলদের কিংবা সরকারী দল বিরোধী দলের অথবা বিরোধী দল সরকারী দলের অগণতান্ত্রিক পন্থায় সমালোচনা করেন তখন দেশের মানুষদের কাছে যাকে সমালোচনা করা হয় তার চেয়ে সমালোচনাকারীকে বেশি দোষী করে তোলে । জনগণ নিরুপায় । সমালোচনাকে বিশ্লেষন করার যৌক্তিক মানদন্ডের হাতিয়ার তারা হারিয়ে ফেলেছে কিংবা কেড়ে নেয়া হয়েছে কিন্তু সমাজের সবাই যদি খেই হারিয়ে ফেলে তবে তা তো আগামীর জন্য বড্ড মুশকিলের হবে । কাজেই সকল রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের বিশেষ করে নেতাদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান, যেন গঠনমূলক সমালোচনা করা হয় । যে সমালোচনা দেশের মঙ্গলের জন্য প্রয়োজন তা অবশ্যই করতে হবে । যদি এ ধরনের সমালোচনার প্রতি কোন নগ্ন হস্তক্ষেপ আসে তবুও ক্ষান্ত হওয়া যাবে না । কিন্তু এমন কোন সমালোচনা করা উচিত নয় যার কারনে শুধু দেশের অভ্যন্তরেই সমস্যার সৃষ্টি হয়না বরং দেশের বাহিরেও দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয় । সুতরাং অচিরেই যেন সকল প্রকার দোষারোপের সংস্কৃতিমুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে বের হয়ে দেশের মঙ্গল এবং কল্যানের কথা চিন্তা করে সামনে আগানোর সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয় এবং দেশের স্বার্থেই দেশের কিছু মহান ব্যক্তিকে বিতর্কমুক্ত রাখা আবশ্যক ।

রাজু আহমেদ । লেখক ও সাংবাদিক ।



বিষয়: রাজনীতি

৭৭৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File