ঈদের কেনাকাটায় গৃহ-পরিচারিকাদের গুরুত্ব দিন

লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ১০ জুলাই, ২০১৪, ১০:৫৪:২৬ সকাল

প্রতিদিনের সূর্য অস্তমিত হওয়ার সাথে অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে একটি করে রোযা। সুদীর্ঘ এক মাসের রোযা পালন শেষে হাজির হবে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতর যত নিকটবর্তী হচ্ছে ঈদের কেনাকাটার প্রতিও মানুষ ততো গুরুত্বারোপ করছে। সবার আগে ঈদের কেনাকাটা শেষ করা চাই। ক্রেতার চাহিদাকে প্রধান্য দিয়ে ব্যবসায়ীরাও তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সাজিয়েছে বাহারি সাঁজে। ক্রেতার পছন্দমত বাহারি পোশাকের পশরা সাজিয়েছে বিপণীবিতানে। সাথে চোখ ধাঁধানো আলোকচ্ছ্বটার কৃত্রিম খেলা তো আছেই। রমযানের শেষদিনগুলোতে ঈদের বাজারে প্রচন্ড ভীড় থাকায় পছন্দমত পোশাক বেছে লওয়া খুব কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। তাই গৃহ-কর্তার ফাঁকিবাজির মধ্যেও গৃহকর্তীরা তাদের ভাবীদের সাথে পাল্লা দিয়ে আগেভাগে ঈদের জন্য কেনাকাটা সমাপ্ত করতে চায়। তাদের দর্শন হল, ঈদের জন্য যে পোশাক-পরিচ্ছদ ক্রয় করা হয় তাতো শুধু ঈদের দিন সকালে পরিধান করার উদ্দেশ্যে নয় বরং কার পোশাকটি ভালো হয়েছে, কার পোশাকে দাম বেশি? শরীরের সাথে ম্যাচিং হবে তো? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর এবং ছোটখাটো প্রতিযোগীতা পরস্পরের মধ্যে লক্ষণীয়। কাজেই অর্ধাঙ্গীর আহ্লাদিত আবদারে বাধ্য হয়েই কর্মব্যস্ত কর্তাকেও ফ্যাশন বিশেষজ্ঞ হতে হয়। এ মার্কেট থেকে ও মার্কেটে ছোটা। তবুও পছন্দমত পোশাক মেলা ভার। পরিবারের বাচ্চাদের নিয়ে তেমন ঝামেলা হয় না কেননা তাদের মা বাবা তাদের জন্য যা পছন্দ করে তাতেই তারা যারপরানই সন্তুষ্ট। কিন্তু যে সকল পরিবারে ষোড়শী,অষ্টাদশী কিংবা স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কন্যা এবং হালের ফ্যাশন সচেতন ছেলে আছে তাদের মা বাবাদের তো চিন্তার শেষ নাই। ঈদের পোশাক ক্রয়ের পূর্বেই আধুনিকা মেয়ে কিংবা ছেলে সাফ জানিয়ে দেয়, যদি আমাদের পোশাক বান্ধবী-বন্ধুদের চেয়ে ক্ষ্যাত হয় তবে সে পোশাক কিন্তু আমরা পড়ব না। অনেকে বাবা মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজেরা নিজেদের জন্য পোশাক পছন্দ করে বাসায় নিয়ে আসার পরেও খুঁত খুঁত ভাব দেখা যায়। নিজের পছন্দসই পোশাক ক্রয়ের পরে খুঁত খুঁতের কারন জানতে চাইলে বলে, এটা না এনে ওটা আনলে ভাল মানাত। এদের অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনলে মনে হয় যেন, নিজের উপর নিজের আস্থা নাই। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেবল পরিবারের দায়িত্বশীলের। নিজের জন্য না হলেও পরিবারের অন্য সকল সদস্যের মূখে হাসি ফোটানোর জন্য গৃহ কর্তাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে দেখা যায়। হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও পত্নী, কন্যা কিংবা ছেলের বাহানার কাছে শেষ পর্যন্ত তাকে হার মানতেই হয়। অনেক সময় সাধ্যের সীমা অতিক্রম করে হলেও প্রিয়জনের মূখে হাসি ফোটানোর প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। নিজের স্বাদ এবং সাধ্যকে গোপন রেখে সকল অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়ানোর সংসারের সবচেয়ে রাগী মানুষটিকেও সাদাসিধে আচরণ করতে দেখা যায়। পরিবারের অন্য সকলের পোশাক ক্রয়ের পর যখন কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করে তুমি কিছু নিলে না? তখন মূখখানাকে হাসিমাখা করে তাদেরকে বলতে শোনা যায়, গত বছর ঈদে যে পোশাকটি নিয়েছিলাম সেটাই তো নতুন আছে আবার নতুন পোশাকের দরকার কী? অথচ খোঁজ নিয়ে জানা যায় গত ঈদের সময় একই কথা বলে কাটিয়ে গিয়েছিল। এরাই কিন্তু আমাদের অভিভাবক। কাজেই প্রত্যেকটি সন্তান ঈদের বাজার করার পূর্বে আপন পিতা-মাতার সাধ্যের কথা একটু ভাববেন। মনে রাখবেন, অচিরেই আপনিও বাবা কিংবা মা হচ্ছেন।

ঈদকে সামনে রেখে বাংলাদেশের পোশাক বাজারগুলো জমে উঠতে শুরু করেছে। তবে দূর্ভাগ্যের বিষয় হলো পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বের তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পরিচিতি থাকলেও অতীতের ন্যায় এবারের ঈদেও ভারতের পোশাক বাংলাদেশের পোশাক বাজারকে দখল করেছে। বিক্রেতাদের মতে, ঈদ উপলক্ষে যত আইটেমেরে পোশাক বিক্রি হবে তার প্রায় ৭০% ভারত থেকে আমদানিকৃত। এবারের ঈদের মূল আকর্ষন ‘পাখি’। না পাঠক কোন জীবন্ত পাখি নয়। ‘পাখি’ হল মেয়েদের প্রিয় থ্রি-পিছ। স্টার জলসায় প্রচারিত ‘বোঝে না সে বোঝে না’ নাটকের অন্যতম চরিত্র পাখিকেই এবারের পোশাক আইটেম করা হয়েছে। তবুও আমাদের সৌভাগ্য। কেননা গত বছর পোশাক আইটেমের নামকরণ করা হয়েছিল ভারতীয় বংশোউদ্ভুত কানাডিয়ান পর্নোস্টার স্যানি লিউনকে। তবে এবছর সে ধারা থেকে বের হয়ে অন্তত সামাজিকতায় ফিরে এসেছে। এজন্য পোশাক ব্যবসায়ীরা ধন্যবাদ পেতেই পারে। ২০১২ সালে ঈদের জন্য জনপ্রিয় পোশাক ছিল ‘মা’ নাটকের জনপ্রিয় চরিত্র ‘ঝিলিক’। সে বছর তো ঝিলিক বলতেই মেয়েরা অজ্ঞান ছিল। এ বছরও ঈদকে সামনে রেখে ‘পাখি’ বাণিজ্যে ব্যবসায়ীরা মোটা অংকের লাভবান হবে সেটা বোঝাই যায়। এছাড়াও এবারের ঈদ বাজার দখল করেছে ফ্লোরটাচ, মধুরমা, লুঙ্গিড্যান্স, তেরেঙ্গা, মনের খুশি, ফড়িং প্রভৃতি আইটেমের পোশাক। এ বছর মেয়েদের ঈদের পোশাক ডিজাইনে বিশেষত্ব হল ঘেরওয়ালা লম্বা জামা, সঙ্গে চিকন পাজামা। মায়েদের বিশেষ পছন্দের মধ্যে বরাবরের মত শাড়িই স্থান পাচ্ছে। সূতির শাড়ির সাথে জর্জেট, জামদানি এবং কাতানেও মায়েদের আকর্ষণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে শাড়ির মধ্যে ‘বাহা’ শাড়ি উল্লেখযোগ্য হারেই ক্রেতার পছন্দের তালিকায় আছে। এবারের ঈদের দেশী-বিদেশী বিখ্যাত ব্রান্ডসমূহের মধ্যে বিবিআনা, স্মার্টেক্স, রঙ, প্রবর্তনা, মেনজ ক্লাব, অহং, এক্সাট্যাসি এবং লাভেন্ডারসহ প্রায় অর্ধ শতাধিক ব্রান্ডের পোশাকের প্রতি ক্রেতাদের বিশেষ আকর্ষন দেখা যাচ্ছে। ঈদকে সামনে রেখে জমে উঠেছে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় এবং জেলা শহরের ফুটপাতের পোশাকের ভাসমান দোকানগুলো। যারা বিলাসী কিংবা ব্যয়বহুল শাপিংমল থেকে পোশাক ক্রয়ের সামর্থ্য রাখে না তাদের শেষ আশ্রয় ফুটপাত। এক্ষেত্রে ফুটপাতের দোকানগুলো থেকে নি¤œ্ আয়ের ক্রেতারা পোশাক ক্রয় করে সন্তুষ্টিতে না ভূগলেও সাধ্যের মধ্যে স্বাদ পূরণ করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ঈদকে সামনে রেখে কসমমেটিক্সের দোকানগুলোতে সাজ সাজ রব। পূর্বের তুলনায় দোকানের বেচা-বিক্রি কয়েকগুন বেড়ে গেছে। দোকানীরা ক্রেতার চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। বিদেশী অভিজাত শ্রেণীর কসমেটিক্সের কাটতি লক্ষনীয়। এছাড়াও ঈদে সব বয়সী পুরুষদের জন্য পাজামা-পাঞ্জাবীর বাহারি ঢং বাজারে লক্ষণীয়। টুপি, জায়নামাজ এবং সুগন্ধির বিক্রি পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি। বিভিন্ন জুতার দোকানে ক্রেতাদের আনা-গোনা দেখে অনুমান করা যাচ্ছে ঈদের বুঝি আর বেশি বাকী নাই। ঈদের প্রধান আকর্ষন সেমাই চিনির বাজারে ক্রেতাদের ততোটা ভিড় লক্ষ্য করা না গেলেও সেমাই তৈরিকারী পল্লীগুলোর কর্মচারীদের ব্যস্ততার সীমা নাই। এছাড়াও দেশী আতপ চাউল, দুধ এবং অনুষাঙ্গিক অন্যান্য উপাদানাদির ব্যবসায়ীরাও আশা করছেন অন্যান্য বছরের ঈদের তুলনায় এবছর তাদের বিক্রি ভালো হবে।

পরিবারের সকলের মূখে হাসি ফোটানোর মানসিকতা দেখা গেলেও অবহেলিত থেকে যায় পরিবারের কাজের ছেলেটি কিংবা মেয়েটি। নতুন পোশাক পরিধান করে অন্য সবার মত ওদের ঈদের দিন আনন্দ প্রকাশ করা হয় না। আপন সন্তানের চেয়ে বয়সে কম কিংবা সমবয়সী হলেও ওরা থেকে যায় অনাদরে অবহেলায়। ওরা তো কাজের লোক! ওদের আবার ঈদ কী ? ঈদের দিন সকালেও ওদের কোন ফুসরৎ নাই। ভোর রাত থেকে শুরু করে পরের দিন গভীর রাত পর্যন্ত ওদের কাজ চলতেই থাকে। সকল মেহমানকে আপ্যায়ণ করার দায়িত্ব ওধের কাঁধে। অন্য সকলের মধ্যে খুশি বিলালেও ওদের জীবন থেকে যায় হাসি-আনন্দের বাইরে। বছরের অন্যান্য দিনগুলোর সাথে ওদের ঈদের দিনটিও কেটে যায় নানা কর্ম ব্যস্ততায়। ঈদের দিনকে আলাদা করে ভাবার কোন পরিবেশ ওদের জীবনে দেখা যায় না। অথচ যে নবীর আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে আমরা ঈদ উদযাপন করছি সেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার জীবনের শেষ ভাষণে বলেছিলেন,‘তোমরা নিজের জন্য যা পছন্দ করবে তোমার অপর ভাইয়ের জন্যও তাই পছন্দ করবে, নিজে যা খাবে অন্য ভাইকেও তা খাওয়াবে, নিজে যা পরিধান করবে অন্যভাইকেও তা পরিধান করাবে’। সুতরাং শ্রেষ্ঠ মানবের এ উপদেশ থেকেই আমাদের শিক্ষা নেওয়া আবশ্যক। ঈদের বাজারে যখন আপনজনদের জন্য কোন পোশাক ক্রয় করতে যাব তখন যেন বাসার কাজের মেয়েটি/ছেলেটির জন্যও পোশাক ক্রয় করা হয়। হোক সেটা কম দামের। ঈদ উপলক্ষে যদি বাসার অবহেলিত মানুষটিকে কিছু উপহার দেয়া হয় তবে তার চেয়ে খুশী এ পৃথিবীতে আর কে হবে? তার মূখের হাসির সামনে পৃথিবীর সকল হাসি ম্লান হয়ে যাবে। যদি বিশ্বাস না হয় এই ঈদে পরীক্ষা করুন। তার হাসিমাখা মূখ দেখে আপনিও স্বর্গীয় সূখ পাবেন। এটা শুধু কথার কথা নয় বরং গ্যারান্টি দিচ্ছি। তাদের জন্য পোশাক কেনাটা যদি অর্থের অপচয়ও মনে করেন তবুও না হয় একবার অপচয় করে দেখুন। আপনিই বলতে বাধ্য হবেন, টাকাটা অপচয় হয় নি বরং ওদের জন্য আরও বেশি টাকা খরচ করা উচিত ছিল। সুতরাং মানবতা, ধর্মসহ সকল দিকের বিবেচনায় ঈদের জন্য পোশাক কেনা-কাটায় সকলের প্রতি সমান গুরুত্বারোপ করুন। আপনার একটি সামান্য সিদ্ধান্ত আরেকজনকে অনাবিল সূখ দিতে পারে।

রাজু আহমেদ। কলাম লেখক।



বিষয়: বিবিধ

৯৪৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File