‘ক্রেস্ট জালিয়াতি’-অবনতির কোন মাত্রায় পৌঁছলে মানুষ বলা যাবে !
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ০৯ জুন, ২০১৪, ০৭:১৬:০৩ সন্ধ্যা
স্বাধীনতা যুদ্ধ বাঙালীত্বকে অর্জন করার সংগ্রাম, এক বীরত্বপূর্ণ মহাকাব্য, স্বাধীনতা অর্জনের প্রবেশদ্বার, বাংলাদেশী হিসেবে স্বতন্ত্র পরিচয় লাভ কিংবা কারও দ্বারা শৃঙ্খলাবদ্ধ না হয়ে স্বাধীনভাবে চলার, মত প্রকাশ করার অধিকার অর্জন । স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ পেয়েছে বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি । আমরা বাংলাদেশী হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের কাছে স্বীকৃতি লাভ করেছি । স্বাধীনতা অর্থের কোন শেষ নেই সীমা নেই । স্বাধীনতা যোদ্ধা । এরা তো এদেশের সোনার সন্তান । আমাদের গর্বিত বীর । যারা জীবনের বিনিময়ে দেশের মর্যাদাকে রক্ষা করেছে, ফিরিয়ে এনেছে । কোন শক্তির পরোয়া না করে শত্রু বেষ্টিত রণাঙ্গনে বুক ফুলিয়ে যুদ্ধ করেছে । বাংলার ভূমিকে হায়েনাদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে মুক্ত করেছে । নিজেদের জীবনের তুলনায় এরা জাতীয় স্বার্থকে প্রধান্য দিয়েছে । দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ শেষে প্রায় তিরিশ লাখ শহীদের বুকের শত সাগর তাজা রক্ত, দুই লাখ মা-বোনের সতীত্ব-সম্ভ্রম এবং অগণনা সম্পদের মায়া ত্যাগ করে হলেও ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট একটা পরিচয়ে পরিচিত হতে পেরেছি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চুড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে । তখন থেকেই আমাদের পরিচয় আমরা বাঙালী কিংবা বাংলাদেশী । পূর্ব-পাকিস্তানের যে মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের হায়েনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তারা কেউ কেউ বাধ্য হয়ে আবার অনেকে দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে । এ বঙ্গের মানুষগুলোর নৈতিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহন করে লাল সবুজের পতাকা ছিনিয়ে আনা উচিত ছিল এবং তারা সেটা এনেছে । ব্যতিক্রম যে ঘটেনি তা নয় । কেউ কেউ মাতৃভূমির সাথে গাদ্দারী করেছে আবার সেজন্য অপমানিত, লাঞ্ছিত হয়েছে । জীবনে চলার পথে পদে পদে পেয়েছে ধিক্কার । ‘বন্ধুর পথ’ পাড়ি দিয়ে আমরা নিজেদেরকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি । পাসপোর্ট কিংবা পরিচয় পত্রের কোন স্থান পেলেই সেখানে বুক ফুলিয়ে লিখি, আমাদের জাতীয়তা বাংলাদেশী । স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা সরাসরি অংশগ্রহন করেছিল কিংবা স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের পক্ষে কোন না কোনভাবে সাহায্য করেছে কিংবা স্বাধীনতার সমর্থক ছিল অথবা স্বাধীনতা প্রশ্নে দো’টানায় ছিল এই সকল শ্রেণীর মানুষ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের পক্ষ থেকে আর্থিক পুরস্কার, স্বীকৃতি পুরস্কার কিংবা শ্বান্তনা পেয়েছে । আবার যারা স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে মাতৃভূমির সাথে গাদ্দারী করে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে কাজ করেছে তারা সাময়িকভাবে ধিক্কৃত হলেও স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদারতার কাছ থেকে পেয়েছে সাধারন ক্ষমা এবং সবচেয়ে বড় পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশে বাস করার অধিকার পেয়ে ।
এতক্ষন যাদের কথা বললাম তার সকলেই বাংলাদেশের মানুষ কিংবা বাংলাদেশী । যারা নীতিগতভাবেই বাংলাদেশের জন্য কাজ করে কিংবা কাজ করতে বাধ্য হয় । তবে শুধু পূর্ব-পাকিস্তান নামক ভূখন্ডে জন্মগ্রহনকারীদের অবদানেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয় নি । বাংলাদেশের স্বাধীনতার পিছনে বিশ্বের কয়েকটি দেশ অর্থ্যাৎ কয়েকটি দেশের বিভিন্ন পেশার মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের অবদান অনস্বীকার্য । মুক্তিযুদ্ধ বান্ধব সরকার হিসেবে স্বীকৃত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামীলীগ নবম জাতীয় সংসদে সরকার গঠন করে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছিল, ‘যে সকল বিদেশী রাষ্ট্র, ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়া হবে’ । সরকারের সে পরিকল্পনার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিক ও সংগঠনসহ প্রায় পাঁচ শতাধিক বিদেশী ব্যক্তি/সংগঠনের একটি তালিকা তৈরি করা হয় এবং কয়েকটি ধাপে তাদেরকে সম্মাননা এবং স্বীকৃতি সনদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । এ পরিকল্পনা মোতাবেক এ পর্যন্ত সাত দফায় ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধীসহ ৩৩৭-এরও বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে তাদের সম্মাননা স্বরুপ ক্রেষ্ট, স্বীকৃতি সনদ এবং বাংলাদেশের সকল মানুষের পক্ষ থেকে বিশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে সম্মানিত করা হয়েছে। সর্বশেষ ধাপে ৬২জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মানিত করা হয় । পূর্বের ধাপ গুলোতে বিতর্ক দেখা না দিলেও এ ধাপে এসে বিতর্ক দেখা দেয় । কেননা মন্ত্রনালয়ের অনুরোধে কাঠ, রুপা ও সোনার সংমিশ্রণে ক্রেস্টের তৈরি কৌশল নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় এবং এগুলো পরীক্ষা করে দেখার দাবী করা হয় । সে দাবী অনুযায়ী, পরীক্ষা শেষে দেখা যায় সরকার নির্দেশিত ভাবে এগুলো তৈরি করা হয়নি । কেননা ২০১২ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর সাবেক মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী এবিএম তাজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত উপহার তৈরির চুক্তিপত্রে প্রতিটি উপহারে ২২.৫ গ্রাম স্বর্ণ এবং ৩৩৯ গ্রাম রুপা দিয়ে তৈরি করার কথা থাকলেও ২০১২ সালের শেষ দিকে বিএসটিআই’র পরীক্ষায় দেখা যায় প্রতিটি উপহারে মাত্র ২.৩৬৩ গ্রাম স্বর্ণ এবং ৪৬৬.২৩৭ গ্রাম পিতল ব্যবহার করা হয়েছে । এ সকল সম্মাননা ক্রেষ্টে রুপার উপস্থিতি পাওয়া যায়নি ।
বিএসটিআই’র এ রিপোর্ট অনেকদিন চাপা পড়ে থাকলেও ২০১৪ সালের মে মাসের শুরুর দিকে গণমাধ্যমে আলোচনায় আসে । সকল প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার চেষ্টায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ব্যাপারটি পৌঁছায় । ক্রেষ্ট জালিয়াতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সাংবাদিকদের রিপোর্টগুলোর শিরোনাম ছিল বেশ চমকপ্রদ ‘বিদেশী বন্ধু ও সংগঠনকে মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা/ক্রেস্টের স্বর্ণের ১২ আনাই মিছে’ ! (মূলত মিছে ছিল পৌণে তের আনা)। প্রধানমন্ত্রী এ খবর শুনে প্রথমদিকে বলেছিলেন, ‘ক্রেষ্টের মান বড় কথা নয় বরং পুরস্কারই বড় কথা’ । পরে প্রধানমন্ত্রী ব্যাপারটি বুঝতে পারার পর এ ব্যাপারটিকে খতিয়ে দেখতে কঠোর নির্দেশ প্রদান করেন । তদন্ত করার পরেও যখন দোষীদের শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করা হলোনা তখন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের এক সাহসী কন্যা এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করে মামলা দায়ের করেন । আবারও ব্যাপারটি সবার নজড়ে আসে । শেষ পর্যায় দুদকে( বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন) এ মামলাটি গড়ায় এবং একজন মন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন সচিব, সচিব সমপর্যায়ের ব্যক্তির দিকে অভিযোগের আঙুল উঠে । তদন্তের ধীর গতির কারনে এখনো মামলাটির নিস্পত্তি হয়নি কিংবা কারা প্রকৃত দোষী তাও সাব্যস্ত করা যায় নি ।
বিভিন্ন ব্যক্তিদের মূখে শোনা যাচ্ছে, ‘ক্রেস্ট জালিয়াতির কারনে মাত্র ৭ কোটি ৪০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে’ । সত্যিকারার্থেই ক্ষতির পরিমানটা খুব সামান্য ! কেননা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঙ্গনে যেভাবে লুটতরাজ চলছে তাতে ৭ কোটি ৪০ লাখ টাকার তো শিশুদের খেলার সামগ্রীর মত প্রায় মূল্যহীন । বিদেশী যে সকল ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে ক্রেস্ট দেয়া হয়েছে তারা ক্রেস্ট জালিয়াতিরর ব্যাপারে কি ঘটেছে বা ঘটছে তা নিযে তেমন মাথা ব্যথা থাকার কথা নয় । তারা কোন পুরস্কারের প্রাপ্তির আশায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে সহয়তা করে নি । বাংলাদেশ সরকার স্বেচ্ছায় স্বপ্রোণদিত হয়ে তাদেরকে সম্মানিত করেছে এ জন্য বিদেশীরাও বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশের সকলকে ধন্যবাদ জানিয়েছে । কেননা বাংলাদেশ থেকে যদি কোন দিন তাদেরকে সম্মানিত করা নাও হত তবুও তারা এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাাশ করত না । কিন্তু আমরা কাজটা করলাম কি ? আমাদের সম্পর্কে বিশ্ববাসীর ধারনা কোন স্তরে নামল ? যে স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য মানুষ জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছে সে স্বাধীনতার স্বীকৃতিতেও আমাদের চোর্যবৃত্তি প্রকাশ পেল ? বিদেশী বন্ধুরা না হোক অন্তত দেশের যে সকল বীর সন্তানেরা স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করে মৃত্যু বরন করেছে ক্রেস্ট জালিয়াতির এ নির্লজ্জ দৃশ্য দেখে হয়ত তাদের আত্মাগুলো ভয়ানক ভাবে আমাদের উপর ক্ষেপেছে এবং আমাদের মানসিকতার উপর ধিক্কার প্রকাশ করছে । তারা দেশের জন্য জীবন দিতে পারল আর আমরা তাদের সাথে জোচ্চুরি করে বেড়াচ্ছি ?
অতীতে প্রতিটি অপরাধ করে অপরাধীরা যেমন ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকেছে তেমনি ক্রেস্টের মূল্যবানু ধাতু চুরি করেও শিক্ষিত অপরাধীগুলো এবারও হয়ত পার পেয়ে যাবে । কিছু কিছু অপরাধীকে ক্ষমা করা যায় কিন্তু ক্রেস্ট জালিয়াতির সাথে জড়িত এ অপরাধীদেরকে ক্ষমা করলে দেশের স্বাধীনতা এবং যারা স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে তাদেরকে অপমান করা হবে । নিশ্চয়ই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ যাদের কাছে ক্ষমতা আছে সে সকল ব্যক্তিরা এ অপরাধের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করবেন । যে সকল মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে আছে তারা জীবন সায়াহ্নে দেখে যেতে চায় অন্তত তাদের মৃত্যুর পর তাদের ত্যাগকে ভাওতাবাঁজির মাধ্যমে স্বীকৃতি দেয়া হবে না । অন্তত এ বিশ্বাসটুকু নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যেন পরপারে যেতে পারে সে নিশ্চয়তাটুকু যেন দেয়া যায় তার ব্যবস্থা সরকারকে অবশ্যই করতে হবে । জাতি হিসেবে আমাদের যে অবনতি কিংবা পদস্খলন হয়েছে তা থেকে উত্তরণের পথ আবিস্কারের উপায় খুঁজতে হবে । নিজেদের কাছে নিজেরা অবিশ্বাসী, শ্রদ্ধাহীন হলেও যেন বিদেশীদের কাছে অবিশ্বাসী, অকৃতজ্ঞ কিংবা চোর হিসেবে চিহ্নিত না হই । ক্রেষ্ট জালিয়াতির সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের কঠোর এবং দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির মাধ্যমে এ অপবাদ থেকে মুক্তির প্রাথমিক ধাপটি দেখে জাতি নিশ্চিত হতে চায় অন্তত সব বিষয়ে এখনো আমাদের অনৈতিক পদস্খলন ঘটে নি । সবচেয়ে বড় কথা, বিদেশী ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানের সাথে জোচ্চুরি করে দেশের সকল স্বাধীনতা যোদ্ধাদেরকে অপমান করা হয়েছে ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
http://www.facebook.com/raju69mathbaria/
বিষয়: রাজনীতি
১০৯২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন