প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করুন নয়ত ফেসবুক
লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ০৭ জুন, ২০১৪, ০৭:২৮:২৩ সন্ধ্যা
দেশের আলোচিত ইস্যুগুলোর মধ্যে হয়ত প্রশ্ন ফাঁস ইস্যুটি অন্যতম । রাজনৈতিক চড়াই উৎড়াই কিংবা স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বাজেটকেও প্রশ্ন ফাঁসের আলোচনা ঢেকে রেখেছে । দেশের নামকরা পরিচিত বহু শিক্ষা বিশেষজ্ঞ কিংবা সচেতন মহলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ইলেকট্রনিক্স কিংবা প্রিন্ট মিডিয়ার বহুল আলোচিত ঘটনা প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি । বিশেষ করে সিলেট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়েল নন্দিত অধ্যাপক, বৈজ্ঞানিক ও কথা সাহিত্যিক জাফর ইকবাল স্যারের লেখা এবং বিভিন্ন সেমিনারে সচেতনতা সৃষ্টিকারী বক্তৃতা কিংবা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থানের মাধ্যমে দেশময় আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে । বিভিন্ন ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক এবং শিক্ষকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে তিনি এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও মূলত তাকে কঠোর হতে বাধ্য করেছে নৈতিক বিবেকের জিজ্ঞাসা । তিনি তার কয়েকটি লেখায় বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র কিভাবে অনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেছে এবং এভাবে চলতে থাকলে জাতি কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে তার ভবিষ্যত বাণী করার চেষ্টা করেছেন । শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান ধারা চলতে থাকলে শুধু জাফর ইকবাল স্যার একা নন বরং দেশের সকল সচেতন মানুষের আশঙ্কা অনুসারে দেশ মেধাশূন্য হয়ে পড়বে । যদি দেশের আশাবাদী মানুষেরা আশা করে দেশের এ কৃত্রিম সংকট অচিরেই কেটে যাবে এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেশের স¦ার্থে এমন কতগুলো সিদ্ধান্ত নিবে যা দেশের তরুন প্রজন্মকে মানহীন শিক্ষা অর্জনের কালো হাত থেকে রক্ষা করবে । যদিও একাজ একজন সৎ মানুষ কিংবা সমাজের কিছু সংখ্যক লোকের উদ্যোগে সম্ভব নয় বরং শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক থেকে শুরু করে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এবং এ মন্ত্রনালয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, কর্মচারীদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করা সম্ভব । এটা করতে পারলেই শিক্ষার্থীরা শুধু জ্যামিতিক হারেই শিক্ষিত হবে না বরং তার সাথে শিক্ষার প্রকৃত মান নিশ্চিত হবে ।
একজন শিক্ষার্থীর জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা অর্থ্যাৎ প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী থেকে শুরু করে জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স, মাষ্টার্সসহ চাকরীর জন্য শিক্ষক নিবন্ধন কিংবা পিএসসির আওতাভূক্ত বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস এখনকার নিত্য-নৈমিত্তিক খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে । ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র কখনো কখনো দেশের জাতীয় পত্রিকাগুলোতে ছাপিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অহরহ পাওয়া যাচ্ছে অথচ কর্তৃপক্ষ ফাঁস হওয়া সে প্রশ্নপত্রেই নিয়মিত পরীক্ষা উঠিয়ে নিচ্ছে এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করার আশ্বাস দেয়া হলেও প্রকৃত অপরাধীরা সর্বত্রই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে । তবে সামান্য আশার কথা হলেও এটা সত্য যে অতীতের তুলনায় বর্তমানে কর্তৃপক্ষ কিছুটা সজাগ হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বরং সর্বশেষ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে । প্রশ্ন হল, ফাঁস হওয়া প্রশ্নের বদৌলতে যারা পরীক্ষায় সফলতা অর্জন করে জীবনের পরবর্তী ধাপে নিজেদেরকে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত করবেন তারা শিক্ষার্থীদেরকে প্রকৃত জ্ঞানের কতটুকু দিতে পারবে ? শিক্ষার্থীরাও সে জ্ঞান সঞ্চয় করে কি পরিমাণ লাভবান হবে ? সুতরাং এ ধারা চলতে থাকলে চক্রবৃদ্ধি হারে দিনে দিনে শিক্ষার মানের অবনতি ঘটবে এবং পরবর্তী প্রজন্ম মেরুদন্ডহীন ভাবে বেড়ে উঠবে কিন্তু তার পরবর্তী প্রজন্মগুলো শিক্ষা বিমূখ হয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়বে । যার ফলে ভারসাম্যহীন একটি সমাজ ব্যবস্থা পুনরায় প্রাচীন কালের অসভ্য সমাজ ব্যবস্থায় ফিরে গেলেও অবাক হওয়ার আহামরি কোন কারন থাকবে না ।
একজন জাফর ইকবাল কিংবা তার আশপাশের কিছু মানুষের প্রচেষ্টায় শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের কিনারা থেকে বের করে আনা কাল্পনিক । তবে তাদের প্রচেষ্টার সাথে যখন সকলের প্রচেষ্টা এবং আন্তরিকতা যোগ হবে তখন এ কাজটি সহজ থেকে সহজতর হয়ে যাবে । দেশের মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী একজন শিক্ষানুরাগী, সজ্জন, এবং সৃজনশীল মেধাবী মানুষ । শিক্ষামন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পর তার ধ্যান জ্ঞান শুধু শিক্ষা কেন্দ্রিক । কিভাবে দেশের মানুষকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা যায় সে চিন্তায় তিনি সর্বদা মশগুল থাকেন । কিন্তু তার সহযোগী কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর নৈতিকতা বিবর্জিত কার্যকলাপের কারনে তার সার্বিক প্রচেষ্টা সফলতার আলো থেকে যোজন-যোজন দূরে অবস্থান করছে । মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় যত দ্রুত তার চারপাশের আগাছা গুলোকে পরিস্কার করতে পারবেন ততদ্রুত তার পরিকল্পনা সার্থক হবে । এক্ষেত্রে তাকে কিছুটা কঠোর এবং নির্মম হওয়ার অনুরোধ জানাই । নিজের জন্য না হোক অন্তত দেশের আগামী দিনের রাহবারদের মূখ পানে চেয়ে হলেও তাকে এ কাজটুকু করতে হবে । শিক্ষা ক্ষেত্রে পাশের হার যদি শতভাগও ছাড়িয়ে যায় আর শিক্ষার্থীরা মানহীন শিক্ষিত হয় তবে সে সফলতা আলেয়ার আালোর চেয়েও কিংবা মরীচিকার চেয়েও অবাস্তব । একটি জাতিকে সামনে অগ্রসর করার জন্য শুধু শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুললেই কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জিত হবে না যতদিন পর্যন্ত জাতিকে নৈতিকভাবে গড়ে তোলা না যাবে । যদিও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ‘নৈতিকতা প্রশ্ন’ অমূলক তবুও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে’ নীতিতে আগাতে হবে । এভাবে সমাজে চলতে চাইলে খড়কুটোর মত ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তবুও এ নীতি অনুসরণ করতে পারলে সেটা হবে চরম সার্থকতা এবং পরম আত্মতৃপ্তির । বর্তমান সময়ে না হোক অন্তত নিকট ভবিষ্যতে এ নীতি অনুসরণকারীরা সমাজে বুক ফুলিয়ে চলতে পারবে এবং প্রশ্নপ্রত্র ফাঁস প্রথা বাতিল করে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সে সুযোগটুকু করে দিতে পারবেন বলে আশা রাখি ।
৫ই জুন ২০১৪ইং মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ২০১৪-১৫ অর্থবছেরর জন্য দেশের ইতিহাসের সর্ব বৃহৎ বাজেট ঘোষণা করলেন । ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার ঘোষিত বাজেটে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে । এ খাতে বরাদ্ধ করা হয়েছে গোটা বাজেটের ১৩.১ শতাংশ । অর্থাৎ ১৪-১৫ অর্থবছরের শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ব্যয় করা হবে ৩২ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা প্রায় । শিক্ষাখাতে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের সকল বাজেটকে ছাড়িয়ে সর্বোচ্চ অংকে দাঁড়িয়ে। শিক্ষাবান্ধব একটি ঘোষণার জন্য মাননীয় অর্থমন্ত্রী মহোদয় সাধুবাদ পেতেই পারেন কিন্তু যাদের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের এতটাকা খরচ করা হচ্ছে তারা এ থেকে কতটুকু লাভবান হতে পারবেন ? শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারনে যে দৈন্যদশা চলছে তাতে শিক্ষা খাতে এ বরাদ্ধ অপচয় হবে নাতো ? রাষ্ট্রের কুলি মজুরের ঘাম জড়ানো আয়ের টাকায় যে শিক্ষার্থীরা শিক্ষিত হবে তাদের প্রকৃত শিক্ষা নিশ্চিত না করতে পারলে অন্তত বিবেকের কাছে কৈফিয়ত দেয়ার কোন ভাষা থাকবে কি ?
অতীতে যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হতো না তা কিন্তু নয় বরং পূর্বেও সামান্য পরিসরে প্রশ্নপত্র ফাঁস হত এবং তা দিয়ে অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী নিজেদের পায়ে নিজেরা কুঠার মারত । বর্তমানেও সেরকম সল্প পরিসরেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় কিন্তু বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কারের কল্যাণ কিংবা অকল্যাণের সুবাদে মুহূর্তেই দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে । এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ফেসবুক, মোবাইল, ইমেল কিংবা ফ্যাক্স । তবে ফেসবুকের ভূমিকাই বেশি । অন্তত জাফর ইকবাল স্যারের লেখা কিংবা কথায় সেটাই মনে হয়েছে । কাজেই জাতীর জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় শিক্ষার্থীদের মেধাহীন এবং শিক্ষার মান বজায় রাখার প্রশ্নে যদি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী কিংবা শিক্ষা মন্ত্রনালয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করতে না পারেন তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দিন । যদিও ফেসবুক বন্ধ করলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার বিরুদ্ধে যে সংখ্যক মানুষ আন্দোলন করত তার চেয়ে কয়েকশত গুণ বেশি মানুষ রাস্তায় নামবে তাতে কোন সন্দেহ নাই তবুও বুলেট দিয়ে হলেও সে আন্দোলন দমিয়েও যদি আগামী প্রজন্ম রক্ষা করা যায় সেটাই হবে মঙ্গলের । তাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম থেকে অন্তত কিছু সংখ্যক দেশের হাল ধরতে পারবে । নয়ত এরূপ চলতে থাকলে মাঝিবিহীন নৌকার মত দেশটা দোদুল্যমান অবস্থায় পেন্ডুলামের মত দুলবে । সিদ্ধান্তটা শিক্ষামন্ত্রীর এবং কল্যাণটুকু জাতির । আশা করি অবশ্যই ভেবে দেখবেন ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
বিষয়: বিবিধ
৯৫০ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন