বিরতিহীনভাবে পরীক্ষাগ্রহন শিক্ষাবান্ধব সিদ্ধান্ত নয়
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ১২ জুলাই, ২০১৪, ০৮:৩৩:৪৪ সকাল
গত কয়েকমাস ধরে দেশের অন্যতম আলোচ্য ইস্যু হয়ে ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি। দেশের প্রায় সকল মানুষ সম্পূর্ণভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টিতে একমত হলেও কেবল মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এটা মানতে নারাজ। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর মতে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোন প্রমান পাওয়া যায় নি। তিনি যে ঢালাওভাবে অস্বীকার করছেন তা নয়। তার মতে, গত পাঁচ বছরে মধ্যে কেবল চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের ইংরেজী দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। এজন্য তিনি কার্যকরী ব্যবস্থাও গ্রহন করেছেন। যথাদ্রুত সম্ভব তিনি পরীক্ষা স্থগিত করেছেন এবং নতুন প্রশ্নপত্র প্রনয়ণ করে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী জনাব নুরুল ইসলাম নাহিদ স্যার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে নিশ্চিত না হলেও পরীক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের ভিন্নমত। তাদের মতে, প্রশ্নফাঁস ব্যতীত কোন পাবলিক কিংবা প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষ অনুষ্ঠিত হয় না। তাদের যুক্তির পক্ষে তারা শক্ত কিছু প্রমাণও উপস্থাপন করেছেন। বিশেষ করে কথাসাহিত্যিক জাফর ইকবাল স্যার এ ব্যাপারে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছেন। অবশেষে সবার দাবীর মূখে শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় বিরোধিতা করেননি। সবার দাবী পূরণের লক্ষ্যে তিনি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করে নিশ্চিত হতে চেয়েছেন আসলেই দেশে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায়সমূহে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় কিনা। শিক্ষামন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসান ও অর্থ) সোহরাব হোসাইনের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি নিরলস পরিশ্রম করে এ ব্যাপারে ১২৬ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে এবং গত ২৯শে জুন রবিবার সেটা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে সমর্পণ করে। তদন্তকারী দল প্রশ্নফাঁসের ব্যাপারে সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেন এবং প্রশ্নফাঁসের উৎস, রোধ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহন এবং ভবিষ্যতে প্রশ্নফাঁস বন্ধের উপায় নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে কতগুলো সুপারিশমালা লিপিবদ্ধ করেন। গত ২রা জুলাই বুধবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী তদন্ত প্রতিবেদনটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তার আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বলেন,‘পাবলিক পরীক্ষার মধ্যে ছুটির দিন ছাড়া অন্য কোন বন্ধ রাখা হবে না’। তার মতে, দেড় মাস ধরে পরীক্ষা নেয়া আর সম্ভব না। কেননা মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় তার ছাত্রজীবনে মাত্র পাঁচ দিনে পরীক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী মনে করেন, বিরতিহীনভাবে পরীক্ষা গ্রহন করলে প্রশ্নফাঁসের ব্যাপারটি আর ঘটবে না। এছাড়াও তিনি তদন্ত প্রতিবেদনে যে সুপারিশগুলো স্থান হয়েছে সেগুলো গ্রহন করার আশ্বাস দেন।
বিরতিহীনভাবে পরীক্ষা গ্রহনের ব্যাপারে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যের পরেই দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। তারা কোন মতেই শিক্ষামন্ত্রীর এ সিদ্ধান্তটি মেনে নিতে রাজি নয়। শিক্ষামন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যের পরেই শিক্ষার্থীরা ব্যানার, ফেস্টুন হাতে দেশব্যাপী মানববন্ধন করছে এবং শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যটি তুলে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। শুধু শিক্ষার্থীরা নয় সাথে তাদের অভিভাবকরাও মানববন্ধনে অংশ নিচ্ছেন। তাদেরও একদাবী, কোন অবস্থাতেই বিরতিহীন পরীক্ষা গ্রহন করা চলবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সকল স্কুল কলেজ রমজান মাসে বন্ধ থাকায় সকল শিক্ষার্থীরা একতাবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নামতে পারছে না তবে ঈদের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পুণরায় খোলার সাথে সাথে তারা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে রাস্তায় নামার ঘোষণা দিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকলেও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া কিছু শিক্ষার্থীরা যোগাযোগ করে বিভিন্নস্থানে একত্রিত হয়ে প্রতিনিয়ত সরব এবং নিরবভাবে তাদের দাবী প্রকাশ করে যাচ্ছে। ফুটবল বিশ্বকাপ ম্যানিয়ায় ইলেকট্রনিক্স এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় শিক্ষার্থীদের দাবীর কথা সেভাবে ফুটে না উঠলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে এটা কম গুরুত্ব পাচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের এক দাবী, তারা কোন অবস্থাতেই বিরতিহীনভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহন করবে না এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারনে তাদের উপর অযৌক্তিক দাবী চাপিয়ে দেয়া যাবে না। অভিভাবকদের দাবী, বিরতিহীনভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহন করলে তাদের সন্তানেরা অসুস্থ হয়ে পারবে এবং সন্তানদের কাঙ্খিত ফলাফলও অর্জিত হবে না।
অনেকে মনে করছেন, ‘শিক্ষামন্ত্রীর এ দাবীটি যেন ‘মাথায় উঁকুন হলে মাথা কেটে ফেলার মত’। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার দায়ভার তিনি শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। অথচ প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় শিক্ষামন্ত্রনালয়ের প্রশাসনিক অদক্ষতায়। এর জন্য শিক্ষার্থীরা কোন অবস্থায় দায়ী নয় বরং প্রশ্নপত্র ফাঁস করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত অন্ধকার করে ফেলা হচ্ছে। যে যুক্তিতে শিক্ষামন্ত্রী মনে করেছেন, বিরতিহীন পরীক্ষা গ্রহন করলেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া রোধ করা যাবে এমনটা ভাবা কতটা যৌক্তিক সেটাও ভেবে দেখা দরকার। পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করতে হলে বিরতিহীন পরীক্ষা গ্রহন নয় বরং যে স্থানগুলো থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় সেখানে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ‘বিড়ির কারখানাও চালু থাকবে আর জনগণকে বিড়ি খেতে নিষেধ করা হবে’ তা কতটা যৌক্তিক । কাজেই তদন্ত প্রতিবেদনে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধের ব্যাপারে অন্য যে সুপারিশগুলো আছে সেগুলোর উপর মনোযোগ দেয়া দরকার। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়দের ছাত্রজীবনে ভিন্ন অবস্থা বিরাজমান ছিল। তারা বিরতিহীনভাবে পরীক্ষা দেয়ার সাহস রেখেছেন সেটা তাদের গর্ব কিন্তু বর্তমান যুগের ছাত্ররা সে সাহস রাখে না। যে যত ভালো ছাত্রই হোক পরীক্ষার আগের রাতে তাকে একবার বইয়ের পৃষ্ঠায় চোখ বুলাতে হয়। বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্য যে বিশাল সিলেবাস তাতে এক রাতে গোটা বইতে চোখ বুলানো সম্ভব নয়। কোন শিক্ষার্থী যদি এক রাতে সমস্ত বইতে চোখ বুলাতে যায় তবে সে নির্ঘাত অসুস্থ হয়ে পড়বে এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে পারবে না। গোটা বছর সুযোগ থাকলেও এবং প্রস্তুতি নিলেও আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার মধ্যকার ছুটির দিনগুলোতে অসমাপ্ত প্রস্তুতির কাজ সমাপ্ত করে। এটা শিক্ষার্থীদের মানসিকতায় পরিনত হয়েছে।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এ মাটির সন্তান। তিনি এদেশের আবহাওয়া-জলবায়ু, প্রতিবেশ-পরিবেশের মধ্যে লালিত পালিত হয়েছেন। তিনি যদি বিরতিহীনভাবে পরীক্ষা দিতে পারেন তবে এদেশের অন্যান্য শিক্ষার্থীরা কেন পারবে না? বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীরাও অবশ্যই বিরতিহীনভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে পারবে। তবে তার জন্য তাদের মানসিক প্রস্তুতির দরকার। ‘কন্যা ঘুম থেকে উঠলেই বলা যাবে না তুমি প্রস্তুত হও তোমার বিয়ে’। বরং শিক্ষার্থীদেরকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ দিতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী বিদ্বান মানুষ। তিনি যদি মনে করেন বিরতিহীনভাবে পরীক্ষা গ্রহন করলে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা যাবে এবং এটা বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীদের জন্যও সহায়ক হবে তবে শিক্ষার্থীরা তাদের স্বার্থেই এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য। তবে শিক্ষার্থীদের সময় দিতে হবে। ন্যুণতম আগামী পাঁচ বছর তো বটেই। ২০১৪ সালে যদি সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে বিরতিহীনভাবে পাবলিক পরীক্ষা গ্রহন করা হবে তবে সেটা ২০১৮ কিংবা ২০১৯ সাল নাগাদ কার্যকরী করা যেতে পারে। মধ্যের এ কয়েকবছর শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ পাবে। তারা তাদের প্রস্তুতিও সেভাবে গ্রহন করতে পারবে এবং স্থানীয় পরীক্ষা কাঠামোও এভাবে প্রণয়ন করতে হবে। যে বছর থেকে বিরতিহীন পরীক্ষা গ্রহনের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে সে বছরই যদি এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহন করা হয় তবে ফলাফলে ধ্বস নামবে এবং শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। আমাদের দেশের যেভাবে পরীক্ষার রুটিন প্রণয়ন করা হয় তাতে অনেকগুলো অসংলগ্নতা পরিলক্ষিত হয়। মাঝে মাঝে দেখা যায় যে পাঠের কঠিন বিষয়গুলো যেমন গণিত, ইংরেজী পরীক্ষার মাঝে মাত্র দু’দিন বন্ধ অথচ কৃষি, সমাজ, ভূগোলসহ সহজ কিছু বিষয়ের পূর্বে সপ্তাহব্যাপী ছুটি থাকে। এ অসংলগ্নতা দূর করা আশু আবশ্যক। পাবলিক পরীক্ষাগুলো দেড় মাসব্যাপী দীর্ঘ না করে এক মাসের মধ্যে গ্রহন করা যেতে পারে। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় তার সূখ-দুঃখের কথা দেশবাসীকে জানিয়ে নিয়মিত পত্রিকায় লিখতে শুরু করেছেন এজন্য তাকে ধন্যবাদ। আশা করি তার এ পদক্ষেপ ধারাবাহিক হবে এবং দেশের অন্যান্য মন্ত্রীমহোদয়গণও শিক্ষামন্ত্রীকে অনুসরণ করবেন। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে বিনীত আরজ, বিরতিহীনভাবে পরীক্ষা গ্রহনের ব্যাপারে তার দেয়া বক্তব্য প্রত্যাহার করবেন এবং রমজান মাসে কিংবা রমজানের পরেও শিক্ষার্থীদেরকে অধ্যয়ণে মনোযোগী হওয়ার সুযোগ করে দিবেন। কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে যেন ফেস্টুন কিংবা ব্যানার হাতে রাস্তায় দাঁড়াতে না হয় কেননা এটা অশোভন দেখায়। দেশের ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেশের শিক্ষামন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করবে এটা বেমানান। সুতরাং আপনি বিরতিহীনভাবে পরীক্ষা গ্রহনের ব্যাপারে আপনার বক্তব্যটি থেকে সরে আসুন। এটা করলে শিক্ষার্থীরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। শিক্ষা অর্জনের উপায়সমূহ যেন শিক্ষার্থীদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে প্রণয়ন করা হয়।
রাজু আহমেদ। কলাম লেখক।
বিষয়: বিবিধ
১১০০ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন