বাংলাদেশের রাজনীতি কি এতই উদার ?
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ০৬ জুলাই, ২০১৪, ০২:২৩:১০ দুপুর
অনেক জল্পনা-কল্পনা, আলোচনা-সমালোচনা, চড়াই-উৎড়াই, মান-অপমান সহ্য করে অবশেষে দীর্ঘ দিনের আকাঙ্খিত পদ্মা সেতু নির্মানের কাজ শুরু হওয়ার দ্বারপ্রান্তে । চিনের বিখ্যাত নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মেজর ব্রিজ কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের চুক্তিও সম্পন্ন হয়েছে । ২০০৮ সালে অনুষ্ঠেয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ কর্তৃক ঘোষিত নির্বাচিত ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মানের প্রতিশ্রুতি ছিল । দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় অন্যতম মাইল ফলক হিসেবেই পদ্মা সেতুকে ধরা হত । পদ্মা সেতু নির্মানের মাধ্যমে ঢাকার সাথে দেশের দক্ষিনাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন সহজ হবে তেমনি শিল্পকারখানায় অনুন্নত দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল । পদ্মা সেতু নির্মানের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রগতিশীলতা অর্জিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নাই । নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করার পর দীর্ঘ পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও তাদের প্রথম পদক্ষেপে পদ্মাসেতু নির্মান কাজ শুরু করা সম্ভব হয় নি । বরং তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে বিশ্ব ব্যাংক তাদের প্রস্তাবিত ঋণ সাহায্য প্রত্যাহার করে । বিশ্ব ব্যাংকের দাবী ছিল, পদ্মাসেতুর কোন অবকাঠামোগত কাজ শুরু ছাড়াই প্রায় আটশ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে । বিশ্বব্যাংক তাদের ঋণ প্রত্যাহার করে নেয়ার পর এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকসহ অন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও বিশ্বব্যাংককে অনুসরন করে । পদ্মা সেতু হবে কি হবে না এমন প্রশ্নে যখন সকল মিডিয়া সরব তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত যোগাযোগমন্ত্রী আব্দুল কাদের দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করলেন নিজেদের অর্থ থেকে হলেও পদ্মা সেতু নির্মান করা হবে । অপরদিকে সরকারী দলের ব্যর্থতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ঘোষণা করলেন, আগামী নির্বাচনে তারা ক্ষমতায় গেলে একটি নয় বরং দু’টো পদ্মা সেতু নির্মান করবেন । আওয়ামী সরকার যে আমলে পদ্মাসেতু নির্মানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা যদি রক্ষা করতে পারত তবে এখন সে সেতুটি ব্যবহার উপযোগী হত । নবম জাতীয় সংসদে আওয়ামীলীগ সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে না পরলেও গত ৫ই জানুয়ারি বিএনপির মতে প্রহসনমূলক দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ আবারও সরকার গঠন করেছে । গত বার ব্যর্থ হলেও ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’ নীতিতে আওয়ামীলীগ এবার সফলতার মূখ দেখবে বলেই বিশ্বাস । তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সমালোচনা বন্ধ করার জন্য পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তাসহ ২৯০ কোটি ডলার খরচ করার কথা ছিল । কিন্তু বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে মূখ ফিরিয়ে নেয়ার পর মূল পদ্মাসেতু নির্মানের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা এবং নদী শাসনের জন্য ৭ হাজার টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে । বাংলাদেশে এ যাবৎ কালে নির্মিত সবচেয়ে দীর্ঘতম সেতু হিসেবে পদ্মাসেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৬.১৫ কিলোমিটার । অনেক আলোচনা সমালোচনার পরে সরকার যে প্রতিষ্ঠানটির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে তারা পদ্মাসেতু নির্মানকাজ সমাপ্ত হওয়ার পর মাত্র এক বছরের ওয়ারেন্টি দিবে । অথচ আন্তর্জাতিক ওয়ারেন্টি দুই বছর এবং যমুনা/বঙ্গবন্ধু সেতুর নির্মানোত্তর ওয়ারেন্টিও দুই বছর ছিল । কাজেই চায়না মেজর কোম্পানি যেহেতু এক বছর ওয়ারেন্টি দিচ্ছে সুতরাং পুরোনো সে ‘কিন্তু’ রয়েই গেল ।
পদ্মা সেতুর নির্মান কাজ আরম্ভ হওয়ার প্রাককালেই আলোচিত যোগাযোগমন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদের ঘোষণা করেছেন পদ্মা সেতুর নাম পদ্মা সেতুই রাখা হবে । তিনি জানিয়েছেন, প্রথম দিকে মাননীয় শেখ হাসিনা কিংবা শেখ রেহানার নামে আবার কারো মতে পল্লী কবি জসিম উদ্দীনের নামে পদ্মা সেতুর নামকরণ করার প্রস্তাব এলেও তা হচ্ছে না । জনাব ওবায়দুল কাদের সাহেবের এ ঘোষণার মাধ্যমে রাজনীতিতে ইতিবাচক উদারপন্থী ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যাচ্ছে । অপরদিকে সমালোচকরা ওবায়দুল কাদের চৌধুরির উদারতাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করছেন । পদ্মা সেতু নির্মান নিয়ে এতসব সমালোচনার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিংবা বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা অবশ্যই তাদের নামে পদ্মা সেতুর নামকরণ হোক এ প্রস্তাবে রাজী হবেন না । তাদের একজন আওয়ামীলীগের প্রধান এবং অন্যজন তার বোন অপরদিকে তারা উভয়েই বঙ্গবন্ধুর কন্যা । বঙ্গবন্ধু যে আদর্শে বিশ্বাস করতেন তারা সে আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে এটা ভাবা অমূলক । কাজেই পদ্মাসেতুর মত একটা আপতকালীন বিতর্কিত বিষয়ের নামকরণে এরা জড়াবেন না এটা স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায় ।
পদ্মাসেতুর নামকরণ নিয়ে কোন বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ হতে না দিলেও বাংলাদেশের ক্ষমতাশীনদল এবং যারা অতীতে ক্ষমতায় ছিল তারা কি নাম পাল্টানোর রাজনীতি থেকে বের হয়ে উদার মঞ্চে আসতে পারবেন বা পেরেছেন ? বাংলাদেশে কোন রাজনৈতিক দল উন্নয়ন কিংবা অন্যকোন মাধ্যমে সমাজ, রাষ্ট্রের পরিবর্তন আনতে পারুক কিংবা না পারুক তাদের দু’দলই একটা জায়গায় এক নীতি গ্রহন করেছে । সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে শুধু পাবলিক টয়লেটগুলো ছাড়া বাকী সব রাষ্ট্রীয় স্থাপনার নাম বদলে দিয়েছে । কখনো নিজেদের নামে, কোন কোন ধর্মীয় সাধকের নামে আবার কখনো দেশের জন্য যারা ত্যাগ করেছে তাদের নামে । এভাবেই বছরের পর বছর চলেছে নাম পরিবর্তনের রাজনীতি । এ ক্ষেত্রে কেউ কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই । দুই দলের মুষ্টিমেয় কয়েকজন নেতার নামে দেশের স্থাপনাগুলোর নামকরণ করা হয়েছে । মাঝে মধ্যে নিজেদের সমালোচনা এড়ানোর জন্য ধর্মীয় সাধক কিংবা দেশের জন্য আত্মত্যাগকারী দল নিরপেক্ষ ব্যক্তিদেরকে টেনে আনা হয়েছে । এসকল ব্যক্তিরা দেশের জন্য, ধর্মের জন্য তাদের জীবনের সকল সুখ-শান্তি ত্যাগ করেছে এমনকি নিজের জীবনকেও উৎসর্গ করেছে । তাদের প্রতি রাষ্ট্রের ঋণ শোধ করার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্থাপনার নামকরণ তাদের নামে করে তাদেরকে অমর করে রাখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব । তবে কোন বিতর্কিত সিদ্ধান্ত এড়ানোর জন্য তাদেরকে টেনে আনার পক্ষে হয়ত তারা কখনো মত দিতেন না । কাজেই নিজেদের দোষ এড়ানো জন্য অন্যকে টেনে আনা কতোটা যৌক্তিক সেটা ভেবে দেখা আবশ্যক ।
দেশের বিভিন্ন স্থাপনার নাম পরিবর্তন করার দৃষ্টান্ত দেশে অহরহ ঘটছে । তবে কোন দল ক্ষমতায় আরোহন করার কয়েকদিনের মধ্যেই এ মহৎ(!) কাজটি সেরে ফেলার প্রবণতা সকল ক্ষমতাশীন দলের ছিল । অসংখ্য স্থাপনার নামকরণ পরিবর্তনের ঘটনার মধ্যে মাত্র দু’টো ঘটনা উল্লেখ করছি । ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার নির্বাচিত হয়ে যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু ব্রিজ নির্মানের কাজ শুরু করে । তাদের পাঁচ বছরে তারা ব্রিজের কাজ সমাপ্ত করে যেতে পারেনি । ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি । বিএনপি সরকার গঠন করার পরে যমুনা নদীর উপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর নাম পরিবর্তন করে যমুনা সেতু নামকরন করে এবং সে নামেই উদ্ভোধন করা হয় । অল্প বিস্তরে হলেও অতীতের রাজনীতিতেও নাম পরিবর্তন করার সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হয়েছে । তবে অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গেছে নবম জাতীয় সংসদের ক্ষমতাশীনদল । ২০০৮ সালে সরকার গঠন করার পর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে দেশের বহু স্থাপনার পূর্বের ফলক ভেঙ্গে নতুন ফলক জুড়ে দেয়া হয় । ঢাকার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন তার মধ্যে একটি । আওয়ামীলীগ সরকার বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নামে থাকা বিমানবন্দরটির নাম পরিবর্তন করে পরবর্তী নাম দেন শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর । একজন মুসলিম সূফী সাধকের নামে বিমানবন্দরটির নামকরনে অন্তত মুসলমানদের খুশি হওয়ার কথা ছিল । কিন্তু মুসলমানরা খুশি হবে কেমন করে ? ইসলাম তো অপচয়ের বিরুদ্ধে বলে । জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নামকরণ করার জন্য রাষ্ট্রকে মাত্র ১২’শ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে । প্রশ্ন জাগতে পারে , এত টাকা খরচ হওয়ার কারন কী ? জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সাথে বর্হিবিশ্বের যে সকল দেশসমূহের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের যোগাযোগ ছিল বা আছে সে সকল বিমানবন্দরে সংরক্ষিত কাগজ পত্র থেকে জিয়াউর রহমান বাদ দিয়ে সেখানে শাহ আমানত লিখতে হয়েছে । এছাড়াও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দলীল দস্তাবেজেও এ নাম পরিবর্তন করতে হয়েছে । এই সামান্য কয়েকটি কাজে গরীব একটি রাষ্ট্রকে অপচয় করতে হল হাজার কোটি টাকা ।
আওয়ামীলীগ যদিও পদ্মা সেতু নির্মানের ব্যাপারে উদার দৃষ্টিভঙ্গি দেখাচ্ছে কিন্তু সে দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তী সরকার রাখবে কি ? পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ ছাড়া যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন তারাও একই পথে হাঁটবে । বিভিন্ন স্থাপনার নাম তারাও পরিবর্তন করবে । আওয়ামীলীগ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পারলেও অন্যান্য দল হয়ত লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করবে । তাতে কি ? রাষ্ট্রের টাকা না থাকলে উচ্চহারে ঋণ গ্রহন করবে । তবুও নাম পরিবর্তনের রাজনীতির ধারা অব্যাহত রাখা চাই ! রাজনীতির এ মানসিকতা থেকে দেশবাসী কবে মুক্তি পাবে তা স্রষ্টাই ভাল জানেন । কাজেই মাননীয় মন্ত্রীমহোদয় যদি ইচ্ছা করেন তবে পদ্মা সেতুর নাম অন্য কারো নামে দিতে পারেন । আওয়ামীগ বাধ্য হয়ে উদার হতে পারলেও অন্যদল অতীতের শিক্ষা নিয়ে নামবদলানোর সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারবে কিনা সন্দেহ । শেখ হাসিনা বা শেখ রেহানার নামে না হোক অন্তত আবুল হোসেনের নামে পদ্মাসেতুর নাম করা যেতে পারে । অন্তত পদ্মাসেতুর মাধ্যমে আবুল হোসেনকে আগামী কয়েক বছর জাতি আবুল হোসেনকে মনে রাখুক । নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেরা বিতর্কিত হোন তাতে কোন আপত্তি নাই কিন্তু ধর্মীয় সাধক কিংবা দেশের জন্য আত্মত্যাগকারীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তাদেরকে বিতর্কে টেনে না আনাই উচিত । তারা আপনাদের কাছে এরকম কিছুই চায় না । তারা স্বার্থহীন ভাবেই দেশের জন্য ধর্মের জন্য কাজ করেছেন । কোন বিনিময় পাবার আশায় নয় । বিনিময় যদি কিছু দিতেই হয় তবে সেটা বিতর্কের উর্ধ্বে উঠে সকলের ঐক্যমত্যতায় ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
facebook.com/raju69mathbaria/
বিষয়: বিবিধ
৮৫৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন