বাড়িওয়ালারা মানুষ নাকি শুধুই বাড়িওয়ালা
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ০৫ জুলাই, ২০১৪, ১২:১৬:০৯ রাত
‘নদীর এপার ভাঙ্গে ওপার গড়ে এইতো নদীর খেলা । সকাল বেলার ধনি তুমি ফকির সন্ধ্যা বেলা’ । আধ্যাত্মিক ভাবধারার এ গানটির মতই পৃথিবীর সকল সৃষ্টিকূল নিয়ত পরিবর্তনশীল । মহান স্রষ্টা কাকে, কখন, কোন অবস্থায় রাখবেন সেটা কেবল তার একান্ত ইচ্ছা । কাউকে ফকির আবার কাউকে আমীর বানানো তার সৃষ্টি কৌশল । কেউ রাজ পরিবারে জন্মায় আবার কেউবা কুঁড়েঘরের ছোট্ট একটি কক্ষে । কারও জীবন সূখে কেটে যায় আবার অনেকে সারা জীবন সংগ্রাম করে একটু সূখের লাগি । সূখ কারো কাছে ধরা দেয় আবার কারো জীবন সূখের ছোঁয়া ছাড়াই কেটে যায় । তবুও নিরন্তর গতিতে মানুষের সংগ্রাম চলতেই থাকে । এ যেন থামিবার নয় । লক্ষ্য একটি সূখের ঠিকানা । গ্রাম ছেড়ে শহর আবার ছোট শহর ছেড়ে বড় শহরের পানে মানুষ কেবল ছুটে চলছে । এভাবে বাস্তুত্যাগের মিছিল নিরবধি বহমান । নদীর ঢেউয়ের মত যেন কোন বিশ্রাম নেই । ঘড়ির কাটার মত ছুটছে তো ছুটছেই । জীবন পিদিম নিভে না যাওয়া পর্যন্ত যেন এ গতি থামবার নয় । কোথায় আশ্রয় নিয়ে অতীতের চেয়ে একটু ভালো থাকা যায় । কেমন করে জীবনযাত্রার মান উন্নত করা যায়-কেবল এই সাধনায় মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মানুষকে কোন এক মোহ কেবল শহর পানে টানছে । নিজের আবাসস্থলের স্থায়ী ভিটে-মাটি ছেড়ে কিংবা জনমের তরে বিক্রি করে বাহ্যিক চাকচিক্যময় শহরে যে কোনভাবেই তাদেরকে স্থায়ী হতে হবে । এটাই মানুষের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে । শহরে গিয়েই মানুষের প্রথম দরকার হয় আশ্রয়স্থল । পরিবার পরিজন নিয়ে রাত কাটানোর মত একটি স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী ছাদ আচ্ছাদিত চার দেয়ালের বন্দি খাঁচা দরকার। গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা মানুষগুলো শহরের জীবনকে যত শান্তির মনে করেছিল ততো শান্তির ঠিকানা সে এখানে খুঁজে পায় না । শুরুতেই হোঁচট খায় বাড়িওয়ালাদের রুঢ় ব্যবহারে । এরপর গ্রাম থেকে আসা সহজ সরল মানুষগুলোকে মুখোমুখি হতে হয় কতগুলো শর্তের বেড়াজালে। গ্রামের কিংবা মফস্বলের উম্মুক্ত দিগন্তে ছুটে চলা মানুষগুলো যেন ধীরে ধীরে বন্দি হতে শুরু করে শহরের অঙ্কিত কৃত্রিম সীমানায়। এ সকল সমস্যা সত্ত্বেও শহরে শান্তিতে বাস করা যেত যদি বাড়িওয়ালারা তাদের ইচ্ছামত বাড়িভাড়া বৃদ্ধি না করত । শত বাহানায় প্রতি মাসেই একেক দফা করে বাড়িভাড়া বাড়ানোর কারনে ভাড়াটিয়াদের জীবনে নাভিশ্বাস চলে আসে । পরিবার যা আয় করে তার প্রায় সবটুকুই মাস শেষে বাড়িওয়ালার হাতে তুলে দিতে হয় । বাকী যে টুকু অবশিষ্ট থাকে তা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোনমতে টেনে-টুনে সংসার ঠিকই চলে তবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে শহরপানে ছোটা সে উদ্দেশ্যের সফলতা অধরাই থেকে যায় । ভবিষ্যতের জন্য একটু একটু সঞ্চয় করে ব্যবসা কিংবা একটি ছ্ট্টো স্থায়ী আবাসস্থল আর গড়া হয়ে ওঠে না । আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করতে না পারায় কাঙ্খিত সে সূখের স্বপ্ন শুধু স্বপ্নেই থেকে যায় ।
দ্রব্য মূল্যের ক্রমাগত উর্ধ্বগতিতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে । প্রতিদিন বাজারের ব্যাগ হাতে বাজারের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বে প্রত্যেককেই ভাবতে হয় আর্থিক বাজেটের সাথে বাজারমূল্যের সঙ্গতি করে বাজারকার্য সম্পন্ন করা যাবে তো ? বাজারে যেন আগুন লেগেছে । দ্রব্য মূল্যের দাম যতই বাড়ানো হোক বেঁচে থাকার তাগিদে যতটুকু দরকার ততোটুকু তো জোগাড় করতেই হবে । এ নিয়ে মানুষের নিত্যদিনকার সংগ্রাম চলছেই । মানুষকে যখন অন্ন জোগাড় করতে সংগ্রাম করতে হয় তখন বাসস্থানের চিন্তায় মানুষকে পাগল প্রায় করে তুলছে । শহরের বাড়িওয়ালারা কোন প্রকার নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ভাড়াটিয়াদের উপর চালাচ্ছে নানা নির্যাতন । তাদের এ নির্যাতন কখনো আর্থিক আবার কখনো মানসিক নির্যাতনে রুপ নয় । নানাভাবে নির্যাতিত হওয়া সত্ত্বেও ভাড়াটিয়ারা সম্পূর্ণ নিরুপায় । আইন কিংবা অন্যকোন উপায়ে ভাড়াটিয়ারা তাদের মৌলিক অধিকারা ভোগ করতে পারছে না । প্রতি মাসে বাড়িভাড়ার নতুন কাঠামো ভাড়াটিয়াদের ঘাম জড়িয়ে ছাড়ছে । দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হলেও তার একটা মাত্রা আছে কিন্তু বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর কোন মাত্রা নেই । সব জিনিসের দাম গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পেলেও বাড়িভাড়া বাড়ছে জ্যামিতিক পদ্ধতিতে । এর লাগাম টানার কোন যোগ্য কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না । কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলঅদেশের (ক্যাব) তথ্যানুযায়ী, গত চার বছরে সবচেয়ে বেড়েছে বাড়িভাড়া । ঢাকার মোট অধিবাসীর ৯০% ভাড়াটে । গত ২২ বছরে ঢাকা শহরে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৩৫০% । ২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ সালে বেড়েছে ১৫ দশমিক ৮৩% । এরপর ২০১২ এবং ২০১৩ সালে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার ২০ শতাংশের বেশি । লাগামহীন এ বাড়িভাড়ায় মানুষের জীবন বিপর্যস্ত । বাড়িওয়ালারা কয়েকটি দুর্বল যুক্তি দিয়ে বাড়িভাড়া বাড়িয়েই চলছে । তাদের দাবি, অস্বাভাবিকভাবে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, গৃহনির্মাণ ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, দফায় দফায় বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার কারনেই তারা বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করে চলছে । ক্যাবে পদত্ত তথ্যের মতে, বাড়িওয়ালাদের ৮০% বাড়িভাড়ার আয় দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন । এ কারনে কোন কিছুর সামান্য দাম সামান্য বাড়লেই বাড়িওয়ালারা মাত্রাহীনভাবে বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করে দেন । শুধু বাড়িভাড়া বাড়িয়েই তারা ক্ষান্ত হননা । ক্যাবের প্রতিবেদন বলেছে, ভাড়া দিতে দেরি হলে রাজধানীর ২৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ বাড়িওয়ালা ভাড়াটেদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন । গৃহহীন মানুষদের তুলনায় বাড়ির সংখ্যা কম হওয়ায় বাড়িওয়ালারা ইচ্ছামত ভাড়া বাড়িয়ে যাচ্ছে । অনেক ক্ষেত্রে বাড়িওয়ালার সাথে ভাড়াটিয়াদের সাথে কোন রকম চুক্তিপত্রও হয় না । যদিও বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রন আইনে বলা আছে, সরকার বাড়িভাড়া নির্ধারণসহ এ সংক্রান্ত সব সমস্যা সমাধানের জন্য নিয়ন্ত্রক নিয়োগ দিতে পারবে । ক্যাবের তথ্যমতে, ঢাকায় এখন পাঁচ থেকে ছয়জন সহকারী জজকে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া আছে । তবে সাধারণ মানুষ এটা জানে কিনা সন্দেহ । ফলে নিয়ন্ত্রকদের আদালতে যাওয়ার সংখ্যাও হাতে গোনা । তা ছাড়া দুই কোটি মানুষের শহরে পাঁচ-সাতজন নিয়ন্ত্রকের কীইবা করার আছে
দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয়কর ফাঁকি দিয়ে চলছেন বাড়িওয়ালারা অথচ এদের বিপক্ষে কোন পদক্ষেপ নিতে শোনা যায় না । সম্প্রতি চলতি বছরের জুলাই মাসের এক তারিখ থেকে ২৫ হাজার টাকার বেশি যাদের বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট ভাড়া তাদেরকে আলাদা ব্যাংক এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বাড়িভাড়া প্রদান এবং বাড়িভাড়া গ্রহনের সিদ্ধান্ত দিয়ে আইন চালু করা হয়েছে । যারা এ আইন মান্য না করবে তাদেরকে ৫০% জরিমানা দিতে হবে । তবে যারা ২৫ হাজার কিংবা তদুর্ধ্বো টাকা বাসা বাড়া দিয়ে ঢাকা শহরে বাস করতে পারে তারা অবশ্যই স্বচ্ছল । নিম্নবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্তের স্বার্থ রক্ষা করবে কে ? যাদের আয় মাত্র নয় কিংবা দশ হাজার টাকা তাদেরকে যদি পাঁচ হাজার কিংবা তার বেশি বাড়িভাড়া দিতে হয় তবে তাদের চলবে কি করে ? কাজেই প্রতিবছর প্রায় ২০-৩০% হারে যেভাবে বাড়িভাড়া বাড়ানো হচ্ছে তাতে ঢাকা শহরে বসবাসরত ৯০% মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা পাবে না । কাজেই সরকার যদি এ ব্যাপারে পদক্ষেপ না নেয় তাহলে ভাড়াটিয়াদের সমস্যা কাটানো সম্ভব হবে না । বাড়িভাড়া নির্ধারণ করে দেয়াসহ সরকারি খাস জমিতে বাড়ি নির্মান করে যদি সরকারিভাবে ভাড়া দেয়ার ব্যবস্থা করা হয় তবে সমস্যার অনেকটাই সমাধান হবে । বাড়িওয়ালাদেরকে যদি যথেচ্ছা স্বাধীনতা দেয়া হয় তবে শুধু পরিবেশগতভাবেই নয় বরং মানবিকভাবেও ঢাকা শহর বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে পড়বে । পরিবেশ দূষণের কারনে ঢাকা বাসস্থানের উপযোগীতা হারালেও মানুষ এখানে শারীরীক যুঁকি নিয়ে বাস করতে পারবে কিন্তু মানবতা ধাক্কা খেলে সেখানে বাস করা সত্যিই অসম্ভব হয়ে পড়বে । সুতরাং সরকার যেন ভাড়াটিয়াদের ব্যাপারে একটু আন্তরিক হয় । ‘যারা বাড়িভাড়া নির্ধারণ করেন তারাই বাড়ির মালিক হওয়ায় এ আইনের বিরোধিতা করেন’ সাধারন মানুষদের এ অভিযোগ থেকে যেন সকলকে মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয় । ব্যাচেলর এবং ছাত্রদেরকের বাড়িভাড়া দেয়ার নামে নানা ধরনের হয়রানি করা হয় এটার ব্যাপারেও পদক্ষেপ গ্রহনের ব্যবস্থা করা হোক । সকল মানুষের মৌল মানবিক (অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বাসস্থানের) নিশ্চয়তা রাষ্ট্রকেই দিতে হবে ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
বিষয়: বিবিধ
৮২৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন