আবারও বাজছে মুসলিম ধ্বংসের দামামা
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ২২ জুন, ২০১৪, ০৬:১০:৩৬ সন্ধ্যা
২০০৩ সালের ২০শে মার্চ থেকে শুরু হয়ে ২০১০ সাল পর্যন্ত আমেরিকা ইরাকের অভ্যন্তরে যুদ্ধ চালিয়েছে । ইরাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তারা ১৯৯১ সালের স্বাক্ষরিত চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মান করেছে । কোন নির্ভরযোগ্য প্রমান ছাড়াই শুধু সন্দেহের বসে ধ্বংস করে দিয়েছে তেল সম্মৃদ্ধ সজ্জিত অর্থনৈতিক পরাশক্তি সাদ্দাম হোসেন শাসিত ইরাককে । ২০০৩ সালের শেষের দিকে সাদ্দাম হোসেনকে গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে হত্যা ও আল কায়েদাকে সমর্থন ছাড়াও অনেকগুলো অভিযোগ উত্থাপন করে এবং প্রহসিত বিচারের নামে তাকে ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে মৃত্যুদন্ডের মাধ্যমে হত্যা করা হয় । সাদ্দামের বিরুদ্ধে যে বিচার কার্য চালানো হয়েছে এটা ছিল বুশ প্রশাসনের ক্ষোভের বাহ্যিক রূপ । তবে সাদ্দাম হোসেনের সাথে আমেরিকার মারাত্মক শত্রুতা শুরু হয় ২০০১ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর থেকে । জর্জ ডাব্লিও বুশ এবং তার প্রশাসন মনে করত টুইন টাওয়ারে হামলার পিছনে সাদ্দাম হোসেনের পরিকল্পনা ছিল । এছাড়াও সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে আমেরিকা তাদের ইচ্ছা মত ইরাক থেকে তেল ক্রয়ে সুবিধা পেত না । এমন কতগুলো তুচ্ছ অভিযোগে ইরাককে যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদে রূপান্তরিত করা হল এবং স্বজন হারানো মানুষের দীর্ঘ নিঃশ্বাস ইরাকের আকাশ-বাতাস ভারী করে তুলল । দীর্ঘ প্রায় সাত বছর ধরে চলতে থাকা বিরামহীন যুদ্ধে প্রায় ১৫ লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয় । পরবর্তীতে মার্কিনবাহীনি ইরাককে মেরুদন্ডহীন করে ইরাকের কর্তৃত্ব ছেড়ে দেয়ার পর সেখানে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠনের চেষ্টা করা হয় । তবে ইরাকীদের সে চেষ্টা সফল হয় নি । বরং ইরাকের শিয়া-সুন্নী-কুর্দিদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ বাঁধে । যে সুযোগে আল কায়েদা ইরাকে তাদের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করে । সবশেষে আমেরিকা হস্তক্ষেপ করে তাদের পছন্দনীয় ব্যক্তি শিয়া সম্প্রদায়ভূক্ত নুরে আল-মালিকিকে ইরানের গভর্নর নিযুক্তি করেন । যে অভিযোগ তুলে আমেরিকা গোটা ইরাককে ১৫ লক্ষ মানুষের কবরস্থান বানাল অথচ সেই অভিযোগের কোন ক্লু বা সত্যতা তারা ইরাকে পায় নি । এই হল মানবতার জন্য আন্দোলনকারীদের মানবতা ! এবং মুসলিমদের প্রাপ্য মানবাধিকার !
শিয়া-সুন্নীদের দ্বন্ধ প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরানো । হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ওফাতের কয়েক বছর পর থেকে শুরু হয়ে এ দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারন করে ১৯৮১ সালে ৫ই জানুয়ারি । শুরু হয় ইরাক-ইরান যুদ্ধ । দীর্ঘ ৮ বছর দীর্ঘ হয় ইরাক এবং ইরানের ব্যানারে শিয়া-সুন্নীদের মধ্যকার যুদ্ধ । যে যুদ্ধে মুসলমানদের শক্তি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায় । মূলত সীমান্ত বিরোধের অজুহাতে যুদ্ধ শুরু হলেও মূল ইস্যু ছিল শিয়া-সুন্নীর টানাপোড়েন সম্পর্ক । এ যুদ্ধে মুসলমানদের দু’টি ফেরকা যখন নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং দু’দলের শেষ শক্তিটুকুও নিঃশেষ হয়ে যায় তখন জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে । এ যুদ্ধে দু’ই দলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় । লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয় যার সবাই মুসলমান । এ যুদ্ধকে ইতিহাস গবেষকরা কাদেসিয়ার যুদ্ধের সাথে তুলনা করেন । যুদ্ধ সমাপ্ত হলেও শিয়া-সুন্নিদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব শেষ হয় না বরং এটা ধীরে ধীরে দু’দলের মধ্যেই পুঁঞ্জিবুত হতে থাকে ।
আমেরিকা ইরাকের সুন্নী-কুর্দিদের জন্য শাসক হিসেবে শিয়া সম্প্রদায়ভূক্ত উগ্রপন্থী নুরে আল মালেকিকে ক্ষমতা দিলেও ইরাকের সংখ্যা গরিষ্ঠ সুন্নীরা আমেরিকার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারে নি । ইরাকের সকল সুন্নীরা আইএসআইএস সংঘঠেন নেতৃত্বে ইতোমধ্যে ইরারেক রাজধানী বাগদাদ ছাড়া সমগ্র ইরাক দখন করে ফেলেছে । সুন্নীদের অধিভূক্ত অঞ্চল সমূহের সরকারি বাহিনীকে বন্দি করে সুন্নীরা তাদের অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে এবং যারা সুন্নীদের সাথে আন্দোলন করতে একমত হয়েছে তাদেরকে আইএসআইএসের কর্মী বানিয়ে তাদেরকেও ইরাক দখলের আন্দোলনের সঙ্গী বানিয়েছে । সুন্নীরা রাজধানীর একেবারে নিকটে পৌঁছতে সম্ভব হয়েছে । এ লেখা পর্যন্ত বাগদাদের ২৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রাসয়নিক অস্ত্রকারখানা দখল করেছে সুন্নীরা । সুন্নীদের এ আগ্রাসন দমাতে শিয়ারাও বসে নেই । শিয়া ধর্মীয় নেতা গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ আলি-সিসতানির ডাক মেনেগত কয়েক দিন ধরেই দলে দলে অস্ত্র হাতে লড়াইয়ে যোগ দিতে নেমেছেন শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ । শুধু ইরাকি শিয়ারাই নয় বরং মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সমূহের সকল শিয়ারাই ইরাকের শিয়াদেরকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে । ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ইরাকে শিয়াদের পবিত্র স্থানসমূহ সুরক্ষায় সুন্নি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যে ধরনের কেঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করা প্রয়োজন হোক, তার দেশ সে ধরনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করবে বলে জানিয়েছেন । আমেরিকা ইরাকে আন্দোলনরত সুন্নীদের দমনে নতুন করে সৈন্য প্রেরন না করলেও যুদ্ধ বিমান এবং অন্যান্য সর্বাত্মক সহযোগীতা করার ঘোষনা দিয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বিবৃতি দিয়েছে । মুসলমানদের জন্য ‘বিষফোঁড়া’ ইস্রাঈল যে ধরনের শক্তি প্রয়োজন তা দিয়েই ইরাকের সুন্নিদের ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে । ইরাকের সুন্নীদের দমন করতে যে রাষ্ট্রসমূহ শিয়াদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসুক না কেন ক্ষতিটা মুসলমানদের হবে । শিয়া বা সুন্নি যারাই নিহত হোক না কেন তাতে মুসলমানদের শক্তি কমবে । মুসলমান বিরোধী মিডিয়া এবং রাষ্ট্র মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে ধ্বংস করতে ইরাকের বর্তমান পরিস্থিতিকে বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগাবে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে ।
মুসলানের শক্তি দু’ই ভাবে ধ্বংস হচ্ছে । তবে মুসলিম বহির্ভূত শক্তি অর্থ্যাৎ ইসলাম বিরোধী শক্তির চেয়ে মুসলমানদের আভ্যন্তরীন কলহ তাদের শক্তিকে বেশি ক্ষয় করছে । ইসলামের ইতিহাস স্বাক্ষী দেয়, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এই ধরাধাম থেকে বিদায় নেয়ার মাত্র ২৪ বছর পেরোতে না পেরোতেই হিজরী ৩৬ সালে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রাঃ) এবং চতুর্থ খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) এর মধ্যকার সিফফিনের যুদ্ধের মাধ্যমেই মুসলমান মুসলমানদের রক্তপাত ঘটাতে শুরু করে । এরপর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর দৌহিত্র হযরত হোসেন (রাঃ) এর সাথে হযরত মোয়াবিয়া পুত্র ইয়াযিদের যুদ্ধ অর্থ্যাৎ ফোরাত তীরে কারবালার যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলমানদের একপক্ষ অন্যপক্ষের শক্তিকে ধুলোয় মিলিয়ে দিতে শুরু করে । মুসলমানদের নিজেদের মধ্যকার যুদ্ধের সে ধারা আজও অব্যাহত রয়ে গেছে । এক মুসলমান ভাইয়ের রক্তে আরেক মুসলমান ভাইয়ের তরবারী আজও রঞ্জিত হচ্ছে । অথচ এই মুসলমানদের একসময় স্বর্ণযুগ ছিল । হারানো সে গৌরবের কথা ভূলে তারা একদল অপরদলের চিরশত্রুতে পরিনত হয়েছে । বিভিন্ন ফেরকার নামে মুসলমান আজ শতধা বিভক্ত । মুসলমানদের এ মতানৈক্যের সুযোগ নিয়ে ইসলাম বিরোধী শক্তি ইসলামের অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে এবং মুসলমানদের মধ্যকার অনৈক্যের কারনে তাদের সে ষড়যন্ত্র সফল হচ্ছে । যা মুসলমানদের জন্য দূর্ভাগ্যের । মুসলমানদের এ দল-বিভক্তির ধারা অব্যাহাত থাকলে মুসলমানদের বর্তমান অবস্থার চেয়ে আরও করুণ রূপ ধারন করবে । যদি সে সন্দেহ সত্য হয়ে যায় তবে মুসলিম পরিচয়ে পৃথিবী আর মুসলমানদের বাসযোগ্য থাকবে না ।
প্রতিদিন মুসলিমদেরকে ননা ধরনের ঠুনকো অজুহাতে হত্যা করা হচ্ছে । কখনো জঙ্গী, সন্ত্রাসী, তালেবান, আল কায়েদা আরও কত ছুঁতোয় । আবার কখনো মুসলিমদেরকে ভাবা হচ্ছে দেশে শান্তি প্রবাহের অন্তরায় রূপে । বিভিন্ন দেশে মুসলিমদেরকে দেশ থেকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে । সর্বশেষ এ বিষয়ে মুখ খুলেছে শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধরা । মায়ানমারের পর শ্রীলঙ্কায়ও হয়ত মুসলিমদেরকে বিনা দোষে হত্যা করা হবে । মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় কেউ কোন প্রতিবাদ করবে না কেননা বিশ্বের যারা বড় মোড়ল তারা তো মুসলমানদেরকে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে শত্রু বলেই ঘোষণা দিচ্ছে । বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষায় আন্দোলনের ঝড় বইয়ে গেলেও মুসলমানদের মানবাধিকার রক্ষা নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নাই । সবাই যেন বুঝিয়ে দিতে চায় ‘মুসলমানদের মানবাধিকার থাকতে নেই’ । অথচ বিশ্বের কোথাও মুসলমান ছাড়া অন্যকোন ধর্মের অনুসারীরা সামান্য পরিমান হয়রানির স্বীকার হলেও তা নিয়ে কত আন্দোলন সংগ্রাম, হুমকি-ধামকি । ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মুসলিমদেরকে ভারত ছাড়া করাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশটির প্রধানমন্ত্রী হলেন অথচ বিশ্বের একটি ছোট দেশের কোন মুসলিম শাসক যদি সে দেশের মুসলিম ছাড়া অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে দেশ ছাড়া করার হুশিয়ারী দিতেন তবে বিশ্বের সকল নামধারী মানবাধিকার সংঘঠন তার বিরুদ্ধে কত ধরনের জনমত গঠন করতেন তার কোন ইয়াত্তা নেই । মুসলমানদের বিরুদ্ধে অতীতেও এ ধরনের ষড়যন্ত্র চলেছে এবং মুসলমানদের বর্তমান কৃতকর্মের কারনে ভবিষ্যতেও এ ধরনের লজ্জিত, লাঞ্চিত অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে ।
নিজেদের প্রয়োজনেই মুসলমানদের বদলানো উচিত । একে অপরের প্রতি সহনীয় হওয়া উচিত । শিয়া-সুন্নি-খারেজী-মু’তাজিলা-আশারিয়া-সিফাতিয়া-জাবারিয়া-ক্বাদেরিয়াসহ মুসলমানদের মধ্যে যতগুলো ফেরকা আছে তাদেরকে মনে রাখতে হবে সবাই মুসলিম এবং এক আল্লাহর একাত্ববাদে বিশ্বাসী । এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই । মুসলিম নিধনে মুসলিমরা অগ্রসর হওয়া আত্মগাতী সিদ্ধান্তের শামিল । কাজেই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় এবং ইসলাম বিরোধীদের ষড়যন্ত্রের কবল থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য মুসলমানদেরকে এক ছাদের নিচে আসা দরকার । মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ থাকতে পারে এবং সেটা স্বাভাবিকও তবে মুসলমানদেরকে সে মতবিরোধসহ ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত । মুসলমান নেতৃবৃন্দকে মনে রাখতে হবে তারা যদি ইসলামের শত্রুদের দালাল হিসেবে কাজ করেন তবে সেটা ধর্মের সাথে গাদ্দারী করার শামিল । যে কারনে তাদের কঠোর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে । বাংলাদেশের মুসলমানদের পক্ষ থেকে আহ্বান, যাতে ইসলামী সংঘঠনের নেতৃবৃন্দ অচিরেই ইরাকের শিয়া-সুন্নীদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব দূর করে মুসলমানের শক্তিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবেন এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশেসমূহের যেগুলোতে মুসলমানরা অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন সে দেশগুলোর মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষায় অচিরেই পদক্ষেপ গ্রহন করবেন । ইসলাম বিরোধীরা যেভাবে মুসলিম ধ্বংসের দামামা বাজাচ্ছে তাদের সে ষড়যন্ত্ররোধ করে মুসলমানরা যেন তাদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে এনে আবারও বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে সে প্রত্যাশায় ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১১৯১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন