শোকের মাসে জন্মদিনের কিছু কথা
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ১৪ আগস্ট, ২০১৪, ০৭:০০:২১ সন্ধ্যা
আগষ্ট এলেই মনের ভিতরটা হুহু করে কেঁদে ওঠে । কষ্টে যন্ত্রনায় যেন নিজেকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলি । এ মাসে দেশের মানুষ এমন কিছু মহান মহীয়সীদেরকে হারিয়েছে যাদের শূণ্যস্থান কোনদিনও পূরন হবার নয় । আগষ্ট মাসে যারা স্বাভাবিক কিংবা অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যু বরণ করেছে তাদের মধ্যে যেমন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কবি সাহিত্যিক, সাংবাদিক আছেন তেমনি রয়েছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং শিক্ষক । সবার মৃত্যুই তাদের স্ব স্ব স্থানে শূণ্যতার সৃষ্টি করেছে । কাউকে না কাউকে নিভৃতে কাঁদিয়েছে কিংবা এখনো কাঁদায় । বিভিন্ন বছরের আগষ্ট মাস জুড়ে যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের সকলের কথা উল্লেখ না করলেও অন্তত ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের স্ব-পরিবারে নিহত হওয়া, ১৯৪১ সালের ৭ই আগষ্টে আমাদের আত্মছবির নিপুণ রুপকার রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু, ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগষ্ট বাঙালীর প্রাণের কবি ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু, ২০০৬ সালের ১৭ই আগষ্ট আধুনিক বাংলা কবিতার বরপুত্র কবি শামসুর রহমানের মুত্যু, ২০০৪ সালের ১১ই আগষ্ট বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক কবি হুমায়ুন আজাদের মৃত্যু, ১৯০৮ সালের ১১ই আগষ্ট ফাঁসির রজ্জুতে দেশপ্রেমিক ও বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর মৃত্যু এবং ২০১১ সালের ১৩ই আগষ্ট এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ও চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ নিহত হন । এদের প্রত্যেকের মৃত্যুই দেশবাসীকে শোক সাগরে ভাসিয়েছিল । তবে আগষ্ট মাসে যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের গুরুত্ব এবং অর্জনভেদে দুঃখ কিংবা শোকের মাত্রা কমবেশি হওয়া অস্বাভাবিক নয় । বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশকে স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা যেমন কোন অবস্থাতেই অস্বীকার করার উপায় নেই তেমনি ক্ষুদিরামের মত বিপ্লবীরা যদি হাসি মূখে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়ানোর সাহস না করত তবে বৃটিশ কলোনী থেকে পাকিস্থানের কিংবা পাকিস্থান থেকে বাংলাদেশের জন্মের কথা বাস করত কল্পনায় । ইতিহাসের চেইন টেনে নিছক বিতর্ক টেনে কারও গুরুত্ব কিংবা মর্যাদা কমবেশি করা অর্থবহ নয় । সাহিত্যে সম্মৃদ্ধির জন্য যেমন নজরুল, রবীন্দ্রনাথদের প্রয়োজন ছিল তেমনি পাকিস্থানের শোষণ থেকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অস্বীকার করা গাদ্দারীর নামান্তর । স্বাধীনতার সময় যুদ্ধ করার শক্তি সমার্থ লাখো মানুষের ছিল কিন্তু সকল যোদ্ধাকে সমন্বয় করে প্রেরণা এবং কৌশল দেয়ার নেতৃত্বের গুনাবলী কেবল শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল । সকল দল মতের উর্ধ্বে অবস্থান করে একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তা এবং বলিষ্ট নেতৃত্বের কল্যানেই আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি । তবে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করছি সেটা কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ ?
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট এক কালোরাতে কয়েকজন বিপথগামী সেনা সদস্য এবং সেনা অফিসারের হাতে বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা নিহত হন । নিহতের তালিকায় যেমন ছিল বঙ্গবন্ধুর সহধর্র্মীনি, পুত্র, পুত্রবধু তেমনি বঙ্গবন্ধুর ভাগিণা এবং তার গর্ভবতী স্ত্রীসহ ছিল আরও অনেক । দুর্বৃত্ত্বদের নির্মম বুলেটে শেখ মুজিবুর রহমানের ৪ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেলকে যেমন রেহাই দেয়নি তেমনি আব্দুল্লাহ সেরানিয়াবাতের ৪ বছরের নাতি সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবুও রক্ষা পায়নি । কুলাঙ্গার সেনারা বঙ্গবন্ধু পুরো পরিাবার ও আত্মীয় স্বজনের মধ্য থেকে ২৬ জনকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল । রাসেলের মত নির্দোষ শিশুর বুকেও গুলি চালানোর সময় হায়েনাদের হাত একাবারও কাঁপে নি । বরং রাসেলকে হত্যার সময় তারা নাকি বলেছিল এটা বেঁচে থাকলেও সমস্যা । ভাগ্যগুনে পড়াশুনার জন্য জার্মানীতে অবস্থান করার কারনে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছোটবোন শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন । বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পিছনে হায়েনাদেরকে কারা প্রলুব্ধ করেছিল তার সঠিক প্রমাণ আজও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি তবে হত্যাকান্ডের প্রায় তিনযুগ পর নবম জাতীয় সংসদের সরকার বঙ্গবন্ধু এবং তার পবিারের সদস্যদের হত্যাকারীদের মধ্য থেকে কয়েকজন দোষীকে শাস্তির মুখোমুখি করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি ঋণের কিয়দাংশ পরিশোধ করার জাতি সুযোগ পেয়েছে তবে এখনো অনেক আসামী ধরাছোঁয়ার অন্তরালে রয়ে গেছেন । বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সেনা হিসেবে সরকারের কাছে দাবী, যেন বঙ্গবন্ধুর বাকী হত্যাকারীদেরকেও অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তির মূখোমূখি করা হয় এবং কোন কারণে তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল তার সঠিক রহস্য উম্মোচন এবং এর পিছনে যদি কোন দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র থাকে তবে সে ষড়যন্ত্রে কারা জড়িত ছিল তাও যেন প্রকাশ করা হয় । বিশেষজ্ঞদের একাংশের ধারনা, ‘১৯৭৫ সালের ২৪ শে জানুয়ারী বাংলাদেশ সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীবলে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় এবং দেশের সমগ্র রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতালীগ) নামক একক রাজনৈতিক দল গঠন করা হয় । সংবিধানের এ সংশোধনীর মাধ্যমে অন্যান্য রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ কিংবা বিলুপ্ত করার কারনেই বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের উপর এহেন নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করা হয়’ । তবে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পিছনের এ সকল ব্যাখ্যাই ধারনাকৃত । কাজেই বর্তমান সরকারের উচিত এ হত্যার আসল রহস্য খুঁজে তা জনগণের সামনে উম্মোচিত করে কিছু মানুষের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভূল ধারণা ভেঙ্গে দিয়ে তাকে সর্বজনগ্রাহ্য করা ।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহযোদ্ধা ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশের অন্যতম সফল প্রেসিডেন্ট মরহুম জিয়াউর রহমানের সহধর্মীনি ১৯৪৫ সালের ১৫ই আগষ্ট জন্ম গ্রহন করেন । যিনি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন । প্রতি বছরের ন্যায় এবারও তিনি উৎসব করে অনাড়ম্বর পরিবেশে তার ৭০তম জন্ম বার্ষিকি পালন করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যদিও আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে বারবার দাবী করা হচ্ছে ১৫ই আগষ্ট খালেদা জিয়ার সঠিক জন্মদিন নয় । বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা অনুরোধ করেছেন ১৫ই আগষ্ট জন্মদিন পালন না করার জন্য । আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে এমনও বলা হয়েছে, ‘যারা ১৫ই আগষ্ট জন্মদিন পালন করে তারা জাহান্নামের কীট’ । তবুও বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জন্ম উৎসব পালন করা থেকে পিছপা হননি এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বুকে ছুড়ি চালানোর মত কষ্ট থেকে তাকেও মুক্তি দেননি ।
স্বাভাবিক দৃষ্টিতে জাতীয় শোক দিবসে উৎসব করে জন্মদিন পালন করা বেমানান । কিন্তু যাদের শোক এবং যাদের জন্মবার্ষিকি তাদের মধ্যে সুড়িত-পিড়িত আছে কতটুকু ? শেখ হাসিনাসহ জাতির কাছে বঙ্গবন্ধু যত মূল্যবান তার চেয়ে খালেদা জিয়ার কাছে তার প্রয়াত স্বামী জিয়াউর রহমান কিংবা তার পুত্র তারেক রহমান কোন অংশে কম মূল্যবান নন । বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পিছনে যদি বঙ্গবন্ধুর ৭০% ভূমিকা থাকে তবে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ছিল ৩০% । সেই জিয়াউর রহমানের কবরকে বারবার বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপের কথা বলা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে কিংবা তারেক রহমানকে দীর্ঘ আটবছর তার মায়ের কাছে এবং জন্মভূমিতে ফিরে আসার সুযোগ দেয়া হয়নি । কাজেই আওয়ামীলীগ কিংবা প্রধানমন্ত্রী অনুরোধ করলেই খালেদা জিয়া তার জন্মদিন পালন থেকে বিরত থাকবেন এটা ভাবা কিছুটা হলেও অযৌক্তিক ।
কথায় বলে, কারো পৌষ মাস আবার কারো সর্বনাশ । ভারতের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহায়তায় আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি । ভারতের সাথে বাংলাদেশের বিশেষ করে আওয়ামীলীগের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ । তাই বলে কি ১৫ই আগষ্ট বাংলাদেশের শোক দিবসে তারা তাদের স্বাধীনতা উৎসব থেকে বিরত থাকবে ? খালেদা জিয়া হয়ত আরও কয়েক বছর বাঁচবেন । আমাদের দেশে সাধারণত জীবিত মানুষের জন্মদিন যেভাবে ঘটা করে পালন করা হয় তেমনিভাবে মৃত্যু মানুষের জন্মদিন পালন করা হয়না । মৃত্যু মানুষের জন্মদিন কেবল নামকাওয়াস্তে পালন করা হয় । কিন্তু ১৯৭৫ সাল পরবর্তী সময়ে যে সকল শিশুরা জন্মগ্রহন করেছে তারা কি জাতীয় শোকের কারনে জন্মদিন পালন করবে না ? নাকি তাদের জন্মদিনের উৎসব আইনের মাধ্যমে স্থগিত রাখা হবে ?
কারও প্রতি ভালোবাসা কিংবা বিতৃষ্ণা কেবল মনের ব্যাপার । কারো শোকে ব্যাথাতুর হওয়া কিংবা কারো খুশিতে প্রাণোচ্ছল হওয়াও হৃদয়ের টানের মধ্যে সীমাবদ্ধ । সুতরাং নিজেদের মধ্যে দুরত্ব সৃষ্টি কিংবা মনোমালিন্যতা বাড়ানো নিরর্থক । সার্বজনীনভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু বার্ষিকীতে এদেশের মানুষ তার রুহের মাগফেরাতের জন্য দোয়া কামনা করে আবার অন্য একপক্ষ খালেদা জিয়ার দীর্ঘায়ু কামনা করেন । যাকে যার ভালো লাগে তাকে নিয়েই যেন সে থাকতে পারে । একজনের মৃত্যুদিনে আরেকজন হাসবে না এতটা উদার আমাদের দেশের মানুষ নয় । শোকের দিনে সারাদিন গম্ভীর হয়ে বসে থাকারও কোন অর্থ নেই কিংবা খুশির দিনে সারাদিন নেচে গেয়ে কাটানোরও কোন যৌক্তিকতা নাই । আবেগ দিয়ে জীবন চলার দিন এ শতকে আর নেই । বাস্তবতা এবং গতিই যেন এ যুগের সব ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
বিষয়: রাজনীতি
১৩১৬ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আর সর্বোপরি শোকতো দূরের কথা অনেকের কাছেতো সেটা আনন্দের দিনই মনে হতে পারে,কেউ জোর করে তাকে রুপান্তরিত করা সম্ভব নয়!
মন্তব্য করতে লগইন করুন